কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

মৌ চক্রবর্তী

 

বিনোদিনী দাসী: আমি নিজেই সেই মেয়েটি হয়ে উঠেছিলাম...

 


প্রতি,

থিয়েটারের দর্শক…

উনিশ শতকের বাংলা নাট্যমঞ্চে এক কিশোরী এল। নাম তার পুঁটি। তার মধ্যে লক্ষ্য করার মতো তখনও কিছুই ছিল না, যা তাকে নিয়ে ২০০ বছর পরও আলোচনায় রাখতে পারে। না জানত সমাজ, না জানত নাট্যসমাজ, না জানতেন ওই দরিদ্র কিশোরীকে যিনি বা যাঁরা নিয়ে এলেন।

বিনোদিনী দাসী ছিলেন সেই পুঁটি। এখন সেকথা কে না জানেন! আর তারপর কোনও শিল্পীর দেড়শ বা দুশো বছর হলে তো কথাই নেই।

কত লেখা তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আর সব লেখার সূত্রে তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’র সুর। আমরা পাই এক নারীর শিল্পী হয়ে ওঠার অমোঘ ইতিহাস। তিনি কেবল অভিনয় শেখেননি, অভিনয়কে নিজের অস্তিত্বের ভাষা বানিয়েছেন। বিনোদিনী শুধু এক নটী? তিনি তো প্রতিবাদের প্রতীক। তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে এক বিদ্রোহী নারীর একলা চল লড়াইয়ের কথা। বাংলা সমাজে যা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বেশি কিছু নয়, একটা সূত্র ধরতে চাইব, এই সংখ্যার লেখায়। ‘নীলদর্পণ’ নাটক, তাঁর ‘সাবিত্রী’ চরিত্রে অভিনয়। এ নিয়ে যে উক্তি তিনি করেছেন, তা নারীবাদ, শিল্পবোধ এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার এক আশ্চর্য সেতুবন্ধ তৈরি করে কিনা? সেই তর্ক তুলতে পড়তে দিলাম, তাঁর কথাটুকু :

“সাবিত্রী চরিত্রে অভিনয় করে আমি অনুভব করলাম, অভিনয় শুধু আনন্দ নয়, এক যন্ত্রণা, এক প্রতিবাদও।  আমি যেন নিজেই সেই মেয়েটি হয়ে উঠেছিলাম…

এটুকুই নারীশিল্পীর আত্মবিকাশের ইতিহাসের এক জরুরি পাঠ নয়? দারিদ্রের ছায়ায় এক শিল্পীজন্ম। মাত্র বারো বছর বয়সে বিনোদিনীর থিয়েটারে অভিনয়। এলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষের থিয়েটারে। সময়টা বড় পক্ষে ছিল না মেয়েদের থিয়েটার করার জন্য ১৮৭৪ সালের আশপাশে। মঞ্চে নারীর অবস্থান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। হবেই তো, কারণ, পরিবারের গৃহঅন্তঃপুরবাসিনীদের অবস্থাও যে খুব উত্তম কিছু ছিল না। এরই মধ্যে কেউ নিজের জন্যে গলা তুলবে, তাও মেয়ে? বিনোদিনী তখনই গলা তুলে লড়াই করেছিলেন এমন নয় ঘটনাটা। তিনি পরে লিখেছিলেন তাঁর অভিনয় ও আত্মপরিচয়ের সন্ধানের পথ নাকি খুলেছিল। ‘নীলদর্পণ’ নাটকে ‘সাবিত্রী’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। নিজের কথনে তিনি লেখেন, কীভাবে অভিনয়ের সময় তিনি নিজেকে চরিত্রে বিলীন করে দেন। সাবিত্রী কাঁদে, প্রতিবাদ করে, বুক চাপড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সে যেন বিনোদিনীর জীবনের প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। ‘নীলদর্পণ’ তখন থেকেই নাট্য ইতিহাসে প্রতিবাদের দলিল। আর তার সঙ্গে আরেকটা সত্তাও যে সাবিত্রীতর হয়ে উঠছে, যার নাম পুঁটি, সেকথা কেই বা জানত? আচ্ছা, সেকথা পুঁটি নিজেও কি জানত, যে সে এত দীর্ঘ লড়াইয়ের পথে যেতে পারবে? এই প্রশ্ন আজও নাট্য অভিনেত্রীদের জন্য প্রাসঙ্গিকযারা থিয়েটার করে লড়াই করেন, আর লড়াইয়ের মানে বোঝেন। এই নাটকের অভিনয় বেশি কিছু হয়নি। মানে হতে পারেনি ব্রিটিশ শাসকের বাঁধায়। সেসবও ইতিহাস। হলেও, আমরা জানি। বা, বিস্মৃত হলে পুনরায় পড়ি। এই পড়া আমাদের প্রতিবাদ।

