কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়




সমকালীন ছোটগল্প


মুডচেঞ্চ মোডে ঘুরছে ক্যামেরা



প্রিয় পাঠক, সাতহাত কাঁকুড়ের গল্প চেয়ো না প্লিজ। ধোঁয়ানো এই ঘর। তার  দোলননির্ভর হৃদ্যতা। হৃদিও তো সেই নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। গল্প নয়। দুএকটা দৃশ্য। ক্যামেরা নির্ভর। আলোবাসা বললে বলো, ভালোবাসা বললে বলো, আমি তার ঠিকানা রাখিনি ছবিও আঁকিনি।


দৃশ্য-১

হেমন্তের শূন্য মাঠের ধার। দাদুর কড়ে আঙুল ধরে ছোট্ট ঘটিবুড়ি। সাদা টেপফ্রক। গাঢ় নীলরং ইজের, ফ্রকের ওপর সামান্য আভাস। ক্যামেরা ল্যান্ডস্কেপ মোডে। সময় সদ্য সকাল

-ওই দিকে দেখ দাদু, আকাশটা কেমন মাঠের গায়ে নেমে এসেছে
-হুঁ
-আমি আকাশ ছুঁতে যাচ্ছি দাদু-উ-উ-উ...

ছুটন্ত পা ক্রমশ দূর। ফ্রেম্‌স প্রতি সেকেন্ডে বাড়ছে। ক্রমশ। চলনের গায়ে যেসব রেখা দূর ডাকছে তাদের পায়ে বসছে স্লো মোশান। দূরকে সুদূরের হাতে তুলে দিলে ক্যামেরা কী দেখে? আকাশের চলন লাগা পায়ে এই যে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠছে ছেলেবেলা, তার খবর কোথায় জমা করে? পা ছুটছে... যেদিকে মাটি নেই, আকাশের সাতরং সওয়ার। পা ছুটছে... যেদিকে আলো নেই, আলোবসনার আলোয়ানি ওম। পা ছুটছে... যেখানে প্রকৃতি নেই, নিসর্গের তালবেতাল স্বর্গরচনা। দূরে বহুদূরে... জুম আউট... জুম আউট...
............

দৃশ্য-২

জামরুল গাছের তলায় ছড়ানো জামরুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সুচি আর পটলা। ঘটিহাতা ফ্রকের লাল ঝালর হাঁটুর সামান্য ওপরে। খুশিয়ালে কিশোরীমার সাজ।  স্নেহপ্রবণ চোখ। সময় ঘোর দুপুর। নেপথ্য কাহিনীতে ফোকাস করছে ক্যামেরা। ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট মোড। সুতরাং লাল রঙে কালো বসছে। নেপথ্যের রঙে নয়, অ্যাপার্চার বাড়িয়ে আলোরং খুঁজছে ক্যামেরার চোখ

-এই পট্‌লা চোখের মাথা খেয়েছিস?
-পাকামি না করে যা বলার সিধে বলদিকিনি
-বাগানে ঢোকার আগে তোকে পইপই করে বল্লুম, জামরুল গাছের গুঁড়ির কাছে যাসনি, তুই সেই...
-বেশ করবো যাবো, একশোবার যাবো, তোর তাতে কি?
-যা না যা, ওই গুঁড়িতে ভট্‌চাজকাকিমার পোষা ঢ্যামনাটা থাকে, একবার ছোবল মারলে আর বাপ বলতে হবেনিকো

ক্যামেরার চোখে পর্যাপ্ত হল কি মুহূর্তের এই মোহত্বক? দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর ঢুকে পড়ছে বাড়ানো অ্যাপার্চারে। এত আলো এত মোহ কীভাবে মুঠো ভরে নেবে ক্যামেরার ফিনফিনে ফিল্ম? সে কি ধরে রাখতে পারে জামরুল গাছের গায়ে কখন কীভাবে লটকে যায় পুরনো পৎঝর?
............

দৃশ্য-৩

ক্যামেরা সুচি থেকে ক্রমশ সুচেতনায়। যদিও নিসর্গে সবে গোধূলি, টোল টলানো গালে তাথৈ কৌমুদী। সুকুমার বৃন্তমূলে বায়োস্কোপিক চন্দ্রোদয়। চৌকাঠের ওপারে সুজন। বাউলাঙুলে নিড়েন দিচ্ছে প্রেমজুরি। গেরুয়া উড়নির সঙ্গে তার অফুরান উড়ান। মিহি টান – প্রেমজুরিতে প্রেম বাজে না, প্রেমেতে বাজে প্রেমজুরি ই ই ই...

-প্রেম কি শুধুই অশরীরী সুজন?
-প্রেমজুরির ঝনক্‌ শোনো গো কন্যে
-প্রেম তবে কী দেয় সুজন?
-প্রতিদিনের বাইরে দুএক টুকরো অনিশ্চয়তা
-কিন্তু পরিবর্তে নিশ্চিত কিছু দামও তো সে ধরে, তা পার করি কীকরে?
-পারাপারেই তুমি ব্যক্তি, তোমার রূপের চিনপরিচয় গো

ক্যামেরা তো টাইমমেশিন টানেল নয়, যে নিজের চোখে বসিয়ে নেবে অতীতের সমস্ত রহস্য! অথচ সে রেখাপারের গল্প বলতে চায়। পারাপার কিছুটা ডেপ্‌থ চায়। ক্যামেরা অ্যাপার্চার কমিয়ে ডেপ্‌থ অফ ফিল্ড বাড়ায়। গোধূলি গাঢ় হয়ে আসে। একটা ফিকে অন্ধকার ঘিরে ধরে ক্যামেরাকে। সে নিজের চোখ খুঁজতে থাকে। আলো কমে আসে। ধীরে। খুব ধীরে।
...............

দৃশ্য-৪

ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভাঙছে ক্যামেরা। সিঁড়ি শেষ হয়েছে একটা বারান্দায়। দুপাশে দুটো আরামকেদারা। সুচেতনা আর তার শরীরী প্রেম। আঙুলের অসংযমে অমিতভাষ। কুহুর ইন্দ্রজালে ফেঁসে উঠছে বারান্দা। সময় রাতপ্রহর। নিতান্ত রাত নয়, বিভাবরী

-তোমায় সুচেতনা ডাকলে কেমন যেন সচেতন হয়ে উঠি। নিঃশেষে দিতে কোথায় একটা বাধা
-সু ডাকে নিশ্চিন্ত বোধ করো?
-বোধহয়
-মানুষের নিজস্ব সংজ্ঞাকে মানতে চাওনা?
-তুমি কি শুধুই তোমার নিজস্ব?
-নয়?

-ধরো তোমার চেনা দুঃখের অলিগলিগুলো। কিংবা তোমার চেনা সুখের ফাঁকগুলো
-থামলে যে!
-চেনাগুলোতে হাত রাখলে আঙুলে উঠে আসে শুধু সু, চেতনা ছাড়াইএ সবই কি আমার নয়?
-হ্যাঁ, চেনাগুলো সব তোমার। কিন্তু চেনার বাইরে যেটুকু অচেনা পড়ে রইল সেটুকু তো আমার!

ক্যামেরা শাটার স্পিড বাড়িয়ে দেয়, যাতে দৃশ্যের প্রত্যেকটা বোধ, তাদের সংজ্ঞা নিখুঁত করে ধরে রাখতে পারে। অথচ চেনা দুঃখের চারুকলাগুলো, অচেনা সুখের মণিহারগুলো কেবলই তার আঙুলের ফাঁকে ঝরে যায় কখন, সে জানতেও পারেনা। আসলে সময়ের এই ক্রান্তিরেখা কখনো ধরা দেয় না ক্যামেরার ফ্রেমে। অসীম অনন্ত এই কাল। কোনো রং নেই কোনো ঢং নেই। শুধু বয়ে চলা। তার পায়ে গণ্ডি দেবে কে? দৃশ্য তাকে গাঁথবে কোন ফ্রেমে?
............

দৃশ্য-৫

ব্যাকগ্রাউন্ডে রাতকান্ত পাখিরা পরবর্তী প্রহর ডাকছে। ক্লান্ত হয়ে আসছে কুহু। মধ্যবিত্ত ধমনীর মুখর উচ্ছ্বাস বাকসংযমে। নিটোল পৃথিবী টোল ভাঙছে। একটু একটু করে বেআব্রু। ক্যামেরা জুম ইন হচ্ছে ক্রমশ দেহসম্বন্ধীয় হাঁসুলি থেকে সম্পর্কসূত্রের কাঁকন থেকে গর্ভমূলের নূপুর থেকে। সমস্ত অলঙ্কার খুলে রেখে হোমকুন্ড জ্বালায় সুচেতনা। সময় রাতের শেষ প্রহর। নিসর্গে ঝুলে আছে খুব ঝাপসা এক বোধ। তার নিচে নিশুতি গুনগুন - তখন ছিল বিভাবরী এখন কেবল রাত

-তুমি কি সত্যি বোঝো না সু আমি কী চাই?
-চাওয়া একজীবনে পাওয়া অন্যজীবনে। মাঝের সময়টুকু হাতে থাক নাহয়
-কিন্তু আমি যে সম্পূর্ণ চাই সু
-পূর্ণতা এক ফ্যান্টাসি মাত্র। তরালে তরাতে পারো, নাহলে অষ্টমীর পূর্ণচাঁদ
-অষ্টমী কি পূর্ণিমা জানি না সু, মাতাল চিনেছো কখনো?
-যে চেনাতে শুধু সু থাকে, সেখানে আমাকে পাবে না

ক্যামেরার পাওয়ার ঝুলিতে কী থাকে? শুধুই কিছু দৃশ্য? এই যে জুম ইন করে করে দৃশ্যের গায়ে লেগে থাকা প্রত্যেকটা রেখায় পূর্ণতা কামনা করে, পূর্ণতা কার নাম? সত্যিই কি কোনো দৃশ্যকে সম্পূর্ণ দেখা যায়? সেই মুহূর্তটি প্রকৃতির ঠিক কোন অবস্থানে ঝুলে আছে; আর সেই মুহূর্তে ‘আমি’টি প্রকৃতির সঙ্গে কতটা কৌণিক অবস্থান রচনা করছে; এসবই দৃশ্যটির সঙ্গে এক আন্তর্ক্রিয়ায় মেতে থাকে। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় ‘আমি’র দেখা। হতে পারে ক্যামেরার যান্ত্রিক চোখ স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ মানে না। কিন্তু ‘আমি’র বশ্যতা যে তাকে মানতেই হয়!
.........

দৃশ্য-৬

ভোর নামছে। আস্তে। ধীরে। ক্যামেরা আকাশের গায়ে ফোকাস করতে না পেরে কাছে আসে। সুচেতনার কপালে কালবেলার মৃদু ভাঁজচোখের টানাবোনা এখনো আয়তই বলা যায়। শূন্যের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠে ফেলে আসা ঘটিবুড়িআলতো হাত রাখে খসখসে হাতের পাতায়

-তুই এখনও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিস?
-আমি যে জেনে গেছি আকাশ শূন্যতার আর এক নাম
-কিন্তু শূন্য তো শূন্য নয়, পূর্ণ
-কার নাম পূর্ণতা? খুঁজতে খুঁজতে বেলা যে পড়ে এল

ক্যামেরা কি শূন্যতা দেখতে পায়? সুপার স্ট্রিং-এর বাজানো তরঙ্গায়িত মোডগুলোর নৃত্যভঙ্গিমা এঁকে রাখতে পারে ফিল্মের গায়ে? আসলে দৃশ্যের তো কোনো কথা থাকে না। তরঙ্গ থাকে। যার স্পর্শ এসে লাগে দর্শকের আত্মবৃত্তের স্পর্শক বরাবর। ঘুরে যায়। অবিরাম ঘুরে যায় এক অপরিসীম বৃত্তধর্মে। আর তারই পূর্ণ আর অপূর্ণের মধ্যমায় বসে এইসব দৃশ্য তাদের রেখাপাঠের পাঠশালা খুলে বসে। প্রহরে প্রহরে পরিবর্তিত হতে থাকে তার মেজাজ তার মর্জি। ভ্রম থেকে বিভ্রমে ঘুরে ঘুরে যায় তার ভাব তার মতি। আর ক্যামেরা ক্রমশ ঘুরতে থাকে মুডচেঞ্চ মোডে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন