‘অমৃত পান্থ’; জ্ঞান-পিয়াসী
পরিব্রাজকের পরিভ্রমণের কথকতা
‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধর্ম শরণং গচ্ছামি
সংঘং শরণং গচ্ছামি’১
ভগবান তথাগত অর্থাৎ বুদ্ধ প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মের ত্রিশরণ মন্ত্রাবলী থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশটি অনুসারে, দুঃখময় মানব জীবনের বহুবিধ ক্লেশ থেকে পরিত্রাণের জন্য ভগবান বুদ্ধের তথা তার মতাবলী এবং বৌদ্ধানুসারীদের পথ অনুসরণ করা আবশ্যিক; কারণ ‘বৌদ্ধধর্মের তিনটি মুখ—বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ। তাহার ধর্মে জ্ঞান, সংঘে কর্ম ও বুদ্ধে ভক্তি আশ্রিত হইয়া আছে।’২ পৌরাণিক মতানুসারে ভগবান বিষ্ণুর নবমতম অবতার বোধিসত্ত্ব। তাঁর অনুসারী ধর্মমতবাদ বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন রূপে পরিচিত। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের সূত্র ধরেই চতুর্বণ প্রথার সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা বর্ণেরও উদ্ভব ঘটে। এই সকল বর্ণের মানুষ তাদের পৈতৃক বৃত্তি অনুসারে জীবিকা নির্বাহ করে; “এইভাবে ধীরে ধীরে বৃত্তিভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি এক একটি জাতিতে পরিণত হয়। এইভাবে ছুতোর, কর্মকার, চর্মশিল্পী, মৎস্যজীবী প্রভৃতি পেশার মানুষরা কর্মভিত্তিক বংশানুক্রমিক জাতি গড়ে তোলে।”৩
ধীরে ধীরে বৈদিক ধর্মের সরসতা হ্রাস পায়। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত জনজাতির আগ্রাসী মনোভাবের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভ দানা বাঁধে। তাছাড়া নারীদের বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় অসূর্যস্পর্শ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হত। অন্যদিকে শহরের উৎপত্তির পাশাপাশি পতিতাদেরও উদ্ভব ঘটে। অথচ ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মতে তারা ঘৃণ্য হিসাবে নির্দেশায়িত। ফলে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সূচনাপর্ব থেকেই ভারতবর্ষে ধর্মীয় আলোড়নের সঞ্চার ঘটে।
অবলোকিতেশ্বর গৌতম প্রবর্তিত উপদেশাবলী সমগ্র ভারতবর্ষের পাশাপাশি এশিয়ার নানান প্রান্তে বিস্তৃত হয়। ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের বিপরীতে অহিংস ও সহিষ্ণুতার বাণী বর্ণ-মত নির্বিশেষে ভারতীয় জনমানসে গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথের অভিমত অনুসারে, ‘ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড়ো করিয়াছিলেন। তিনি জাতি মানেন নাই, যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়াছিলেন, দেবতাকে মানুষের লক্ষ হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন। তিনি মানুষের আত্মশক্তি প্রচার করিয়া করিয়াছিলেন। দয়া এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ হইতে প্রার্থনা করেন নাই, মানুষের অন্তর হইতে তাহা তিনি আহ্বান করিয়াছিলেন।”৪
পালি ভাষায় কথিত বুদ্ধ-বাণী ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘ত্রিপিটক’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়। বৌদ্ধ-শাস্ত্রটি ত্রি অর্থাৎ তিনটি ‘পাত্র বা ঝুড়ি’তে বিভক্ত; যথা – সূত্ত-পিটক, বিনয় পিটক এবং অভিধর্ম পিটক। যার মধ্যে বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক-তত্ত্বাদি বিবৃত হয়েছে অভিধর্ম পিটকে। বাকি দুটি অংশে জীবনাচরণের প্রতি বুদ্ধের উপদেশাবলী এবং বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভিক্ষুদের পালনীয় বিধিসমূহ এবং সঙ্ঘের নিয়ামাচরণ যথাক্রমে গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছে সূত্ত-পিটক, বিনয় পিটক অংশে। দুঃখ পরিবৃত মানুষকে জরা-ব্যাধি-শোকের সীমানাকে সাধনার মাধ্যমে অতিক্রম করার লক্ষার্থে তথাগত চারটি আর্যসত্য এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রবর্তন করেন। গৌতমের মতানুসারে, একটি ভ্রূণ ভূমিষ্ঠ হওয়ার অনতিবিলম্ব পরেই দুঃখের সূচনা হয়; ‘জন্মের পর থেকে মানুষ একের পর এক দুঃখের জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।’৫ এই যাত্রাপথ কার্য-কারণ সম্পর্কে আবদ্ধ; ‘রোগ-ব্যাধি-জরা-মৃত্যু এর কারণ হল জন্ম। এই জন্মের জন্যে দায়ী দেহজ কামনা বাসনা।’৬ অতএব দুঃখের কারণগুলি নিরোধের মাধ্যমে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। অষ্টমার্গের অনুসরণের ফলে মুক্তিলাভ সম্ভবপর হয়। এই মার্গের অন্তিমাংশে উন্নীত হলে দুঃখের নির্বাণ ঘটে। তখন দেহজ কামনাবাসনা তিরোহিত হয়।
মানবজীবন সম্পর্কে বুদ্ধের মানবতাবাদী আদর্শ অবিভাজিত ভারতের আদি ভূখণ্ডের সীমানা অতিক্রম করে অন্যান্য দেশে বিস্তৃত হয়। মূলত বণিক এবং পরিব্রাজকের মাধ্যমেই এই ধর্মকথা ছড়িয়ে পরে চর্তুদিকে। চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের দরুণ সুদূর চিন দেশেও বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটে। পরবর্তীকালে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ ভারত ভ্রমণ করেন। তার পরমারাধ্যের স্মৃতি আধারিত ভারতভূমির দর্শন এবং জ্ঞানান্বেষোণের উদ্দেশ্যে ১ অগাস্ট ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা করেন। সুদীর্ঘ ১৪ বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। নালন্দা সহ অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার এবং ভারতের নানান প্রদেশের রাজ পণ্ডিতদের কাছে বিদ্যাভাস করেন সাঙ। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে বহু বৌদ্ধ পান্ডুলিপির চৈনিক অনুবাদ করেন তিনি। এছাড়া বিপদসঙ্কুল চিনদেশের পথ অতিক্রম করে ভারতবর্ষের কাটানো দিনযাপনের কাহিনি ‘সি-ইউ-কাই’ গ্রন্থে বিধৃত করেন হিউ-এন-সাঙ। ফলত একাধারে প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং বুদ্ধাদর্শের পাশাপাশি জ্ঞানপিয়াসী এক মানবের সত্যান্বেষ্ণণের যাপনচিত্রও পরিলক্ষিত হয়।
৬০২ খ্রিস্টাব্দে চীনের প্রদেশে লো-ইয়াং প্রদেশের অন্তর্গত সাং-শেন-পাওকু গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হিউ-এন-সাঙ। পারিবারিক সূত্রে বৌদ্ধ ধর্মীবলম্বী ছিলেন তারা। তার দাদা ছেলেবেলাতেই বৌদ্ধ-শ্রমণ হিসাবে বিহারে চলে যান। দাদার সঙ্গে দেখার করার জন্য বৌদ্ধ বিহারে যাতায়াত করার মাধ্যমে সেখানকার ধর্মীয় পরিমণ্ডলের প্রতি আকর্ষিত হন তিনি। লোইয়াং বিহারে ১২ বছর বয়সে বৌদ্ধ ভিক্ষুক হিসাবে হিউ-এন-সাঙ জীবনাচরণ শুরু হয় তার। সমকালীন চীন সম্রাটের থাই চুং-এর আদেশকে উলঙ্ঘন করে ভারতে যাত্রার উদ্যোগ শুরু করেন বিদ্যাচর্চার উদ্দেশ্যে; কারণ ‘ভারতবর্ষ ভগবান বুদ্ধের দেশ। তার ধূলিকণাও পবিত্র।’৭
চীনের হান বংশের সম্রাট মিন একদা স্বপ্নে এক দিব্য পুরুষ মূর্তি অবলোকন করেন। সেই সময় ভারতবর্ষীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ বুদ্ধমূর্তি সহ চীন দেশে বুদ্ধের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে উপনীত হয়। তাদের মাধ্যমে সম্রাট বুদ্ধমূর্তি দেখে সেখানে তার স্বপ্নের দিব্যমূর্তিটিকে চিহ্নিত করেন এবং বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে শ্বেতাশ্ব মঠ স্থাপন করেন। পরবর্তী সময় কুমারজীব, গৌতম সংঘদেব, বুদ্ধভদ্র প্রমুখ তথাগতের বাণী চীনের নানান প্রান্তে প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। তারপর ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত সামসি প্রদেশে আর্বিভূত কুৎ অর্থাৎ ফা-হিয়েন অবিকৃত ‘বিনয়পিটক’ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে আসেন। চিনা পরিভাষা অনুযায়ী কয়েক হাজার লি অতিক্রম করে ভারতবর্ষের আসেন তিনি। তবে এই পথ কেবলমাত্র বন্ধুর নয় তা বিপদ-সংকুল এবং দুর্গম। ফা-হিয়েন কাবুলের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। তারপর প্রায় ১০ বছর ভারতবর্ষে নানা প্রান্তে ভ্রমণ করেন। পালি ভাষায় রচিত বিনয়পিটক আত্মস্থ করার উদ্দেশ্যে ফা-হিয়েন যাত্রা করেছিলেন বুদ্ধভূমির উদ্দেশ্যে।
কারণ অনুবাদের ভাষায় মূলগ্রন্থের সারবত্তা মেলে না কিংবা তার ভাবানুসারী কথার প্রক্ষেপ দেখা যায়। কারণ দুটি ভিন্ন ভাষার দুটি ভিন্ন ব্যাকরণ রয়েছে পাশাপাশি রয়েছে তাদের শব্দগত অভিধানের পরিধি। ফলে অনুবাদের মাধ্যমে কখনোই কোনো বস্তুকে বা কোনো বৃত্তান্তকে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় অনুবাদক সচেষ্ট হন শুধুমাত্র মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ করার জন্যে; আবার অনেক সময় মূল গ্রন্থের ভাবানুবাদও রচিত হয়। ফলত সংযোজন-বিয়োজনের কার্যকলাপ চলতে থাকে। তাই একটি প্রচ্ছন্ন শিথিলতা রয়েই যায়। ফা-হিয়েন সেই শিথিলতা অতিক্রম করে বুদ্ধ-নির্দেশিত ভিক্ষুকদের প্রতি নিয়মাবলী জানতে এবং তার দেশে সেই নিয়মাবলী জানাতে পালি ও সংস্কৃত ভাষায় শিখেছিলেন। তিনি প্রায় তিন বছর পাটুলিপুত্রে তিনি বিনয়পিটক আত্মস্থ করেন।
কারণ বৈদিক সময়কাল থেকেই শ্রুতিধর বিষয়টি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তৎকালীন সময় গুরু তার শিষ্যদের প্রতি বেদকে মৌখিকভাবে বিবরণীর মাধ্যমে তুলে ধরতেন। শিষ্যরা সেই সকল বিষয়গুলি শ্রুতির মাধ্যমে কন্ঠস্থ করতেন। সে কারণে বেদের অপর নাম শ্রুতি বলে অভিহিত। বৈদিকযুগের পরবর্তীকালেই বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা হয়। তাই বৌদ্ধপন্ডিতদের মধ্যেও শ্রুতিধরের বিষয়টির লক্ষ্য করা যায়। ফা-হিয়েনও সেই প্রথা অনুসারে ‘বিনয়পিটকে’ কন্ঠস্থ করেন। পরবর্তীকালে ৩০ টি দেশ ভ্রমণ করে চীনে প্রত্যাবর্তন করে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন। সেই লিপিবদ্ধ ইতিহাসের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হন নবীন শ্রমণ হিউ-এন-সাঙ। ভারতবর্ষে জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে ধর্মগুরু মাত্র ২৭ বছর বয়সে দুর্গম পামির মালভূমি, গোবি মরুভূমি এবং চীনের সুবিস্তৃত পরিখা অতিক্রম করেন।
সমকালীন চিনের অন্যতম প্রধান প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বরূপে অগ্রগণ্য ছিলেন সাঙ। নবীন বয়সেই তিনি জগতের অনিত্যতা সম্পর্কে জ্ঞানারোহণ করেন। প্রকৃতির নিয়মশৃঙ্খলাময় চরাচরের মধ্যেই শৃঙ্খলাহীন মানবজীবনের ক্ষণকালীনতাকে উপলদ্ধি করেন; “শুধু মানুষের জীবন, তার মধ্যে কোথাও শৃঙ্খলা নেই। জীবনের যা কিছু স্বাভাবিকতাকে ত্যাগ করে শুধুমাত্র তার পার্থিব কামনায় নিজেকে রিপুর দাস করে তুলেছে। গোটা জীবনটাই তার দুঃখময়। সে ভুলে যায় সব কিছুই ক্ষণিকের। আজ যা আছে কাল তা অবলুপ্ত হয়ে যাবে। তবুও প্রতিমুহূর্তে সেই অনিত্যে মোহের আকর্ষণে ছুটে চলেছে।’’৮ আর সেই মোহের ধ্যমেই দুঃখময়তা উত্তরোত্তর সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। তাই সুখ অর্থাৎ পরম সত্যের সন্ধানে, নিজের জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে চাঙ-আন বিহারের ধর্মগুরু তার যাত্রা শুরু করেন। পথমধ্যে সর্বাঙ্গীন সঙ্গী কেবল তথাগতের অনির্বচনীয়তা।
পথশ্রম সহ দুর্গম পথরেখার সর্বত্রই মৃত্যুর হাতছানি। চীন সীমান্ত পেরিয়ে দুর্লঙ্ঘ্য হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে বামিয়ানে উপনীত হন হিউ-এন-সাঙ। তার সমগ্র যাত্রাপথের মধ্যে এই অংশটিই দুস্তররূপে বিবৃত করেছেন; তার মতে, “আমার যাত্রাপথে এই পথই ছিল সবচেয়ে কঠিন। মরুভূমির চেয়েও কঠিন। তুষার নদীর চেয়েও ভয়ংকর। সর্বক্ষ্ণ তুষারঝড় বইছে। তার সঙ্গে রয়েছে নানান অশরীরী শক্তির উপদ্রব।”৯ এই বামিয়ান প্রদেশটির অবস্থান অধুনা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে এটি ‘প্রাচীন যে সিল্ক রুট, তারই পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সংযোজন ভূমি।”১০ ইতিহাসের নিরীখে বামিয়ানের গুরুত্ব দ্বিবিধ; প্রথমত বৌদ্ধধর্মের উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান এটি। দীপঙ্কর বুদ্ধের ১৭৫ ফুট উঁচু মূর্তি স্থাপিত হয় বামিয়ানে। যদিও কালের প্রবাহে তালিবানি শাসনে ২০০১ সালে সেই ভাস্কর্যের অবলুপ্তি ঘটে। দ্বিতীয়ত বামিয়ানেই একমাত্র তিন বিদেশীয় জাতির সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলার সমন্বয় দেখা যায়। গ্রিক,তুর্কি, চৈনিক এবং ভারতীয় সংস্কৃতির এমন মেলবন্ধন পৃথিবীর অন্যত্র দেখা যায় না।
ঐতিহ্যমণ্ডিত বামিয়ানের পথ ধরে ভারতের পশ্চিম প্রান্ত অর্থাৎ গান্ধারে উপনীত হন হিউ-এন-সাঙ। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার এই অংশে গ্রিক আধিপত্যের সূচনা হয়। তারপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং পরবর্তী বৌদ্ধ-মতাধারী সম্রাট অশোক গান্ধার শিল্পশৈলীর অনুসরণে সংঘারাম, স্তূপ এবং বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন। কথিত রয়েছে গান্ধারেই বুদ্ধাস্থি সংস্থাপিত করা হয়। অতঃপর ভারতের সুপ্রসিদ্ধ জ্ঞানপীঠ তক্ষশীলা বিহারে কালযাপন করে সাঙ উপনীত হন ভারতের ভূস্বর্গ অবিভক্ত কাশ্মীরে। প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র রূপে কাশ্মীরের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। ভারতীয় আলঙ্কারিক তথা ঔচিত্যবাদের প্রবক্তা আচার্য ক্ষেমেন্দ্র ছিলেন কাশ্মীরীয় পণ্ডিত। সম্রাট অশোকের সময়কাল থেকে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। কাশ্মীররাজ মহাদুলর্ভবর্মনের সহায়তায় আচার্য ধর্মকীর্তি এবং ২০ জন অনুলিপি লেখকের সাহায্যে শাস্ত্রচর্চা শুরু হয় জ্ঞান-পিয়াসু সাঙের; “পণ্ডিত ধর্মকীর্তি মহা আনন্দে হিউ-এন-সাঙ। যদিও তখন তাঁর বয়স সত্তর। বয়সের ভারে দুর্বল ও কাতর হয়ে পড়েছেন। হিউ-এন-সাঙ-এর মত ছাত্র পেয়ে জ্ঞানদানে কোনো কুন্ঠা নেই। প্রতিদিন সকালে হিউ-এন-সাঙ অভিধর্মকোষ শাস্ত্র পড়েন। দুপুরে অভিধর্ম ন্যায়নুসারে শাস্ত্রপাঠ, রাতের বেলায় তিনি শিক্ষা নিতেন হেতুবিদ্যা শাস্ত্র।’’১১
ক্লান্তিহীন ভাবে বিদ্যাচর্চায় নিবেশিত হয় চৈনিক পথযাত্রীর মন। দুই মাস কাশ্মীরে বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ করে তোষাসন বিহারে ত্রিপিটক বিশেষজ্ঞ আচার্য বিনীতপ্রভ মহাশয়ের কাছে সুদীর্ঘ চোদ্দো মাসব্যাপী ‘অভিধর্ম সমুচ্চয় ব্যাখ্যা’ এবং ‘অভিধর্ম প্রকরণ শাসন শাস্ত্র’ অধ্যয়ন করেন। ইতিহাসের পথরেখা অনুসরণ করে আমরা পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ-এর যাত্রাপথের কালপঞ্জি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারি। অথচ সাহিত্য তার সুনিপুণ চারুত্বে সেই কাল্পপঞ্জির প্রচ্ছন্নতায় নিবিষ্ট ‘সত্যের’ সন্ধান দেয় আমাদের। গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলের মতে যা ‘কাব্যের সত্য ইতিহাসের তথ্য’ রূপে পরিচিত। মানবীয় আবেগ কিংবা তার অনুভূতির সম্মীলন বা জনশ্রুতির আধারে ইতিহাস রচিত হয় না। ইতিহাসের ব্যাপ্তি নির্দিষ্ট হয় কার্য-কারণ-যুক্তি-বাস্তবতাকে আধেয় করে। সাহিত্যিকরা তাই সেই যুক্তি পরম্পরার বেড়াজালে আবদ্ধ মানবীয় কাহিনিকে বিধৃত করেন সাহিত্যে। কথাসাহিত্যিক চঞ্চলকুমার ঘোষ প্রণীত ‘অমৃত পান্থ’ সেই ধারারই অনুসারী।
ইতিহাসের কালগাথা অনুসারে থানেশ্বরের অধিপতি হর্ষবর্ধনের রাজধানী কনৌজ তথা উত্তরভারতের প্রাণকেন্দ্রে কালযাপন করেন ভারতপথিক সাঙ। ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত কনৌজ ধর্মসম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। আঠারো দিন ব্যাপী এই সভায় বৌদ্ধদর্শনের তত্ত্বাদি আলোচিত হয়। তারপর কীভাবে পরম সত্যের অন্বেষণ কীভাবে করেছিলেন তিনি কিংবা কীরূপে পান্থের জ্ঞান-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়েছিল সেই পরিচয় সাহিত্যের আঙিনায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। গৌতমের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্ম হীনযান, মহাযান নামক কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়।
বুদ্ধের বাণী সকলক্ষেত্রেই সার-সত্য হিসাবে গৃহীত হলেও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে পৃথকতা দেখা যায়। হিউ-এন-সাঙ এই সকল বিষয়গুলি সম্পর্কেই ধারণা লাভ করেন। তোষাসনের পরে হরিদ্বার অঞ্চলে ত্রিপটক বিশেষজ্ঞ জয়গুপ্তের কাছে সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়ের বিভাষাশাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করেন। শাস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি শাক্যবংশের রাজধানী কপিলাবস্তু, লুম্বিনী সহ কুশীনগরে ভ্রমণ করেন। এই কুশীনগরেই পরিনির্বাণ লাভ করেন তথাগত। জন্ম-মৃত্যুর যাত্রায় আবদ্ধ মানবজীবন সম্পর্কে ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বুদ্ধের অন্তিমতম উপদেশ কুশীনগরেরই বিবৃত হয়;
‘জীবন হল এক যাত্রা
মৃত্যু হল জীবনে ফেরা,
এ বিশ্ব যেন এক পান্থশালা
বহতা বাতাস যেন এক ধূলিকণা
মনে রেখো জগৎ মায়াময়,
ভোরের শুকতারা সম পুবে মিলায়
গ্রীষ্মের আকাশে যেন বিদ্যুতের চমক
এ জীবন এক কম্পমান শিখা,
শুধু এক স্বপ্ন।”১২
মানবজীবনের প্রধানতম সারকথা বুদ্ধের অন্তিমকথায় নির্দেশায়িত হয়েছে। জন্মের পর থেকে বয়ঃকালীন সীমারেখার পাশাপাশি অভিজ্ঞতার আধারে সম্পূর্ণ হয় জীবনযাত্রা। ‘অমরত্বের’ আস্বাদন কেবলমাত্র সৃষ্টি বা কৃষ্টির মাধ্যমেই কালের রেখায় অঙ্গীভূত হয়। কারণ মৃত্যু মানুষের জীবনের অন্তিম পরিণতি। তাই মায়াময় বিশ্ব সংসারে মানুষের জীবনপ্রবাহ স্বপ্নসম একটি পথের প্রতীকায়িত রূপেরই নামান্তর। যা সর্বশ্রেষ্ঠ জীবে জীবদ্দশার অমোঘ সত্যকে উদ্ভাসিত করে। মহিমান্বিত কুশীনগরের পর বৈশালী নগর থেকে ‘বোধিসত্ত্বপিটক’ গ্রন্থ সংগ্রহ করে মগধ এবং পরবর্তীকালে নালন্দা সহ বুদ্ধগয়া, রাজগৃহের নানা স্থান দর্শন করে ভারত পরিক্রমায় অগ্রসর হন পরিব্রাজক সাঙ। ভারতের পূর্ব দিক বরাবর বিহারের মুঙ্গের হয়ে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ নগরে উপনীত হন। সেখান থেকে প্রাচীন তাম্রলিপ্তবন্দর আসেন। পূর্বজ পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের যাত্রা রূপনারায়ণ তীরবর্তী এই বন্দরেই সমাপ্ত হয়। তারপর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলার এই প্রাচীন বন্দরের পাশাপাশি সংলগ্ন জনবসতির পরিচয় মেলে হিউ-এন-সাঙ-এর বৃত্তান্তে; ; ‘এলাকাটি গ্রীষ্মপ্রধান। এখানে প্রচুর ফলমূল শস্য জন্মায়। লোকজন পরিশ্রমী। দশটি সংঘারামে প্রায় এক হাজার ভিক্ষু শ্রমণ বাস করেন। নগরে প্রায় দুশো ফুট উঁচু একটি স্তূপ রয়েছে। বন্দর গড়ে ওঠায় প্রচুর সম্পদ রয়েছে নগরে।’’১৩
তারপর ভারতের দক্ষিণদিকে যাত্রা করেন চৈনিক পান্থ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর পর পল্লবদেশে যান তিনি। সেখানে সিংহলীয় বৌদ্ধিকদের কাছ থেকে স্থবিরবাদী ত্রিপিটক সম্পর্কে অবহিত হন তিনি। অবশেষে মালব প্রদেশের মাধ্যমে হিউ-এন-সাঙ-এর ভারত পরিক্রমা সমাপ্ত হয়। সমগ্র পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত পরিভ্রমণের পাশাপাশি শাস্ত্রচর্চা এবং পুথি-পত্রাদি সংগ্রহ করেন তিনি। যার মধ্যে অধিকাংশ পুথির মূলাংশ অবলুপ্ত হয়, প্রামাণ্য নির্দশনরূপে হিউ-এন-সাঙ বিরচিত অনুবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ ধরে নিঃসঙ্গ একাকী যাত্রার মাধ্যমে পরামাঙ্খিত সত্যের পাশাপাশি বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ভারতবর্ষকে একটি সূত্রাকারে গ্রন্থন করেন ভারতপথিক হিউ-এন-সাঙ। প্রখর, প্রবল শক্তিশালী পরাক্রমীদের সমান্তরালে ‘অমর’ অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। পরম করুণা এবং প্রেমের মাধ্যমেই সর্ব ধর্মের সম্প্রদায়ের কাছে গৃহীত হয় তার মতামত। পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণ সেই ধারায় অঙ্গীভূত হন। আসলে ‘প্রেম’ বিশ্বমানবকে জয়ের প্রধানতম উপাধান। কোনোরকম হাতিয়ার কিংবা অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার কিংবা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ঈর্ষা বা দ্বেষের যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, তার করালগ্রাসে মানবতা ধ্বংস হয়। সভ্যতার প্রতি হিংসার কলতান মুখরিত হয়। আর সেই জন্যেই চেঙ্গিস খানের মতো প্রবল শক্তিমানরাও অনন্তকালের চক্রে বিলীন হয়ে যান; “অথচ বুদ্ধ, যীশু, নানক, শংকর, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ-তাঁরা তো কেউ শক্তিমান ছিলেন না। ছিল না রাজত্ব, সৈন্যদল। তাঁরা শুধু প্রেমের শক্তিতে বিশ্বমানবকে জয় করে নিলেন অনন্তকালের জন্যে।’’১৪
ঐতিহাসিক দীনেশ্চন্দ্র সরকারের মতে, ‘ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ও আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে গৌতম বুদ্ধ প্রথম সার্থক প্রতিবাদ জানান এবং ভারতের জনজীবন ও চিন্তাজগতে নতুন পথের সন্ধান দেন।’’১৫ ‘মানবতার’ প্রথম জয়গাথা ঘোষিত হয় পরমকারুণ্য এবং মানবপ্রেমের মাধ্যমে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ তার আরাধ্যের সেই প্রেমময়তাকে সঙ্গী করে দুস্তর মরভূমি, বরফের প্রান্তর অতিক্রম করে নৈরঞ্জনা নদীতীরে বোধিবৃক্ষ থেকে তথাগতের পার্থিব জীবনের অন্তিম বাসস্থানটিও দর্শন করেন। পরিপূর্ণ হয় তার পরামাঙ্খা। হিউ-এন-সাঙ-এর এই পরিক্রমার সূত্রে প্রাচীন ভারতের একটি সুনির্দেশিত রূপ প্রতিফলিত হয় জনসমক্ষে।
তথ্যসূত্র
১) ঘোষ, চঞ্চলকুমার, ‘অমৃতপান্থ’, কলকাতা : পারুল প্রকাশনী, পৃ ৭৩
২) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘বুদ্ধদেব’, কলকাতা : বিশ্বভারতী, পৃ ৩৫
৩) মুখোপাধ্যায়, জীবন, ‘স্বদেশ, সভ্যতা ও বিশ্ব’, কলকাতা
: শ্রীধর পাবলিশার্স, পৃ ৪৪
৪) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘বুদ্ধদেব’, কলকাতা : বিশ্বভারতী, পৃ ৪৮
৫) ঘোষ, চঞ্চলকুমার, ‘অমৃতপান্থ’, কলকাতা : পারুল প্রকাশনী, পৃ ৯৭
৬) তদেব, পৃ ৯৭
৭) তদেব, পৃ ৩৩
৮) তদেব, পৃ ৩০
৯) তদেব, পৃ ১৩৮
১০) তদেব, পৃ ১৪০
১১) তদেব, পৃ ১৭০
১২) তদেব, পৃ ২৩৫
১৩) তদেব, পৃ ৩০৯
১৪) তদেব, পৃ ১২৭
১৫) মুখোপাধ্যায়, জীবন, ‘স্বদেশ, সভ্যতা ও বিশ্ব’, কলকাতা
: শ্রীধর পাবলিশার্স, পৃ ৪৪
1.
অত্যন্ত সুলিখিত এবং তথ্যবহুল লেখা।
উত্তরমুছুন