এবারে নাটকের অভিনয়ের তারিখগুলোও তুলে আনা যাক। ৭ ডিসেম্বর ১৮৭২, কলকাতা ন্যাশনাল থিয়েটার, চিতপুর রোড, প্রথম মঞ্চায়ন; ব্যাপক আলোচনা ও প্রশংসা। ২১ ডিসেম্বর ১৮৭২, কলকাতা ন্যাশনাল থিয়েটার, দ্বিতীয় শো; সমালোচনামূলক চিঠি প্রকাশ। ১৮৭৫ লখনউ এবং পরবর্তী পর্যায় যা ছিল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার, ভ্রমণরত দল বা ট্যুরিং, সেটা দর্শকের আপত্তিতে নাটক বন্ধ। রিভিউ ও সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি, প্রথম প্রদর্শনীর পর ভারতীয় সংবাদপত্র নাটকের প্রোডাকশন ও অভিনয়ের জন্য প্রশংসা জানায়। ব্রিটিশ সরকার নাটকের বিদ্রোহী কনটেন্টের কারণে ১৮৭৬ সালে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করে। আলোচ্য নাটক ঔপনিবেশিক শোষণ, কৃষকবিরোধী আন্দোলন ও নারী কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব হিসেবে বিবেচিত। পাশাপাশি, এক কিশোরীর সত্তার বিকাশও ঘটে। যা, পরবর্তীতে আত্মজীবনীর লেখায়, এক আত্মপ্রতিষ্ঠার দলিল যেমন, তেমনই প্রতিষ্ঠিত প্রতিবাদও হয়ে থাকে। ‘আমার কথা’ বাংলা ভাষায় প্রথম কোনও নারী মঞ্চশিল্পীর আত্মজীবনী। এখানে বিনোদিনী শুধু নিজের অভিনয়ের কথা বলেন না। বলেন সমাজের চোখে ‘নটী’ পরিচয়ের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট, পুরুষদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, নাট্যজগতের অন্ধকার, এবং নিজের মধ্যে ক্রমশ জাগতে থাকা আত্মমর্যাদার সত্তার কথা। তিনি স্পষ্ট করেন যে অভিনয় তাঁর কাছে নিছক পেশা  নয়, এ তাঁর আত্মার ভাষা, নিজের অস্তিত্বের প্রতিবাদ। যখন তিনি বলেন, "আমি নিজেই সেই মেয়েটি হয়ে উঠেছিলাম...", তখন বোঝা যায়, শিল্প আর শিল্পীর মধ্যে কোনও দূরত্ব তখন আর থাকে না।

আর আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ আজও লিখতে হয় এ এক নারীবাদী পাঠ ও সামাজিক প্রতিবাদ। এই আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা এবং ‘নীলদর্পণ’ নাটকে সাবিত্রী চরিত্রে তাঁর অভিনয় উভয়ই নারীবাদী পাঠে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। নাটকে সাবিত্রী কাঁদে তার স্বামীর জন্য, কিন্তু সেই কান্না কেবল এক অভিনীত চরিত্রের ব্যক্তিগত নয়, তা একটি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীসত্তার প্রথম কণ্ঠস্বর। পুঁটি যখন সাবিত্রী হয়, তখন তার কণ্ঠে কেবল সংলাপ থাকে না, থাকে গর্জন। এ এক কিশোরীর সেই মুহূর্ত, যখন সে আর চরিত্র নয়, সে হয়ে ওঠে নিজেরই মুখপাত্র।

পরে, বিনোদিনীর উপলব্ধিতে অভিনয় কেবল নাট্যনন্দন নয়, বরং সামাজিক দায়ও বটে। তাঁর 'সাবিত্রী' চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়া ছিল নিপীড়িত শ্রেণির কণ্ঠে কণ্ঠ মেলানো। আর সেই কণ্ঠ একমাত্র একজন নারীশিল্পীর পক্ষেই সম্ভব ছিল, যিনি নিজেও সমাজের অবহেলার শিকার। শিল্প ও প্রতিবাদের এই সংমিশ্রণ বাংলা নাট্যমঞ্চে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

বিনোদিনী দাসীর নাট্যচর্চা এবং আত্মজীবনী আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চেও আলোচিত। তাঁর জীবন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের নানা দেশে নাট্যপ্রযোজনা হয়েছে, যা নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে তাঁকে বিশ্বনাট্যে এক ব্যতিক্রমী অবস্থান দিয়েছে। 'বিনোদিনী' নাটকের মঞ্চায়ন নানা সময়ে, নানা দেশে আলোড়ন তুলেছে। যেমন, এক, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে, ১৯৯৫ ও ২০০৬ সালে ‘নটি বিনোদিনী’ নামে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার কামানী অডিটোরিয়ামে। নির্দেশনা দেন অমল আল্লানা, আর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন সীমা বিশ্বাস।

দুই, ২০০৬ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত থিয়েটার অলিম্পিকসে বাংলাদেশের ঢাকা থিয়েটার এই নাটকটি উপস্থাপন করে। আন্তর্জাতিক পরিসরে বিনোদিনীর কাহিনি নতুনভাবে আলোচনায় আসে।

তিন, ২০১৫ সালের ১১ই জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে বাংলা সম্মেলনে 'বিনোদিনী' আবারও মঞ্চে উঠে আসে। সেদিন শিমুল ইউসুফের একক অভিনয় দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে তোলে।

চার, ২০১৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নির্দেশনায় ছিলেন নাট্যকার নাসিরউদ্দিন ইউসুফ এবং মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন শিমুল ইউসুফ। এই মঞ্চায়নটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।এছাড়া, বিনোদিনীর জীবন, তাঁর শিল্পসাধনা এবং নাট্যজগতে তাঁর অবস্থান এই সমস্ত কিছুই সময়ের পর সময়, ভাষার পর ভাষা অতিক্রম করে নানা দেশে নাট্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি মঞ্চায়নেই উঠে এসেছে তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং নারীবাদী চেতনার গভীর  তাৎপর্য।

বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপাইন বা আমেরিকার মঞ্চে ‘বিনোদিনী’ নাটক কখনো শিমুল ইউসুফের একক অভিনয়ে, কখনো সীমা বিশ্বাসের প্রাঞ্জল উপস্থিতিতে, আবার কখনো ঢাকা থিয়েটারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তুলে ধরেছে এক নারীর লড়াইয়ের ইতিহাস। কিন্তু এই উপস্থাপন কেবল একজন শিল্পীর আত্মজীবনী নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রতীক প্রতিবাদ।

আন্তর্জাতিক থিয়েটারে যেখানে The Vagina Monologues (যুক্তরাষ্ট্র), This Is Not a Love Song (পোল্যান্ড), 7 Minutes (ফ্রান্স), কিংবা Ni Una Menos (আর্জেন্টিনা)–এর মতো নাটক নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, সেখানে Binodini নাটক দক্ষিণ এশীয় নারীর কণ্ঠ হয়ে উচ্চারিত হয়েছে। এই কণ্ঠ শুধু ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয় না, বরং বর্তমানকেও নাড়া দেয়।

এই উদাহরণগুলি প্রমাণ করে যে, বিনোদিনীর পথ ধরেই আজকের থিয়েটার নারীজীবনের যন্ত্রণা, প্রতিরোধ এবং আত্মপ্রতিষ্ঠাকে ভাষা দিচ্ছে। তাঁর ‘সাবিত্রী’ চরিত্রটি হয়ে উঠেছে এক শক্তিশালী প্রতীকযেখানে নারী  কেবল একটি চরিত্র নয়, বরং একটি কণ্ঠস্বর, একটি অবস্থান, এবং একটি প্রতিবাদ। সুতরাং, বিনোদিনী শুধু অতীতের একজন শিল্পী নন। তিনি আজকের লড়াইয়েরও এক অদৃশ্য কিন্তু গভীরভাবে সংলগ্ন সহযোগী। তাঁর জীবন এবং শিল্পের সূত্র ধরেই থিয়েটার হয়ে উঠছে নারীর যন্ত্রণার প্রকাশ ও প্রতিবাদের এক প্রগাঢ় ভাষা। ভারতে ‘But What About the Women?’ বা ‘Nirbhaya’ নাটক একাধিকবার দেশে ও বিদেশে মঞ্চায়িত হয়েছে, যেখানে নির্ভয়া কাণ্ডসহ যৌন হেনস্থার ঘটনা নাট্যরূপ পায়। বাংলাদেশে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’বা ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়’-এর প্রযোজনাগুলোতে নারী অধিকার ও সামাজিক প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

এইসব উদাহরণই প্রমাণ করে যে, বিনোদিনীর পথেই আজকের থিয়েটার হাঁটে, নারীর যন্ত্রণাকে কণ্ঠ দেয়, সমাজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে বিনোদিনীর “আমি নিজেই সেই মেয়েটি হয়ে উঠেছিলাম...” উক্তিটি যেন আজকের অনেক নারীর অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। নাটকের মঞ্চ থেকে রাস্তায়, রাজনীতির মঞ্চ থেকে আদালতের দরজা পর্যন্ত নারীর লড়াই আজও অব্যাহত। সেই লড়াইয়ের পথিকৃৎদের মধ্যে একজন ছিলেন বিনোদিনী। তিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন, এক শিল্পী হতে পারেন সমাজচেতন নারীর কণ্ঠস্বর। এই উত্তরাধিকার আজকের শিল্পী, গবেষক, নাট্যকার ও দর্শকদের জন্য এক অনন্ত প্রেরণা।

ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী

(ছবি সৌজন্যেঃ  Alkazi Theatre Archives এবং ইন্টারনেট আর্কাইভ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন