কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

জহর আলি



সমকালীন ছোটগল্প



একটি নতুন গাধার পুরনো সেই গল্প


না, আমার এই কাজটা করা ঠিক হয়নি। ভুল হয়েছিল। অবশ্য জেনে শুনে কোনো অন্যায় কাজ করাকে ভুল কাজ বলা ঠিক কিনা, আমি জানি না। তবে এটাও ঠিক যে, কাজটা করার সময় এতকিছু ভেবে দেখার কথা মাথায় আসেনি। আসলে তখন এত রেগে গেছিলাম যে, ভাবার বা ভেবে দেখার ইচ্ছেও হয়নি। কেননা এর আগে আমার সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছিল, সেটাই আমার মাথায় ছিল এবং অনেকদিন ধরেই তা চলছিল। আমি বুঝতে পেরেও মেনে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের এতদিনের সম্পর্ক, তাই এটুকু ভুল মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু দেখলাম, ভুলটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে অন্যায়ের দিকে যাচ্ছে।  আর তখন আমার মনে হলো, এবার কিছু একটা করা দরকার। কী করব, প্রথমে ভেবে পেলাম না। আমি তো গাধা, লিখতে পড়তে জানি না। তাহলে?

ব্যাপারটা না হয় খুলেই বলি। হ্যাঁ, আমিই সেই ধোপার গাধা যে নুনের বস্তা পিঠে নিয়ে জলে নেমে গেছিল। ছোটবেলা থেকেই ওদের বাড়িতে আছি। দুবেলা খেতে দেওয়ার বদলে সারাদিন খাটায়। কোনো কোনো দিন তো বিশ্রামের একটু সময়ও পাই না। অবশ্য এরকমই হওয়ার কথা, না হলে গাধার খাটুনি কথাটাই আসত না। যাইহোক আমার কাজ হলো কারখানা থেকে নুনের বস্তা পিঠে চাপিয়ে গুদামে পৌঁছানো। মাঝপথে একটা নদী পড়ে। সেতুটা খুব একটা পোক্ত নয়। কাঠের সেতু তো, যাওয়ার সময় একটু নড়বড় করে, তবে যাওয়া যায়। আগে দিনে দুবার যেতে হতো। এখন মালিকের ব্যবসা বেড়েছে। আর তাই গুদামে জমা করা ছাড়াও কখনও কখনও আড়তদারের কাছেও পৌঁছে দিতে হয়।

আর ঠিক এখান থেকেই গন্ডগোলের শুরু। প্রথম কিছুদিন তো তিন-চার, এমনকি পাঁচবারও যেতে হতো সারাদিনে। এমনকি দু’একবার সন্ধ্যের পরেও যেতে হয়েছে। তাতে মালিকের কোনো অসুবিধে ছিল না, কেননা আমি তো মানুষ-শ্রমিক নই যে আমাকে ওভারটাইম দিতে হবে! ব্যবসা যত বাড়ছিল, মালিকের লোভও তত বাড়ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার ওপর কাজের চাপটা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে, মালিক নিশ্চয়ই আরও একটা গাধা কিনবে, আর আমিও তাহলে একজন সাথী পাব। কয়েকদিন পরেই বুঝলাম, মালিকের মতলব  অন্য। যেহেতু পাঁচ-ছ’বারের বেশি আমাকে পাঠানো সম্ভব নয়, তখন আমার পিঠে বেশি ওজন চাপানো শুরু হলো। প্রথম দু’তিনদিন ওজনটা বেশি মনে হলেও চালটা ধরতে পারিনি। ভেবেছিলাম, বোধহয় জরুরি অর্ডার আছে তাই বাড়তি ওজন নিতে হচ্ছে। সেরকম হলে আমি কষ্ট করেও তা মেনে নিতে পারতাম, আর যদি আমাকে জানিয়ে তা করা হতো, তাহলে আরও ভালো  লাগত। কিন্তু মালিকের তো সেই উদ্দেশ্য ছিল না, তাই আমার খুব রাগ হয়ে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম, কীভাবে মালিককে জব্দ করা যায়!

সেদিন ওজন এত বেশি ছিল যে প্রায় চলতেই পারছিলাম না। চারবারের পর পাঁচবারে কারখানা থেকে পিঠে বোঝা নিয়ে বেরোবার সময় বুদ্ধিটা মাথায় এলো। প্রথম থেকেই এমনভাবে খোঁড়াতে লাগলাম, যেন মনে হয়, অতিরিক্ত ওজনের ভারে আমি ঠিকঠাক চলতেই পারছি না। তারপর নদীর সেতুতে উঠেই টলতে টলতে নদীতে পড়ে গেলাম। মালিক চিৎকার করে পেছন থেকে ছুটে এলো, কিন্তু জল থেকে আমাকে ওঠানোর কোনো চেষ্টাই করল না। বরং আমি কী করি তা  লক্ষ্য করছিল। আমি জল থেকে উঠে আসার পর আমাকে নিয়ে কারখানায় ফিরে এলো। অন্যদিন ছোটখাটো কোনো ভুল করলেও বকাবকি করে, লাঠিপেটাও  করে, কিন্তু আজ এতবড় কান্ড ঘটার পরেও একটা কথাও বলল না। আমি তো নিজের জেতার আনন্দে আত্মহারা তখন। অন্য দিকটা ভাবার কথা মাথাতেই আসেনি। আসলে তাহলে তো গাধাই হতাম না আমি।

পরের দিন সকালে বেরোতে হলো না। আমি তো জেতার আনন্দে খুব খুশি। মনে হচ্ছিল, মালিককে ঠিক জব্দ করতে পেরেছি। আর বোধহয় আমাকে দিয়ে এত  কাজ করাবে না! কিন্তু একটু পরেই আমার পিঠে বস্তা চাপানোর কাজ শুরু হয়ে গেল। মনে হলো, মালিক বোধহয় কালকের ব্যাপারটা ভুলে গেছে, যদিও ভোলা এত সহজ নয়, অনেক টাকার ধাক্কা তো! এদিকে আমার পিঠে একে একে বোঝা চাপানো চলতেই থাকল, আর তাতেই আমি বুঝলাম, মালিক কিছুই ভোলেনি। মনে হচ্ছে কালকের থেকেও অনেক বেশি ওজন চাপিয়ে দিয়েছে। আমারও রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ঠিক করলাম, যা হয় হবে, আজও নদীতে লাফ দেব। দেখি, মালিক কী করে তারপর!

খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেতুর ওপর উঠেই নদীতে ঝাঁপ দিলাম। হঠাৎ দেখি, মালিক আর দৌড়েও আসছে না বা চ্যাঁচাচ্ছেও না। দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে আমাকে দেখছে। এরকম তো হবার কথা নয়! তাহলে! হঠাৎ মনে হলো, আমি জল থেকে উঠতেই পারছি না। নুনের বস্তাগুলো জলে ডুবে হাল্কা হবার বদলে আরও যেন ভারী হয়ে গেছে! কী করে এমন হলো কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে মালিক ততক্ষণে আরও কিছুটা কাছে চলে এসেছে। অবাক হয়ে দেখলাম, তার মুখ হাসিতে ভরে গেছে। বুঝলাম, আমাকে জব্দ করার জন্য সে নতুন কোনো কায়দা করেছে। এদিকে পিঠের বোঝা এতটাই ভারী যে যতবার উঠতে চেষ্টা করি, ততবারই পড়ে যাই। আরও অবাক কান্ড, পিঠের বোঝাটা ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছে! কেন এমন হচ্ছে? একসময় মনে হলো, আর বোধহয় উঠতে পারব না  জল থেকে। এখানেই ডুবে মরতে হবে। যাইহোক কী করে যে শেষপর্যন্ত জল থেকে উঠে এসেছিলাম, তা আমিই জানি। জল থেকে উঠে আসার পর মালিক কাছে এসে বস্তাগুলো আমার পিঠ থেকে নামিয়ে নিল। আর তখনই তার খেলাটা বুঝতে পারলাম। আগের দিন আমি ইচ্ছে করে জলে পড়ে গেছিলাম তা মালিক বুঝতে পেরে আজ নুনের বস্তার বদলে আমার পিঠে তুলোর বস্তা চাপিয়ে দিয়েছিল। আমার সত্যি সত্যিই খুব রাগ হয়ে গেল। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমাকে মেনে নিতেই হলো, এই খেলাটায় আমি জিততে পারলাম না, শেষপর্যন্ত মালিকই জিতে গেল; যদিও প্রথম অন্যায়টা আমি করিনি, মালিকই করেছিল।  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন