কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১৩০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১৩০

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১৩০ / ত্রয়োদশ বর্ষ : তৃতীয় সংখ্যা  




 

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলা ভাষায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যে সংখ্যক কবিতা প্রকাশিত হয়, তার তুলনায় গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হয় অনেক কম, প্রবন্ধ-নিবন্ধ আরও কম। আমি বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে একথা লিখছি, কেননা অন্যান্য ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞান ও ধারণা সীমিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গল্প উপন্যাস ও প্রবন্ধ-নিবন্ধের তুলনায় এই যে কবিতা প্রকাশের অত্যধিক প্রবণতা, তার পেছনে কী কারণ বা যুক্তি থাকতে পারে? প্রথমত হতে পারে, গল্পকার ও প্রাবন্ধিকদের তুলনায় কবির সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। আবার অনেক লেখক আছেন, যাঁরা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি কবিতাও লেখেন। বিশেষত বাংলা পত্র পত্রিকার জগতে অনেক পত্রিকা আছে, যাতে শুধুমাত্র কবিতাই প্রকাশ করা হয়। অবশ্য কবিতা কেন্দ্রিক কিছু পত্রিকায় কবিতা সম্পর্কিত প্রবন্ধ-নিবন্ধও প্রকাশিত হয়। শুধুমাত্র গল্পপত্রিকা ও প্রবন্ধ-নিবন্ধের পত্রিকাও প্রকাশিত হয়, কিন্তু তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কবিতা বেশি লেখা এবং প্রকাশিত হওয়ার আর একটা কারণও থাকতে পারে, কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো গল্প উপন্যাস লেখা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা থেকে কবিতা লেখা সহজ বলে মনে হয়। যাইহোক এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা সঠিক কারণ নির্দিষ্ট করতে পারবেন, কিন্তু এই সূত্রে যে ব্যাপারটা উল্লেখ করার জন্য আমার এসব কথার উপস্থাপনা, তা হচ্ছে, স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর যেমন প্রায় নিত্যদিন বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত হয়, তার পাশাপাশি স্বরচিত গল্পপাঠ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠের আয়োজন করা হয় না বলা যেতেই পারে। এর কারণও একাধিক হতেই পারে। প্রথমত যেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গল্পকার ও  নিবন্ধকারদের থেকে কবির সংখ্যা অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত একটা গল্প বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠ করতে যতটা সময় লাগে, সেই একই সময়ে অন্তত পাঁচ-ছ’জন কবি তাঁদের কবিতাপাঠ করতে পারেন। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই কবিদের সঙ্গে দর্শকশ্রোতাদের যতটা সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে, শুধুমাত্র গল্পকার ও প্রবন্ধ-নিবন্ধকারদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ থাকে না।

সম্প্রতি গত ৫মে সোমবার মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকা ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ পত্রিকার উদ্যোগে প্রথম গল্পপাঠের আসর আলোচনাসভা আয়োজিত হয়েছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার সংলগ্ন বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে চাঁদপুর সম্মিলনীর সভাঘরে। বিকেল ৫টা থেকে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত এই আসরে গল্পপাঠ করেছিলেন সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের চারজন অত্যন্ত প্রতিভাবান গল্পকার তৃষ্ণা বসাক, শতাব্দী দাস, অলোকপর্ণা এবং মনীষা মুখোপাধায়। তাঁদের এই পঠিত গল্পগুলি নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে বিশদ ও তীক্ষ্ণ আলোচনা করেন চারজন বিশিষ্ট গল্পকার ও প্রাবন্ধিক বাসব দাশগুপ্ত, উপল মুখোপাধ্যায়, তপনকর ভট্টাচার্য এবং রাহুল দাশগুপ্ত। পরিশেষে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিমান মৈত্র, সুদীপ দাস এবং শ্রেষ্ঠা সিনহা। অনুষ্ঠানে  সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ধ্রুব হালদার। আসরের শুরুতে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার পক্ষে সম্পাদক কাজল সেন ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ পত্রিকার পক্ষে সম্পাদক পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র প্রাথমিক বক্তব্য রাখেন। আসর ও আলোচনাসভা সঞ্চালন করেন কাজল সেন এবং সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক ছিলেন টিভি সাংবাদিক বিধান ঘোষ। বলা বাহুল্য, বাংলাসাহিত্য ক্ষেত্রে কলকাতায় এই আয়োজন ছিল সাম্প্রতিক কালে অভিনব ও অভূতপূর্ব। অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক এই ধরনের আসর ও আলোচনাসভা আয়োজনের জন্য আমরা দায়বদ্ধ।  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের জানাই গ্রীষ্মকালীন আন্তরিক শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহারাজ (ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন)

 

উপনিষদ্ ও ভারতীয় ইসলাম

(বক্তৃতা, Messages of Upanishad)

 (বক্তৃতাটির অনুলিখন, সম্পাদনা ও টীকা: শিষ্য অর্ঘ্য দত্ত বকসী)



 

(এখানে একটু মুখবন্ধ দরকার। হিন্দুধর্মে শাস্ত্রের দুটি ভাগ আছে। এক শ্রুতি ও দুই স্মৃতি। শ্রুতি বলতে মূলত বেদকে বোঝায়। আরো নির্দিষ্ট করে বললে উপনিষদ বা বেদান্তকে। বেদের যে যাগ যজ্ঞ মন্ত্র সংগীত ইত্যাদি হল কর্মকাণ্ড। এগুলিকে বলে পূর্ব মীমাংসা। আর বেদান্ত হল জ্ঞানকাণ্ড। উত্তর মীমাংসা। এখানেই সনাতন ধর্মের কোর আধ্যাত্মিক তত্ত্বটি ব্যক্ত করা আছে। তাই সামান্যীকরণ করলে যে কোন ধর্মের আধ্যত্মিক সারবস্তুটিকে বলা যায় শ্রুতি। আর হিন্দুধর্মে আরো অনেক স্মৃতিগ্রন্থ, পুরাণ, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ, নিয়ম কানুন, আচার বিচার গ্রন্থগুলিকে একত্রে স্মৃতি বলা যায়। সেটি সামাজিক ও মূল্যবোধের নিয়মাবলী। যেমন টেন কমাণ্ডমেন্ডস।)

 

 

পূর্বে ভারতীয় ইসলামের ওপর উপনিষদের প্রভাব বেশি গভীর হয়নি। যদিও ইসলামের মরমিয়া সম্প্রদায়, সুফিরা অনেকটা উপনিষদের ভাবে ভাবিত, ইসলাম ধর্ম সমগ্রভাবে নিজ উপশাখার প্রতি যেমন, তেমনি ইসলাম বহির্ভূত বিশ্বাসের প্রতিও শত্রুভাবাপন্ন থাকায়, প্রধানতই উপনিষদের প্রভাবমুক্ত ছিল।

পয়গম্বর মহম্মদ যেমন গভীর ভগবৎপ্রেমী ছিলেন তেমনি মানব প্রেমিকও ছিলেন।

এই দ্বিমুখী প্রেম তিনি কোরআন-এর অন্তরে প্রবেশ করিয়ে গেছেন। অল্-হজ হাফিজ গুলাম সরওয়ার প্রণীত কোরআন-এর ইংরেজী অনুবাদের কিছু সঙ্কলন দেওয়া হলো।

নিচের তিনটি রুকু-তে (স্তবক বা বাক্যসমষ্টি) যে ঈশ্বর মহিমা গীত হয়েছে তা বেদের তথা উপনিষদের মন্ত্রে বার বার পাওয়া যায়। প্রথম আয়াতগুলি কোরআন-এর (বাক্য) বিরল আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য ও মাধুর্যমণ্ডিত:

আল্লাহর নামে (আরম্ভ করি),

যিনি (আদিতে) অনন্ত করুণাময়,

যিনি (অন্তেও) অনন্ত করণাময়।

সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য,

(তিনিই) বিশ্বজগতের প্রতিপালক,

যিনি (আদিতে) পরম দয়ালু,

যিনি (অন্তেও) পরম দয়ালু।

(যিনি) কর্মফলদিবসের প্রভু।

আমরা কেবল আপনারই উপাসনা করি,

এবং আপনারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।

আমাদের ঠিক পথে চালিত করুন,

তাদের পথে যাদের আপনি অনুগ্রহ দান করেছেন,

যারা (আপনার) ক্রোধে পড়েছে তাদের পথে নয়,

যারা বিপথে গিয়েছে তাদের পথেও নয়।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ২৫৫ রুকূ-তে আমরা পড়ি ঈশ্বরের শক্তি ও মহিমাঃ

আল্লাহ্!

তিনি ছাড়া অন্য কোনও উপাস্য নেই,

(তিনি) চিরঞ্জীব,

(তিনি) অনাদি

তন্দ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না,

নিদ্রাও না।

আকাশ, পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তাঁর।

কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?

তাদের (মানুষের) সম্মুখে ও পশ্চাতে যা-কিছু আছে তা তিনি অবগত আছেন;

যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ছাড়া

তাঁর জ্ঞানের কিছুই মানুষ আয়ত্ত করতে পারে না;

তাঁর আসন আকাশ ও পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত;

এবং তাদের (আকাশ-পৃথিবীর) রক্ষণাবেক্ষণে তিনি ক্লান্ত হন না,

এবং তিনি

অতি উচ্চ মহামহিম।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদের ২৫নং রুকূ-তে ঈশ্বরের ঐশ্বর্য কীর্তিত হয়েছেঃ

বল, হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ্!

তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর।

এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও;

এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত কর;

আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর;

(যাবতীয়) কল্যাণ তোমার হাতেইঃ

তোমার ইচ্ছামতো সব কাজ তুমি করতে পার

কোরআন-এ আছে, মুক্তি কেবল মুসলমানদের একচেটিয়া নয়। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৬২নং রুকূ-তে আছেঃ

যারা (কোরআন-এ) বিশ্বাস করে,

যারা ইহুদী

এবং যারা খ্রীস্টান

এবং সাবেয়ী-

এদের যে কেহ আল্লাহ্

এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করে

ও সৎকাজ করে,

তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার আছে,

এবং তাদের কোন ভয় নেই,

তারা দুঃখিত হবে না।

 

কোরআন জোর দিয়ে বলে, ঈশ্বর-কৃপা লাভের একটিই শর্ত—তা হলো সজীবন, সৎকর্ম—কেবল একটি মতে বিশ্বাস নয় (তদেব, ২২, ১৭৭):

পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে

তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোন পুণ্য নেই

কিন্তু পুণ্যবান সে যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে,

এবং (যে) শেষ দিবসে (বিশ্বাস করে),

এবং ফেরেস্তাগণকে (বিশ্বাস করে),

এবং কিতাব,

ও নবীগণকে (বিশ্বাস করে),

এবং যে আল্লাহর ভালবাসায়

আত্মীয়স্বজন,

এবং অনাথ,

এবং অভাবগ্রস্ত,

এবং পর্যটক,

এবং ভিখারি

এবং দাস-মুক্তির জন্য অর্থ দান করে,

এবং যে নামাজ পড়ে,

যথাযথভাবে দান করে,

এবং যারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পালন করে;

আর যারা দুঃখকষ্ট,

আঘাত

ও যুদ্ধের সময়

ধৈর্যধারণ করে;

এরাই হলো সত্যনিষ্ঠ,

এবং এরাই শ্রদ্ধার পাত্র।

 

পয়গম্বর অমুসলমানদের প্রতি আচরণে সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধার এক উচ্চ আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। কোরআন-এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ২৫৬ নং রুকূ-তে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সখ্যভাব প্রকাশ পাচ্ছে:

ধর্মে কোনও জোর জবরদস্তি যেন না থাকে,

সুপথ, নিশ্চয়, স্পষ্টভাবে কুপথ থেকে পৃথক হয়,

সুতরাং যে নিয়মলঙ্ঘনকারীকে বিশ্বাস না করে,

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে

নিশ্চয় সে এমন এক শক্ত হাতল ধরতে পায়,

যা কখনও ভাঙবে না:

এবং ঈশ্বর সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

 

কোরআন-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১৩৫ নং রুকূ-তে (এবং পঞ্চম পরিচ্ছেদের ৮নং রুকূতেও) মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ন্যায়বিচার ও সাম্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে:

 

হে বিশ্বাসিগণ!

তোমরা ন্যায় বিচারের রক্ষক হও,

আল্লাহর পক্ষে সাক্ষ্য দাও,

যদি তা তোমাদের নিজেদের

বা তোমাদের পিতামাতার

এবং তোমাদের আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধেও হয়।

কোনও ব্যক্তি ধনী বা দরিদ্র যা-ই হোক,

আল্লাহ্ (তোমার থেকে) তার নিকটবর্তী,

সুতরাং (নিজ) নিম্নতর কামনার অনুসরণ করো না

পাছে তোমার ন্যায়-বিচারে বিঘ্ন ঘটে।

এবং যদি তুমি (সাক্ষ্যপ্রমাণ) বিকৃত কর,

বা পাশ কাটিয়ে চলো,

তবে, নিশ্চয়ই, আল্লাহ্ তোমার কাজের খবর ভালভাবে জানেন।

 

এইগুলি এবং অনুরূপ অন্যান্য অংশে কোরআন যেসব সর্বকালীন ও সর্বজনীন সত্য যোষণা করেছে ভারতীয় অধ্যাত্ম-সংস্কৃতির ভাষায় সেগুলি শ্রুতি পর্যায়ে পড়ে। ঈশ্বরলাভের অন্যতম পথস্বরূপ যে ইসলাম তা এই। ইসলামের অন্যদিকও আছে, যাতে সমাজজীবন যাপনের পথ নির্দেশ দেয়। এগুলিই হলো ইসলামের বিশাল স্মৃতি শাস্ত্রস্বরূপ। এতে আছে কতকগুলি আদর্শ ও মূল্যবোধের ধারণা যার মাধ্যমে পয়গম্বর তাঁর অনুবর্তীদের একটি আরব জাতিতে গড়ে তুলেছিলেন। এর প্রয়োগ কিন্তু সীমিত, কারণ এতে আছে বাক্তিজীবনের নীতি ও সমাজজীবনের নিয়ম কানুন—এই অংশগুলিকেই ধর্মের সামাজিক-রাজনৈতিক অনুশাসন বলে ধরা হয়। কোন ধর্মশাস্ত্রই এই বিষয়ে সর্বকালীন ও সর্বজনীন আইন প্রণয়ন করতে পারেন না। যে আইনগুলি খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের হিসাধন করেছিল, তা ভারতীয়, ইন্দোনেশীয়, ইউরোপীয়, বা আমেরিকাবাসীদের হিতসাধন না-ও করতে পারে—আশ্চর্যের বিষয় এমনকি বিংশ শতাব্দীর আরবদের পক্ষেও নয়। প্রগতিশীল দুনিয়া আজকাল বিচার করে এগুলির পরিবর্তন করছে বর্তমান যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী।

কিন্তু কোরআনের আধ্যাত্মিক বাণী, তার শিক্ষা, যা মানুষকে আধ্যাত্মিক অনুভূতির পথ দেখিয়ে দেয় তা সর্বকালীন ও সর্বজনীন। দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের যুগে প্রত্যেক ধর্মেরই পুনর্ব্যাখ্যান প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যাকে টয়েনবির ভাষায় বলা যেতে পারে, হাওয়া দিয়ে শস্যের আবর্জনা উড়িয়ে দেওয়া; এ কাজে আক্ষরিক অর্থ অস্পষ্ট রেখেও ভাবের ওপর জোর দিতে হবে, ইতিহাসের থেকে যা চিরন্তন তারই প্রাধান্য থাকবে—যাতে পুনর্গঠিত ধর্ম নবযুগের আপত্তির মোকাবিলা করতে পারে; যেমন নব সুসমাচারে বলা হয়েছেঃ কথায় মরণ আনে, ভাবই জীবন দেয়। এ যদি না করা হয় তবে সে ধর্ম হবে জোর করে চাপানো ধর্ম—অনুগামীদের ব্যক্তিত্বকে মোচড় দিয়ে সম মতে আনার ধর্ম, যেমন গ্রীক ডাকাতের ধর্ম ছিল অঙ্গহানি করে অপহৃতজনকে ছোট বিছানায় শোয়ানো।

খ্রীস্টীয় মরমিয়া সাধনা ও ইসলাম-পূর্ব ইরানের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সংস্পর্শজাত ইসলামের সুফি আন্দোলন—ইসলামের 'শ্রুতি' অংশ ইতিহাস বহির্ভূত অংশেরচিরন্তন অধ্যাত্ম কেন্দ্রটির-ওপর জোর দেবার চেষ্টা করেছিল; এখানেই অধ্যাত্ম অনুভূতি লাভের পথ হিসাবে ইসলামের তেজ সর্বাধিক জাজ্বল্যমান। সুফিরা সহানুভূতি লাভ করেছিল প্রথমে মেসোপটেমিয়া ও ইরানের মাটিতে, পরে ভারতে এসে বেদান্তের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। কিন্তু সর্বত্র তাদের তীব্র বিরোধিতা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল গোঁড়া ইসলামের কাছ থেকে যা কেন্দ্রীভূত ছিল তার 'স্মৃতি' অংশের প্রতি সুকঠোর আনুগত্যের ওপর—তার সঙ্গে অত্যুৎসাহী শাসক ও উৎপীড়ক যোদ্ধাদের প্রবর্তিত সামাজিক রাজনীতিক আদর্শ ও কার্যসূচী পালনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। সামাজিক-রাজনীতিক আদর্শ যদি উচ্চ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত না হয়, তবে তাতে মানুষের নিম্নতর সত্তা পুষ্টি লাভ করে যা থেকে উৎপত্তি হয় স্বার্থপরতা, অসহিষ্ণুতা, হিংসা ও যুদ্ধবিগ্রহের। প্রতিটি ধর্মের প্রথম উদ্দেশ্য তাই মানবের নিম্নতর সত্তাকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তা না হলে, ধর্ম সামাজিক-রাজনীতিক আদর্শকে নিজ স্তরে উন্নীত করার পরিবর্তে নিজে তাদের নিম্নস্তরে নেমে আসে ও তাদের পরিচারিকার মতো কাজ করে। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িত থাকায় ইসলাম ব্যাহত হয়েছে, যেমন হয়েছিল খ্রীস্টধর্ম কনস্ট্যানটাইনের পরে। ইসলামের সন্তরা, ভগবৎ ও মানব প্রেমিকরা মূক হয়ে গিয়েছিল, আর ইসলামের যে বার্তা শোনা যেত মূর্ব ধর্মান্ধ গোঁড়াদের কাছে, যুদ্ধোন্মাদ বিজেতাদের কাছে, তা অনৈস্লামিক ও পূর্ণমাত্রায় ভোগবাদ—কেবল লুট-ক্ষমতা-ভোগ লাভে প্রযুক্ত নিজ ভোগ চরিতার্থ করার জন্য ইসলাম নামের অপব্যবহার।

ভারতের সঙ্গে ইসলামের যোগাযোগ হয় তার জন্মলগ্ন থেকে প্রথম চারশো বছর ধরে মুসলিম আরব বণিক ও প্রচারকদের মাধ্যমে। এই পর্যায়েই স্বাভাবিক ধরনের ধর্মে ধর্মে ও দেশে দেশে যোগাযোগের ফলে শান্তিপূর্ণ আদান-প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক কল্যাণ হতে দেখা যায়। এই সময়েই আবার আরব জাতীয় মানস নতুন নতুন ভাব আহরণের ও তাদের প্রতি সাদর আতিথেয়তা দেখাতে উৎসুক হয়ে গ্রীকো-রোমান, ইরাণী ও ভারতীয় সংস্কৃতির ভাবধারা থেকে ইচ্ছামত গ্রহণ করায় ইসলাম তার তেজ ও গৌরবের শিখরে উঠেছিল।

কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে এ-সবেই পরিবর্তন ঘটল। রাজকীয় ক্ষমতা ও ভোগবিলাসের সাথী বিভেদ ও দুর্নীতি সরল মরুবাসী আরবদের আচ্ছন্ন করে ফেলল; এই শতাব্দীর মাঝামাঝি মোঙ্গল আক্রমণ আরবীয় ইসলামের আধিপত্য সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল। কয়েক শতাব্দী ধরে ঐস্লামিক শিক্ষা সংস্কৃতি ভয়ানক ভাবে চাপা পড়ে রইল। বিজেতারা ও অন্য মধ্য এশীয় গোষ্ঠীগুলি জেগে উঠে ইসলামকে গ্রহণ করল, অথবা বলা যেতে পারে নিজেদের নিম্নমানের সংস্কৃতি ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী ইসলামকে পরিবর্তিত করে গ্রহণ করল। সেইসময় বিচার ও সত্যের প্রতি ভালবাসা সিংহাসনচ্যুত হলো, 'আইনের কথাগুলিই' জয়ী হলো, আর প্রতিক্রিয়াশীল গোঁড়ামি যুদ্ধোন্মাদদের সঙ্গে অশুভ-আঁতাতে মিলিত হয়ে তাদের হিংসাত্মক কাজকে আশীর্বাদ করে ধর্মের অনুমোদনের ছাপ দিয়ে, পবিত্র যুদ্ধ বা জেহাদ পরম্পরায় পরিণত করল।

ভারতের ইসলামের সংস্পর্শে আসার দ্বিতীয় পর্যায়ে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে, যখন ভারত ও তার ধর্মগুলি নিয়মিতভাবে আঘাত পেয়েছে সেই ধর্মের নামে যা পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতীয় জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধি থেকে ইচ্ছামতো আহৃত সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে নিজ দেহে পালন করেছিল এবং বিজ্ঞান ও মানবতার আলোকবর্তিকা বহন করেছিল। ভারত-ইতিহাস এবং ভারতীয় ইসলাম ও হিন্দু সমাজ অন্যরকম হতো যদি ইসলাম প্রথম পর্যায়ে যেমন বন্ধুর মতো শান্তিতে এসেছিল তেমনি দ্বিতীয় পর্যায়েও আসত। মানব ইতিহাসে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটতে পারত তার মধ্যে এটি একটি। এটি ঘটলে এর সামাজিক সাম্যের বাণী হিন্দুর জাতি-অধ্যুষিত সমাজ সৌধটির সংস্কার সাধনে সহায়তা করত। হিন্দুধর্ম আনন্দের সঙ্গে এই শিক্ষা গ্রহণ করত, আর নিজ বৈদান্তিক উদারভাব ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা ভগিনী পর্যায়ের ইসলাম ধর্মকে প্রদান করত। কিন্তু ভারতে ইসলামের প্রকৃত আগমন হলো অজ্ঞ ধর্মান্ধ ও বিজেতা যোদ্ধাদের নীৎসের (Nietzsche) ভাষায় 'হিংসাপ্রণোদিত কাজের ও ব্যবহারের' মাধ্যমে; ফলে হিন্দুর মনে ইসলাম চোখের বালি-স্বরূপ হয়ে রয়েছে। এটি আন্তঃ-সাংস্কৃতিক যোগাযোগের অন্যতম বিষাদময় অধ্যায়, যার ফল হয়েছিল তিক্ত কিন্তু অন্যভাবে হলে হয়ত মানবীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির পক্ষে অতিমাত্রায় সুফলপ্রসূ হতো।

এই দ্বিতীয় পর্যায় তাই ভারত ইতিহাসে একটি দুঃখজনক অধ্যায় রচনা করেছে, যার সুদূরপ্রসারী কুফল আজ ভারতীয় প্রজ্ঞার সামনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (প্রশ্ন সমাধানের) আহ্বান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ভারত তার ঔপনিষদিক অধিকারে পূর্বদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি, শক্তি ও দক্ষতার সঙ্গে এই বিশাল দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয়েছে।

ঈশ্বরপ্রেম ও মানবপ্রেম, ন্যায় বিচার ও সাম্যময় মানবিক সম্পর্ক, মানুষে মানুষে সমতা, সহিষ্ণুতা ও পরমতে শ্রদ্ধা-এক কথায় ইসলামের যাবতীয় 'শ্রুতি' অংশ, যা ধর্মজীবনে অগ্রগতির প্রাথমিক স্তর—এ সব চাপা পড়ে গিয়েছিল ক্রমাগত ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতার তরঙ্গে। প্রতিক্রিয়াশীল ইসলাম কেবল হিন্দু ও হিন্দু-সন্তদেরই নির্যাতন করেনি, মুসলমানরা নিজেরা ও তাদের শ্রদ্ধাস্পদ সন্তগণ, যাঁরা প্রগতিশীল আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি-সম্পন্ন, বা যুক্তিবাদী সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শ ও কার্যক্রম সমর্থন করেছেন, তাঁরাও নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও নিহত হয়েছেন। তবু দুটি সংস্কৃতির মধ্যে প্রচুর আদান প্রদান হয়েছে ও একে অপরের চিন্তাগ্রহণে লাভবান হয়েছে এবং এই সময়েও মাঝে মাঝে মরমিয়া সাধক ও সন্তের আবির্ভাব বন্ধ হয়নি, এইগুলিই ইসলামের মধ্যে নিহিত চিরন্তন ও সর্বজনীন আদর্শের সাক্ষীস্বরূপ হয়ে ইসলামে শ্রুতি অংশের বিদ্যমানতা প্রমাণ করছে। এই সময়েও মাঝে মাঝে এমন রাজা বা সম্রাটের আবির্ভাব দেখা যায় যাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনীতি ছিল, যেমন মোঘলরা ও শেরশাহ। এইসব সন্ত ও শাসকরা সব সময়ে বেদান্তে অভিব্যক্ত ভারতীয় প্রজ্ঞার আধ্যাত্মিক মাধুর্য ও গভীরতায় সাড়া দিয়েছেন।

মুসলিম অসহিষ্ণুতা সত্ত্বেও হিন্দু তার সহিষ্ণুতা বজায় রেখে চলেছে, কারণ এই সহিষ্ণুতা উপনিষদ‌ভিত্তিক অধ্যাত্ম অনুভূতি ও দার্শনিক প্রত্যয়জাত এবং ভারতীয় জীবন দর্শন ও জীবনচর্যায় এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারতীয় সহিষ্ণুতার স্বাতন্ত্র্য ধর্ম বিশ্বাস থেকেই আসে, আধুনিক পাশ্চাত্য-দেশীয়ের মতো ধর্ম বিশ্বাসের অভাব থেকে নয়। এই ভারতীয় ধারা সম্বন্ধে ডঃ রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন: (Dr. S. Radhakrishnan-Eastern Religions and Western Thought, p.317)

সহিষ্ণুতা হলো অসীমের চিরপূর্ণতার প্রতি সসীম মনের শ্রদ্ধা নিবেদন’।

মুসলমান অসহিষ্ণুতার মধ্যে হিন্দু সহিষ্ণুতার এই আশ্চর্য ঘটনা মুসলমান লিপিকাররাই লিখে গেছেন। রাধাকৃষ্ণণ (তদেব, পৃঃ ৩১২) Murray's Discoveries and Travels in Asia (Vol. II, p. 20) থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে গ্রন্থকার কেরলস্থিত কালিকট রাজ্যে হিন্দু রাজার সভায় মুসলিম পারস্য রাজদূতের নিম্নোক্ত মন্তব্য উল্লেখ করেছেন:

(কালিকটের) অধিবাসীরা অবিশ্বাসী, অতএব আমি (আবদুল রাজক বোর্ন, পারস্যের সভা থেকে রাজদূত, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি) নিজেকে শত্রুরাজ্যে রয়েছি বলে মনে করি, কারণ যারাই কোরাণ মানে না মুসলমানরা তাদের প্রত্যেককেই শত্রু মনে করে। তবু আমি স্বীকার করি, আমি সম্পূর্ণ সহিষ্ণুতার মুখোমুখি হচ্ছি এমনকি সুবিধাও পাচ্ছি; আমাদের দুটি মসজিদ আছে ও প্রকাশ্যে প্রার্থনা করারও অনুমতি পেয়েছি’।

এমনকি ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ধর্মান্ধ মুসলিম লেখক খাফি খাঁ দক্ষিণের হিন্দুরাজা শিবাজীর উচ্চ প্রশংসা না করে পারেননি, কারণ তিনি হিন্দু মুসলমান উভয়কে সমানভাবে পালন করতেন ও তাদের ধর্মস্থানগুলিকে সমান যত্নে রক্ষা করতেন, অথচ সেই সময়েই তাঁকে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সুপরিকল্পিত হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হয়েছে। পাঞ্জাবের গুরুগোবিন্দ সিংহও একই রকম সুসভ্য ভাব ও নীতি অবলম্বন করেছিলেন, যখন তিনি নিয়ত তীব্র সংগ্রাম চালাচ্ছেন এই সম্রাটের অসহিষ্ণুতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে; ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই ভুলের জন্য সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ল। ঐতিহাসিক S. N. Sen বলেছেন: (Military System of the Marathas, p.18) ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কদাচিৎ দেখা যায়। শিবাজীর হিন্দু সাম্রাজ্যের ধারণায় কোনরকম ধর্মীয় হয়রানি বা নির্যাতন স্থান পায়নি। তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যে সাতশো (মুসলিম) পাঠান ছিল যারা বিজাপুর ত্যাগ করে এসেছিল। অন্তত তিনজন নৌসেনাধ্যক্ষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিল। তিনি মুসলমান সন্ত শেখ-মহম্মদকে হিন্দু সন্ত তুকারাম ও রামদাসের মতোই শ্রদ্ধা করতেন, মুসলমান সন্তদের মন্দিরে (মাজার) "আলোক সজ্জা ও ভোগ নিবেদনের জন্য ইনাম-জমি দান করতেন এবং সরকারি খরচে মুসলিম মসজিদের মেরামতির ব্যবস্থা করেছিলেন।" তাঁর কর্মময় জীবনে কেবল একটি ক্ষেত্রে এক মুসলমান সন্ত কর্তৃক পলাতকদের আশ্রয়দান সমর্থন করেননি, কিন্তু তিনি পবিত্র মুসলিম ধর্মগ্রন্থের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে কখনোই ভুলতেন না। এবং খাফি খাঁ যিনি শিবাজীকে প্রচুর নিন্দাবাদ করে আনন্দ পেতেন, তিনিও স্বীকার না করে পারেন নি যে "তিনি নিয়ম করেছিলেন, যখনই তাঁর অনুগামীরা লুটতরাজ করবে তারা যেন মসজিদে ঈশ্বরীয় গ্রন্থ বা নারীর কোন ক্ষতি না করে। যখনই একখানি পবিত্র কোরাণ তাঁর হাতে আসত তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন ও কোন মুসলমান অনুগামীকে তা দিয়ে দিতেন। যখন তাঁর লোকেরা কোন হিন্দু বা মুসলমান নারীকে বন্দী করে আনত, তাদের সহায়ক কোন বন্ধু না থাকলে তিনি তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, যতদিন না তাদের আত্মীয়রা এদের মুক্তির জন্য উপযুক্ত মুক্তিপণ নিয়ে আসত।" (Elliot & Dawson, History of India, Vol. II. pp. 254, 256, 262 and 269)

আমরা দেখেছি, ঐস্লামিক অসহিষ্ণুতা শুদ্ধ ইসলামের ফলস্বরূপ নয়, তা হলো সঙ্কীর্ণমনা ও একান্ত গোষ্ঠীগত প্রাধান্য এবং রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে গোঁড়া ধর্মান্ধদের শাস্ত্র ব্যাখ্যার ফল। ইতিহাস বলে প্রগতিশীল ইসলামের সূক্ষ্ম সহিষ্ণুতা দেখা যায় ইসলামের বেশ কয়েকটি সন্ত ও গৃহীর এবং রাজার ও রাজ্যের জীবনে। বর্তমান জগতের পরিপ্রেক্ষিতে এই গোঁড়া ইসলামীদের মন ও মুখ যেন অতীত যুগের মুখোশে ঢাকা, যে যুগ আর ফিরবে না। প্রগতিশীল ইসলামের মন ও বুদ্ধি এখন সংগ্রাম চালাচ্ছে, ভারতীয় চিন্তায় যাকে যুগের ধর্ম নাম দেওয়া হয় সেরূপ, নতুন ঐস্লামিক যুগধর্ম প্রবর্তনের জন্য। এই নতুন ইসলাম এখনই কয়েকটি আরব দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে ও প্রাণে সাড়া জাগিয়েছে। দু-রকম ইসলামের দ্বন্দ্ব এখন নিছক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আর প্রগতিশীল শক্তির, অনমনীয় অতীত-দর্শী আর নমনীয় ভবিষ্যৎ-দর্শীর দ্বন্দ্বরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রথমটি, ইসলামকে সুচারুরূপে বিন্যস্ত একটি পরিপূর্ণ স্মৃতি মনে করে-যা স্বতন্ত্র থাকতে চায়-অন্য কোন 'স্মৃতিকে' সহ্য করতে পারে না, আর অপরটি ইসলামকে 'শ্রুতি'র আলোকে নবযুগের বৈজ্ঞানিক ও মানবিক চিন্তার আলোকে দেখছে ও চেষ্টা চালাচ্ছে নতুন ঐস্লামিক 'স্মৃতি' রচনা করতে যা ইসলামের চিরন্তন তত্ত্ব ও বর্তমান প্রগতিশীল ভাব, উভয়ের সঙ্গে একতাবদ্ধ হবে।

এখানে ওখানে ছোট ছোট গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছাড়া আজকের ভারতীয় ইসলাম যে এতদিন কোনরূপ তীব্র দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে পেরেছে তার অন্যতম কারণ হলো, নিজ রাজত্ব কায়েম রাখার স্বার্থে বিদেশী ব্রিটিশ শাসকদের ইসলামের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে ও ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনকারী উন্মত্ত দাঙ্গাকে সহায়তা ও সমর্থন। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিগুলিই পশ্চাৎ-দশী ঐস্লামিক আদর্শকে পোষণ ও পালন করতে সহায়তা করেছে। কিন্তু প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল-দের দ্বন্দ্ব ভারতীয় ইসলামকে অবশ্যই আচ্ছন্ন করবে, যেমন করেছে আরবীয় ইসলামকে। পাকিস্তানের উৎপত্তির বিশেষ কারণেই সেখানে এ দ্বন্দ্বের অভিজ্ঞতা হবে দেরিতে। যোগাযোগ আগেই হোক বা পরে মুসলিম, খ্রীস্টান বা হিন্দু ধর্ম বা সমাজকে আধুনিক চিন্তাধারায় শিক্ষিত ও প্রতিপালিত বুদ্ধিমান তরুণসমাজের অনুসন্ধিৎসা এবং প্রায়শ অবজ্ঞাসূচক প্রশ্নবাণ ও প্রেক্ষণের সম্মুখীন হতেই হবে; এমন তরুণ তরুণীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। চিন্তাশীল ভারতীয় মুসলিমরা অচিরে তাদের যুক্তিপূর্ণ সন্ধানী আলো নিয়মিতভাবে ফেলতে থাকবে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যাবলির ওপর—কোনটির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে আর কোনটির প্রয়োজন ফুরিয়েছে বেছে নেবার জন্য যেমন অনুসন্ধান চালিয়েছেন স্বাধীনচেতা খ্রীস্টানরা খ্রীস্টধর্মের মধ্যে, স্বাধীনচেতা হিন্দুরা হিন্দুধর্মের মধ্যে।

এইটিই যখন আত্মরক্ষার বাঁধ হয়ে দাঁড়ায় তখন দুটি জিনিস হতে পারেঃ একরকম সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হতে পারে যা উচ্চ আধ্যাত্মিকতায় অন্তর্দৃষ্টি বা দৃঢ় বিশ্বাসের অভাবে ইসলামকে তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ করবার চেষ্টায় অপ্রয়োজনীয় অংশগুলির সংস্কার করতে করতে শেষে ইসলামকেই সংস্কার করে ফেলে তাকে একটি সমাজ সংস্কার সূচীতে বা কেবল সাংসারিক আদর্শে পরিণত করবে, যেমন প্রোটেস্টান্ট খ্রীস্টানদের ক্ষেত্রে হয়েছে; অথবা একটি সৃজনশীল পরিবর্তন চালু করে ইসলামের চিরন্তন ও সর্বজনীন অধ্যাত্ম তত্ত্বগুলির উত্তরোত্তর বিকাশের সুযোগ করে দেবে, যার শক্তি নিকটবর্তী ধর্মবিশ্বাসের শক্তির সঙ্গে সমপর্যায়ে আসতে সচেষ্ট হবে—নবযুগের মুসলমান যুবকগণের অধ্যাত্ম-ক্ষুধাকে ধর্মীয় খোরাক দিয়ে নিবৃত্ত করতে, কারণ তারা অনুদার ও সেকেলে ধর্মমত ও বিশ্বাসের 'পাথর' দিয়ে আর ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে চায় না।

অপরিহার্য বস্তুর সন্ধান আর অপ্রয়োজনীয়ের পরিহার ঐস্লামিক আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন ঐতিহ্য। ডঃ ভগবান দাস (Essential Unity of All Religions, Bharatiya Vidya Bhavan, Edition 1960, p.100) পবিত্রতায় মুসলমানগণ কোরাণের পরেই যার স্থান বলে স্বীকার করেন সেই বিখ্যাত মসনবী গ্রন্থের একটি স্তবক উল্লেখ করেছেন—যাতে লেখক মৌলানা জালালউদ্দীন রুমি ফারসি ভাষায় তাঁর কাজের উদ্দেশ্যটি সঠিক বর্ণনা করেছেনঃ

মন যে কুরাণ মগরু রা বর্দস্তাম,

স্‌তু খাঁ পেসে সাগাঁ অন্দাখতম—

'আমি কোরাণের মজ্জাটুকু টেনে নিয়েছি, আর রসহীন

হাড়গুলি ফেলে দিয়েছি কুকুরগুলির জন্য।'

কোরাণ সম্বন্ধে আজ যখন এরূপ করা হবে, তখন ইসলামের 'স্মৃতি' অংশের অধিকার, যথা বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক আইনগুলি যুক্তিনিষ্ঠভাবে বিচার্য হবে এবং বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী একদিকে রাজনীতিক সনদ ও সংসদীয় সামাজিক আইনের এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশের উন্নত সমাজবোদ্ধাদের তত্ত্বাবধানে এসে যাবে, আর অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলিরও আওতায় আসবে। উপরে যে দুটি পথ বর্ণিত হলো, তার অর্থ হয় ধর্মকে 'ধর্মসংস্থার শাসনমুক্ত' করা—না হয় মানবের সংসারজীবনকে 'আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ' করা; পরেরটি ধর্মের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক সত্যের অপরিহার্য মূল বস্তু অনুযায়ী মানবের সংসারজীবন গঠনের সমসাময়িক চাহিদা মেটাবে।

অনা দেশে ইসলামের এই দুটি বিকল্প পথ সম্বন্ধে যে মনোভাবই নেওয়া হোক না কেন, ভারতীয় ইসলামের গতি কেবল তার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারাই পরিচালিত হবে না, পারিপার্শ্বিক শক্তিগুলিরও সহায়তা নেবে যে শক্তি আসবে অন্যান্য বস্তুর মধ্যে অতি প্রাচীন আধ্যাত্মিক ভিত্তি ও আধ্যাত্মিক গতিসম্পন্ন ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত সমগ্র সামাজিক ব্যবস্থা থেকে। ধর্ম সম্পর্কিত এইসব শক্তির উৎস হলো উপনিষদের শক্তিদায়ী পবিত্রকারী একত্বভাবী দর্শন ও অনুভূতি। ইসলাম ও হিন্দুদের বহু প্রাচীন ও বর্তমান পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ এই ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, ইসলামের আধ্যাত্মিক মূল সম্পূর্ণভাবে এই দর্শন ও অনুভূতির সুরের সঙ্গে বাঁধা, এবং ব্যবহারে- যেমন সামাজিক সাম্যের ক্ষেত্রে—ইসলাম হিন্দুদের অনুরূপ ব্যবহারের চেয়েও ঐ সুরের আরো নিকটবর্তী। এখন এই দুই সমজাতীয় আধ্যাত্মিক শক্তির ঘনিষ্ঠ মিলনের সাহায্যে শুধুই যে একটি স্বাধীন সাম্যভাবাপন্ন এবং আধ্যাত্মিকতাপ্রবণ প্রগতিশীল নবভারতীয় সমাজ গড়ে উঠবে তা নয়, পরন্তু ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার ছাপ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভারতীয় ইসলামেরও উদ্ভব হবে—ঐস্লামিক গণতন্ত্র মানবিক গণতন্ত্রে পর্যবসিত হবে।

ভারতীয় ইসলামের পুনরভ্যুদয়ের আন্দোলন এতদিন 'রাজনীতিকভাবে' অনুপ্রাণিত এবং প্ররোচিত হয়েছে, কেবল পেছনে তাকিয়েছে লাভ করেছে তিক্ত ফল। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে—ইসলামের অধ্যাত্মশক্তিকে এবং হিন্দু ও খ্রীস্টান আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে তার আত্মীয়তাবোধকে ধ্বংস করতে। কিন্তু ভারতীয় ইসলাম বেশিদিন নবজাগরণের সংস্পর্শকে এড়িয়ে চলতে পারবে না; শীঘ্রই তাদের ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাধীন বাতাবরণে পুষ্ট ক্রমবর্ধমান আধুনিক শিক্ষার প্রেরণায় অভ্যন্তরীণ আলোড়ন ও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে চলতেই হবে। এই দুই অবস্থাই প্রতিটি ভারতীয় ধর্মকে প্রচুর সুযোগ দেয়—নিজের মধ্যে যা বৃহত্তম ও মহত্তম তাকে বিকশিত করার জন্য। যখন ভারতীয় ইসলাম এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে আরম্ভ করবে তখনই সে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার ভাব ও মেজাজ ধরতে পারবে এবং অনুধাবন করবে নতুনভাব আয়ত্ত করার কর্মচঞ্চল ক্ষমতা যা খলিফাদের আমলে মধ্যপ্রাচ্যে বিকশিত হয়েছিল—যখন ইসলাম তার গৌরবের উচ্চ শিখরে। এর ফলে ইসলামের উচ্চতর মন প্রভাবিত হবেই বেদান্তের ভাবধারার দ্বারা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের জীবনে বেদান্তের যে বর্তমান কার্যকরী অভিব্যক্তি হয়েছে তার দ্বারা যেমন সে আগে প্রাচীন গ্রীক চিন্তার দ্বারা ও উচ্চতর প্রাক্-ইসলাম পারসিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এর পরেই তার অভিজ্ঞতা হতে থাকবে ব্যাপক পুনরভ্যুদয়ের ও প্রকৃত আধ্যাত্মিক চরিত্রের পুনর্গঠনের নবযুগের জ্ঞানোন্মেষ ও প্রগতিশীলতার ও চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে। ভারতীয় ইসলামের পুনর্গঠন হলে উপনিষদের আলোকে কোরাণের নতুন নতুন ভাষ্য ও অন্যান্য ধরনের আলোচনা প্রকাশিত হবে—এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা অমূলক হবে না। বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, ভারতের নবজাগরণ হলে বেদান্ত ও ইসলামের অধ্যাত্ম স্রোতের শুভ মিলন হবে। সে শুভ পরিণতি সকলে আন্তরিকভাবে আকাঙ্ক্ষা করে যা দুই ধর্মের সন্ত ও ভক্তজন সামান্যভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন মধ্য যুগের প্রতিকূল সময়েও। এই হলো ভারতীয় ইসলামের সামনে তার গৌরবময় ভবিষ্যতের ছবি।



এটি অতি প্রচলিত ঐস্লামিক সৃষ্টি তত্ত্ব বিষয়ক একটি সিম্বলিক চিত্র। তুলনামূলক পুরাকথায় স্নাতকোত্তর করার সময় সৃষ্টি বিষয়ক পুরাকথাগুলি তুলনা করার কালে ঐস্লামিক এই চিত্রটি আমাদের সামনে উপস্থাপনা করা হয়।

 


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

‘অমৃত পান্থ’; জ্ঞান-পিয়াসী পরিব্রাজকের পরিভ্রমণের কথকতা




 

‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

ধর্ম শরণং গচ্ছামি

সংঘং শরণং গচ্ছামি’

ভগবান তথাগত অর্থাৎ বুদ্ধ প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মের ত্রিশরণ মন্ত্রাবলী থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশটি অনুসারে, দুঃখময় মানব জীবনের বহুবিধ ক্লেশ থেকে পরিত্রাণের জন্য ভগবান বুদ্ধের তথা তার মতাবলী এবং বৌদ্ধানুসারীদের পথ অনুসরণ করা আবশ্যিক; কারণ ‘বৌদ্ধধর্মের তিনটি মুখ—বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ। তাহার ধর্মে জ্ঞান, সংঘে কর্ম ও বুদ্ধে ভক্তি আশ্রিত হইয়া আছে।’ পৌরাণিক মতানুসারে ভগবান বিষ্ণুর নবমতম অবতার বোধিসত্ত্ব। তাঁর অনুসারী ধর্মমতবাদ বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন রূপে পরিচিত। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের সূত্র ধরেই চতুর্বণ প্রথার সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা বর্ণেরও উদ্ভব ঘটে। এই সকল বর্ণের মানুষ তাদের পৈতৃক বৃত্তি অনুসারে জীবিকা নির্বাহ করে; “এইভাবে ধীরে ধীরে বৃত্তিভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি এক একটি জাতিতে পরিণত হয়। এইভাবে ছুতোর, কর্মকার, চর্মশিল্পী, মৎস্যজীবী প্রভৃতি পেশার মানুষরা কর্মভিত্তিক বংশানুক্রমিক জাতি গড়ে তোলে।”

ধীরে ধীরে বৈদিক ধর্মের সরসতা হ্রাস পায়। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত জনজাতির আগ্রাসী মনোভাবের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভ দানা বাঁধে। তাছাড়া নারীদের বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় অসূর্যস্পর্শ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হত। অন্যদিকে শহরের উৎপত্তির পাশাপাশি পতিতাদেরও উদ্ভব ঘটে। অথচ ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মতে তারা ঘৃণ্য হিসাবে নির্দেশায়িত। ফলে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সূচনাপর্ব থেকেই ভারতবর্ষে ধর্মীয় আলোড়নের সঞ্চার ঘটে।

অবলোকিতেশ্বর গৌতম প্রবর্তিত উপদেশাবলী সমগ্র ভারতবর্ষের পাশাপাশি এশিয়ার নানান প্রান্তে বিস্তৃত হয়। ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের বিপরীতে অহিংস ও সহিষ্ণুতার বাণী বর্ণ-মত নির্বিশেষে ভারতীয় জনমানসে গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথের অভিমত অনুসারে, ‘ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড়ো করিয়াছিলেন। তিনি জাতি মানেন নাই, যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়াছিলেন, দেবতাকে মানুষের লক্ষ হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন। তিনি মানুষের আত্মশক্তি প্রচার করিয়া করিয়াছিলেন। দয়া এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ হইতে প্রার্থনা করেন নাই, মানুষের অন্তর হইতে তাহা তিনি আহ্বান করিয়াছিলেন।”

পালি ভাষায় কথিত বুদ্ধ-বাণী ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘ত্রিপিটক’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়। বৌদ্ধ-শাস্ত্রটি ত্রি অর্থাৎ তিনটি ‘পাত্র বা ঝুড়ি’তে বিভক্ত; যথা – সূত্ত-পিটক, বিনয় পিটক এবং অভিধর্ম পিটক। যার মধ্যে বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক-তত্ত্বাদি বিবৃত হয়েছে অভিধর্ম পিটকে। বাকি দুটি অংশে জীবনাচরণের প্রতি বুদ্ধের উপদেশাবলী এবং বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভিক্ষুদের পালনীয় বিধিসমূহ এবং সঙ্ঘের নিয়ামাচরণ যথাক্রমে গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছে সূত্ত-পিটক, বিনয় পিটক অংশে। দুঃখ পরিবৃত মানুষকে জরা-ব্যাধি-শোকের সীমানাকে সাধনার মাধ্যমে অতিক্রম করার লক্ষার্থে তথাগত চারটি আর্যসত্য এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রবর্তন করেন। গৌতমের মতানুসারে, একটি ভ্রূণ ভূমিষ্ঠ হওয়ার অনতিবিলম্ব পরেই দুঃখের সূচনা হয়; ‘জন্মের পর থেকে মানুষ একের পর এক দুঃখের জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।’ এই যাত্রাপথ কার্য-কারণ সম্পর্কে আবদ্ধ; ‘রোগ-ব্যাধি-জরা-মৃত্যু এর কারণ হল জন্ম। এই জন্মের জন্যে দায়ী দেহজ কামনা বাসনা।’ অতএব দুঃখের  কারণগুলি নিরোধের মাধ্যমে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। অষ্টমার্গের অনুসরণের ফলে মুক্তিলাভ সম্ভবপর হয়। এই মার্গের অন্তিমাংশে উন্নীত হলে দুঃখের নির্বাণ ঘটে। তখন দেহজ কামনাবাসনা তিরোহিত হয়।

মানবজীবন সম্পর্কে বুদ্ধের মানবতাবাদী আদর্শ অবিভাজিত ভারতের আদি ভূখণ্ডের সীমানা অতিক্রম করে অন্যান্য দেশে বিস্তৃত হয়। মূলত বণিক এবং পরিব্রাজকের মাধ্যমেই এই ধর্মকথা ছড়িয়ে পরে চর্তুদিকে। চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের দরুণ সুদূর চিন দেশেও বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটে। পরবর্তীকালে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ ভারত ভ্রমণ করেন। তার পরমারাধ্যের স্মৃতি আধারিত ভারতভূমির দর্শন এবং জ্ঞানান্বেষোণের উদ্দেশ্যে ১ অগাস্ট ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা করেন। সুদীর্ঘ ১৪ বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। নালন্দা সহ অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার এবং ভারতের নানান প্রদেশের রাজ পণ্ডিতদের কাছে বিদ্যাভাস করেন সাঙ। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে  বহু বৌদ্ধ পান্ডুলিপির চৈনিক অনুবাদ করেন তিনি। এছাড়া বিপদসঙ্কুল চিনদেশের পথ অতিক্রম করে ভারতবর্ষের কাটানো দিনযাপনের কাহিনি ‘সি-ইউ-কাই’ গ্রন্থে বিধৃত করেন হিউ-এন-সাঙ। ফলত একাধারে প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং বুদ্ধাদর্শের পাশাপাশি জ্ঞানপিয়াসী এক মানবের সত্যান্বেষ্ণণের যাপনচিত্রও পরিলক্ষিত হয়।

৬০২ খ্রিস্টাব্দে চীনের প্রদেশে লো-ইয়াং প্রদেশের অন্তর্গত সাং-শেন-পাওকু গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হিউ-এন-সাঙ পারিবারিক সূত্রে বৌদ্ধ ধর্মীবলম্বী ছিলেন তারা।  তার দাদা ছেলেবেলাতেই বৌদ্ধ-শ্রমণ হিসাবে বিহারে চলে যান। দাদার সঙ্গে দেখার করার জন্য  বৌদ্ধ বিহারে যাতায়াত করার মাধ্যমে সেখানকার ধর্মীয় পরিমণ্ডলের প্রতি আকর্ষিত হন তিনি  লোইয়াং বিহারে ১২ বছর বয়সে বৌদ্ধ ভিক্ষুক হিসাবে হিউ-এন-সাঙ জীবনাচরণ শুরু হয় তার সমকালীন চীন সম্রাটের থাই চুং-এর আদেশকে উলঙ্ঘন করে ভারতে যাত্রার উদ্যোগ শুরু করেন বিদ্যাচর্চার উদ্দেশ্যে; কারণ ‘ভারতবর্ষ ভগবান বুদ্ধের দেশ তার ধূলিকণাও পবিত্র।’

চীনের হান বংশের সম্রাট মিন একদা স্বপ্নে এক দিব্য পুরুষ মূর্তি অবলোকন করেন। সেই সময় ভারতবর্ষীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ বুদ্ধমূর্তি সহ চীন দেশে বুদ্ধের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে উপনীত হয়। তাদের মাধ্যমে সম্রাট বুদ্ধমূর্তি দেখে সেখানে তার স্বপ্নের দিব্যমূর্তিটিকে চিহ্নিত করেন এবং  বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে শ্বেতাশ্ব মঠ স্থাপন করেন। পরবর্তী সময় কুমারজীব, গৌতম সংঘদেব, বুদ্ধভদ্র প্রমুখ তথাগতের বাণী চীনের নানান প্রান্তে প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন তারপর ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত সামসি প্রদেশে আর্বিভূত কুৎ অর্থাৎ ফা-হিয়েন অবিকৃত ‘বিনয়পিটক’ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে আসেন। চিনা পরিভাষা অনুযায়ী কয়েক হাজার লি অতিক্রম  করে ভারতবর্ষের আসেন তিনি। তবে এই পথ কেবলমাত্র বন্ধুর নয় তা বিপদ-সংকুল এবং দুর্গম। ফা-হিয়েন কাবুলের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন তারপর প্রায় ১০ বছর ভারতবর্ষে নানা প্রান্তে ভ্রমণ করেন। পালি ভাষায় রচিত বিনয়পিটক আত্মস্থ করার উদ্দেশ্যে ফা-হিয়েন যাত্রা  করেছিলেন বুদ্ধভূমির উদ্দেশ্যে।

কারণ অনুবাদের ভাষায় মূলগ্রন্থের সারবত্তা মেলে না কিংবা তার ভাবানুসারী  কথার প্রক্ষেপ দেখা যায় কারণ দুটি ভিন্ন ভাষার দুটি ভিন্ন ব্যাকরণ রয়েছে পাশাপাশি রয়েছে তাদের শব্দগত অভিধানের পরিধি। ফলে অনুবাদের মাধ্যমে কখনোই কোনো বস্তুকে বা কোনো বৃত্তান্তকে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় অনুবাদক সচেষ্ট হন শুধুমাত্র মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ করার জন্যে; আবার অনেক সময় মূল গ্রন্থের ভাবানুবাদও রচিত হয়। ফলত সংযোজন-বিয়োজনের কার্যকলাপ চলতে থাকে। তাই একটি প্রচ্ছন্ন শিথিলতা রয়েই যায় ফা-হিয়েন সেই শিথিলতা অতিক্রম করে বুদ্ধ-নির্দেশিত ভিক্ষুকদের প্রতি নিয়মাবলী জানতে এবং  তার দেশে সেই নিয়মাবলী জানাতে পালি ও সংস্কৃত ভাষায় শিখেছিলেন তিনি প্রায় তিন বছর পাটুলিপুত্রে তিনি বিনয়পিটক আত্মস্থ করেন।

কারণ বৈদিক সময়কাল থেকেই শ্রুতিধর বিষয়টি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তৎকালীন সময় গুরু তার শিষ্যদের প্রতি বেদকে মৌখিকভাবে বিবরণীর মাধ্যমে তুলে ধরতেন।  শিষ্যরা সেই সকল বিষয়গুলি শ্রুতির মাধ্যমে কন্ঠস্থ করতেন সে কারণে বেদের অপর নাম শ্রুতি বলে অভিহিত বৈদিকযুগের পরবর্তীকালেই বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা হয়তাই বৌদ্ধপন্ডিতদের মধ্যেও শ্রুতিধরের বিষয়টির লক্ষ্য করা যায়। ফা-হিয়েনও সেই প্রথা অনুসারে ‘বিনয়পিটকে’ কন্ঠস্থ করেন। পরবর্তীকালে ৩০ টি দেশ ভ্রমণ করে চীনে প্রত্যাবর্তন করে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ  করেন। সেই লিপিবদ্ধ ইতিহাসের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হন নবীন শ্রমণ হিউ-এন-সাঙ ভারতবর্ষে জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে ধর্মগুরু মাত্র ২৭ বছর বয়সে দুর্গম পামির মালভূমি, গোবি মরুভূমি এবং চীনের সুবিস্তৃত পরিখা অতিক্রম করেন।

সমকালীন চিনের অন্যতম প্রধান প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বরূপে অগ্রগণ্য ছিলেন সাঙ। নবীন বয়সেই  তিনি জগতের অনিত্যতা সম্পর্কে জ্ঞানারোহণ করেন। প্রকৃতির নিয়মশৃঙ্খলাময় চরাচরের মধ্যেই শৃঙ্খলাহীন মানবজীবনের ক্ষণকালীনতাকে উপলদ্ধি করেন; “শুধু মানুষের জীবন, তার মধ্যে কোথাও শৃঙ্খলা নেই। জীবনের যা কিছু স্বাভাবিকতাকে ত্যাগ করে শুধুমাত্র তার পার্থিব কামনায় নিজেকে রিপুর দাস করে তুলেছে। গোটা জীবনটাই তার দুঃখময়। সে ভুলে যায় সব কিছুই ক্ষণিকের। আজ যা আছে কাল তা অবলুপ্ত হয়ে যাবে। তবুও প্রতিমুহূর্তে সেই অনিত্যে মোহের আকর্ষণে ছুটে চলেছে।’’ আর সেই মোহের ধ্যমেই দুঃখময়তা উত্তরোত্তর সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। তাই সুখ অর্থাৎ পরম সত্যের সন্ধানে, নিজের জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে চাঙ-আন বিহারের ধর্মগুরু তার যাত্রা শুরু করেন। পথমধ্যে সর্বাঙ্গীন সঙ্গী কেবল তথাগতের অনির্বচনীয়তা।

পথশ্রম সহ দুর্গম পথরেখার সর্বত্রই মৃত্যুর হাতছানি। চীন সীমান্ত পেরিয়ে দুর্লঙ্ঘ্য হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে বামিয়ানে উপনীত হন হিউ-এন-সাঙ। তার সমগ্র যাত্রাপথের মধ্যে এই অংশটিই দুস্তররূপে বিবৃত করেছেন; তার মতে, “আমার যাত্রাপথে এই পথই ছিল সবচেয়ে কঠিন। মরুভূমির চেয়েও কঠিন। তুষার নদীর চেয়েও ভয়ংকর। সর্বক্ষ্ণ তুষারঝড় বইছে। তার সঙ্গে রয়েছে নানান অশরীরী শক্তির উপদ্রব।” এই বামিয়ান প্রদেশটির অবস্থান অধুনা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে এটি ‘প্রাচীন যে সিল্ক রুট, তারই পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সংযোজন ভূমি।”১০ ইতিহাসের নিরীখে বামিয়ানের গুরুত্ব দ্বিবিধ; প্রথমত বৌদ্ধধর্মের উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান এটি। দীপঙ্কর বুদ্ধের ১৭৫ ফুট উঁচু মূর্তি স্থাপিত হয় বামিয়ানে। যদিও কালের প্রবাহে তালিবানি শাসনে ২০০১ সালে সেই ভাস্কর্যের অবলুপ্তি ঘটে। দ্বিতীয়ত বামিয়ানেই একমাত্র তিন বিদেশীয় জাতির সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলার সমন্বয় দেখা যায়। গ্রিক,তুর্কি, চৈনিক এবং ভারতীয় সংস্কৃতির এমন মেলবন্ধন পৃথিবীর অন্যত্র দেখা যায় না।

ঐতিহ্যমণ্ডিত বামিয়ানের পথ ধরে ভারতের পশ্চিম প্রান্ত অর্থাৎ গান্ধারে উপনীত হন হিউ-এন-সাঙ। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার এই অংশে গ্রিক আধিপত্যের সূচনা হয়। তারপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং পরবর্তী বৌদ্ধ-মতাধারী সম্রাট অশোক গান্ধার শিল্পশৈলীর অনুসরণে সংঘারাম, স্তূপ এবং বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন। কথিত রয়েছে গান্ধারেই বুদ্ধাস্থি সংস্থাপিত করা হয়। অতঃপর ভারতের সুপ্রসিদ্ধ জ্ঞানপীঠ তক্ষশীলা বিহারে কালযাপন করে সাঙ উপনীত হন ভারতের ভূস্বর্গ অবিভক্ত কাশ্মীরে। প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র রূপে কাশ্মীরের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। ভারতীয় আলঙ্কারিক তথা ঔচিত্যবাদের প্রবক্তা আচার্য ক্ষেমেন্দ্র ছিলেন কাশ্মীরীয় পণ্ডিত। সম্রাট অশোকের  সময়কাল থেকে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। কাশ্মীররাজ মহাদুলর্ভবর্মনের সহায়তায় আচার্য ধর্মকীর্তি এবং ২০ জন অনুলিপি লেখকের সাহায্যে শাস্ত্রচর্চা শুরু হয় জ্ঞান-পিয়াসু সাঙের; “পণ্ডিত ধর্মকীর্তি মহা আনন্দে হিউ-এন-সাঙ। যদিও তখন তাঁর বয়স সত্তর। বয়সের ভারে দুর্বল ও কাতর হয়ে পড়েছেন। হিউ-এন-সাঙ-এর মত ছাত্র পেয়ে জ্ঞানদানে কোনো কুন্ঠা নেই। প্রতিদিন সকালে হিউ-এন-সাঙ অভিধর্মকোষ শাস্ত্র পড়েন। দুপুরে অভিধর্ম ন্যায়নুসারে শাস্ত্রপাঠ, রাতের বেলায় তিনি শিক্ষা নিতেন হেতুবিদ্যা শাস্ত্র।’’১১

ক্লান্তিহীন ভাবে বিদ্যাচর্চায় নিবেশিত হয় চৈনিক পথযাত্রীর মন। দুই মাস কাশ্মীরে বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ করে তোষাসন বিহারে ত্রিপিটক বিশেষজ্ঞ আচার্য বিনীতপ্রভ মহাশয়ের কাছে সুদীর্ঘ চোদ্দো মাসব্যাপী ‘অভিধর্ম সমুচ্চয় ব্যাখ্যা’ এবং ‘অভিধর্ম প্রকরণ শাসন শাস্ত্র’ অধ্যয়ন করেন। ইতিহাসের পথরেখা অনুসরণ করে আমরা পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ-এর যাত্রাপথের কালপঞ্জি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারি। অথচ সাহিত্য তার সুনিপুণ চারুত্বে সেই কাল্পপঞ্জির প্রচ্ছন্নতায় নিবিষ্ট ‘সত্যের’ সন্ধান দেয় আমাদের। গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলের মতে যা ‘কাব্যের সত্য ইতিহাসের তথ্য’ রূপে পরিচিত। মানবীয় আবেগ কিংবা তার অনুভূতির সম্মীলন বা জনশ্রুতির আধারে ইতিহাস রচিত হয় না। ইতিহাসের ব্যাপ্তি নির্দিষ্ট হয় কার্য-কারণ-যুক্তি-বাস্তবতাকে আধেয় করে। সাহিত্যিকরা তাই সেই যুক্তি পরম্পরার বেড়াজালে আবদ্ধ মানবীয় কাহিনিকে বিধৃত করেন সাহিত্যে। কথাসাহিত্যিক চঞ্চলকুমার ঘোষ প্রণীত ‘অমৃত পান্থ’ সেই ধারারই অনুসারী।

ইতিহাসের কালগাথা অনুসারে থানেশ্বরের অধিপতি হর্ষবর্ধনের রাজধানী কনৌজ তথা উত্তরভারতের প্রাণকেন্দ্রে কালযাপন করেন ভারতপথিক সাঙ। ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত কনৌজ ধর্মসম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। আঠারো দিন ব্যাপী এই সভায় বৌদ্ধদর্শনের তত্ত্বাদি আলোচিত হয়। তারপর কীভাবে পরম সত্যের অন্বেষণ কীভাবে করেছিলেন তিনি কিংবা কীরূপে পান্থের জ্ঞান-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়েছিল সেই পরিচয় সাহিত্যের আঙিনায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। গৌতমের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্ম হীনযান, মহাযান নামক কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়।

বুদ্ধের বাণী সকলক্ষেত্রেই সার-সত্য হিসাবে গৃহীত হলেও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে পৃথকতা দেখা যায়। হিউ-এন-সাঙ এই সকল বিষয়গুলি সম্পর্কেই ধারণা লাভ করেন। তোষাসনের পরে হরিদ্বার অঞ্চলে ত্রিপটক বিশেষজ্ঞ জয়গুপ্তের কাছে সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়ের বিভাষাশাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করেন। শাস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি শাক্যবংশের রাজধানী কপিলাবস্তু, লুম্বিনী সহ কুশীনগরে ভ্রমণ করেন। এই কুশীনগরেই পরিনির্বাণ লাভ করেন তথাগত। জন্ম-মৃত্যুর যাত্রায় আবদ্ধ মানবজীবন সম্পর্কে ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বুদ্ধের অন্তিমতম উপদেশ কুশীনগরেরই বিবৃত হয়;

‘জীবন হল এক যাত্রা

মৃত্যু হল জীবনে ফেরা,

এ বিশ্ব যেন এক পান্থশালা

বহতা বাতাস যেন এক ধূলিকণা

মনে রেখো জগৎ মায়াময়,

ভোরের শুকতারা সম পুবে মিলায়

গ্রীষ্মের আকাশে যেন বিদ্যুতের চমক

এ জীবন এক কম্পমান শিখা,

শুধু এক স্বপ্ন।”১২

মানবজীবনের প্রধানতম সারকথা বুদ্ধের অন্তিমকথায় নির্দেশায়িত হয়েছে। জন্মের পর থেকে বয়ঃকালীন সীমারেখার পাশাপাশি অভিজ্ঞতার আধারে সম্পূর্ণ হয় জীবনযাত্রা। ‘অমরত্বের’ আস্বাদন কেবলমাত্র সৃষ্টি বা কৃষ্টির মাধ্যমেই কালের রেখায় অঙ্গীভূত হয়। কারণ মৃত্যু মানুষের জীবনের অন্তিম পরিণতি। তাই মায়াময় বিশ্ব সংসারে মানুষের জীবনপ্রবাহ স্বপ্নসম একটি পথের প্রতীকায়িত রূপেরই নামান্তর। যা সর্বশ্রেষ্ঠ জীবে জীবদ্দশার অমোঘ সত্যকে উদ্ভাসিত করে। মহিমান্বিত কুশীনগরের পর বৈশালী নগর থেকে ‘বোধিসত্ত্বপিটক’ গ্রন্থ সংগ্রহ করে মগধ এবং পরবর্তীকালে নালন্দা সহ বুদ্ধগয়া, রাজগৃহের নানা স্থান দর্শন করে ভারত পরিক্রমায় অগ্রসর হন পরিব্রাজক সাঙ। ভারতের পূর্ব দিক বরাবর বিহারের মুঙ্গের হয়ে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ নগরে উপনীত হন। সেখান থেকে প্রাচীন তাম্রলিপ্তবন্দর আসেন। পূর্বজ পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের যাত্রা রূপনারায়ণ তীরবর্তী এই বন্দরেই সমাপ্ত হয়। তারপর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলার এই প্রাচীন বন্দরের পাশাপাশি সংলগ্ন জনবসতির পরিচয় মেলে হিউ-এন-সাঙ-এর বৃত্তান্তে; ; ‘এলাকাটি গ্রীষ্মপ্রধান। এখানে প্রচুর ফলমূল শস্য জন্মায়। লোকজন পরিশ্রমী। দশটি সংঘারামে প্রায় এক হাজার ভিক্ষু শ্রমণ বাস করেন। নগরে প্রায় দুশো ফুট উঁচু একটি স্তূপ রয়েছে। বন্দর গড়ে ওঠায় প্রচুর সম্পদ রয়েছে নগরে।’’১৩

তারপর ভারতের দক্ষিণদিকে যাত্রা করেন চৈনিক পান্থ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর পর পল্লবদেশে যান তিনি। সেখানে সিংহলীয় বৌদ্ধিকদের কাছ থেকে স্থবিরবাদী ত্রিপিটক সম্পর্কে অবহিত হন তিনি। অবশেষে মালব প্রদেশের মাধ্যমে হিউ-এন-সাঙ-এর ভারত পরিক্রমা সমাপ্ত হয়। সমগ্র পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত পরিভ্রমণের পাশাপাশি শাস্ত্রচর্চা এবং পুথি-পত্রাদি সংগ্রহ করেন তিনি। যার মধ্যে অধিকাংশ পুথির মূলাংশ অবলুপ্ত হয়, প্রামাণ্য নির্দশনরূপে হিউ-এন-সাঙ বিরচিত অনুবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ ধরে নিঃসঙ্গ একাকী যাত্রার মাধ্যমে পরামাঙ্খিত সত্যের পাশাপাশি বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ভারতবর্ষকে একটি সূত্রাকারে গ্রন্থন করেন ভারতপথিক হিউ-এন-সাঙ। প্রখর, প্রবল শক্তিশালী পরাক্রমীদের সমান্তরালে ‘অমর’ অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। পরম করুণা এবং প্রেমের মাধ্যমেই সর্ব ধর্মের সম্প্রদায়ের কাছে গৃহীত হয় তার মতামত। পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণ সেই ধারায় অঙ্গীভূত হন। আসলে ‘প্রেম’ বিশ্বমানবকে জয়ের প্রধানতম উপাধান। কোনোরকম হাতিয়ার কিংবা অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার কিংবা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ঈর্ষা বা দ্বেষের যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, তার করালগ্রাসে মানবতা ধ্বংস হয়। সভ্যতার প্রতি হিংসার কলতান মুখরিত হয়। আর সেই জন্যেই চেঙ্গিস খানের মতো প্রবল শক্তিমানরাও অনন্তকালের চক্রে বিলীন হয়ে যান; “অথচ বুদ্ধ, যীশু, নানক, শংকর, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ-তাঁরা তো কেউ শক্তিমান ছিলেন না। ছিল না রাজত্ব, সৈন্যদল। তাঁরা শুধু প্রেমের শক্তিতে বিশ্বমানবকে জয় করে নিলেন অনন্তকালের জন্যে।’’১৪

ঐতিহাসিক দীনেশ্চন্দ্র সরকারের মতে, ‘ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ও আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে গৌতম বুদ্ধ প্রথম সার্থক প্রতিবাদ জানান এবং ভারতের জনজীবন ও চিন্তাজগতে নতুন পথের সন্ধান দেন।’’১৫ ‘মানবতার’ প্রথম জয়গাথা ঘোষিত হয় পরমকারুণ্য এবং মানবপ্রেমের মাধ্যমে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ তার আরাধ্যের সেই প্রেমময়তাকে সঙ্গী করে দুস্তর মরভূমি, বরফের প্রান্তর অতিক্রম করে নৈরঞ্জনা নদীতীরে বোধিবৃক্ষ থেকে তথাগতের পার্থিব জীবনের অন্তিম বাসস্থানটিও দর্শন করেন। পরিপূর্ণ হয় তার পরামাঙ্খা। হিউ-এন-সাঙ-এর এই পরিক্রমার সূত্রে প্রাচীন ভারতের একটি সুনির্দেশিত রূপ প্রতিফলিত হয় জনসমক্ষে।

 

তথ্যসূত্র

 

১) ঘোষ, চঞ্চলকুমার, ‘অমৃতপান্থ’, কলকাতা : পারুল প্রকাশনী, পৃ ৭৩

২) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘বুদ্ধদেব’, কলকাতা : বিশ্বভারতী, পৃ ৩৫

৩) মুখোপাধ্যায়, জীবন, ‘স্বদেশ, সভ্যতা ও বিশ্ব’, কলকাতা : শ্রীধর পাবলিশার্স, পৃ ৪৪

৪) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘বুদ্ধদেব’, কলকাতা : বিশ্বভারতী, পৃ ৪৮

৫) ঘোষ, চঞ্চলকুমার, ‘অমৃতপান্থ’, কলকাতা : পারুল প্রকাশনী, পৃ ৯৭

৬) তদেব, পৃ ৯৭

৭) তদেব, পৃ ৩৩

৮) তদেব, পৃ ৩০

৯) তদেব, পৃ ১৩৮

১০) তদেব, পৃ ১৪০

১১) তদেব, পৃ ১৭০

১২) তদেব, পৃ ২৩৫

১৩) তদেব, পৃ ৩০৯

১৪) তদেব, পৃ ১২৭

১৫) মুখোপাধ্যায়, জীবন, ‘স্বদেশ, সভ্যতা ও বিশ্ব’, কলকাতা : শ্রীধর পাবলিশার্স, পৃ ৪৪

1.