![]() |
কবিতার কালিমাটি ১৪৫ |
নিশ্চলতার ভেতর
বাতাসের নিশ্চলতার ভেতর থেমে যায় আহ্ণিক গতি। পৃথিবীর স্তব্ধতার পাশে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য মাঠের দিকে হাত বাড়িয়ে দিই—পদ্মসৌরভ থেকে উষ্ণ ধ্বনি বেরিয়ে আসে, আমার প্রত্যেকটি আঙুলে নেচে ওঠে পত্রাঙ্কুর। তাদের দারুচিনিবর্ণ থেকে সুর ফোটে, আমি চোখ বন্ধ করি—অন্তঃশ্রবণ আমার সমগ্র সত্তা হয়ে ওঠে।
চোখ খুলে দেখি আমার সামনে ঘুমিয়ে আছে আবছা অরণ্য। দুয়েকটি পাখি সময়কে বেগশীল করে তোলে। আমার অস্তিত্ব থেকে ঝরে পড়ে মিথ্যা কোলাহল। অদৃশ্য সঞ্চারপথে তুমি ভেসে আসো, তোমার দেহের অদৃশ্যতাকে আমি স্পর্শ করি।
নিস্তব্ধতার ভেতর তুমি স্বরময় হয়ে ওঠো। তোমার অনুপস্থিতির অর্থ স্পষ্ট হয় ওঠে। তুমি দীর্ঘতম পথের মূঢ়তা উন্মোচন করেছো। যে কোনো সময় আমার ইঙ্গিতময় প্রশ্নের উত্তর দিতে জানো—উত্তরের জন্য তোমাকে স্বরযন্ত্রীর অপেক্ষায় থাকতে হয় না। আমি নিশ্চিত, বাজিকরের খেলা তোমার কাছে গুরুত্বহীন।
যে ভাষায় বাক্যগুলো অন্ধকার আর আলোর সংগমস্থলে জেগে ওঠে তার কোনো ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নেই। পদ্মসত্তার ভেতরে থাকে সঙ্গীত প্রবাহ আর সে প্রবাহ ভাষাকে শ্রুতিগম্য করে তোলে। আমি যা স্পর্শ করি তা সংবেদন সূত্রে আবদ্ধ নয়, অশ্রুত জীবনক্রন্দনের ভেতর তা জাগ্রত।
কোথাও শব্দের স্বনন নেই
শেষ দিনে পিতামহ সূর্যের আলোয় শুয়ে একটু হেসেছিলেন। একটি ঝাপসা ফটোগ্রাফে তার স্ফীত গালের দিকে অনেক দিন আমার দৃষ্টি পড়েছে। জীবনধারণের যুদ্ধ বড় যন্ত্রণাকর। পিতামহের যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক আগে মা মৃত্তিকার সাথে মিশে গেছেন। সার্সির কোনো নেক্রোম্যানটিক ক্রিয়া তাদের স্বরনালিকে আর সমুচ্ছল করতে পারবে না।
আমি শালবনের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। ঝরা পাতার গানে রাস্তা মুখরিত। অদৃশ্য হাওয়ায় ভেসে চলে পৃথিবী। স্তব্ধতা থেকে জঙ্গমতার দিকে যেতে যেতে পুনশ্চ স্তব্ধতার ভেতর মহাকাশ দাঁড়িয়ে থাকে; কোথাও শব্দের স্বনন নেই বলে মনে হচ্ছে। স্তব্ধতার ভেতর শব্দের শ্রাব্যতা নিঃশেষিত—অহল্যার জমাট-বাঁধা ধ্বনির সাথে ওড়ে পথের ধুলো।
আমি একটি রাস্তার তেমাথায় দাঁড়িয়ে ভূ-প্রকৃতি নিরীক্ষণ করি। দূরে অগ্নিকুণ্ড থেকে ধোঁয়া উদ্গীরিত হচ্ছে; কোথাও ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মিত হচ্ছে বাড়ি। হারিয়ে যাওয়া কোনো সঙ্গীত মেঘের পেছনে ছুটে চলেছে। শব্দহীন পাখি কিংবা বিভ্রমের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হলাম। এ বিস্ময়ের সম্ভাব্য অর্থ আমার গতিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্লথ করে তুললো।
অস্তিস্তহীন সত্তায় আন্দোলিত হওয়ার অর্থ খুঁজি। আন্দোলিত হওয়ার পর এরূপ সত্তার প্রভাব বাড়তে থাকে। তখন পৃথিবীর ভেতর একটি ভূমণ্ডল বিস্তৃত হয় এবং কোনো বাসস্থানেই গৃহ নির্মাণ করা সম্ভব হয় না।
আকাশে আবির্ভূত হলো অগ্নিময় উল্কারেখা; কয়েক সেকেন্ডের ভেতর রেখাটির অস্তিত্ব হারিয়ে গেলো। বাতাসের উত্তপ্ত অণুর আন্দোলন কতো দূর বিস্তৃত হতে পারে ভাবলাম। দহনের পর ঘনিয়ে আসে শৈত্য। নিস্তব্ধতার ভেতর শ্রুত হলো তালারিয়ার অস্পষ্ট ধ্বনি। হার্মিজের বার্তা সুবোধ্য নয় বলে মনে হলো।
ফেরা
(হারম্যান হ্যাসার কাছে ঋণী)
আমি উপবনের ত্রিসীমা ছেড়ে এলাম—বৃক্ষতলের নিস্তব্ধতার ভেতর আমার কৌতূহলী সত্তাকে বিসর্জন দিয়েছি। আমি বৃক্ষস্বভাবের সংক্রমণ রোধ করতে পারিনি, ভূর্জবৃক্ষের ফ্লোয়েম আমার সত্তাকে সঞ্জীবিত করেছে; আমি বাকল ফেলে ছুটে এসেছি। আমার প্রথম সত্তা থেকে আমি বিযুক্ত। প্রোতিউস অভীষ্টসাধনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করেছে। আমি নিজের ভেতরে যে পরিবর্তন লক্ষ করেছি তা শারীরিক রূপান্তরণ নয় বলে প্রায় অদৃশ্যমান। আমি পথে পথে হেঁটেছি আর নিজের ভেতরে নিমগ্ন থেকে অস্তিত্বের উৎস সন্ধান করেছি। চেয়েছি আমার সমস্ত মুহূর্ত থেকে পদ্মবর্ণ পালক ঝরুক।
আমি সাধারণ শিক্ষাকাল পেরিয়ে এসেছি।শিক্ষকের নির্দেশনা, প্রদর্শিত পথের ঔজ্জ্বল্য নবীন শিক্ষার্থীর স্নায়ুকে উদ্দীপ্ত রাখে। একদিন এ ঔজ্জ্বল্য আমার স্নায়ুকে আলোড়িত করেছে, আমার নিশ্বাসে সঞ্চার করেছে সবুজের সৌরভ। অসামান্য শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকেও আমি পার্বত্য পথ পেরিয়ে দূর বদ্বীপে চলে এসেছি। শিক্ষককে অবজ্ঞা করে পথের ক্লান্তি বরণ করিনি; এও ভাবিনি যে শিক্ষকের দৃষ্টিতে সত্যের কোনো স্ফুলিঙ্গ নেই। শিক্ষক তার সত্যকে শিক্ষার্থীর করতলে তুলে দিতে পারেন না। সত্য হতে পারে না উত্তরাধিকার। প্রাতিস্বিক আলো ব্যতীত সত্যের কম্পাসে চুম্বকশলাকা দৃশ্যমান হয় না। নিজেকে প্রশ্ন করি আমি এতকাল কী সন্ধান করেছি। রাশি রাশি গ্রন্থ পাঠ কিংবা শিক্ষার ভেতর দিয়ে কী উন্মোচন করতে চেয়েছি? আমার অন্তর্গত মনিটরে ভেসে ওঠে 'সত্তা'। আমি নিজেকে জানতে চেয়েছিলাম। আমার আকাঙ্ক্ষার অনুজ্জ্বলতা সত্তার স্পর্শ থেকে আমার দূরত্ব রচনা করেছে। আমি বিশুদ্ধ প্রতীকের ছায়ায় আশ্রিত হতে চেয়ে আমার সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছি।
নিজের প্রতিচ্ছবি আমাকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। নিজের প্রতিচ্ছবি থেকে জেগে ওঠা ধ্বনি শোনার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। ভীতি আমাকে অদৃশ্য শক্তি ও বিমূর্ত সত্যের দিকে চালিত করেছে। তারা আমাকে নিরুদ্দিষ্ট দ্বীপের ভেতরে নিয়ে যায়নি; আমি আমার সত্তাকে সেখানে বন্দি করে রেখেছিলাম। আমি নিজেকে অবজ্ঞা করেছি বলে নিজের সত্তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারিনি। নিস্তরঙ্গ জলে জেগে ওঠে আমার শান্ত ছবি। যাকে তুচ্ছ ভেবেছিলাম তার ভেতরে প্রোথিত কেন্দ্রমূল। দীর্ঘতম নিদ্রা শেষে আলোর উৎসের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। উত্তরের জন্য পরিব্রজ্যার প্রয়োজন নেই বলে আমার বোধোদয় হলো। আমি এখন অবিচলিতভাবে হাঁটি। ল্যাভেন্ডার মাঠের ভেতর দিয়ে নির্মিত অনাত্মীয় পথে আমার আগ্রহ নেই; যে পথ আমাকে অন্তর্বাসিক সত্তার কাছে নিয়ে যায় তার স্বর্ণাভ ধুলোয় দাঁড় করিয়ে রাখি বিভাবিত মার্কার।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন