কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৪ |
চঞ্চলা
খুবই শান্ত সাদামাটা মেয়ে।
অথচ অদূরদর্শী মা-বাবা কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই জন্মের আগে থেকেই নাম ঠিক করে রেখেছিলেন, ছেলে
হলে চঞ্চল, মেয়ে হলে চঞ্চলা। নিতান্ত ছেলেবেলায় চঞ্চলা ব্যাপারটা আদৌ বুঝে উঠতে
পারেনি ঠিকই, কিন্তু একটু বড় হতেই, মানে
যখন থেকে তার বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা ইত্যাদি অঙ্কুরিত হতে শুরু করল, তখন থেকেই তার মনে শুরু
হলো দ্বন্দ্ব। একী! তার নামের সঙ্গে তো
তার স্বভাবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সবাই তাকে চঞ্চলা নামে ডাকছে, অথচ
সে বিন্দুমাত্র চঞ্চলতা অনুভব করে না মনে মনে। বরং তার সবকিছুই বড় শান্ত শিষ্ট মৃদু ও নরম। সে
পড়ে আস্তে আস্তে, লেখে আস্তে আস্তে,
চলাফেরায় ধীরলয়, কাজেকর্মে শম্বুকগতি। তাহলে!
বোধোদয়ের প্রথম পর্বে সে ঠিক
করেছিল, চঞ্চলা নাম ধরে কেউ সম্বোধন করলে সে কোনো সাড়া দেবে না। কিন্তু তাতে অন্য
বিপত্তি ঘটল। বারবার ডেকে সাড়া না পাওয়ায় কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করল, কী রে
চঞ্চলা, তোকে এতবার ডাকাডাকি করছি, শুনতে পাচ্ছিস না? কালা হয়ে গেলি নাকি? তাহলে
তো ইএনটি ডাক্তার দেখাতে হয়!
সুতরাং বোধোদয়ের দ্বিতীয়
পর্বে সে ঠিক করল, না এভাবে নয়, বরং তার ভুল নামকরণের ব্যাপারটা সবাইকে চোখে আঙুল
দিয়ে দেখাতে হবে। কীভাবে? এমনিতেই সব কাজে ঢিলেঢালা চঞ্চলা তার কাজের গতি আরও
কমিয়ে দিল। আঠারো মাসে বছরের হিসেব ঠিক করে সে এত শ্লথগতি হয়ে পড়ল যে, সবাই অনুযোগ
করতে লাগল, তুই এত ঠান্ডা হয়ে গেছিস কেন? কোনো কাজই তো দেখছি তোকে দিয়ে হচ্ছে না! তুই একটা কুঁড়ে অকর্মণ্য
হয়ে উঠেছিস! চঞ্চলা বুঝতে পারল, এভাবে সে কাউকে তার উদ্দেশ্য বোঝাতে পারবে না।
এরপরে অর্থাৎ বোধোদয়ের তৃতীয়
পর্বে চঞ্চলা ব্যাপারটা অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য হলো। এত কান্ড করেও যখন তার নামকরণের
সার্থকতা ভুল প্রমাণিত করা গেল না, তখন তা ঠিক প্রমাণ করার জন্য একটা চেষ্টা করে
দেখতেই পারে। এবং ভাবামাত্র সে তার যাবতীয় কাজের বেগ এত বাড়িয়ে দিল যে, সবকিছুই
কেমন লন্ডভন্ড হয়ে যেতে থাকল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দ্রুতবেগে পড়াশোনার পরিণতিতে সবার কানে ধামসা বাজতে লাগল, চায়ের
কাপপ্লেট ধুতে গিয়ে ভেঙেই ফেলল দামী টিসেট, স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টসে
স্লো-সাইকেল রেসে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে লাস্ট পজিশন দখল করল, ইলেভেন ক্লাসে
তিনঘন্টার পরীক্ষার খাতা একঘন্টায় জমা দিল, কিন্তু পরীক্ষক সেই হাতের লেখার
পাঠোদ্ধার করতে পারলেন না।
আর ঠিক এই ক্রিটিক্যাল
মানসিক বিপর্যয়ের দুঃসময়ে তার জীবনের চিত্রনাট্যে উঁকি মারল রাজেশ খান্না।
হরিয়ানার ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তোর ফিজিক্সে তার দাদার সহপাঠী। চঞ্চলার
তখন চঞ্চলযুগ চলছে। একদিন দাদার সঙ্গেই তাদের বাড়িতে এসেছিল। আর প্রথম দর্শনেই
চোখে চোখ রেখে দুজনেই অনুভব করেছিল, কোথায় যেন একটা ভাঙচুর শুরু হলো। সেইসঙ্গে চঞ্চলা
আরও অনুভব করল, তার বাইরের সব চঞ্চলতা স্তিমিত হয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর।
সেখানে এখন নতুন চঞ্চলতার উৎপাত।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন