ধারাবাহিক উপন্যাস
দ্য ক্লাউড
(চতুর্দশ পর্ব)
গভীর ঘুমের দেশে মহাকাশ। আর ঘুমন্ত মহাকাশের ঠিক নীচে বাবলু। যেন আপেল গাছের ডালে ঝুলন্ত আপেল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাবলু হাতরাচ্ছে। কী যেন খুঁজেই চলেছে।
ঘুম ভাঙা উৎপল চিত্রকর। শিল্পীদের
মধ্যে, যারা স্রষ্ঠা, তাদের এমনই হয়। কিছু একটা মাথায় আসলে তাকে না নামানো পর্যন্ত
স্বস্তি নেই।
ঢকঢক শব্দটা উৎপলের জল খাওয়ার।
এরপর ঠক্। ঠক্ মানে কাঁচের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখার শব্দ। এরপর চপ্পলের মস্ মস্
শব্দ। এ শব্দের মানে হেঁটে যাওয়া।
চিত্রকর এখন তার প্রিয় কবরস্থানে
নেই। সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় সজ্ঞানে ঘরের আলো জ্বেলে ক্যানভাসে উৎপল চিত্রকর বাবলুর হাতে
ধরিয়ে দিলেন বাবলুর প্রিয় ফাইব জি অ্যানড্রয়েড সেট।
আকাশ ফর্সা হতে এখনো ঢের দেরি। পাখিরা এখন সংখ্যায় খানিকটা হলেও বেড়েছে। অথচ করোনা কালের মন্দিরা বাজার অনেক আগে থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে কিট পতঙ্গ, পাখপাখালি, জীবজন্তু সবেরই মধ্যে একটা কমে যাওয়ার লক্ষ্মণ দেখা গিয়েছিল।
এখন অনেকটাই মাটিমাখা হয়েছে ধরিত্রী।
চারিদিক ভীষণ শান্ত হয়ে আছে। ঘুমলে সবকিছুই সুন্দর হয়ে যায়। প্রাজ্ঞরা বলেন, নিস্তব্ধ
রাত্রির সিঁড়ি বেয়ে দেবতারা পৃথিবীর উঠোনে হাঁটতে বেড়ান। আর সেই সময়টাকেই মাহেন্দ্রক্ষণ
বলে। অর্থাৎ মানুষকেও বুঝতে হয়, ঠিক মাহেন্দ্রক্ষণ কোন সময়কে বলে। একবার যদি সময়কে
সঠিকভাবে ধরে ফেলা যায়, তবে সময় কখনোই সে হাত ছাড়ে না। আর চিরঘুমে তলিয়ে গেলে? যেমন
বাবলু!
বাবলুর হাতের অ্যানড্রয়েডে এখন কত আরআইপি!
স্ক্রোল করে করে দেখছে বাবলু-
পরলোকে তুমি শান্তিতে থাকো।
তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি।
ওঁ শান্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি...
বাবলুর পরলোকে এইবার বুঝি একটু সময়টা অনেকটা এগিয়ে গেলো। সে লক্ষ্য করলো, এখানকার আকাশে ফুটে আছে অজস্র জুঁইফুল। তারা সবাই বিকশিত। ফুলগুলো মহাকাশে যেন রাতজাগা ভারী সুন্দর একটি গল্পের চরিত্রেরা। তারা নিজেদের জীবন নিয়ে নিজেরা পারস্পরিক সংলাপ চালায়।
বাবলুর চোখে পড়লো- এজন্মের ওর মা মনিরত্না ভরদ্বাজ নিমচাঁদ দাগার সাথে তাদের ফেলে আসা জীবন নিয়ে কথা বলছে। সে-সব বস্তাবন্দি রাশিরাশি কথাগুলো লাভহীন। মানে লোকসান করে। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে অতীত থেকে শিক্ষা নেওয় যেতে পারে, তবে অতীত আঁকড়ে থাকলে বর্তমান নষ্ট হয়ে যায়। আর বর্তমান নষ্ট হলে, ভবিষ্যৎ, যাকে কল্পনা করা সম্ভব, তা অস্পষ্ট হয়ে যায়।
অর্থনীতির ভিত শক্ত করে দেয় সুস্পষ্ট একটি ভাবনা। যেমন, বাবলুর জেলায় একসময়ে তুঁত গাছের আধিক্য ছিলো। সেই গাছের পাতা খেয়ে রেশমপোকা তার জীবনচক্রের শেষে রেশম তন্তু দেয়। যা না-কি বস্ত্রশিল্পের এক যুগান্তকারী ঘটনা। অথচ বাবলু তার ছেড়ে আসা বাবার কাছ থেকে শুনেছে, চীনা রেশমগুটির এতো আমদানি হয়েছে দেশে যে, এদেশের তুঁত চাষি কৃষকেরা তাদের আগ্রহ হারিয়েছে এই চাষের ক্ষেত্রে। বাবলুর ভাবনায়, একটা কৃষি, যা শিল্পীত অনুশীলনের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্বেও শিল্প হয়ে উঠতে পারে না, তার পেছনের কারণ হলো, অপরিণামদর্শিতা।
ভোর হয়ে আসছে। আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর আলো ম্লান হয়ে আসছে। পূব আকাশটা ধীরে ধীরে তার কপালে রক্ত চিহ্নের মতো লাল বড় টিপ হয়ে এগিয়ে আসছে ঘুমন্ত বাবলুর দিকে। ঠিক যেন মা। মা ঠিক যেভাবে আদর করার সময়, কপালে চুমু দেবার সময় মা-এর সিঁদুরের টিপের দাগ লেগে যেত বাবলুর গালে! ঠিক সেইরকমই আলোমাখা লাল দাগ আজ বাবলুর গালে।
শব্দ হচ্ছে কিচিরমিচির। শুনতে পাচ্ছে বাবলু সবই।
মনিরত্না ভরদ্বাজ, মানে বাবলুর
এজন্মের মা নিমচাঁদ দাগাকে বলছেন, এতো কম বয়সে একজন প্রতিভাবানের মৃত্যু! নিমচাঁদ দাগা
বলে উঠলেন,
অপরিণামদর্শিতা...
(ক্রমশঃ))
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন