কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

স্মৃতিকণা সামন্ত

 

থমাস_দ্য_অ্যাপস্তল



ওই যে ডিঙি নৌকোটা গ্যাঁট হয়ে বসে আছে ডাঙায় ওকে একটা টুসকি দিলেই হুড়মুড়িয়ে জলে গিয়ে পড়বে। আর তারপর ঢেউয়ের ঠাট্টায় খানিক নাকানিচোবানি খেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে মাপতে থাকবে "এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে — এ — এ না..."

ডিঙিটা দেখতে দেখতে চোখের সামনে আস্ত এক ‘ফটিক’ হয়ে উঠবে, আর আলবেলা বিকেলখানা সুমুদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে চায়ের দোকানে, চেয়ারে। চাওয়ালি আম্মা তাকে সুনজরে দেখবে না মোটে। তবু বিকেলের সাথে তার এক চুক্তি আছে। সে এসে বসবে চায়ের দোকানে, সমুদ্দুরে ডুব দেওয়ার আগে চেয়ারের গায়ে ফেলে যাবে সেদিনের বাকি ওমটুকু, সেই ওম বিকিয়ে যাবে খদ্দেরের আয়েসী চুমুকে।

বিকেল তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। বালির ওপর মেয়েটি হেঁটে যায় প্রেমিকটির পায়ের ছাপের পাশে ছাপ ফেলে। ওখানে অন্য কেউ হেঁটে যাবে কাল। অবেলায় বড় দার্শনিক হয়ে ওঠে বিকেল। এই যে টুকুস আগে চার্চের দেওয়াল ধরে হাঁটছিল সে, ভিকো-টার্মারিক-রোদ ভাগ করে নিচ্ছিল দুজনে এখন সে আর সেখানে নেই। অন্য এক অচেনা গুঁফো লোক এসে হাত বোলাচ্ছে দেওয়ালের গায়ে, বুকের ওপর ক্রস আঁকছে, কাল আবার অন্য কেউ আঁকবে... ভাবতে ভাবতে যত নির্মোহ হয় ততই তার তেজ কমে, সন্ধ্যার দিকে ঢলে পড়ে অকারণ। ঢেউভাঙা জলে পা ডোবায়, জলের টানে নামতে থাকে আরও জলে, আরও আরও জলে, তারপর ডুবে যায় ঝুপ করে।

চার্চের ঘণ্টা বেজে ওঠে ঢং ...

ঘণ্টার শব্দ চারিয়ে যায় রাস্তা পেরিয়ে অন্ধকার কালো জলে। সমুদ্দুরের বুকে ভেসে বেড়ায় ঘণ্টার সুর.... ঢং।

আলেকজান্দ্রিয়া শহর তখন গভীর ঘুমে। যীশুর ক্রুশিফিকেশন হয়েছে সদ্য। সেই ছেলেটি, যাকে যীশু বিক্রি করেছিলেন এক ব্যবসায়ীর কাছে সে নিজের চোখে দেখেছে সেই ক্রুশ, রক্ত আর একটি ঈশ্বরের সন্তানের শেষ পরিণতি। হয়ত ভয় পেয়েছে। হয়ত পালাতে চেয়েছে। পালানোর রাস্তা কদ্দুর নিয়ে যায়? জানেনা ছেলেটি। হাবান তার মালিক, সে ফিরবে ভারতে। যীশু বলেছেন নাকি সেদেশে যেতে। মিশন ধর্মপ্রচার। ভোররাতের জাহাজে হুইসেল বেজে ওঠে, বদরের নাম নিয়ে ভেসে পড়ে জলে। থমাস নামের ছেলেটি জুলজুল চোখে তাকায় হাবানের দিকে, এই যে নিরুদ্দেশ ভেসে পড়া এও কী ক্রুশের চেয়ে কম খারাপ কিছু? একটা উঠতি বয়সের ছেলে, যীশুকে সে ভালোবাসতে পারে, তার সাথে হওয়া অন্যায় সে মেনে নিতে নাই পারে, তবে প্রচারক হতে সে কবেই বা চেয়েছে? প্যালেস্তাইনের রাস্তায় যেসব সুন্দরীরা হেঁটে গেছে এতদিন তাদের কাউকেই যে দেখা হল না কাছ থেকে, দুটো কথা বলে ওঠা হল না!

বাহান্ন খ্রিস্টাব্দ। প্যালেস্টাইন, আলেকজান্দ্রিয়া, নুবিয়া, ইথিওপিয়া, হয়ে স্কর্টা থেকে কেরালার বন্দরে এসে থামল হাবানের জাহাজ। ওই, ওই যে ডিঙিনৌকোটা ঝিমোচ্ছে এখন, ওরই কোন দাদী, পর দাদী কিম্বা তস্য দাদী বা নানি গাছের কাঠে জন্মানো যে ডিঙির খুকিকাল তখন সেই ডিঙি তাকে এনে ফেলেছিল জেলেদের গ্রামে। ভাস্কো দা গামা তখনও জন্মায়নি। পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল (এক) তখনও বেহেশতে সার্ভিস দিচ্ছে। ইতিহাস তৈরী হচ্ছে দিস্তা দিস্তা খালি কাগজ নিয়ে, একটি দুঃসাহসিক সমুদ্র যাত্রা, একটি বাণিজ্যতরী, আর হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী অব্দি একটা দেশের আগামী পাঁচশ বছরের কিস্যা লিখবে বলে।

বিকেলটা খানিক হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ডিঙির গায়ে। মেছো গন্ধ উড়ে আসে। মেছোগন্ধ ঘুরে বেড়ায় জেলে পাড়ার রাস্তায়। সমুদ্রের গা ঘেঁষে যেসব রাস্তারা চলে যায় তারা সব রাজপথ কিম্বা মেছোপথ। রাজপথে চাকার ধুলো আর মেছোপথে নোনা হাওয়ারা ঘুরে বেড়ায় দল বেঁধে। কেউ কারো এলাকা মাড়ায় না। নোনা গন্ধওলা রাস্তায় ঘোরে থমাস, আর গোঁড়া নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণের ছেলেটাকে তার শিষ্য বানিয়ে ফেলে।

ঈশ্বরের জন্মের আগে বেঁচে থাকাই ছিল ধর্ম। সেই ধর্মের নামে দল হয়েছে, মারামারি হয়েছে, হারজিত, দখলদারি হয়েছে। নন্দগৃহের আনন্দে ঈশ্বর যতই ষোলকলায় বেড়ে উঠেছেন ততই পৃথিবী ভরে উঠেছে নানান ধর্মে, বেড়েছে ধর্মের দূত আর মানুষের পাপ পুণ্যের পারদ। দেশে দেশে দেবতা, উপদেবতা, লোকদেবতার বাড়বাড়ন্তের গল্পটা আসলে একটাই গল্প, শুধু নদী পেরোলে, সমুদ্র পেরোলে, পাহাড় ডিঙ্গোলে বদলে যায় চরিত্রদের নাম।

থমাসকে বন্দী করার পর ঠিক সেই স্বপ্নটাই দেখলেন রাজা গুন্ডাপ্পা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ধনপতি সওদাগর আর কমলেকামিনীর গল্পের রাজা , কিম্বা সত্যপীরের গল্পে সাধু সদাগরকে বন্দী করা রাজা। থমাস যে ঈশ্বরের দূত, যেমনটি ঠিক আমাদের চাঁদবণিক। রাজা গুন্ডাপ্পা ছেড়ে দিলেন তাঁকে। চলতে শুরু করলেন থমাস। পায়ে তাঁর হাজার-মাইল পথের ধুলো, গায়ে সমুদ্রের গন্ধ।বিকেলটা আঁচড় কাটে ডিঙির গায়ে। মেছোডিঙি দুলতে থাকে। দুলতে দুলতে মনে পড়ে তার দাদী ডিঙির কথা। দাদী বলত তার দাদীর কথা। দাদীর গায়ে তার নানীর উঠতি বয়সের সাবেক গন্ধ, শ্যাওলার ছাপ।  দুলতে দুলতে ডিঙিটা পিছিয়ে যায় হাজার হাজার বছর। বিকেলের দেরি হয়ে যায়, ডুব দেওয়া হয় না। সমুদ্র গম্ভীর হয়ে ওঠে অকারণ।

ওই যে বন্দরে বন্দরে জ্বলে উঠেছে আলো, ওই যে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণবপোত, ওর খোল ভরে আছে সুতির শাড়ি, রেশম, মুক্তো, হাতির দাঁত আর গোল মরিচের দানা। জাহাজগুলো একে একে ভেসে যাবে জলে, মিশরে, রোমে। এমন করেই ভেসে যায় ওরা, হরপ্পায় ভেসে আসে মিশরের ডিঙা, ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ থেকে ভেসে আসে ছপছপ দাঁড়ের আওয়াজ। ওরা আসে, আজ নয়, কাল নয়, আরো আরও অতীতের পথ বেয়ে, বনলতা সেনের অন্ধকার চুলের গলি বেয়ে।

উনিশ খ্রিস্টাব্দের ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদ স্ট্রাবো লিখলেন পশ্চিম থেকে বছরে একশ কুড়িটা জাহাজ যাতায়াত করে ভারতের দিকে। আর তখনই হিপ্পালাস হিসেব কষে ফেলছেন জাহাজের গতি ও অভিমুখের ওপর মৌসুমী হাওয়ার প্রভাবের।

তাম্রলিপ্ত বন্দরের পলি, আর পলির নিচে পাওয়া দু আড়াই হাজার বছর আগের তৈরি গ্রিস বা রোমের  পুতুল কিম্বা মাটির বাসনকোসনের টুকরো,  ইতিউতি ছড়ানো মুদ্রারা বলছে বিদেশিরা সেদিনও আসতো, আসতো নৌকা বেয়ে, জাহাজে চড়ে। রোম গ্রিস মিশরে ভেসে যেত এদেশের ডিঙা। চাঁদ বেনেও সাজিয়েছে তার  টিয়াঠুটি, গুয়ারেখি, ধবল, উদয়সারা, শঙ্খতালির চোদ্দ ডিঙা  প্রজন্মের উত্তরাধিকার নিয়ে। পাটনের রাজাকে বলেছে ‘নাম আমার চন্দ্রধর, বাপ আমার ধনের কুবের।'

থমাস চলেছেন কেরালা পেরিয়ে মাদ্রাজের দিকে। সমুদ্রের গায়ে গায়ে নুনের গন্ধ লাগা রাস্তায় রাস্তায় বাড়ছে তাঁর কনভার্টের সংখ্যা। গসপেলগুলি ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাঠে ঘাটে, ভারতে এক আমদানি হচ্ছে নতুন এক ধর্ম। রাস্তা এনে ফেলেছে তাঁকে মাইলাপুরের দরজায়।

মইলাপুর যেন এক ধর্মনগরী। শিব প্রতিষ্ঠিত দেবতা। মইয়ালি, ময়ূর দেবী পার্বতীর প্রতীক। মইলাপুরের রাস্তায় ঘোরে থমাস, বাড়তে থাকে শিষ্য আর শত্রু। বিদেশ বিভুঁইয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে পালানোর জায়গা খোঁজে থমাস। ছোট্ট পাহাড়ি গুহায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। শ্রোতা বেড়েছে, অনুগামী বেড়েছে, মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ম্যাজিক দেখে কতারে কাতারে বেড়েছে দুস্থ লোকের ভিড়। ধীরে ধীরে প্রফেট হয়ে উঠছে সন্ন্যাসী থমাস। আর ঠিক তখনই একদিন একটা বল্লমের ফালা এসে বিঁধল বুকের ভেতর। লুটিয়ে পড়লেন সেইন্ট। বাহাত্তর খ্রিস্টাব্দ।

পৃথিবীর গল্পগুলো হেঁটে যায় সহজ সোজা পথে। প্রতিটি যুদ্ধ জয়ের গল্প আসলে মানুষ জয়ের গল্প। খুনখারাপির গল্পে গল্পে কখনো হাতির মাথা কেটে বসেছে সিংহের মুখ, কখনো ঘোড়ার পিঠে চেপে বসেছে হাতি, কখনো মন্দিরের ইঁট খুলে তৈরি হয়েছে মসজিদ, কখনো মসজিদ ভেঙে তার ওপরে উড়েছে ধর্মচক্র,  জয়ধ্বজা। স্তূপ গুঁড়িয়ে গেছে, জৈন মূর্তি হয়ে গেছে বাসুদেব কৃষ্ণ। এসবই রাজধর্মের গল্প।

নেহাত উড়ে এসে জুড়ে বসা এক ভবঘুরে সন্ন্যাসী থমাস। যে দেশে শ্রী চৈতন্য হাপিস হয়ে যান পুরীর মন্দির থেকে সে দেশ থমাসকে বল্লমের ফালায় গেঁথে ফেললে অবাক হয়না সময়। ইতিহাস শুধু ছাপ তুলে রাখে।

রক্তমাখা শরীরটা তুলে আনল ওরা, যারা ভিড় করে বসেছিল থমাসের গসপেল শুনবে বলে। শেষ বিকেলের আলো সেদিনও থমকে ছিল সমুদ্র পেরোনোর আগে ওইখানে, ওই দেওয়ালের ধারে।  ঝুরঝুরে বালির গায়ে হেঁটে যাচ্ছিল বিকেল। থমকে গেল হাওয়া। দেশ ছেড়ে, চেনা ঘর ছেড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা, বহুদূরের ওপার হতে যীশুর বাণী বয়ে আনা প্রথম মানুষটার  জন্য ওদের মায়া হল খুব। বেলা শেষের আলো ঢেকে দিল থমাসের শরীর। নীল হয়ে আসা মুখে সমুদ্র বুলিয়ে দিল নোনা হাওয়া, বিকেল এসে চুপটি করে বসল পাশে আত্মীয়ের মতো।

মাইলাপুরের ওই যে চার্চ, একদিন থমাস যেখানে ইঁটের ওপর ইঁট গেঁথে ছিল প্রভু যীশুর নামে, তারই এককোণে শুইয়ে দিল ওরা প্রফেটের শরীর। প্যালেস্টাইনের থমাস ঘুমিয়ে গেল ভারতের মাটির নিচে ধর্মের নামে, জেসাসের নামে।

নির্লিপ্ত বিকেল এসে দাঁড়াল ডিঙির গায়ে। ছপছপ ছপছপ... জল ভাঙার শব্দে কান পাতে ওরা। মার্কো পোলো, নিকোলাই দি কন্টির পিছু পিছু একটা জাহাজ এসে থামে বন্দরে। পর্তুগালের রাজার সনদ নিয়ে এসেছে ভাস্কো দা গামা আর অজস্র লটবহর। খাগের কলমে খসখস আওয়াজ তোলে ইতিহাস। গথিক স্ট্রাকচারে বেড়ে উঠছে সেই চার্চটা, যার নিচে শোয়ানো থমাসের হাড়গোড়গুলো লোপাট হয়ে গেছে বহু আগেই। পড়ে আছে শুধু সমাধির ইঁট।

উনিশশ পঁয়তাল্লিশের আর্কিওলজিকাল হদিস বলছে থমাসের সমাধির ইঁট আর মাইলাপুর থেকে শ’ খানেক কিলোমিটার দূরের বন্দরে প্রথম শতাব্দীর রোম্যান শস্যাগারের ইঁটের গঠন একই রকম।

ডিঙি নৌকোটা জোরে জোরে শ্বাস নেয়। তার দাদী, পরদাদী, পর পর পরদাদী'র কাছে শোনা থমাসের গল্পটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় খুব। ইচ্ছে করে বালির বুকে আর একটু জিরিয়ে নিয়েই ছুট্টে জলে নামতে।  বিকেলকে ভিজিয়ে দিয়ে, চাওয়ালি আম্মাকে চমকে দিয়ে তারও নিরুদ্দেশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে খুব, ঠিক ওই থমাসের মতো।



(চেন্নাইয়ের মাইলাপুরে সেন্থম চার্চটি লাতিন অর্থোডক্স চার্চ। সেইন্ট থমাস ভারতে আসা বারোজন দূতের মধ্যে প্রথমজন যিনি যীশুর সরাসরি শিষ্য ছিলেন। তাঁরই নির্দেশে এদেশে আসেন। এই চার্চটি ভারতে তৈরি প্রথম শতাব্দীর অর্থোডক্স চার্চ, সারা দুনিয়ায় আর মাত্র দুটি এই ধরনের চার্চ রয়েছে। থমাস এদেশে  এসেছিলেন কিনা, এলেও মাইলাপুরের সমাধিটি তাঁরই কিনা সে নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু খ্রীষ্ট ধর্মের বিশ্বাসীরা মনে করেন ওই সমাধি থমাসের, এবং সমাধির হাড়গুলি পর্তুগিজ আমলের প্রথম দিকে এডেসা ও অন্যান্য জায়গায় বিলি হয়ে গেছে। প্রমাণ হিসেবে পড়ে আছে চার্চের কিছু লিখিত তথ্য, আর ওই সমাধির ইঁট।)


1 কমেন্টস্: