কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

মৌলীনাথ গোস্বামী



কবিতার কালিমাটি ১০০


শিমলা - ঘুম ভাঙানিয়া

আরও এক সকালের সংকেত 
উঠে আসে জানালার পাশে
পরিচিত পড়শি আকাশ
পুবের পাহাড় বেয়ে ঘুম ভেঙে নেমে আসে সে

সারারাত ধরে তার নিঃসৃত হিম নিঃশ্বাস
নিথর শিশির হয়ে পড়ে আছে
ঘাসেরা সে ফোঁটার কাঙাল...

শুধু ঘাস নয়
ফোঁটার হরিরলুটে ছেয়ে গেছে কার্নিশ-
ঢেউটিন ঢালু ছাদ
টপটপ টপটপ
গাছের পাতার থেকে
  
একমনে পড়ে চলে নেশাতুর একরোখা জল
 

সেই জলে ধুয়ে যায় আকাশের রক্তিম চাদর
আমরা ঘুমিয়ে থাকি
শুয়ে থাকে কুয়াশার মশারির জমাট আদর
ঘুমপুরী পাড়া এক নিঝুম নিঝুম
আজ ভোর
 
কাকভোর - রূপকথাদের মরশুম...

আমরা ঘুমিয়ে থাকি
জিওন কাঠির তরে অপেক্ষা করে থাকি
ঘুমের মরণ হতে
বুঝি বা জাগিয়ে যাবে কোন এক রাজার কুমার!

তখন সকাল হলে
ঘন খড়কুটো ঠাসা ঘুলঘুলি থেকে
মৃদু হেঁকে
আপত্তি ডেকে ওঠে পায়রার সুখী পরিবার
 
এত ওম উষ্ণতা অলস মৌতাত
ওরা ঝেড়ে ফেলে, উঠে যেতে চাইছে না আজ আর

জামরঙা ভেজা পথে বড় বড় শ্বাস টেনে
রোজকার অভ্যাসের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসে
নিজেদের নিঃশ্বাস চিরে চিরে
একমনে হেঁটে যায় একদল ছেলে
একা স্ট্রিটল্যাম্প
তার হলদেটে আলো
চায়ের দোকানঘরে ছাউনির ফাঁকে
মুমূর্ষু সন্তানের মতন নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে
পাকদণ্ডী বেয়ে ওঠে স্যাঁতস্যাঁতে বাতাস
কাচের স্বচ্ছতা ঝাপসা হয়ে আসে
খুলে দিলে জানালার অবারিত দ্বার
ওইপাশে ফুটপাথে ফোটে এক চায়ের দোকান
উনুনের আঁচে ফোটে পোড়ালাগা দুধটির চা-
আসে ঘ্রাণ
জাগে পশমের মত ভালোবাসা...
আর
গরাদের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসে
ডিসেম্বরের উনতিরিশের ভোরের কুয়াশা...




শিমলা - সূত্রধর

টিনের ছাদের থেকে ঠোক্কর খেয়ে
লাফ মেরে রাস্তায় নেমেছে ঈশ্বর
একরাত অনেক শীতের পর
রোদে গোল পিঠ পেতে
শিশিরের ঘন সরোবর
গোলাপের... পাইনের...
পাতা পাপড়ির গায়ে বসে থাকে
নিজেদের শীতঘুমে নিজেরাই ডুবে থাকে!

তারপর
একটা প্রহর থেকে আর এক প্রহর
দিকে দিকে রটে গেলে রোদের খবর
সোনালি ধানের মত
আশীর্বাদের মত
গায়ত্রী মন্ত্র হয়ে জেগে ওঠে শৈল শহর...

অবিরল ধনাঢ্য ফসলের মত
লাল সোয়েটার প'রে স্কুলে যায় হিমাচলি মেয়ে
তাদের রিবনে লাগে
গুঁড়োগুঁড়ো শীতশীত কাঁপনের আদর
কুয়াশার ওই পারে তাহাদের ইশকুল বাড়ি
সেইখানে মেঘের উঠোন...

বাতাসের বই খুলে মোহিনী শোলোক পড়ে মেয়ে
পড়ে জীবনের অবাক অবাক ছবি
পবিত্র অক্ষর
তাদের সবার মনে ছাপ ফেলে রোদ
হৃদয়ের অঙ্কুরে ওম দেয় উষ্ণ ঈশ্বর!


শিমলা - ক্ষণপ্রভা

প্রছন্ন শীতের সকালে
বসে আছি শিমলার মলে
অনেকটা হেঁটে এসে পাকদণ্ডীর পথ
পায়ে পায়ে পাহাড়ের রাস্তায়
দু'কদম দম হারিয়েছে আমারই
দশটা-পাঁচটা এই সমতল হন্যমান হৃদয়
বসে আছি পাইনের নিভৃত ছায়ায়...

পাহাড়ের ঘ্রাণ ভালোবেসে
এইখানে
গোল হয়ে শুয়ে থাকে ময়ালের ঘুম বারোমাস
রাতের দেরাজ খুলে লাফ মেরে
ছটফটে রোদ তবু এসে ছুঁয়ে যায় ঘাস
নিথর কুয়াশা হয়ে জমে থাকে
কত গতরাত, কত রাত্রির হিমনিঃশ্বাস

একখানা গোল্ড-ফ্লেক ধরিয়ে
দিয়ে এক বাদশাহী টান
যখন শুনেছে স্নায়ু মাঘদিন
বাতাসের গিরিখাতে ভোরের আজান

তখন হঠাৎ দেখি-
সোনালি রৌদ্র যেন
যেন তার কাছে কোন পাণ্ডুর পিঙ্গল ব্যঞ্জনা
সাড়ম্বর পা ফেলে
জমাট কুয়াশা ঠেলে
হেঁটে আসে শ্বেতাঙ্গী অঙ্গনা

অনাবিল সাবলীল
ভিনদেশী পোখরাজ-পরী
হলুদ হাওয়ায় ওড়ে আগুনের চুল
গাউন লুটিয়ে আসে ইন্দ্রানী, রাজার কুমারী

লোকে বলে ফিরিঙ্গি নারী
আমি ভাবি বালুচরি শাড়ি
পরালে কেমন হত
কেমন দেখাত
মাথায় ঘোমটা তার, হয়ত বা সামনে আঁচল
নীলাভ চোখের পাড়ে নিটোল কাজল...
হৃদয় যে স্পন্দন হারায়!

সে দেখি আমারই দিকে আসে
ত্রুবাদুর, আমার পাশেই এসে দাঁড়ায়-
মোনালিসা সম মৃদু হাসে
হাতের ইশারা ক'রে ব'লে ওঠে-
"য়ু গট্ ম্যাচেস?"

বালুচরি ডোবে বালুচরে
ভেঙে যায় ভাবনার তাঁত
ঠোঁটের আলিম্পন নরম মায়ায়
একখানি সিগারেট ধরে থাকে
তারপর রাজেন্দ্রাণী টান...

মাচিস ফিরিয়ে দিয়ে "থ্যাংকিউ" ব'লে
স্বপ্নের পরী, সুকুমারী রাজার কুমারী
সুকুমার রোদ্দুরে হেঁটে যায় চ'লে
আমায় একলা ফেলে
শিমলার মলে!


শিমলা – অপরাহ্ন

প্রাচীন শহর অশীতিপর জলসাঘরে
শিমলা দুপুর স্নিকার খোলে রোদের ধারে

মোজায় ভ'রে অনন্ত পথ শীতের শখ
পাহাড় মানেই পা চিরকাল পর্যটক
মফস্বলে সর্ষেদানা ঘুঙুর হলে
মনের তেহাই পায়ের সমে পা মেলালে
পথের ধারে একটুখানি জিরিয়ে নিই
টুপির বুকে শীতের গুঁড়ো মাখিয়ে দিই
বাড়ি ফেরত রোদ সেঁকছে স্কুলব্যাগ
শিমলা মানেই শীতের সঙ্গে হ্যাশট্যাগ
পাহাড়, আমার হাতের মুঠোয় ঘামের বই
সমতলে শীত পোহানোর ঠাণ্ডা কই
পাহাড়, আমি ছাত্র তোমার ইশকুলে
ফিরে আসব পাইন পাতার রোল-কলে
খাতায় খাতায় পাকদণ্ডীর রুল টানা
সেই পথে ছক হারিয়ে যেতে নেই মানা
সব ভ্রমণের শেষ ঠিকানা মাঘের ঘাস
আমার পৌষ মাঘে উজাড় বারোটামাস...



শিমলা – বোধিসত্ত্ব

আরতির ঘণ্টা বাজে...
রক্তশূন্য নগরের মাঝে
সন্ধ্যা ছুঁড়ে ফেলে গোধূলির খোলস
বোধিসত্ত্ব মাধুকরীর বৃত্তি নিয়ে হাঁটে
আঁধার জমাট বাঁধে পাহাড়ের শুখা তল্লাটে
ভেসে আসে অস্পষ্ট সামগান
বৌদ্ধ সংঘ বুঝি-
দিনশেষ করে আবাহন সঙ্গীতে সঙ্গীতে
অথবা হয়ত রাতে, নীল কালো আকাশের মাঠে
শ্রমণে এসেছে যারা, তারা-
রোহিণী বা আরও আরও নিঃশব্দ নক্ষত্রের দল
প্রাঞ্জল হাওয়া
তাহাদের মন্থর স্তব ফেরি করে...
শীত... শীত...
বড় শীত চারিদিকে
একা রাতে কেঁদে ওঠে শৈলশহর!
চোখের সরণী ধ'রে শেষ সীমানায়
রাত থেকে আরও ঘন রাতের জঙ্গলে
জ্বলে
পাহাড়ের গায়ে
টিমটিম আবছায়া হলুদ আলোর তারা-
কে সেখানে বাস করে? ...রাত জাগে কারা?
সেও কি রোহিণী বুঝি-
আমাকে দেখে?
বিষণ্ন তারার হৃদয় সেজে থাকে?
জ্বলে আর জ্ব'লে পুড়ে যায়-
পোড়া ছাই হাতে নিয়ে রাত-পাহাড়ের গায়ে
আমার মুখের ছবি আঁকে...
কাঁদে!
ভেসে আসে তারাদের কান্নার গান...
বোধিসত্ত্ব মাধুকরীর বৃত্তি নিয়ে হাঁটে...


শিমলা - তাপস

হাতে নিয়ে পুরনো বিকেল
হাতে নিয়ে ফুরোনো বিকেল
অতল খাদের পাড়ে
প্রাচীন সন্ত এক এসে বসে
জট পড়া চুলে জ্বলে আগুনের আসন্ন গোধূলি
আলোর আকরে লেখে
ধূসর ধূসরতম সময়ের শ্লোক...
কাদের জন্য?
কারা হাতে তুলে নেয় বিষণ্ন বিকেলের গ্রন্থলোক?
কেউ বুঝি সময়ের পিঠ চাপড়িয়ে বলে-
"ঈশ্বর
আর একটা পরিচ্ছদ হোক!
একপাতা আরও লিখে দাও-
লিখে দাও পাইনের ঘন বন...
তুষারের তারা আর বরফের জ্যোৎস্নাপাত"...
কেউ নয়.... কেউ নয়!
তারা সব ভুলে গেছে
ওক আর জুনিপার গাছের হৃদয় থেকে
কেমন অবাক ক'রে ঝ'রে পড়ে একাকী শিশির...
কুয়াশার সাথে তাহাদের রোজ দেখা হয়
তাহাদের
নালডেহরা থেকে ভেসে আসা দেবদারু হাওয়াদের...
বিস্মরণের শীত এসে লাগে
কেঁপে কেঁপে ওঠে তাই শহরের প্রাচীন হৃদয়!
মৌন সন্ত শুধু বসে থাকে
সময়ের কড়ি গোনে
হাতে নিয়ে পুরনো বিকেল
হাতে নিয়ে ফুরোনো বিকেল...


শিমলা - নিহিত ছায়ার মত...

আমার সময় হল
ফিরে যাব এইবার
এ আমার বানপ্রস্থের অধিকার...
বাতাসের রোমকূপে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফের ভিড়
রাস্তায় হাত ধরে নিরন্ন আলোক
শীত শীত তিমিরবিনাশী
পাইন পাতার থেকে খসে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা পরিত্যক্ত শিশিরেরা-
কে তার একার কান্না সংগোপনে কাঁদে?
একান্ত অনিচ্ছায় পাণ্ডুর সন্ধ্যায়
গোধূলির এলো চুল বাঁধে?-
চুল তার ব্যথানীল শ্যাওলার মত
অতল জলের তলে
অনেক অনেক দিন সমাহিত সমাধির মত ম্লান...
সেইখানে পাইনের বনে
মলিন ঘাগরা ঘষে চকমকি পাথর
কে জ্বালায় কুয়াশার ধোঁয়া, নিহিত ছায়ার মত সকাল সন্ধ্যায়!
আমার সময় হল ঘরে ফেরবার
নগরের কর্ষণকাল আজ যবে শেষ হল প্রায়-
আমার শিরায় আর শাখা প্রশাখায়
জেগে ওঠে দু'টি নদী এক!
...............................................
অবশেষে অনেক ঘুমের পর
জাগে স্রোত
জোয়ারের ঘণ্টা বাজে
আজ ফিরে যাব সেই নদীদের কাছে
তাদের জলের বুকে
মেঘেদের ছায়া কথা কয়
সব ক্লান্তি সব কষ্ট মুছে দেবে
সেই জলে জেগে থাকা পাথরের অনন্ত আশ্রয়
শেষবার সেখানেই শোব
জলেতে ডুবিয়ে পা
পাথরের গায়ে
প্রিয়ার চেয়েও প্রিয় সেই দুই নদী-অমরায়
তারপর নতুন এক সূর্যোদয় হব...



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন