পত্রিকা সমালোচনা / পাঠ প্রতিক্রিয়া
‘কালিমাটি’ / সংখ্যা ১১১ / বিষয় : সত্তর দশক / পৌষ ১৪৩১ / সম্পাদক : কাজল সেন ও পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র
কালিমাটি ১১১ হাতে এসেছে। বিষয়
- সত্তর দশক। এটি এমন একটি বিষয় যা বিতর্কিত এবং বহুমাত্রিক, আর সেইসাথে কিছুটা বিভ্রান্তিকরও
বটে। এই কথাটিই স্পষ্ট হয়েছে ‘সম্পাদকীয়’-তে, যেখানে অনেকদিন থেকে চলে আসা কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও বিকৃত বিশ্লেষণের
বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সম্পাদক দু’জন এরকম একটি সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। মোট
১৮টি বিষয়কে সামনে রেখে কাজ হয়েছে। সংকলিত হয়েছে মোট ২০টি প্রবন্ধ। মূলত পশ্চিমবঙ্গের
ঘটনাগুলিকে ভিত্তি করেই (অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে) আলোচনাগুলি আবর্তিত হয়েছে। অনুষঙ্গ
হিসাবে পূর্ববঙ্গের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ) কথাও এসেছে বইকি,
তবে তা নানা কারণে সীমাবদ্ধ। বাদ গেছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ (কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা ছাড়া),
সীমান্তের দুই পারেই যার অভিঘাত ছিল বিপুল। তবে আধুনিক পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে
একটি সম্পূর্ণ নূতন জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, ভাষাগত আত্মপরিচয়কে ভিত্তি করে, - এই ঘটনার
ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্ভবত একটি স্বতন্ত্র পরিসর দাবী করে। বাদ গেছে সম্পাদকদের বাছাই
করা কিছু বিষয়। কিন্তু তারপরেও বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই সংকলনটির নানা স্বাদের প্রবন্ধগুলি
পাঠককে অন্যমনস্ক হবার অবকাশ দেয় না। বিশেষ করে এই সংকলনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের
পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সম্পাদকদের
এহেন মনস্কতা আলাদা করে উল্লেখের দাবী রাখে। সব মিলিয়ে অনুসন্ধিৎসু, কিন্তু নানা কারণে
কিছুটা সংশয়ী পাঠক, বিশেষত যাঁদের সত্তর দশক সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বেশ কম, তাঁদের
জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা।
এই সংকলনের প্রথম প্রবন্ধ অমর্ত্য
মুখোপাধ্যায়ের ‘খ্রিস্টাব্দ ১৯৬৮ ও পশ্চিমবঙ্গে সত্তরের দশক : একটি তাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক
উপক্রমণিকা’। শিরোনামেই স্পষ্ট, প্রবন্ধটি ইতিহাস চর্চার একটি তাত্ত্বিক উপস্থাপনা
এবং সেইসাথে পরবর্তী সমস্ত প্রবন্ধ, তথা আলোচনার
মুখবন্ধও বটে। অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ এই আলোচনাটি জুড়ে মণিমাণিকের মত ছড়িয়ে আছে অনেকানেক
উদ্ধৃতি। সেখানে প্লেটো বা থুকিদিসিসের মত প্রাচীন জ্ঞানী থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের
ভিকো, কার্ল মার্কস, পলান্যির মত প্রাজ্ঞ পণ্ডিত হ’য়ে অধুনা বিশ কিংবা একুশ শতকের বিশেষজ্ঞ
ব্রদেল বা ওয়ালার্স্টিন, - সামিল অনেকেই। এসেছে বহু আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর প্রসঙ্গ ও
সেই সম্পর্কে লেখকের মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ। বাদ পড়েনি বিশ শতকের ‘নতুন বিজ্ঞান’, আধুনিক
পরিবারের ‘একগামী’ মূল্যবোধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা নারীমুক্তি আন্দোলন। পাশাপাশি এসেছে
ভাষাতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই ধরনের
দশক ভিত্তিক ইতিহাসের তাত্ত্বিক পর্যালোচনায়
অনুভূমিক ও উল্লম্ব (লেখকের পরিভাষায় অক্ষাংশী ও অনুদৈর্ঘ্যিক, latitudinal ও
longitudinal) এই দু’টি প্রকরণের মেলবন্ধন ঘটানো জরুরি। অর্থাৎ স্থান ও কালে সীমাবদ্ধ
কোন ইতিহাস বুঝতে গেলে সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের ঘটনা পরম্পরা ও সময়ের ধারাপাতে
সেই স্থানের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের ইতিহাসের ধারা, এই দু’টিকে বাদ দেওয়া চলে না।
সেই হিসাবে সত্তর দশকের যে ইতিহাস-চর্চা, তার সময়সীমা গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে শুরু
করে অধুনাকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। তাত্ত্বিকতায় ঋদ্ধ, বিদগ্ধ এই রচনাটি সঙ্গত কারণেই সংকলনের
প্রথমেই জায়গা করে নিয়েছে। প্রবন্ধের শেষে উল্লিখিত দীর্ঘ রচনাপঞ্জী লেখকের শ্রম ও
নিষ্ঠার সাক্ষী। তবে পরিভাষাকীর্ণ এই রচনাটি বিষয়-অনভিজ্ঞ পাঠকের পক্ষে কিছুটা দুরূহ।
খটকা রইল ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার সময়কাল নিয়ে। সম্ভবত ওটি মুদ্রণপ্রমাদ।
পরবর্তী রচনা নন্দন রায়ের ‘সত্তর দশক : বিভ্রান্তির দশক’। অত্যন্ত ঝরঝরে, সাবলীল এই লেখা। একই সাথে এতটাই আঁটোসাঁটো যে বাড়তি কোন কথা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যুক্তির শৃংখলা প্রায় অঙ্কের মত, ঋজু, স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ। ঈর্ষণীয় লেখকের পরিমিতিবোধ এবং ‘ঠিক পেরেকটির ওপর হাতুড়ির ঘা’ মারার দক্ষতা। সর্বোপরি রচনাটির নিশ্চিত অভিমুখ এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশে ‘আজ কাল পরশু’র ঘনিয়ে ওঠা সংকট। রচনাটিতে লেখক সত্তর দশকের চারটি প্রধান প্রধান ঘটনাবিন্দু বেছে নিয়েছেন। প্রথমেই এসেছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে, মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম থেকে শুরু করে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ঘটনাপঞ্জী পর্যন্ত, একটি প্রাঞ্জল রেখাচিত্র উপস্থিত করেছেন লেখক। তাঁর আর্থ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রত্যাশিতভাবেই একরৈখিক, এমনকি কিছুটা হয়তো অতি-সরলীকৃত। তবে তিনি নিজেই তাঁর সীমাবদ্ধতা ও সচেতন সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সেই দেশের অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব ও সংকট এবং প্রতিবেশী দেশ হিসাবে এ দেশের সাথে সেসব ঘটনাবলীর অন্যোন্যক সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া পাঠকের চোখ এড়ায় না। পরবর্তী ঘটনাবিন্দু ‘নকশালপন্থা ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় বিভাজন’। আলোচনাটি সংক্ষিপ্ততর, এমনকি বলা যায় অতি-সংক্ষিপ্ত। এটিও একটি রেখাচিত্র, কিন্তু একই সাথে অতি-বাম রাজনীতির একটি নির্মোহ ও নিরপেক্ষ প্রতিবেদনও বটে। প্রতিশ্রুতিমান যুব-ছাত্রদের আদর্শবাদ ও দিগ্ভ্রান্ত, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সীমাহীন অজ্ঞতায় পরিকীর্ণ নেতৃত্ব, দুনিয়া-কাঁপানো বিপ্লবের স্বপ্ন এবং অজস্র উপদলে দীর্ণ, এলোপাথাড়ি খুনোখুনির বহ্নুৎসব, সেদিনের নকশাল আন্দোলনের পড়ে থাকা আজকের দিনের ‘বাকি ইতিহাস’ এবং সরকারী (পড়ুন কেন্দ্রীয় সরকারী) ‘নিকেশ’ নীতি - আলোচনাটি শেষ হয়েছে উগ্র বামপন্থার মূল উৎসটিকে চিহ্নিত করে। যেহেতু শোষণ-পীড়ন অধুনা রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাই প্রতিবেদনটি যতটা অতীত ইতিহাস, প্রায় ততটাই বর্তমানও বটে। অন্তত লেখকের মন্তব্য সেইদিকেই ইঙ্গিত করে।
তৃতীয় ও চতুর্থ ঘটনাবিন্দু দু’টি
ব্যাপ্তি ও গভীরতায় বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে। তৃতীয় ঘটনাবিন্দুর শিরোনাম ‘জরুরী
অবস্থা ও জাতীয় রাজনীতিতে অতিদক্ষিণপন্থার উদ্ভব’। তিন পর্বে বিধৃত এই রচনাংশের প্রধান
নিষ্কর্ষ দু’টি - ১) ফ্যাসিবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা
নিরূপন ও ২) ১৯৭৫ সালে ঘোষিত ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার সাথে বর্তমান মোদী জমানার
একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিতুলনা। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি বিপজ্জনকভাবে অতিব্যবহৃত। কাজেই
যদিও ‘ফ্যাসিবাদ মাত্রেই স্বৈরাচারী, তবু সব স্বৈরাচারই শেষপর্যন্ত ফ্যাসিবাদ নয়’
- এই ধারণাটি স্পষ্ট হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে ফ্যাসিবাদ একটি অত্যন্ত পরিচিত, স্বাভাবিক, এমনকি প্রায় মান্য-প্রক্রিয়া
বলে মনে হতে পারে। দ্বিতীয় নিষ্কর্ষটি ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উপরোক্ত দু’টি ঘটনাকে
এক বন্ধনীতে রাখার মত মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় এবং সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে
তাদের অনেকেই যথেষ্ট ধীমান ও নেতৃস্থানীয় অথবা আমাদেরই কোন নিকট আত্মীয় বা বন্ধুস্বজন।
ফলত ফ্যাসিবাদের এই সামান্যীকরণের ফলে আমরা ক্রমশ সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, বর্তমান
সঙ্কটের ভয়াবহতাকে তোয়াক্কা না করেই। রচনাংশের তৃতীয় ভাগে রয়েছে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের
পটভূমি ও সেইসাথে অস্বস্তিকর, অথচ অনিবার্য একগুচ্ছ প্রশ্নের অঙ্কুর। লেখকের বেশ কিছু
মন্তব্য যে কোন তন্নিষ্ঠ পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে, অনিচ্ছায়, এমনকি অসচেতনভাবে হলেও।
‘ফ্যাসিবাদ ব্যর্থ বিপ্লবের ফসল’, লেখকের এই কথাটি প্রতিটি বামমনস্ক মানুষকে আত্মসমীক্ষার
মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ফ্যাসিবাদ প্রকৃত পক্ষে একটি গণ আন্দোলন যার ‘একটি শ্রেণীচরিত্র
ও একটি গণচরিত্র উভয়ই আছে’ - এই বিশ্লেষণ সঙ্কটের ব্যাপ্তিকে অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি
পৌঁছে দেয়। তাকে আর মুষ্টিমেয় কিছু বিভ্রান্ত অথবা ষড়যন্ত্রকারীর উৎপাত বলে পাশ কাটিয়ে
যাওয়ার উপায় থাকে না। বর্তমান রাজনীতির প্রায় সম্পূর্ণ কর্পোরেট-করণ ফ্যাসিবাদী গণ
আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার সূক্ষ্ম ও গুণগত পার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে
দেয়। আর সবশেষে থাকে ব্যষ্টি অথবা সমষ্টি মানুষের মানসিকতার গভীরে নিহিত এক ‘সর্বশক্তিমান
প্রভু’, তথা ‘মেসায়া’-র আকাঙ্ক্ষা, যা অবধারিতভাবে ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর।
এই প্রবন্ধের চতুর্থ, তথা শেষ ঘটনাবিন্দু
‘প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রণ্টের অভিজ্ঞতা এবং বামফ্রণ্টের সুদীর্ঘ শাসন’। অত্যন্ত দুরূহ
ও সংবেদনশীল একটি বিষয়, একইসাথে অত্যন্ত জরুরি এবং প্রাসঙ্গিকও বটে। সীমিত পরিসরে তুলে
ধরা হয়েছে এই বাংলার বাম রাজনীতির ইতিহাস ও তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। অবধারিতভাবেই
ফিরে এসেছে নকশাল আন্দোলনের কথা। লেখকের মতে তদানীন্তন সি.পি.এম. ও নকশালপন্থীদের মূল
পার্থক্য ছিল রণকৌশলের, রণনীতির নয়। অথচ ‘সংসদীয় রাজনীতি আর সংশোধনবাদী রাজনীতি যে
এক কথা নয়’, বিপ্লবী কমরেডরা সে কথা বুঝতে চাননি, বা পারেননি। নকশাল আন্দোলনের অনিবার্য
ফল, প্রতিশ্রুতিমান অসংখ্য তরুণের অকালমৃত্যু - যার পরিণাম পরবর্তীকালে মধ্যমেধার বিস্তার
ও বাম নেতৃত্বের অবক্ষয়। দীর্ঘদিনের শাসন ও দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির ফলে ‘আমাদের রাজ্যে
সরকারী রাজনীতিটি শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সরকার-সর্বস্বতার রাজনীতিতে’। তবে নিছক
অতীতের সমালোচনা আর বাঁধা গতের চর্বিতচর্বণ
মোটেই লেখকের উদ্দেশ্য নয়। বরং তিনি চেষ্টা করেছেন এই দেশের ‘বামপন্থীদের সাম্প্রতিক
সমস্যার’ মূলে পৌঁছতে। তাঁর মতে ‘সংস্কার (relief) ও বিপ্লবের মধ্যেকার দ্বান্দ্বিক
সম্পর্কটি বামপন্থীদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সূচনাবিন্দু হওয়া উচিত’। অথচ পার্টির ভেতরে
বা বাইরে এই সম্পর্কে উপলব্ধি তো নেইই, এমনকি
কোন আলোচনাও চোখে পড়ে না। তিনি নিজে এর একটি তাত্ত্বিক এবং ফলিত প্রয়োগের রূপরেখা দেওয়ার
চেষ্টা করেছেন। উদাহরণ হিসাবে বেছে নিয়েছেন সাম্প্রতিক আর. জি. কর আন্দোলনের ঘটনাবলী।
আধুনিক বৈদ্যুতিন পরিভাষা ধার করে বলা যায় তিনি সাম্প্রতিক বামপন্থার অতি প্রয়োজনীয়
upgradation-এর একটি যুক্তিগ্রাহ্য দিকনির্দেশ দিতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক
থাকতেই পারে, কিন্তু গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার যে আশু প্রয়োজন
তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আশা করা যায় এই প্রবন্ধ অন্তত কিছু মানুষের মধ্যে চিন্তা
করার এই অভ্যাস চারিয়ে দিতে পারবে আর সেখানেই
এই প্রবন্ধের সার্থকতা।
পরের প্রবন্ধ রবীন্দ্র গুহের ‘সত্তর দশকের নির্বাচিত সূচি’। শিরোনামে ‘সূচি’ শব্দের ব্যবহার সার্থক, কারণ প্রবন্ধটি সত্তর দশকের বাছাই করা কিছু ঘটনার ‘মন্তাজ’, কিছু ছবির চালচিত্র। ছবিগুলি সবই যে স্থিরচিত্র তা মোটেই নয়, বরং অনেক ছবিই বেশ অস্থির, এমনকি রক্তাক্ত। বেশ কিছুটা জুড়ে রয়েছে শাহবাগ, রয়েছে রবীন্দ্র-বিদূষণ, মুক্তিযুদ্ধ, মুজিব-হত্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি অসংখ্য সাধারণ মানুষ। সত্তরের দশকের মহামন্দার পাশাপাশি রয়েছে তথ্য ও মহাকাশ প্রযুক্তির অগ্রগতি, অবাধ বিনোদন, নতুন ধারার সিনেমা, REGE মিউজিক। রয়েছে এই দশকের বাছাই করা কিছু রাজনৈতিক ঘটনা, (ভারতের বাইরে) পৃথিবীর দু’টি দেশে নারীর সর্বোচ্চ ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছনোর খতিয়ান, আর শেষপাতে ভারতের পরমাণু শক্তিধর হওয়ার ঘোষণা। এককথায় প্রবন্ধটি বিশ্বজোড়া সত্তর দশকের একটি ঝাঁকিদর্শন। বস্তুত এই আপাত-এলোমেলো ভাবটির জন্যই প্রবন্ধটিকে সত্তর দশকের এক মান্য প্রতিনিধি বলা চলে।
উপরের তিনটি প্রবন্ধই কোন না কোনভাবে সত্তর দশকের ইতিহাস ও রাজনীতির একটি সামগ্রিক রূপ ধরতে চেয়েছে। পরবর্তী বেশ কিছু প্রবন্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে কিন্তু রয়েছে এই দশকের নির্দিষ্ট কোন ঘটনা, বা আন্দোলন। অশোক চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবীর দত্ত হত্যার পঞ্চাশ বছর’ এই ধারার প্রথম প্রবন্ধ। লেখকের নিজের বয়ানে, “চারু মজুমদার-হত্যার ঠিক একান্ন সপ্তাহের মাথায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ শত-শত মানুষের বিস্ময়াহত চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে ... হত্যা করেছিল নাট্যকর্মী এবং কবি প্রবীর দত্তকে । সেদিনটি ছিল শনিবার, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই”। রাষ্ট্র স্বভাবতই এই হত্যার দায় স্বীকার করেনি। এই প্রবন্ধে সম্পূর্ণ ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দাখিল করা হয়েছে। ঘটনার অনুষঙ্গে রয়েছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চালচিত্র। বিশেষত বর্তমান সরকারের (কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয়ত) বিভিন্ন দমনমূলক একপেশে আইনের ক্রমবর্ধমান অপব্যবহারের যে পরিসংখ্যান লেখক দিয়েছেন তা যদিও পরিচিত, এমনকি প্রত্যাশিতও, তবু যথেষ্ট চিন্তার। পাশাপাশি রয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। “... প্রবীর দত্ত শহিদ হওয়ার ঠিক দু-সপ্তাহ পরে কার্জন পার্কেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল নাটক ‘মিছিল’। সেই নাটকে কেয়া চক্রবর্তী অভিনয় করেছিলেন”। অংশ নিয়েছিলেন সেই সময়ের আরো অনেক বরেণ্য মানুষ। তাই লেখকেরও বিশ্বাস “আজ প্রবীর নেই, কিন্তু আন্দোলন রয়ে গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে প্রবীরদের রেখে-যাওয়া পথ”। তবে এই প্রবন্ধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অংশ বোধহয় এটাই যে, সেদিন যা ছিল ভয়াবহ সন্ত্রাস, আজ তা অনেকটাই সাধারণ জীবন যাপনের অঙ্গ। এমনকি সন্ত্রাস ছড়ানোর রাষ্ট্রীয় মৌরসী পাট্টায় রীতিমত ভাগ বসাচ্ছে আমার আপনার চেনা জানা বেশ কিছু সাধারণ মানুষ, আর তাকে নীরব সমর্থন যুগিয়ে চলেছে আরো অনেক প্রচ্ছন্ন ভদ্রজন। কোন সময়টা যে বেশি অন্ধকার তা হলফ করে বলা শক্ত।
এই পর্যায়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ সুজয় রায়ের ‘জরুরি অবস্থার অন্ধকার দিনগুলি ও কিছু জরুরি কথা’। প্রবন্ধের সাথে মিশেছে স্মৃতিকথার আদল। বিষয় জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপট, যার ভরকেন্দ্র ছিল তদানীন্তন অবিভক্ত বিহার। অনিবার্য ভাবেই এসেছে জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রসঙ্গ। তবে স্বল্প পরিসরে লেখক কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাননি । বরং অল্প কয়েকটি রেখার আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন জরুরি অবস্থার আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি, আর জোর দিয়েছেন জরুরি অবস্থার পরিসর ও প্রকারের ওপর। কিভাবে শব্দের চয়ন (আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা) একটি অতি বিশেষ অবস্থাকে অনায়াসেই ‘নির্বিশেষ’ করে তুলতে পারে, তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক। এসেছে বর্তমান সময়ের সাথে প্রতিতুলনা। শাসন আর দমনের নিক্তিতে দু’টিই লেখকের বিচারে তুল্যমূল্য। তাঁর নিজের জবানিতে “... প্রথমটিতে ঘোষণার চাবুক ও দ্বিতীয়টিতে মাদকের চাবুক। প্রথমটিতে আড়াল নেই – দ্বিতীয়টিতে আছে”। এক্ষেত্রে লেখকের মত পূর্ববর্তী প্রবন্ধকার নন্দন রায়ের কিছুটা বিপ্রতীপ।
এই সংকলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ স্বপন মুখোপাধ্যায়ের ‘দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি - প্রবঞ্চনা উদ্বাস্তু জীবনব্যাপী’। খুব সংক্ষেপে সম্পূর্ণ প্রবন্ধটির সারাৎসার এক কথায় ‘এ আমার, এ তোমার পাপ’। মনে রাখা ভালো, বাংলার বাইরে বাকি ভারতবর্ষে দেশভাগ মানেই পশ্চিম সীমান্ত, পূর্ব সীমান্ত সেখানে লক্ষ্যণীয় ভাবে অনুপস্থিত। আর খোদ বাংলার পশ্চিম অংশের সাবেক বাসিন্দা যাঁরা, তাঁদের এক গরিষ্ঠ অংশের কাছে দেশভাগের ফলে ছিটকে আসা ছিন্নমূল মানুষেরা নেহাৎই ‘ঊড়ে এসে জুড়ে বসা উটকো আপদ’। কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা উদাসীনতা, অনেকটাই মানিয়ে চলার সাবেক প্রবণতা - সেখানে সহানুভূতির জায়গা কম, সমানুভূতির আশা তো আরোই সুদূর। তাছাড়া মরিচঝাঁপি ঘটনার মূল কুশীলব যাঁরা, তাঁরা সকলেই চাষিবাসি মানুষ। কাজে কাজেই শিক্ষিত, ভদ্র বাঙালির মনস্কতার পরিধির অনেক বাইরে, নিতান্ত প্রান্তিক তাঁদের অবস্থান। বস্তুত প্রভাবশালী নাগরিক সমাজের সম্মিলিত ঔদাসিন্য না থাকলে কোন জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের পক্ষে এমন পরিকল্পিত গণহত্যা ঘটিয়ে তোলা সহজ হত কি? প্রবন্ধটির বয়ানে অন্তর্তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ছাপ। সেখানে তন্নিষ্ঠ ঘটনাপঞ্জীর বিবরণের সাথে মিলেমিশে গেছে ব্যক্তিগত জীবনের ছবি। প্রবন্ধটির শেষে কানে বাজে অসহায় চিৎকার, “আমাগো লাশ নিয়া যান, আমরা যামু না”। পরিতাপের বিষয় এই যে এই ঘটনার সংঘটক বামফ্রণ্ট সরকার, হাজার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যাঁদের মনে করা হয়েছে সাধারণ মানুষের সরকার, হয়তো আজও। যাঁরা এখনও সরকারের সামগ্রিক শুভবুদ্ধিতে আস্থা রাখতে চান তাঁদের জন্য প্রবন্ধটি একটি বড় দুঃসংবাদ। মনে পড়ছে আরো একটি কথা। এপার-বাংলা ওপার-বাংলা মিলিয়ে যে বিস্তৃত ভুমিখণ্ড, পৃথিবীর মানচিত্রে তা সবচেয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। কাজেই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য সাবেক বঙ্গভূমির বাইরে জমি খোঁজা জরুরি ছিল। দণ্ডকারণ্যের পাশাপাশি আরো একটি জায়গায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কথা ভাবা হয়েছিল। সেটি হল আন্দামান। মাটিতে জো’ পেলে বাঙালি চাষির দু’ হাত যে সোনা ফলাতে পারে তার প্রমাণ আসামভূমের মিঞারা, আন্দামানে বসতি গাড়া কিছু উদ্বাস্তুদের উত্তর পুরুষরাও। অথচ সেলুলার জেলের কুখ্যাত ইতিহাস আর কালাপানি শব্দের সাথে জড়িয়ে থাকা ভয় ও সংস্কারের সুবাদে কিছু মানুষের বিরোধিতায় পরিকল্পনাটি মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়। তা না হ’লে এই আন্দামানই হয়তো হয়ে ঊঠত সাবেক বঙ্গের বাইরে বাঙালির আর এক শক্তিশালী, সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রয়োজন ছিল সঠিক পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি আর আন্তরিকতার। সত্যিই, সরকারের নীতিনিয়ামকরা যে কাদের কথা শুনে কাদের সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেন, বোঝা ভার!
পূর্ণেন্দুশেখর মিত্রর প্রবন্ধের বিষয় ‘১৯৭৪ সালে ভারতীয় রেল-শ্রমিক আন্দোলন’। ভারতীয় জীবনচর্যার প্রায় প্রতিটি স্তরের সাথে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। শুধু যাত্রী পরিবহনই তো নয়, রয়েছে সারা দেশ জুড়ে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে থাকা মাল পরিবহনের ব্যবস্থা। কাজেই ১৯৭৪ সালের টানা ২০ দিন রেল পরিষেবা বন্ধ থাকার সেই অভিঘাত সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। অথচ আমাদের অতি পরিচিত রেলগাড়ি, যা নাকি আমাদের ছোটবেলার অনেক স্বপ্ন, স্মৃতি, এমনকি রোমাণ্টিকতারও চাঁদমারি, তার চাকাকে সচল রাখেন যাঁরা সেই রেলশ্রমিকদের সম্বন্ধেই আমরা সীমাহীন অজ্ঞ। “ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই রেল শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনার পরম্পরা প্রবাহমান” - লেখকের এই মন্তব্য আমাদের যতটা লজ্জিত ও ব্যথিত করে, ততটাই কৌতূহলীও করে তোলে। অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ এই লেখায় লেখক অবশ্য সেই কৌতূহল মেটানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। আমাদের সামনে খুলে খুলে যেতে থাকে রেল শ্রমিকদের সংগ্রামের অনেক অজানা ইতিবৃত্ত। জানতে পারি রেল শ্রমিকদের আন্দোলনে অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের প্রভাব, রেল শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। জেনে অবাক হই, গর্বও হয়, যখন জানতে পারি দুনিয়া কাঁপানো শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ঘটনার দু’ দশকেরও আগে আমাদের দেশেরই রেল শ্রমিকরা শুরু করেছিলেন তাঁদের আটঘণ্টার লড়াই। অথচ আমরা কেউ তা মনে পর্যন্ত রাখিনি। ধন্য আমাদের মজ্জায় মজ্জায় মিশে থাকা ইতিহাস বিমুখতার ঐতিহ্য! স্বাধীনতার আগে রেল শ্রমিকদের লাগাতার সংগ্রাম আর বঞ্চনার ইতিহাসকে যদি ঔপনেবেশিক শাসকদের ঔদ্ধত্য বলে পাশ কাটাতে চাই, তাহলেই বা স্বস্তি মেলে কই? ১৯৬০ সালে, খোদ স্বাধীন ভারতে, স্রেফ মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করার অপরাধে প্রাণ গেছে শ্রমিকদের, উৎসন্ন হয়ে গেছে অসংখ্য পরিবার। আধুনিক আরামের ছত্রছায়ায় বসে যাঁরা কথায় কথায় সেকালের ‘ধুঁয়া বন্ধ, চাক্কা বন্ধ’-কে বিদ্রূপ করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই শ্রমিকদের টিঁকে থাকার এই লড়াইয়ের হদিস রাখেন না। হদিস রাখেনি রেলকে আষ্টেপৃষ্টে ব্যবহার করে চলা মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজও। তবু বারবার প্রবল রাষ্ট্রশক্তির সামনে শ্রমিক আন্দোলনের লাগাতার ব্যর্থতার ইতিহাস আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। অবশেষে স্বস্তি পাই এই জেনে যে, পালাবদলের পালায় জনতা আমলে ষাট ও সত্তর দশকের শ্রমিক আন্দোলনের অনেক দাবি দাওয়া সাফল্যের মুখ দেখতে পেয়েছিল। তাই প্রত্যক্ষ অর্থে সত্তরের রেল শ্রমিক আন্দোলন ব্যর্থ হলেও পরোক্ষ অর্থে তাকে ততটাও অসফল বলা চলে না।
(ক্রমশ)
(সম্পাদকীয় বক্তব্যঃ ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১১১তম সংখ্যার আলোচ্য বিষয় ছিল সত্তর দশক। মোট কুড়িটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনে প্রকাশিত লেখাগুলির আলোচনার জন্য আলোচক প্রথম কিস্তিতে বেছে নিয়েছেন প্রথম সাতটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। পরবর্তী কিস্তিগুলিতে বাকি লেখাগুলি সম্পর্কে আলোচনা প্রকাশ করা হবে।)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন