![]() |
কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৮ |
আলো-অন্ধকার
রাস্তায় নামতেই একটা অপার্থিব আলো দেখল মহেন্দ্র। একটা মেঘভাঙা আলো। এই আলো বড় সাংঘাতিক। তাকে ঘিরে আছে কালো হয়ে আসা মেঘ চক্রবুহ্যের মধ্যে একটি অদ্ভুত আলোর বলয়। লোকজন, অটো আর ফুটপাথের ফেরিওয়ালারা ত্রস্ত হয়ে গুটিয়ে নিচ্ছে সব্জিব্যাগ, সস্তার ছিটের ব্লাউজ। মহেন্দ্র গলিতে পা বাড়ালো। আর মুহূর্তের মধ্যে বিকট আওয়াজে চোখ ঝলসানো আলো। গাছটা থেকে ধোঁয়া উঠছে। আরো দুটো বাজ পড়ল আশপাশে। মহেন্দ্র র শরীরটা এখন পড়ে আছে গাছের তলায়। ঝলসানো গাছ আর ঝলসানো শরীরটা অবিকল এক হয়ে আছে।
ছেঁড়াতার, জল - দূর থেকে লোকজন
বিস্ফারিত হয়ে দেখছে। ছড়িয়ে আছে দুটো মুসাম্বি ফাটা চটের ব্যাগ। সাময়িক হতবুদ্ধি
হয়ে যাওয়া মানুষগুলো ক্রমে বেরিয়ে আসছে গহ্বর থেকে পোকার মতো। শুরু হচ্ছে অল্প গুঞ্জন।
ইছামতি এসবের কিছু টের পেল না।
শ্রাবণমাসে তো বৃষ্টি হবেই। তার আজ শ্রাবণের সোম, উপোস। সে কার জন্য উপোস করে ভেবে
দেখেনি। সকলেই করে। তাই সেও। চল্লিশ বছর বিয়ে হয়েছে মহেন্দ্রর সঙ্গে। ছেলেপুলে হয়নি।
শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ যে যার গন্তব্যে চলে গেছে।শ্বশুর শাশুড়ি ছবিতে ঝুলছে অনেক
বছর হয়ে গেল। দেওর মৈনাক মুম্বাই, ননদ মধুমিতা বোস্টনে। কখনও সখনও ফোন করে সহোদর ভাই
রূপ দিল্লী থেকে বাতের ব্যথায় পঙ্গু, বিপুলা দিদিটিকে।
মহেন্দ্র গেছে পেনশনের টাকা তুলতে।
খাবার ঢাকা দেওয়া আছে টেবিলে। ইছামতি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ভেতর চলে গেলেন সেই পুরনো
দুপুর, মৈনাক সামনে বসে এস্রাজ বাজাচ্ছে, সামনে নবীন বধূ মুগ্ধ হয়ে দেখছে। বিয়ের
পর সদ্য তরুণী ইছামতি কলকল করে বইছে দুই পাড় উপচে। সদ্য যুবক মৈনাক আলোর মতো বাড়িটায়
তার একমাত্র মনের মত সঙ্গী হয়ে উঠল। মহেন্দ্র ব্যাঙ্কে চাকরি করত তারপর ইউনিয়ন অফিস,
আড্ডা সেরে মায়ের সঙ্গে রাতে কথা। গভীর রাতের নরমাংস খাবলা খাবলি ছাড়া আর তেমন কথাবার্তা
বলার যোগ্য মনে করত না বাংলা অনার্স ইছামতিকে। ফিজিক্সএ মাস্টার্স করা বড়ো ছেলেকে
নিয়ে শাশুড়ির গর্ব ছিল খুব।
পাতলা নিদ্রার ঘোরে ইছামতি দেখছেন
জল। সিঁড়ি থেকে পড়তে পড়তে একটা চাতালে, চারিদিকে খাঁড়া হাতে জিভ বার করা চামুণ্ডা
অস্পষ্ট, মৈনাকের হাত গরম নিঃশ্বাস, দুপুর খা খা করে ডেকে উঠছে একটা দাঁড়কাক।
হঠাৎ বাসন পড়ল ঝনঝন করে। ঘরটা
একটা চোখ ঝলসানো আলোয় নিকষ অন্ধকার করে ফেলল। বুক ধড়ফড় করে উঠে বসলেন ইছামতি। মৈনাক
ভাল আছে তো!
খাবার এখনও পড়ে। মহেন্দ্র এখনও
কেন ফেরেনি? সন্ধ্যা নামছে, বাইরে কালোমেঘ ঝুলে। পাতা থেকে গড়িয়ে নামছে বৃষ্টির জল,
সদরে আওয়াজ হচ্ছে। একজন নয় অনেকের গলার আওয়াজ। কারেন্ট চলে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে।
নিকষ অন্ধকারে ইছামতি একটা প্রকাণ্ড সরীসৃপের মত এগিয়ে চললেন মেঝে ঘষটে ঘষটে দরজাটা
খুলতে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন