কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় দেখা হিন্দী ছায়াছবি (পঞ্চম পর্বঃ ১৯৮৮-২০০০) 




১৯৮৮-তে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি হিন্দী ছবিই দেখেছি – মীরা নায়ার পরিচালিত সেলাম বম্বে, মেট্রোতে – যেখানে ইংরেজী ছবির রাজত্বকাল মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার সংস্থার অবলুপ্তির পর অনেক দিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ছবিতে মিঃ ইন্ডিয়া-র একটি গানের দৃশ্য ব্যবহার করা হয়েছিল, আর একজন অভিনেতা নজর কেড়েছিলেন, যাঁর নাম পরে জেনেছি – নানা পাটেকর।

১৯৮৯-তে একাধিক ছবি দেখা হয়। সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সেইজন্য উপভোগ্য, ‘হরর’ ছবি সৌ সাল বাদ, যেটি দাদার সেই বন্ধুর কল্যাণে বিনামূল্যে দেখি সোসাইটিতে। একটা নতুন ব্যাপার এবারে লক্ষ্য করলাম। একই হল বিভিন্ন শো-তে ভিন্ন-ভিন্ন ছবি দেখাচ্ছে। হল মালিকের ছেলে, চক্ষু-চিকিৎসক ডাঃ ফিরোজি, বললেন যে ছবিটির ‘রীল’গুলো (এটা প্রাক-ডিজিটাল যুগ) আছে অন্য কোন হলে, সেখান থেকে কলকাতার যানজট ঠেলে এসে পৌঁছলে তবেই ছবিটা দেখা যাবে। প্রদর্শনীর পর আবার রীল যাবে অন্য কোন হলে! যাক, ঠিক সময়েই রীল এসে যায়, ছবি দেখাও হয়।

অপর দুটি ছবির মধ্যে জীবনে প্রথম এবং শেষবার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের ‘লোটাস’-এ দেখি বিধু বিনোদ চোপড়ার প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সেন্সরের ছাড়পত্র পাওয়া – সৌ সাল বাদ-এর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য ছিল – ‘গ্যাংস্টার’-দের নিয়ে ছবি পরিন্দা। কেন্দ্রে তখনকার জনপ্রিয় জুটি – কিন্তু নারী-পুরুষ নন, দুই পুরুষ – জ্যাকি স্রফ আর অনিল কাপুর। অবশ্য, দ্বিতীয়জনের সঙ্গে গতানুগতিক জুটি বেঁধে ‘হিট’ করা মাধুরী দীক্ষিতও ছিলেন, তবে কাহিনীর প্রেক্ষিতে তিনি পার্শ্বচরিত্র। মূল প্রতিপক্ষ সেই নানা পাটেকর। সৌ সাল বাদ দেখে কোন অপাপবিদ্ধ অ-প্রাপ্তবয়স্ক ‘ভয়’ পাবে জানি না, আর ছবিতে যৌনতাও হাস্যকর। পরিন্দা ‘এ’ সার্টিফিকেট পেয়েছিল প্রধানত অনিল-মাধুরী অভিনীত চরিত্রদ্বয়ের বিবাহরাত্রিতে সঙ্গমের দৃশ্য এবং ঠিক তার পরেই নানা পাটেকরের বন্দুকের গুলিতে বিবাহ-শয্যাতেই দুজনের ঝাঁঝরা হয়ে রক্তাক্ত মৃতদেহে পরিণত হওয়ার জন্য। জ্যাকি-অনিল-মাধুরী ত্রয়ীকে এই প্রথম আমার বড় পর্দায় দেখা।

ইতিমধ্যে বিখ্যাত ‘নন্দন’-এ যাওয়া হয়ে গেছে প্রধানত উত্তম-সুচিত্রার না-দেখা ছবি দেখার জন্য। এবার গেলাম মৃণাল সেনের একদিন অচানক দেখতে। অক্সফোর্ডে দক্ষিণ এশীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সংস্থা ‘মজলিশ’-এর কল্যাণে উক্ত পরিচালকের একদিন প্রতিদিন দেখে ভালো লেগেছিল, সে কথা বড় পর্দায়  বাংলা ছবি দেখার ইতিহাসে বলেছি। একদিন অচানক দেখে, তারপর ভিডিও ক্যাসেটে পরিচালকের মহাপৃথিবী দেখে, এবং তাঁর খারিজ-এর সম্বন্ধে জেনে এই উপলদ্ধি হলো যে ‘বাণিজ্যিক’ ছবির মতো ‘কলাত্মকবা ‘আর্ট ফিল্ম’-ও একই ‘ফরমুলা’ অবলম্বন করে ছবির পর ছবি করতে পারেঃ এক  পরিবারের বা বাড়ির একজন সদস্য সাময়িকভাবে (একদিন প্রতিদিন) বা চিরকালের জন্য (একদিন অচানক) নিখোঁজ হয়ে যাবে অথবা মারা যাবে (খারিজ, মহাপৃথিবী), এবং এই অনুপস্থিতি বা হারিয়ে যাওয়া ঘিরে পরিবার এবং বাড়ির অবশিষ্টদের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া চলবে, তাইই হবে ছবির বিষয়।

১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে আমার বিয়ে হয়। তারপর সস্ত্রীক মেট্রোতে দেখি, নাকি ফরাসী উপন্যাস মাদাম বোভারি অবলম্বনে, মায়া মেমসাব। নাম ভূমিকায় পরিচালক কেতন মেহতার সুন্দরী স্ত্রী দীপা শাহী, এবং মায়ার একাধিক প্রেমিকের মধ্যে রাজ বব্বর এবং শাহরুখ খান, তাছাড়া দোকানদারের চরিত্রে পরেশ রাওয়াল। তখনও লতা মঙ্গেশকর ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠ দিচ্ছেন, এবং তাঁর গলায় কেন্দ্রীয় চরিত্রের মুখে গান ছিল। মায়া মেমসাব কি মূলধারার ছবি না ‘আর্ট ফিল্ম’? এর পরের ছবি, কল্পনা  লাজমি পরিচালিত এবং ভূপেন হাজারিকা সুরারোপিত রুদালী (চ্যাপলিনে দেখা), একেবারেই ‘কলাত্মক’। ডিম্পল কাপাডিয়ার মুখে আবার সেই লতাকণ্ঠে অত্যন্ত সুখশ্রাব্য ‘দিল হুম হুম করে’, এবং আরেকটি মরুভূমিতে বর্ষা আবাহনের গান। অন্যান্য ভূমিকায় সেই রাজ বব্বর আর অতি নিরীহ চরিত্রে গব্বর সিং-খ্যাত আমজাদ খান। ডিম্পলের অভিনয় খুবই মনোগ্রাহী ছিল।

১৯৯৪-তে ফোড়েপুকুরের টকি শো হাউসে দেখি সেই বছরে বক্স অফিসে একেবারে শীর্ষে থাকা মাধুরী দীক্ষিত-সলমন খান অভিনীত হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন। ছবিটি যেমন জনপ্রিয় তেমনই বিদ্রুপের শিকারঃ সোজা ভাষায় প্রায় তিনঘণ্টা লম্বা একটি বিয়ের ভিডিও! বলতে দ্বিধা নেই, এটি কিন্তু আমার ভালো লাগা হিন্দী ছবির মধ্যে একটি, নিঃসন্দেহে বিদেশ থেকে ফিরে এসে এখন অবধি যে ক’টি হিন্দী  ছবি দেখেছি, তাদের মধ্যে সেরা (হ্যাঁ, সজ্ঞানেই এই কথা বলছি, মৃণাল সেন, কেতন মেহতা, কল্পনা লাজমিদের ছবির চেয়ে অনেক বেশী মনোরঞ্জনকারী)। দুটি পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে সৌহার্দের তুলনায় বিরূপতা, তিক্ততা, অসূয়া যে কী পরিমাণে জনিত হয়, নিজের জীবনে তা একাধিকবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এই ছবিটির কাহিনীকার এক কল্পজগৎ সৃষ্টি করেছেন যেখানে এইরকম দুটি পরিবারের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শুধু পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মৈত্রী, এবং আর যা যা ইতিবাচক হতে পারে, প্রায় শুধুই তাই, যার মধ্যে সামিল এক বাড়ির পোষা কুকুর অবধি। যেটুকু নেতিবাচক ক্রূরতা দেখা গেছে, তার উৎস, দুই পরিবারের কোন সদস্যের চেয়ে, বন্ধুস্থানীয়া একজন (চরিত্র রূপায়নে এককালীন ভ্যাম্প এবং পরবর্তীকালে অত্যাচারী শাশুড়ির ভূমিকায় পারদর্শিনী বিন্দু)।  তা’ বলে কি দুঃখ আসেনি? এসেছে, কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে, যখন নিজের বোন নিশার (মাধুরী দীক্ষিত)  সঙ্গে দেওরের (সলমন খান) প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে আনন্দে উচ্ছ্বসিতা বৌদি (রেণুকা সাহানে) সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নামতে গিয়ে পড়ে যান এবং গুরুতর আঘাত পেয়ে মারা যান। তাঁর ইশারার বক্তব্য ভুল বুঝে দুই পরিবার বৌদির স্বামীর (মোহনিশ বেহেল) সঙ্গেই নিশার বিয়ের ব্যবস্থা করে। বাড়ির ভৃত্য শেষে শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা জানাতে যেন স্বয়ং তিনিই পোষ্য সারমেয়টিকে পাঠিয়ে দেন  মুখে করে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চিঠি দাদা (মোহনিশ)-এর হাতে পৌঁছে দিতে। সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটে।

১৯৯৫, ১৯৯৭, এবং ১৯৯৮-তে তৈরি একই জনপ্রিয় নায়ক অভিনীত তিনটি ছবি নিয়ে একসঙ্গে লেখার আগে ১৯৯৭ আর ১৯৯৯-এর দুটি অন্য ছবির কথা বলব। ১৯৯৭-এর আস্থাঃ In the Prison of Spring ছবিতে ১৯৭০-এর সাওন ভাদো ছবির জুটি নবীন নিশ্চল ও রেখাকে আবার উপস্থাপিত করা হয়, তবে প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবে নয়। রেখার চরিত্রটি, মানসী, এক অধ্যাপক অমরের (ওম পুরী) স্ত্রী যে ভোগবাদী জীবনের লালসায় দেহোপজীবনীতে পরিণত হয়, যে পথে তাকে চালিত করে রীনা (ডেইজি ইরানী) এবং রীনার পরিকল্পনা অনুযায়ী মানসীর সঙ্গে প্রথম বিবাহ-বহির্ভূত সঙ্গম করা নবীন নিশ্চল অভিনীত চরিত্রটি। বিতর্কিত ছবি কিন্তু চিত্র সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত এবং পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যের আগের ছবির তুলনায় নাকি – একাধিক সঙ্গম দৃশ্যের কল্যাণে – খানিকটা বাণিজ্যিকভাবে সফলও, যদিও ১৯৯৭-এর দশটি সফলতম ছবির মধ্যে এর নাম নেই। দেখেছিলাম চ্যাপলিন প্রেক্ষাগৃহে।

১৯৯৯-র সূর্যবংশম দেখেছিলাম সস্ত্রীক লেক টাউনের জয়া সিনেমায়, পরে, পুনর্মুক্তির পর। দুটি বক্তব্য রাখবোঃ

১। দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা ভানুপ্রতাপের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন যথাযথ। কিন্তু ছেলে হীরার ভূমিকায়, close-up-এ তাঁকে একেবারেই নেওয়া যাচ্ছিল না – অনেকটা পাকীজা-র কিয়দংশে মীনাকুমারীর মতো! ওই সময়ে অভিষেক বচ্চন দুর্ভাগ্যক্রমে ছবির জগতে আসেননি। এলে ছবিটি অনেক বেশী মনোগ্রাহী হতো।

২। একটি চরিত্রের ব্যাপারে ছবির কাহিনীকার রাজনৈতিক সঠিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছেন। রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত গৌরী খোলাখুলিভাবে হীরার সঙ্গে মেশে, হীরাও গৌরীকে অন্তর থেকে ভালোবাসে। কিন্তু যখন ভানুপ্রতাপ, অনিচ্ছাসত্বেও, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন, গৌরী আত্মহত্যার চেষ্টা করেঃ এক ইস্কুল-ফেল (হীরা তাইই) ছেলেকে বিয়ে করার চেয়ে মরাই ভালো! গৌরীর অসংবেদনশীল আচরণ এবং তজ্জনিত দুর্নাম থেকে তাকে বাঁচাতে হীরাই বলে যে সে গৌরীকে প্রত্যাখ্যান করেছে – যার ফলে ভানুপ্রতাপ নিরক্ষর ছেলের প্রতি আরও কুপিত হন। গৌরী এক বিত্তশালীকে বিয়ে করে গ্রাম ছাড়ে। কিন্তু, সব জানার পর হীরার বোনের ননদ রাধা (সৌন্দর্যা) নিজে এগিয়ে এসে হীরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, হীরার নিঃস্বার্থ আচরণকে সম্মান জানিয়ে, এবং পরে গৌরীকে কিছু কড়া কথাও শোনায় গৌরীর হঠকারী আচরণের জন্য। মেয়েরাই যে সব সময় নির্যাতিতা হয় না, বরং সুযোগ পেলে নির্যাতন করে একথা বলার সাহস ছবিটি দেখিয়েছে।

(ক্রমশ) 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন