ধারাবাহিক উপন্যাস
হে নেপথ্যচারিণী
(২২)
বিকল্প
সকালবেলা কলেজে আসতেই তথাগত অধিকারীর সঙ্গে দেখা। সঙ্গে লগবুক। বসে কথা হল কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। শুভঙ্কর শাসমলের লাশটা পাওয়া গেছে। চার নম্বর ব্রিজের নীচে রেললাইনের ধারে পড়েছিল। যেহেতু এলাকাটা আমার হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে পড়ে, তাই তার ময়নাতদন্তর ভার আমাদেরই। কথায় কথায় জানলাম সবিতা আগরওয়ালের শরীরের তেমন উন্নতি ঘটেনি এখনও। পিজি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। কথা বলতে বলতেই তথাগত আমাকে একটি সাদা খাম দিয়ে বলল,"এটা আশুবাবুকে অবশ্যই দেবেন। কনফিডেনশিয়াল।"
লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছেন
শুভঙ্কর শাসমল। এক কালনাগিনী যেন তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। দুদিনের পচন রয়েছে শরীরে।
তার তীব্র দুর্গন্ধ ফর্মালিন ঢাকতে পারেনি। মুখ ঢেকে ব্যবচ্ছেদে মন দিলাম। এই কাজটা
নিজেই করব ঠিক করেছিলাম। তাই আর জয়ন্তকে ডাকিনি।শুভঙ্করের মাথার খুলিতে দুটি চোখের
মাঝখানে একটি গভীর ক্ষত। সেই ক্ষতর ধরণ আমাদের পরিচিত। মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থি
সহ বেশ কিছুটা অংশ নেই। অর্থাৎ প্রমাণ লোপাট করতে নিজের সুযোগ্য অনুচর শুভঙ্করকেও রেহাই
দেননি সবিতা। খুলির ব্যবচ্ছেদের রেখা তার লোবোটমির রেখাকে শৈল্পিক কায়দায় আড়াআড়ি স্পর্শ
করল। শুভঙ্করের হৃদপিণ্ড পাকস্থলি এক এক করে বের করছিল রঘু ডোম। শরীরের আর কোথাও কোনও
ক্ষতচিহ্ন নেই। মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ মস্তিষ্কের আঘাত। পাকস্থলীর খাবারে পচন ধরে গেছে।
রেললাইনের পাশে আবর্জনার স্তূপে পড়ে থাকায় শরীরের ডান পায়ের বুড়ো আঙুল আর বাম হাঁটুর
খানিকটায় কামড় বসিয়েছে ইঁদুররা। সম্ভবত এটাই ত্রিনেত্র শেষ খুনের লাশ। এক ভয়াবহ অধ্যায়ের
সমাপ্তিতে তথাগতর পদোন্নতি নিশ্চিত। তথাগতকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে মনে ঘুরপাক
খাচ্ছিল গতকাল চোখে বুলোনো কবিতার কয়েকটা লাইন। আমার এই অভ্যাসও আশুদার কাছ থেকেই পাওয়া।
কবিতার লাইন মনে গেঁথে গেলে তা সহজে মুছতে চায় না। শুভঙ্কর শাসমলের অসহায় লাশ দেখে
বোঝা যায় সে আত্মরক্ষার তেমন সুযোগই পায়নি। মনে পড়ে গেল কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর লাইন।"যে
যতটা ব্যগ্র, আর মৃত্যুর কূপের মুখোমুখি/ তারই দিকে বন্দুকের নল থাকে ঈষৎ বাড়ানো,/পশু,
পাখি, পতঙ্গ, মানুষ বলে আলাদা কিছু নেই/ শুধু
উপস্থিতি আছে, আর সার্চলাইটের মতো ঘূর্ণ্যমান/প্রকৃতির নিজস্ব মুকুর..."।
নানান কাজের ভিতর একটি
কাজ আশুদার দেওয়া। মনসুর গাজীকে তলব করতে হবে। মনসুরের অনুরাগী মানুষ কলেজে অভাব নেই
আগেই বলেছি। বিশেষত পার্ক সার্কাসের এই অঞ্চলে স্বল্প কেতাবিশিক্ষিত মানুষগুলোর কেউকেউ
মনসুরকে ফেরেস্তার চোখে দেখে। তার রেশমি পুতুল, অদ্ভুত চালচলন আর রহস্যময় অভিগমণ তাদের
কাছে করিশ্মার মতো। তেমনই একজনকে চিনি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের মিউজিয়ামে ফর্মালিনে
ধরে রাখা নমুনার বয়াম ঝাড়পোঁচ করে। নাম বনোয়ারি। ওর বাড়ি মনসুরের ডেরার কাছেই। বনোয়ারিকে
চিরকুট হাতে পাঠালাম মনসুরকে তলব করতে। ফেরেস্তাই বটে। এই আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার
যুগেও মনসুরের হাতে প্রাগৈতিহাসিক মোবাইল, যা বছরের অর্ধেক সময় বন্ধ থাকে, কখন তা সচল
হবে তার খবর একমাত্র ঈশ্বর আল্লাতালাই জানেন । আর তার অন্ধবিশ্বাস এক তুলো ফোলানো সেলাই
ফোঁড়াই করা ভুডু পুতুলে, যার গতিবিধি বিজ্ঞানের আঙ্গিকে নির্ণয় করা অসম্ভব। বনোয়ারি
চিরকুট পৌঁছে জানাল, মনসুর কাছাকাছিই আছে চিরকুট
পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ আজ সন্ধ্যায় আশুদা আর আমার দেখা হচ্ছেই তার সঙ্গে।
ঘরে ফিরতে বিকেল হলো।
গাড়ি গ্যারেজে ঢোকাতে গিয়ে একঝলক নজর গেল আমাদেরই ফ্ল্যাটের একতলার একপাশে গড়ে ওঠা
নতুন কফিশপের দিকে। কফিশপের নাম না বেশ অদ্ভুত!'বিকল্পযোগ'।আশুদা বলেছে এই 'বিকল্প'
যোগসাধনার এক অঙ্গ। বস্তুকে স্পর্শ না করে শুধুই শব্দ আর অক্ষর দিয়ে উপলব্ধি করা। আমি
দেখলাম কফিশপের একটি কর্নার টেবিলে বসে আশুদা এক অপরিচিতা তরুণীর সঙ্গে কথা বলছে। আমি
এসময়ে অপ্রত্যাশিত প্রবেশের পরিপন্থী নই। তাই গাড়ি যথাস্থানে রেখে উঠে এলাম নিজের ফ্ল্যাটে
বাইরের গোধূলির আবছায়ায় আমাদের বসার ঘরের টেবিলে রাখা আশুদার রঙের গোলক অদ্ভুত বর্ণলীযুক্ত
হয়েছে যেন। থিয়েটারে আলোর ভারসাম্য যেমন, ঠিক তেমনই মানুষের জীবনে আবেগ ও অনুভূতির
ভারসাম্য। টেবিলের এক কোণায় রাখা মুনসেলের জলরঙে আঁকা কয়েকটি ফুলের ছবি। আর একটি কালার
গ্রুপ চার্ট। আমি তথাগতর দেওয়া সাদা খাম তার পাশে রেখেই নিজের ঘরে ফিরে এলাম।কিংবদন্তি
শিল্পী রাফায়েল টিটিয়ান ভেলাস্কেজ যেভাবে ধূসর রঙ নিয়ে পরীক্ষা করেছে, তা আর হয়তো কেউ
করেননি। মুনসেল বলছেন, ধূসরকে রঙগোলকে চিনতে পারাই রঙগবেষণার সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার
চারপাশে এখনও ধূসরতা কাটেনি। কে ওই তরুণী যার সঙ্গে আশুদা কথোপকথনরত, সে কথা জানতে
হবে। তবে কি নতুন কোনও রহস্যসন্ধানে নেমে পড়ল আশুদা। নাকি আশুদার পূর্বপরিচিত কেউ।
এই অনধিকার চর্চাই বা কেন করছি অবচেতনে, তা আমার অজানা। তবু আশুদার জীবনের প্রতিটি
বাঁকে লুকিয়ে থাকা ধূসরতার প্রতি আমার প্রবল অপ্রতিরোধ্য আগ্রহ। সে আগ্রহ যেন অধিকারের
আকার ধারণ করেছে। এ কি একধরনের বিখল্পসাধনাই। ডাক্তার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে সবয়বে বিশ্লেষণের
সাধনা?কে জানে!
সন্ধ্যা হতেই আশুদা
ফিরল ঘরে। কিন্তু আমি প্রশ্ন করলাম না কোনও। বরং প্রবল উৎসাহে বললাম শুভঙ্কর শাসমলের
লাশ উদ্ধারের কথা। আশুদা শুনল মন দিয়ে। তারপর সাদা খাম খুলে তথাগতর দেওয়া কাগজগুলো
মন দিয়ে পড়তে লাগল। পড়ে নিশ্চিন্তচোখে কাগজগুলি আবার খামে ভরে বলল,"আমার অনুমান
সুনিশ্চিত করতে তথাগতর এই দুটো কাগজের প্রয়োজন ছিল।"
-কী আছে ওর ভিতরে?
-অলোককৃষ্ণ আর মুরারী
পালচৌধুরীর মৃত্যুর ময়নাতদন্তর রিপোর্ট। প্রথমটা খানিকটা আমিও অনুসন্ধানে যুক্ত থাকায়
আন্দাজ করেছিলাম। আর দ্বিতীয়টি জেলরের জেল রিপোর্ট থেকে নেওয়া।
-কী বলছে ওরা?
-অলোককৃষ্ণর মৃত্যু
হয় মৃগীর জন্য মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে।কিন্তু এই মৃগী সাধারণ মৃগী নয়। অলোককৃষ্ণ
জেলে বন্দি থাকাকালীন তার শরীরের ভিতর বেশিমাত্রায় স্ট্রিকনিন পাওয়া গেছে যা একজন মানুষকে
বেশি মৃগীর পরিপন্থি করে তুলেছিল।
-আর অলোককৃষ্ণর জেলের
খাবার আসত ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীর বাড়ি থেকে।
-ঠিক তাই। তাহলে কী
দাঁড়ালো?
-মুরারী পালচৌধুরীর
বাড়ি থেকে আসা খাবারে কেউ স্ট্রিকনিন মিশিয়ে দিত!
-ঠিক। এবার প্রশ্ন,
কে এবং কেন?
-কে হতে পারে?
-তার আগে খটকা। অত্রির
বাড়ির বই আলমারি থেকে বের করা আগাথা ক্রিস্টির বইটি, যার কিছু অঅংশ লাল পেনসিল দিয়ে
দাগ দেওয়া। সেই অংশ যেখানে অপরাধী তার ভিক্টিমকে ওই স্ট্রিকনিন বিষ ঢেলেই মেরে ফেলছে!
-তবে কি মুরারী পালচৌধুরীর
বাড়ির কেউ? নাকি ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরী নিজে!
-যদি ধরে নিই দ্বিতীয়টাই
তাহলে এবার প্রশ্ন কেন? অলোককৃষ্ণর স্ত্রী শকুন্তলাদেবীর সঙ্গে মুরারীর একটা গভীর সম্পর্ক
ছিল। কোনও ভাবে সেটাই কি কারণ! তাহলে মৃত্যুর সময় মৃগীর ট্রিগার ঘটাতে হত্যাকারী শকুন্তলাদেবীর
গান ইয়ারফোনে ব্যবহার করল কেন?
-তবে কী শকুন্তলাদেবীর
সেই সন্দেহ? কেউ বা কারা তাকে মেরে ফেলবে!
-হতে পারে।তবে মন বলছে
অলোককৃষ্ণর রহস্যজনক মৃত্যুর পিছনে শকুন্তলাদেবীর দ্বিতীয় ধর্ষকের আসল পরিচয় লুকিয়ে
আছে।
-আর দ্বিতীয়?
-দ্বিতীয় ডাক্তার মুরারী
পালচৌধুরীর মৃত্যু। প্রত্যক্ষদর্শী ও জেলরের রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি বারবার পরে যেতেন।
হাত কাঁপত বলে বেহালা বাজাতেন। মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। অর্থাৎ স্বাভাবিক
মৃত্যু। ডাক্তার নিখিলেশ মালাকার নিজে বলেছেন তার শারকট মেরিটুথ ব্যাধি ছিল।
-বেশ। এখন প্রশ্ন, অলোককৃষ্ণর
খুনী আর শকুন্তলাদেবীর ধর্ষক কি একই ব্যক্তি।
-ঠিক তাই। সে প্রশ্নর
উত্তর যে দিতে পারে, সে এখন তোর ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে।
আশ্চর্য! আশুদা বলামাত্রই
কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি দরজার ওই পারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মনসুর গাজী। আমিই তো
সকালে তাকে তলব করে এসেছি। মনসুরের চোখেমুখে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। সোফায় বসতে
বসতে বলল,"একটু পানি দিবেন?"
আমি জল আনতেই সে জল
ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। আশুদা বলল।
-মনসুর। আজ তোমাকে এখানে
আনার কারণ, কয়েকটা যুক্তির দরজা খুলছে না। তোমার সাহায্য ছাড়া খুলবে না। তুমি সাহায্য
করো।
-বলেন।
-অলোককৃষ্ণ তো তুমি
আগেই বলেছ, দেবতার মতো মানুষ ছিলেন। মুরারী ডাক্তার আর শকুন্তলাদেবী কেমন মানুষ ছিলেন?
মনসুর বলল না কিছু।
একদৃষ্টিতে আশুদার রঙের গোলকের দিকে তাকিয়ে রইল।আশুদা বলল।
-আমি জানি তুমি জানো।
বলো মনসুর।ওদের ভিতরে কেমন সম্পর্ক ছিল।
-আমি জানি না।
-তুমি জানো মনসুর।তুমি
বললে আমি বলে দেব রেশমি কোথায় আছে!
মনসুর চমকে তাকালো আশুদার
দিকে।
-আমার রেশমিকে খুঁজে
পাওয়া যাচ্ছে না একথা আপনি জানলেন কীকরে?
আশুদা আমার দিকে তাকিয়ে
মুচকি হেসে বলল,"এই বিদ্যে কী তুমি একাই জানো মনসুর? এখন বলো।"
মনসুর খানিক চুপ থেকে
বলল,"একটা সম্পর্ক ছিল। মাঝেমাঝেই দুজনে একলা রিহার্স করতেন।"
-অলোককৃষ্ণ জানতেন ব্যাপারটা?
-প্রথম প্রথম জানতেন
না। পরে জানতে পারেন।
-তারপর? জেনে কি প্রতিক্রিয়া
হলো তার?
-অলোককৃষ্ণ ফরিস্তা
আছেন। আমার আপা ওঁর জন্য জিন্দা আছে। উনি রাগতেন না।মাফ করে দিয়েছিলেন।
-মিথ্যা বলছ মনসুর।
ঠিক করে বলো।
দেখলাম দুই বিপরীত প্রান্তের
মানুষ পরস্পর পরস্পরের চোখে চোখ রেখে যেন বুদ্ধির ডুয়েল খেলে চলেছে।মনসুর চুপ থাকতে
আশুদা বলল।
-অলোককৃষ্ণ তোমাকে শকুন্তলাদেবীর
ওপর নজর রাখতে নিযুক্ত করেননি মনসুর?
মনসুর ঘাড় নেড়ে জানায়
আশুদার অনুমান সঠিক। আশুদা বলে চলে।
-সেই নজরদারি করে কী
জানতে পারলে তুমি?
মনসুর কপালের ঘাম মুছতে
মুছতে বলল,"শকুন্তলা ম্যাডাম খুব ভালো ইনসান। নরম মন। ডাক্তার মুরারী পাল চৌধুরীর
সঙ্গে ফেঁসে গেলেন।"
-তারপর?
-আমি খবর এনে দিতাম।
অলোক স্যার শুনতেন।
-তারপর?
-তারপর একদিন অলোক স্যার
আর শকুন্তলা ম্যাডামের ভিতর খুব ঝগড়া হলো। অলোক স্যার বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। শকুন্তলা
ম্যাডাম কাঁদছিলেন।
-তুমি তখন কোথায় ছিলে?
-আমি অলোক স্যারের জন্য
পারম্যাঙ্গানেট আনতে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম...
-কী দেখলে মনসুর? শকুন্তলা
-অলোক স্যার ফরিস্তা।
-কী দেখলে বলো?
-দেখলাম অলোক স্যার
তার বিবির ওপর হাত তুললেন। তবে ওটা রাগের মাথায় স্যার। সবার হয়। ও কিছু নয়।
-বেশ।আচ্ছা মনসুর। যেদিন
ওই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটেছিল সেদিন তুমি কোথায় ছিলে?
মনসুর খানিকটা ভেবে
বলে, "সেদিন একটা কাজে কলকাতার বাইরে ছিলাম।" আশুদা শান্ত চোখে মনসুরের দিকে
তাকিয়ে বলল,"মিথ্যে বলো না মনসুর। আচ্ছা। আমাকে একটা কথা বলো তো! সেদিন বললে শকুন্তলাদেবীর
ধর্ষক আর খুনী কে জানতে পারলে জিন্দা থাকত না? সত্যিই কি তাই মনসুর? সত্যিই তুমি জিন্দা
রাখতে না? রাখোনি কী?সেদিন ওই ঘটনার সময় দরজার আড়াল থেকে তুমি কি দেখোনি সবকিছু মনসুর!"
প্রাকবসন্তে ঝরে পড়া
পাতার মতো ভেঙে পড়ল মনসুর। হাউহাউ করে দুহাতের চেটোয় মুখ চেপে মনসুর কেঁদে উঠল এবার।
তারপর সামলে নিয়ে বলল।
-আপনি ঠিক বলেছেন আশুদা।
আমি ছিলাম। আসলে অলোক স্যার ফরিস্তা। কিন্তু তার রাগ চণ্ডালের মতো। মুরারী ডাক্তারের
সঙ্গে ম্যাডামের সম্পর্কের কথা জানতে পারার পর স্যার পাগল হয়ে ওঠেন। আমি ছাড়াও অভিনন্দন
বাবুকে ম্যাডামের পিছনে টিকটিকি লাগান। আমার এটা ভালো লাগেনি। তারপর সেইদিন...
-তুমি পুরোটা দেখলে।
বাঁধা দিলে না কেন মনসুর? কেন পুলিশকে ডাকলে না।
-অলোক স্যার বারণ করেছিল।
আমি চমকে উঠি। শকুন্তলাদেবীর
সেদিন ভয়ানক ধর্ষণ ও খুন যে হবে একথা অলোককৃষ্ণ জানতেন! মনসুর এরপর একে একে বলল সেই
রত্তিমিত্তি মুখোশধারী মানুষ আর অভিনন্দন শিকদারের কথা। ছোট্ট সুচন্দ্রার প্রত্যক্ষদর্শিতার
কথা। শুনতে শুনতে মনে হলো এক গভীর অন্ধকার যেন ঘিরে ধরছে আমাদের সকলকে। কে সেই মুখোশধারী?
মনসুর কি তাকে চিনতে পেরেছিল? মনসুর একনিশ্বাসে বলে ফেলল সবটুকু। তারপর মাথা নীচু করে
রইল। আশুদা বলল,"অন্যায় তোমার হয়েছে মনসুর। তোমার আপার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন তোমার
আল্লা তালা। তোমার অলোক স্যার শুধুই সেখানে একটা উপলক্ষ্য। তোমার উচিত ছিল সেদিন পুলিশকে
ডাকা। নীরব দর্শক হয়ে নিজের পাপের বোঝা দোজখের পথ খুলে দিলে তুমি মনসুর গাজী। এখন একটা
শেষ কথা আমাকে বলো দেখি। সুচন্দ্রাকে সম্মোহন করতে কেন তুমি? সত্যর কাছে পৌঁছোতে? নাকি
সত্যিকে ভোলাতে!"
মনসুর বিস্ফারিত চোখে
আশুদার দিকে তাকালো। আশুদা শান্ত হয়ে বলল। "সুচন্দ্রা কি সেদিন ওই রত্তিমিত্তির
আড়ালে থাকা মানুষটাকে চিনে ফেলেছিল?"
মনসুর আতঙ্কিত হয়ে বলে,
"জানি না স্যার।"
-তুমি জানো মনসুর। সেই
কারণেই তুমি ওকে ভোলানোর চেষ্টা করতে। তাই তো।
মনসুর অপরাধীর মতো মাথা
নেড়ে সম্মত হয়ে উঠে পড়ে।আশুদা আশ্বস্ত করে।
-তোমার ভয় নেই মনসুর।
যা ঘটে গেছে তা তো অতীত। পুলিশের খাতায় ও কেস ক্লোজড। আমি তথাগতকে বলে দেব। শুধু আমার
সত্যিটা নিশ্চিতভাবে জানার ছিল। এবার তুমি মুক্ত। যাও।
দরজার কাছে গিয়ে আবার
ফিরে তাকাল মনসুর।"আমার রেশমি পুতুল?কোথায় সে?"
আশুদা হেসে বলল,"তোমার
ঘরে কোনও মাটির কুঁজো আছে মনসুর?"
মনসুর 'হ্যাঁ' বলতেই
আশুদা বলল,"ওর ভিতরে তুমি রেশমিকে রেখে ভুলে গেছ। অন্যমনস্ক হয়ে গেছ তুমি। শোনো।
অলোক স্যার তোমার কাছে ফরিস্তা যেমন ছিল। তেমনই থাকবে। জোর করে কারো মনে সেই জলছাপ
ফেলতে যেও না।ওতে বিপত্তি ঘটে। সুচন্দ্রার মনে তো একেবারেই নয়। আমার মনে হয় অতো ছোট
বয়সের স্মৃতি। তাও অনুমান। ও কর্কটরোগের মতো। বেশি খুঁড়লেই ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া আরেকটা
কথা মনসুর। সুচন্দ্রা অন্তঃসত্ত্বা। ওকে এখন আর ওসব সম্মোহনের জালে জড়াতে যেও না তুমি।
"
মনসুর ঘাড় নেড়ে অন্তর্হিত
হতেই আমি আশুদার হাত চেপে ধরলাম।
-কী করে বললে রেশমি
আছে মাটির কুঁজোর ভিতর?
আশুদা হাত জাড়িয়ে হাই
তুলে সোফায় বসতে বসতে বলল,"যেমন করে তোকে প্রথম যেদিন মনসুরের কেরামতির কথা বলেছিলি,
বুঝিয়েছিলাম। তোর শো কেসে একটা বাহারি কুঁজো আছে দেখ। মনসুর যখন ঘরে ঢুকল, ওর মুখচোখ
অস্থির, হাতে রেশমিপুতুল নেই। বুঝলাম ও রেশমিকে নিয়ে চিন্তায় আছে।তারপর দেখলাম ঘনঘন
নিজের অবচেতনেই মনসুর তোর ওই শো কেসের কুঁজোটার দিকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। অনেকটা ডাক্তারি
পরিভাষায় নিস্টাগমাসের মতো। ব্যাস। দুই আর দুইএ চার।
-আর ওই ঘটনার দিনে মনসুরের
থাকার কথাটা?
-ওটাও ব্যবচ্ছেদ করেই
পাওয়া। কবিতা বইয়ের ভিতর একটা চিরকুট ছিল। তাতে দুটো শব্দ লেখা। 'মনসুর' আর 'অভিনন্দন'।সঙ্গে
জিজ্ঞাসার চিহ্ন। হাতের লেখা শকুন্তলাদেবীর। সন্দেহ হল শকুন্তলাদেবী আন্দাজ করেছিলেন
এরা দুজন হয়তো তার আর মুরারীর সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছে। মন বলছিল, মনসুর ওই ঘটনার
প্রত্যক্ষদর্শী। কেন মন বলছিল জিজ্ঞেস করিস না আবার। ওটা ইনট্যুইশান। ওটার কেন হয় না।
-আর সেই রত্তিমিত্তি
মুখোশ পরা দ্বিতীয় আততায়ী! কাকে দেখে ফেলেছিল সুচন্দ্রা।
আশুদা হেসে বলল,"আরেকটু
গভীরে ডিসেকশন করতে হবে তোকে। এটা তোর বোঝা উচিত ছিল কিন্তু। শকুন্তলাদেবীর দ্বিতীয়
ধর্ষক ও খুনী আর কেউ নয়, তাঁরই বিবাহিত স্বামী আর সুচন্দ্রার পিতা, অলোককৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়!"
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন