কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৪ |
পোর্ট্রেট
শুতে যাবার আগে
দেখলাম, তুলি হাতে
চিত্রনিভা স্থির দাঁড়িয়ে। আমার চোখ চিত্রনিভার দিকে। চিত্রনিভার চোখ ক্যানভাসে।
রাত প্রায় তিনটে কুড়ি। আবারও কারো পোর্ট্রেট আঁকা চলছে। সমস্ত মনোযোগ ওর সেখানেই।
ডাকলে সাড়া দেবে না।
চিত্রনিভা, আমার বউ। আমি রূপম ইসলাম। বয়স দু’জনেরই পঁয়ত্রিশ। চিত্রার হাইট পাঁচফুট পাঁচইঞ্চি। ওর এথনিক ধাঁচের চেহারা, বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বের পাশে নিজেকে রীতিমতো বামন লাগে। চিত্রা পোর্ট্রেট
শিল্পী হিসেবে অল্পদিনেই বেশ নাম করেছে।
অনেক ছবির ভিড়ে চিত্রার আঁকা
পোর্ট্রেটকে আলাদা করা যায় সহজেই। ওর আঁকাগুলোর
ঠিক দুটো বৈশিষ্ট্য। প্রথমত পোর্ট্রেটগুলো দেখলেই মনে হবে অত্যন্ত হেঁয়ালিতে যেন ও
রং নিয়ে খেলেছে। দ্বিতীয়ত রং। বার্ন্ট সিয়েনা, এই একটাই শেডের
সাথে সামান্য ক্যাডমিয়াম ইয়ালো এদিক ওদিক করে ও এঁকে ফেলে ছবি। অবয়বগুলো স্পষ্টতা
পেতে পেতে পায় না। ধোঁয়াশায় ভরে থাকে পোর্ট্রেট অথচ প্রতিটি মুখের অভিব্যক্তি
একেবারে আলাদা হয়ে ওঠে। খুব সচেতনভাবে আঁকায় ও ব্যাপারগুলো ঘটায়। তাছাড়া নানা কারণেই
চিত্রা সবার খুব প্রিয়। সুন্দরী, গড়পড়তা বাঙালি নারীদের চাইতে বেশি হাইট, স্মার্ট, মিশুকে। হয়ত এসব মিলিয়েই সবাই তাকে নিজের
মত করে ভালোবেসে ফেলে এককথায় অনন্যা, চিত্রনিভা
ইসলাম। আমার কাছে চিত্রা অবশ্য ওর
আঁকা ছবিগুলোর মতই অস্পষ্ট। সেদিন একটা পার্টিতে চিত্রার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কানে এসেছিল, রাসেল বলছে, আমার টিশার্টের
রংটা আরেকটু গাঢ় হতে পারত। চিত্রা মৃদুমৃদু হাসছিল। মিষ্টি করে রাসেলকে বলছিল, এটা তোরই পোর্ট্রেট তুই শিওর? আমাদের কমন
বন্ধু রমিত, ও এসেছিল যেদিন, সেদিনও হঠাৎ চিত্রার ঘরে ঢুকতে
গিয়ে থমকে যাই, রমিতের কোঁকড়া
চুল ঘেঁটে কী মিষ্টি করে হাসছিল চিত্রা।
এসব দেখলে মনে পড়ে যায়, বছর পাঁচেক আগে
আমি রূপম ইসলামও ওর আঁকা পোর্ট্রেটের সাথে নিজেকে গুলিয়ে ফেলতাম। চিত্রা তখনও
এভাবেই মৃদু হাসত। চুল ঘেঁটে দিত। পরে বোকামোটা টের পেয়েছি। বুঝেছি মানুষ যেসব বাড়িতে থাকে সেখানেও থাকে আলো হাওয়ার
খেলা। এই ফ্ল্যাটটার কথাই ধরা যাক। সেই বার্ন্ট সিয়েনাই। সাথে যোগ হয়েছে ফরেস্ট
গ্রিন, পেল ইয়ালো, কোল ব্ল্যাক।
রংগুলোর ব্যবহারে যে অন্ধকারাচ্ছন্নতা আসার কথা তা না এসে পুরো ফ্ল্যাটটাই বরং
আলোছায়ায় খেলছে। বিশাল বিশাল জানালা-দরজা দিয়ে কতরকম আলো আর হাওয়া আসা যাওয়া করছে। মন কি আর
আলাদা কিছু? কত কুঠুরি আর
কতশত জানালা-দরজা তারও। কেবল একইরকম হাওয়া কেন বইবে সেখানে! অতএব হাওয়া আসুক। আলো
খেলুক। ছায়াও পড়ুক। তবেই না জীবন হবে
অভিজ্ঞান!
ভোর হতে চলেছে।
ডাকলাম। আনমনা খুব। শুনল না। কাছে গিয়ে আলতো হাত রাখলাম কাঁধে। ঘুমোতে যাবে না
বলার বদলে বললাম, নতুন মুখ?
ক্যানভাস ছেড়ে ও
এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলে দিল।
আকাশের রং এখন
বার্ন্ট সিয়েনা। একটু পর ক্যাডমিয়াম ইয়ালো আলো ঝরবে।
চিত্রার ঠোঁটে মৃদুহাসি।
আমার চোখে চোখ রাখল চিত্রা।
-ঈশ্বরের... অথবা একজন মানুষও হতে পারে যে অন্তত পুরুষ নয়...
দারুণ
উত্তরমুছুন