ধারাবাহিক উপন্যাস
দ্য ক্লাউড
(একাদশ
পর্ব)
উৎপল চিত্রকর কবরস্থানে মৃতদের স্মরণ করে তার আঁকার সামগ্রী গোটানো শুরু করলে সে-সব বস্তাবন্দি অজস্র সরঞ্জামের মধ্যে পা আঁটকে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো নিমচাঁদ দাগা। শরীর বিহীন শরীরের যে কেমন জ্বালা তা এতোদিনে বিলক্ষণ বুঝে গেছে নিমচাঁদ। হাত-পা নেই। তবু চলন আছে। বুক নেই তবু ব্যাথা আছে। পেট নেই।তবু খিদে পায়। মন নেই। তবু মনে পড়ে সে-সব দিনের কথা। চোখ না থাকলেও বাতাস হওয়ার কারণে সে দেখতে পায় যে,তাঁর তৈরি দাগা অয়েল মিলের শরীর জড়িয়ে এক বিরাট বটগাছ শীকর নামিয়ে ঢেকে ফেলেছে মিলটাকেই।এই মুহূর্তে নিমচাঁদের পা-কে আঁটকে রেখেছে বর্তমান সময়ের মডেল মাদ্রাসার গলিটা।
তখন সে গ্রাম থেকে জেলা স্কুলে পড়তে এসেছিলো। থাকতো হোস্টেলে। সারাদিন স্কুল করার পরে বিকেলে শহরের লম্বুর দোকানে তাকে যেতেই হতো। দোকানদার ছেলেটি আদপে লম্বা না হলেও ওর দোকানের অদ্ভুৎ দেখতে লম্বু বিস্কুটের খ্যাতির তীব্র আকর্ষণে ছেলেপুলেরা ভীড় জমাতো ওর দোকানে। লম্বু বিস্কুটের জন্য একটি দোকানীর নাম যে দেশে পাল্টে যায়, সে দেশ যে তাঁরই, একথা ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়লো বুনিয়াদি স্কুলের শিক্ষকের কথা। তিনি শিখিয়েছিলেন, আমাদের দেশ, মহাদেশের মতোই বড় বলে এদেশকে উপমহাদেশ বলা হয়। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে তিন সমুদ্র, পূর্বে পাকিস্তান আর পশ্চিমে গুজরাট ও মহারাষ্ট্র। এইসব রাজ্যের স্থলসীমান্ত প্রান্ত জুড়ে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকটা অংশ।
কিছু কিছু কথা আছে, যা একবার মাথায় ঢুকে গেলে তা চিরস্থায়ী হয়ে যায়। যেমন পাকিস্তান। পাকিস্তান বললেই মনে পড়ে বন্ধু মনসুর আলীর কথা। মনসুরের দাদুর আব্বা এদেশে এসেছিলেন খাইবার গিরিপথ দিয়ে হিং-এর ব্যাবসা করতে। এরপর এ-শহরের মীরপুরে তিনি বসবাস করতে গিয়ে ভারতীয় হয়ে যান।
সেবার উনিশশো ছেষট্টি সাল। মনসুর শহরের মডেল মাদ্রাসার হস্টেলে। আর, নিমচাঁদ জেলা স্কুলের হস্টেলে। মাঝে কেবল সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ রোড। আর সেই রাস্তার ওপরে লম্বুর চা-এর দোকান।
সে দিনটাও ভারী সুন্দর দিন ছিলো না অন্য দিনের মতো নিয়ে নিমচাঁদ বা মনসুরের কাছে। নিমচাঁদ দেখেছিলো খুব কাছ থেকে। হস্টেলের গেট দিয়ে মনসুর বেড়ুতেই একদল উন্মত্ত তাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞাসা করছে- কী নাম তোর? মনসুর আলী, একথা শোনামাত্র সেইসব উন্মত্ত জনস্রোত তাকে কিল-চর ঘুষিতে অচৈতন্য করে রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিলো। কোনোরকমে কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় মনসুরকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো নিমচাঁদ। চেতনা ফিরে এলে মনসুর বলেছিলো, সুপার স্যার আমাকে বলেছিলেন, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তুই হস্টেল ছেড়ে আজ বেড়াবি না।
নিমচাঁদের শরীর পরিত্যক্ত আত্মা গুজরাট থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে - সেই উন্মত্ত জনস্রোত আজও এবং সেদিনও কেবলমাত্র তাঁরই মতো শরীর পরিত্যক্ত একরকমের সময়ের দলিল।
বহুদিন বাদে নিমচাঁদ দাগা তখন দাগা অয়েল মিলের প্রোপাইটার। গভর্মেন্ট বি টি কলেজের একদল শিক্ষক-ছাত্র হরিরামপুর ব্লকের বাবু- দিঘির পাড়ে এসেছেন কি এক গবেষণার কাজে।
তারই মধ্যে একজন মনসুর স্যার হাত
উঁচু করে বাবু-দিঘির মহাভারতীয় ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক ব্যাপ্তি বোঝাচ্ছেন তার ছাত্রদেরকে।
দূর থেকে নিমচাঁদ মনসুরের দেহের ভাষা পড়তে পেরে তাড়াতাড়ি করে হেঁটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে
ধরেছিলেন প্রিয় বন্ধু মনসুর আলিকে।
উৎপল চিত্রকরের হাতের তুলির আগুন রঙ এমুহূর্তে নিমচাঁদের মনকে পোড়াচ্ছে। সে দেখছে তার বুনিয়াদি স্কুলের শিক্ষকের পাঠদানের উপমহাদেশের একটি অঞ্চলে আগুন হুহু করে জ্বলছে। নিমচাঁদ দাগা মনে মনে মরিয়া - এই অগ্নিকে সর্বভুক্ অভিশাপ না দিয়ে তাকে বিশুদ্ধতার প্রমিতপ্রেমিক রূপে প্রকাশ করতে হবে।
মহাজাগতিক মন্ডলে অবস্থিত নিমচাঁদ
প্রশ্ন করলো- হে অশান্তি সৃষ্টিকারী, তোমার নাম কী? উত্তর, অগ্নি।
তোমার বসবাস ভূমি কোথায়? উত্তর, উপমহাদেশের
রাজনীতি করে বেঁচেবর্তে থাকা কিছু মানুষের
স্বার্থের দৃষ্টিকোণে।
নিমচাঁদ বললো, তবে তো তুমি মুখ্য
অগ্নি বাহক নও! যে অগ্নি পঞ্চভূতের অন্যতম ও মুখ্য অগ্নি বাহক, সে-তো নও তুমি! তুমি
তো দাঙ্গা!
মনখারাপেরও শেষ থাকে। কিন্তু নিমচাঁদ দাগা দেখলো, অদ্ভুত লেলিহান লালসার তৃপ্তির আগুন দাও দাও করে পোড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘর গৃহস্থালি থেকে বসবাসের মনটাকেও।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন