কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

অদিতি ফাল্গুনী




সমকালীন ছোটগল্প



জোসেফ কে-র যে গল্পগুলো কোনোদিন কাফকা লেখেন নি



(২)


জোসেফ কে-র আর একটি সকাল

তখন জোসেফ কে আগের দুপুরে পুরনো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে পদত্যাগপত্র জমা  দিয়ে আর নতুন কোম্পানীতে কাজ শুরুর মধ্যবর্তী একমাস সময় ছুটিতে খানিকটা লিখতে পারবেন এটা ভেবে সকালে খানিকটা সময় দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন। জানালা থেকে তাকিয়ে দ্যাখেন সোনিয়া ঠিক প্রতিদিনের অভ্যাস মতো তার নীল স্কার্ট-ব্লাউজে রাস্তায় নেমে পড়েছে। মাথায় হ্যাট আর হাতে ছাতা। ছুটে যাবেন নিচে? কি বলে ক্ষমা চাইবেন? হ্যাঁ, একথা সত্যি যে জোয়া দ্যুনিয়েভস্কায়ার মুখে একবার পৃথিবী বদলানোর রূপকথা শুনে আমি অনেকদিন মেয়েটিকে নিয়ে অবসেসড থেকেছি। কিন্ত সে-ই কিনা দেখা দিল সবচেয়ে বড় ইহুদি-বিদ্বেষী হিসেবে? যে কিনা শুধু আমি ইহুদি বলেই ভাবত যে আমি লম্পট ও দুশ্চরিত্র হতে বাধ্য? ওর চেয়ে ক্যাপিট্যালিস্ট নাতালী যে আমার লেখার প্রশংসা করেছিল বটে এবং প্রাগের অনেকে এখনো ভাবে লিবারেল ফরাসিনী নাতালীর সাথে আমি সব ধরনের  সম্পর্কেই গেছিলাম... শুধু নাতালী ও আমি জানি যে ঘটনার পাকচক্রে বা যেভাবেই হোক... তার সাথে আমার হাত ধরাও হয়নি... তা’ ক্যাপিট্যালিস্ট নাতালী ও পরবর্তী সময়ে এক মার্কিনী ধনকুবেরের স্ত্রী ও তার সন্তানের মা-ও ইন ফ্যাক্ট জোয়ার মাত্রার ইহুদি-বিদ্বেষী নয়। আর এই যে মহা সুন্দরী মাদাম পোপোভা... দু’দিন চুপ থাকে আবার গত চারদিনে চার ঝুড়ি ফুল আর আমার চারটা স্কেচ এঁকে পাঠিয়েছে... যদিও আমি, জোসেফ কে, তেমন সুদর্শন না আর ইহুদি এবং ক্ষয় কাশি আছে আমার যা সবাইকে বলেও বেড়াই... আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়েওছিলাম। কিন্ত পোপোভা যত রূপসী হোক আর যত ভাল ছবি আঁকিয়ে হোক... ফুলের ঝুড়িতে চতুরা নারীটি আবার আমার স্কেচের সাথে তার পুত্র-কন্যার সাথে নিজের একটি ফ্যামিলি পোর্ট্রেটও এঁকে দিয়েছে। ওরে চতুরা রে... ফ্লার্ট করতে চায় তবে কুল-মান সব রক্ষা করবে! আজ সকালে আবার ওর পরিচারিকা ফুলের ঝুড়ি নিয়ে এসেছে ত’ ভাগিয়ে দিলাম। এখন সোনিয়া... ফিরে এসেছি সোনিয়া... ফিরতে চাচ্ছি... আমি কোনদিনই এই ইহুদি পাড়া থেকে দূরে যেতে পারিনি। এখানেই ছিলাম। প্রাগের ক্রিশ্চিয়ান সমাজ যত তার সব মোহময় প্রলোভনে আমাকে ডাকুক... এই সিনাগগ, এই রাব্বির বাড়ি, এই তালমুদের উপর ঝুঁকে থাকা ইহুদি শিশুরা আর তুমি সোনিয়া... বহু কাল তোমাকে প্রতীক্ষারত রেখেছি... মানসিক বিচলন হয়েছে বারবার... তবু শেষপর্যন্ত আমি ইহুদিই... চির অভিশপ্ত চির নির্বাসিত... এই সিনাগগ আর এই ইহুদি পাড়া ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারি না।


(৩)


জোসেফ কে ও প্রাগের বিস্তারিত দিনলিপি:

মাদমোয়াজেল নাতালী... থুক্কু... মাদাম নাতালী কি এখন প্রাগে এসেছে আবার? মার্কিনী ধনকুবেরকে বিয়ে করার পর সে আর ‘মাদমোয়াজেল’ ত’ নেই... মাদাম বলতে হবে তাকে। প্রাগের কিছু সাহিত্যসভায় সে ঘুরছে বলে খবর আসছে  কানে। আচ্ছা - নাতালী কি সত্যি তার প্রেমে পড়েছিল যেমনটা সবাই ভেবেছিল প্রাগে? অনেক আগে? জোসেফ কে একটি মাঝারি উচ্চতার, হ্যাংলা-পাতলা যুবক। ক্ষয়কাশীর রোগী তাতে ইহুদি। নাতালী তার প্রেমেই বা পড়বে কেন? তবে নাতালী তার একটি গল্পের পাঠ শুনে উচ্ছসিতভাবে কে-র লেখা ফ্লবেয়ার ও বালজাকের মাপের বলার পর থেকেই প্রাগের সাহিত্য সমাজে বের হওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছিল কে-র। ‘নাতালীর সাথে কেমন চলছে, ভায়া?’ ‘নাতালীর সাথে এনগেজমেন্টের ঘোষণা দিচ্ছ কবে?’ ‘নাতালীকে কবে বিয়ে করছো?’ অবাক হত কে। আরে, কে যে ইহুদি আর নাতালী যে ক্রিশ্চিয়ান এটাই দেখি এরা সবাই ভুলে আছে। এদিকে কে-র বাসায় বয়স্কদের মাথায় হাত। 

‘তোমার মেজ কাজিন দিমিত্রফ তা-ও যদি কোন মহাসুন্দরী ক্রিশ্চিয়ান মেয়ের প্রেমে পড়ত ত’ কথা ছিল। অমন একটা মেয়ের ভেতর কি পেল কে জানে! এত  বছর তার জন্য অপেক্ষা করার পর উল্টো সে মেয়েই আর এক ইহুদি ছোকরাকে বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে। আর এই নাতালী শুনছি সুন্দরী - তোমাকে বালজাক বলছে? মতলব কি শুনি? তোমাকে ক্রিশ্চিয়ান বানাবে?’

চিরদিনের মেগালোম্যানিয়াক কাজিন দিমিত্রফ কেন ক্রিশ্চিয়ান অসংখ্য সুন্দরী বা ইহুদি পাড়ারই আরো কিছু সুন্দরীকে ছেড়ে ঐ ছেলেটিকে পছন্দ করেছিল তা’ একমাত্র কে-ই জানে। দিমিত্রফ তার জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের মানুষের কাছ থেকে কুকুরের মত ভক্তি ও আনুগত্য চায় যেটা ঐ ক্রিশ্চিয়ান মেয়েটি দিয়েছিল। ঐ পরিমাণ ভক্তি ও আনুগত্য আসলেই কঠিন। বেচারা দিমিত্রফ! সে সবার কাছ থেকে কঠিন ভক্তি ও আনুগত্য চায় এবং একসময় সবাই তার সাথে বিদ্রোহ করে। পরিবার-পরিজন-বন্ধু-প্রেমাষ্পদ... সবাই।
‘বালো - এই নাতালী তোমাকে ফ্লবেয়ার বলেছে কেন? কি মতলব তার?’
‘আমি কি করে বলব তার কি মতলব? সে আমাকে বালজাক কেন বললো তাই ত’ জানি না!’
তো তো করে বলেছিল জোসেফ কে। সত্যিই সে জানত না। তবে মনে মনে সে খুশি হয়েছিল নাতালী তার ‘প্রতিভা’কে বুঝতে পেরেছে বলে। তার চেহারা দেখে নাতালী মুগ্ধ হবে কেন? সে কি এমন হাতি-ঘোড়া? আরে দূর... নাতালী তার প্রেমে পড়বে কেন? স্বর্ণকেশী, সুন্দরী নাতালী? নাতালীর সেই মন্তব্যের পর রাস্তায় দেখা হয়েছিল তার সোনিয়ার সাথেও। তারা দু’জনেই তখন ২৭/২৮। কে ত’ চাইলে সোনিয়াকে বিয়ে করতেই পারে। কিন্ত ঘর-সংসার-বাচ্চা-কাচ্চা... ওহ, এখনি নয় হে জিহোভা... এখনি নয়! সোনিয়া মৃদু হাসলো। দু/চার কথার পর মৃদু ভাবে জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা - মাদমোয়াজেল নাতালী তোমাকে নিয়ে এভাবে বললো কেন? ওনাকে ত’ চিনি। আমাদের মেয়েদের কনভেন্টে এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তারপর বহু বছর পারিতে ছিলেন। ওনার বাবা চেক আর মা ফরাসিনী কিনা!’
‘কি বলেছে? দূর!’

সোনিয়া তাকে সহজে ছেড়ে দিলেও জোয়া দ্যুনিয়েভস্কায়া তাকে অত সহজে ছেড়ে দেয়নি। জোয়া সেই একমাত্র ক্রিশ্চিয়ান মেয়ে যার জন্য জায়োনিস্ট জোসেফ কে-ও বাস্তবিক ভেতরে ভেতরে স্পন্দিত হয়েছিল। দীর্ঘাঙ্গিনী, রুশ হলেও একটু তামাটে ধাঁচের ত্বক, কোঁকড়া কালো চুলের যত অবাধ্য অলক আর গাঢ় স্বপ্নালু দুই চোখের জোয়া এক সন্ধ্যায় তার সামনে সহসা লজ্জায় বহুক্ষণ অবনতমুখী থাকার পর থেকেই কে-কে দেখলে এড়ায়। কিন্তু নাতালীকে নিয়ে  সে প্রাগের এক ফুলের দোকানের সামনে খুব বিরক্তির সাথে ভ্রু কুঁচকায়, ‘ঐ মেয়েটার নাম যেন কি যে আপনার লেখাকে বালজাকের লেখার সাথে তুলনা করলো?’
আরে জোয়াই না কয়েকদিন আগে নাতালী ড্যুরখেইম নামে এক সাহিত্যবোদ্ধা নারী প্রাগে এসেছে বলে খুব প্রশংসা করছিল? আর এখন নামই মনে করতে পারছে না?
‘নাতালী ড্যুরখেইম।’
‘বাহ্- নাম দেখি মুখস্থ?’

নাতালী কার কাছ থেকে যেন কে-র ফোন নম্বর নিয়ে তাকে ফোন করে, একটি সাহিত্য পত্রিকার জন্য লেখা যায়... মায়ের দিক থেকে মোপ্যাসাঁর নাতনী নাতলী। কে লেখা দিয়েওছিল। স্বর্ণকেশী নাতালী সুন্দরী। তবে মোপ্যাঁসার নাতনী প্রাগের এক অখ্যাত, অসুস্থ ইহুদি যুবকের প্রেমে পড়বে কেন আর নির্বোধ প্রাগের লোকরা এটা নিয়ে লেবু কচলাচ্ছে কেন সেটা বোঝা তার পক্ষে কঠিন ছিল। মোপ্যাঁসার নাতনী তার লেখার প্রশংসা করেছে - এতেই সে ধন্য। কিন্ত জোয়ার স্বপ্নালু দুই চোখ আর ইহুদি পাড়ার সোনিয়া - কে তার আরাধ্যা হবে সে বুঝে উঠতে পারে না। জোয়া ইদানীং তার সাথে খুবই মন্দ ব্যবহার করছে। কমন প্লেসে দেখা হলে কথাও বলে না। মেজো কাজিন দিমিত্রফ প্রায়ই ঠাট্টা করে, ‘নাতালীর সাথে কত দূর কি হলো?’
হ্যাঁ - কল্পনার নাগালের বাইরের নাতালীকে নিয়ে মানুষের মুখে শুনতে শুনতে আর জোয়ার রূঢ় আচরণ ও সোনিয়ার নিস্পৃহতা (সেজন্য কে নিজেই দায়ি- সাহিত্যিক বাসনায় মেয়েটিকে কোন ভরসাই সে দেয়নি- শুধু পিছাচ্ছে আর ঘোরাচ্ছে) তাকে বছর খানেক পরে নাতালীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করবে। তবে, ততদিনে বাস্তববাদী নাতালীর কাছে তার মার্কিনী ধনকুবের প্রেমিক চলে এসেছে আর নাতালী বিয়ে করে নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছে।
‘আমার হয়তো আর লেখা হবে না। নিউইয়র্কের আবহাওয়া আমার লেখার জন্য কোনদিন অনুকূল ছিল না- হয়ওনি।’
‘ওহ্’- ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া জোসেফ কে বলেছিল।

পৃথিবীর সবার কাছেই জোয়া বলে যে কে নাকি লম্পট। কেন জোয়া? এখন নিজেই ত’ এক বিবাহিত ভদ্রলোকের সাথে প্রেম করছো? তবে ভদ্রলোক সুদর্শন, বিত্তবান, ক্রিশ্চিয়ান সব ঠিক আছে। অবশ্য প্রেম করছেই যে বা করলেও কত দূর কে ত’ জানে না। এক টেবিলে বসে কফি বা শ্যাম্পেন পান করলেই শয্যা এক হয়েছে এমন বাজে ভাবনা কে অন্তত: ভাবে না। যদিও জোয়া ভেবেছে। আচ্ছা - জোয়া কি ইহুদি বলেই তাকে দুশ্চরিত্র ভাবে? হতে পারে। মাঝখানে কে একজন বললো যে কে-র উদাসীনতার প্রতিশোধ নিতে সোনিয়াও নাকি এক ক্রিশ্চিয়ান যুবকের সাথে জড়িয়েছিল এবং সম্পর্কটা দৈহিক ছিল। এটা শুনেও ক্ষোভ হয়নি কে-র। তার একাধিক মানসিক বিচলনের প্রতিশোধে সোনিয়ার একটি দৈহিক বিচলনে সে রাগ করবে কেন? তবু দিন শেষে সোনিয়াকে একাই দেখা যায়। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে একটি মার্কিনী মেয়ে এসে দিব্যি ক’দিন অফিসের পরিসরে যতটা সম্ভব কে-র সাথে হাল্কা ফ্লার্ট করে আবার একদিন চাকরি ছেড়ে চলেও গেল নিজ দেশে। তার বর তাকে তলব করেছে। তার ওপর কয়েক বছর শুধুই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর হাড়ভাঙ্গা কাজ আর রাতে পান্ডুলিপি নিয়ে বসা কে-র সাথে গত বছর পরিচয় হলো মাদাম পোপোভার যা গত একমাসে হুট করে একটা বাঁক নেয় গতানুগতিক, সাধারণ ভদ্রতার পরিচয় থেকে। ভয়ানক রূপসী পোপোভা ছবি ও ফুল পাঠায় আবার পরক্ষণেই দূরালাপনীতে ছেলে সেরিওজার হাম হবে কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে। নিকুচি করি তোর প্রেমের হতচ্ছাড়ি! আর সোনিয়া- সোনিয়া যদি ইহজীবনে তাকে বিশ্বাস না-ও করে... কে যে বাস্তবিকই আজো ব্যাচেলর এটা যদি কেউ বিশ্বাস না-ও করে... হয়তো ব্যাচেলর থাকা তার হত না... ২৮/২৯-এর সেই দূর্দমনীয় সময়টাতেই সে নাতালী ও জোয়া দু’জন নারীর আগ্রহের মাঝে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছিল… নাতালী কি সত্যি প্রেমে পড়েছিল তার? জোয়াকে নিয়ে আচ্ছন্ন কে বোঝেনি। জোয়া তাকে সন্দেহ করেছে শুধু। নাতালী চলে গেল নিউইয়র্ক। সোনিয়া অমন একা। জোয়া ও নাতালী- দুই নারীর কেউই তাকে বোঝে নি হয়তো, সে-ও নিজেকে বোঝাতে পারেনি। আর জোয়া তাকে লম্পট ও দুশ্চরিত্র ভেবেছে বলেই গত তিন/চার বছর সে টানা চেষ্টা করেছে জোয়ার ভুল ভাঙ্গানোর। কিন্তÍ জোয়া মারাত্মক রকম সন্দেহবাতিকগ্রস্থ। ঠিক আছে, থাকুক সে তার ভুল বোঝা নিয়ে। গত চার বছরে কে-ও কম তিক্ত হয়নি। জোয়া ও নাতালী আবার সোনিয়া... এই যাবতীয় ছায়ার পাখিদের নিয়ে না ভেবে সে বরং পতিতা গমন করলেও পারত। নিদেনপক্ষে বাড়ির পরিচারিকাদের সাথে কিছু। যাক গে... সোনিয়া যদি তাকে ক্ষমা না করে? না করুক... পান্ডুলিপি আর উচ্চাশা ছাড়া কি-ই বা আছে ভগ্নস্বাস্থ্য, চির অকৃতদার, ইহুদি যোসেফ কে-র?








0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন