![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
বাক্
(১)
অভিন্নসত্তা
দেশটার সীমানায় দুটো বিশাল উঁচু পর্বতচূড়া... অগম্য গিরিখাত, ওপারে কী আছে এপারের লোক জানে না, আদিকাল থেকেই। কোন পথিক আসে না, অশ্বারোহী বা সন্ত। প্রাসাদের পাথর আনতে রাজস্থপতির অনুচরেরা মাঝেমধ্যে পর্বতের দ্বারস্থ হয়... কিন্তু তারও সীমারেখা রয়েছে। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে গিরিখাত অভিযানের কী পরিণাম হয়, তা বংশপরম্পরায় ছেলেভুলানোর গল্পে গাঁথা আছে। সত্যাসত্য বিচারের মাপকাঠি জানা নেই কারো। সেখানেই শমী গাছের তলায় এক আগন্তুককে বসে থাকতে দেখে অনুচরদের বিস্ময় বাগ মানে না! এদেশে সবাই কটিদেশ বস্ত্রাবৃত রাখে, ঊর্ধাঙ্গে অলঙ্কার ছাড়া অন্য কিছু পরার রীতি নেই। আগন্তুকের ঊর্ধাঙ্গে মসলিনের উত্তরীয়। কণ্ঠীতে চিত্রবিচিত্র চন্দনের কারুকাজ। চূর্ণকেশ স্তরে স্তরে স্রোতের মতো ভাঁজ হয়ে কাঁধ-পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। উষ্ণীষখানা পাক খুলে পড়ে রয়েছে মাটিতে আর কোথাও অলঙ্কারের রেশমাত্রও নেই। নেই একখানি রত্নাঙ্গুরীয়ও। অনুচরেরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে অভিবাদন করল নিজেদের ভাষায়। আগন্তুক শ্রান্ত চোখ তুলে প্রত্যাভিবাদন করলেন, অনুরূপ ভঙ্গিতে-
-আপনি কি আমাদের ভাষা বুঝবেন? কিভাবে
আপনাকে পরিচর্যা করব বুঝতে পারছি না আর্য! পর্বতের এপারে গৌরকান্তি দীর্ঘাঙ্গ আর্যদের
বসবাস, আগন্তক শ্যামাঙ্গ।
-আমি বাক। নিজ রাজ্য প্রকৃতির রোষকবলিত।
প্রাণধারণের তাড়নায় সমস্ত বিপদ তুচ্ছ করে যেদিকে বোধ যায় দিনরাত এক করে হেঁটে গিয়েছি।
তিন পূর্ণচাঁদ পার করে এখানে এসে শেষ অবধি মানুষের ঠিকানা পেলাম।
অনুচরদের অবিশ্বাস যায় না। জনপদবিহীন
যাত্রায় প্রাণধারণের খাদ্যপানীয় কোথায় পেলেন আগন্তুক? আরো বহু প্রশ্ন ভিড় করছে মাথায়, কিন্তু তারা রাজার
সেবকমাত্র। অনুসন্ধানের দায়ভার সেনাধ্যক্ষের, রাজপারিষদদের।
তো বাক রাজ্যে বসবাস করার অনুমতি
পেলেন সমস্ত অনুসন্ধান প্রশ্নোত্তরের পর। রাজার রাজ্যে সবাই যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান,
অধিকার পায়। কেউ অস্পৃশ্য অশুচি বা দ্বাররুদ্ধ না। রাজা ধর্মাচরণে বিশ্বাসী। বিদ্রোহ, রক্তক্ষয় এসব হয়ই না বলতে গেলে।
বাককে জিজ্ঞাসা করলেন রাজা, স্বদেশে
কী কাজ করতেন তিনি? বাক উত্তর দিলেন, বংশপরম্পরায় তাঁরা স্তোত্ররচনা, সাধনা এবং অধ্যাপনা
করে থাকেন। এবার রাজার যা অভিরুচি। রাজা বুদ্ধিমান, নবাগতকে অধ্যাপকের মর্যাদা দিয়ে
পণ্ডিতদের অহংচর্যায় ঘা দিলে আশু গণ্ডগোলের সম্ভাবনা। বাকের ধীশক্তি, জ্ঞান বা বুদ্ধিমত্তার
গভীরতা এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছেন তিনি। তাই রাজপরিবারের শিক্ষাগুরু হিসাবে বহাল করলেন
তিনি বাককে। সঙ্গে নিজের পছন্দমতো যে কোন বিষয় অধ্যয়নের জন্য সমস্তরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
দিলেন। বাক প্রাসাদের কোন কক্ষে থাকতে চাইলেন না। প্রাসাদ প্রাঙ্গণেই কুটির বানিয়ে
নিজের নতুন জীবন শুরু করলেন। রাজসভায় বাকের অবাধ বিচরণের মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন রাজা,
কিন্তু স্পষ্টতই, তাঁর ব্যবহারে বুঝে গিয়েছেন বাক, পণ্ডিতদের তর্কসভা বা সাহিত্যালোচনায়
বাকের উপস্থিতি চাইছেন না রাজন। বাকও এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। দিনমানে রাজপরিবারের
পুত্রকন্যাদের পড়ান। সূর্য পাটে বসলে চলে যান কুটিরের পিছনে সরোবরের দিকে। মেষপালকেরা
ধুলো উড়িয়ে ফেরে পাথুরে রাস্তা দিয়ে, জলের পাশে বসে অল্প বিশ্রাম নেয়, বাক তাদের সঙ্গে
গল্পগুজব করেন। কিছু শেখেন, কিছু শেখান। দিনের
এই একটা সময়ই ভালো কাটে তাঁর। রাত ফেরত এলে প্রদীপের শিখার সামনে বসে পুঁথির অক্ষর
ঝাপসা হয়ে যেতে দেখেন বাক। অদূরে পাথরের ঠাণ্ডা প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে গমগম করে
বেজে উঠতে থাকে শব্দগুলো--
-"নিজের জিহ্বা চিবিয়ে খেয়ে
নাও বাক... ওটাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা তোমার"।
মহলের প্রত্যেক সিংহতোরণ হলুদ এক বিশাল প্রাসাদের অনুরণন ছেপে দিতে থাকে মগজে, যার গুপ্তকক্ষ কখনও না খোলার শপথ নিতে হয় সে রাজ্যের সকলকে, প্রথম শিক্ষাগ্রহণেরও আগে। সমস্ত রহস্য, ধ্বংস এবং অভিশাপ আজীবন গিলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য ছাড়ার আগে শেষ কঠিন শপথ নিজের কাছেও করেছিলেন বাক, যে নিজের নারীসত্তাকে জগতে কারো কাছে প্রকাশিত হতে দেবেন না আর, বা অগোচরেও উদযাপন করবেন না কখনও। বাক একজন নারী, সম্ভবত পৃথিবীর সেই একটিমাত্র দেশের তপস্বীকুলের উত্তরাধিকারী, যেখানে নারী যজ্ঞের প্রথম অগ্নিহোত্র হন এবং ইনি নিজের বংশের চতুর্থ বাক। তাঁদের বংশ সম্পর্কে বহু রটনা, গল্প প্রচলিত ছিল দেশে। বাকরা অজর, অমর। তাঁদের বয়স বা মুখাবয়ব সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। বংশপরম্পরায় ঈশ্বরের জ্ঞানের ভাণ্ডার তাঁদের কাছে সুরক্ষিত রয়েছে। প্রথম প্রস্ফুটিত সূর্যালোক অনূদিত হয় বাকের জিহ্বায়। মানুষের ভাষায়। ঈশ্বরের প্রত্যেক সত্য। কেবলমাত্র বাকের বংশধরেরাই জানেন নিজেদের সঠিক উত্তরাধিকার বা আয়ু। জনসমক্ষে আসার আগে কণ্ঠ এবং মুখ চন্দনে চর্চিত করে, মসলিনে আবৃত করে নিতে হয়। বাকের কেবলমাত্র স্বর জনগণের গম্য। হলুদ প্রাসাদ তাঁদের সমস্ত সাধনার আধারগৃহ। বাকের আবাসস্থল। দেশের রাজাও দেউড়ির অন্দরভাগে প্রবেশ করার অধিকার পান না। পবিত্রভূমি। চতুর্থ বাক, ঘটনাচক্রে, বংশের প্রথম উত্তরাধিকারিণী। নারী।
প্রত্যেক বাক বংশজ নিজের জীবন এবং
তপস্যা যাপন শেষ হলে নতুন বাককে অভিষিক্ত করে গুপ্তকক্ষের ভেতরে গিয়ে এক এক করে প্রদীপ
জ্বালেন, তৃতীয় বাক যেমন জ্বালবেন তিনটি। ধ্যানরত অবস্থাতেই দেহত্যাগ করেন তিনি। প্রদীপগুলি
নিভে গেলে জানা যায়, কাজ শেষ হয়েছে। নতুন তালা পড়ে গুপ্তকক্ষের বাইরে। একজন্মের মতো।
বংশের দৈবীশক্তিধারীকেই নতুন বাক অভিষিক্ত করেন পূর্বজ। তার কিছু নিজস্ব নিয়ম, রহস্য
রয়েছে। এত সবকিছুর পরেও, বাকবংশের নিজস্ব অভিশাপ রয়েছে, অন্তর্গত। শক্তির পাশাপাশি,
শক্তির কালগ্রাস। গুপ্তকক্ষের এই তালা, জীবদ্দশায় অভিষিক্ত বাকেরও খোলার অধিকার নেই।
শোনা যায়, ভেতরে এযাবৎ ঋষিদের সমস্ত শব্দ, স্বর, জ্ঞান জীবন্ত ভেসে বেড়ায়। প্রাণবান
বিগত অতীত, এবং কালশক্তি রুদ্ধ রয়েছে সেখানে, অভিশাপসহ।সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন চতুর্থ
বাক। খুলে ফেলেছিলেন তালা। তারপর সেই সবকিছু তছনছ করে দেওয়া প্রলয় শুরু হল। নিজের ভেতরে,
প্রাসাদের বাইরে, সর্বত্র। আর সেই গমগম করতে থাকা লৌহশলাকার মতো বাক্যবাণ
-নিজের জিহ্বা গলাধঃকরণ করো বাক,
গিলে খাও... বাঁচতে চাইলে।
পিছনে ফেলে এসেছেন এক ভরা সাম্রাজ্য... যেখানে
বৈভব, সম্পদ, গরিমা, মানুষ, ভবিষ্যৎ সমস্ত রয়েছে, কিন্তু একটি মানুষের গলাতেও স্বর
নেই। মূক হাজার হাজার অধিবাসী, মূক সম্রাট। মুখ, কপালের সমস্ত আবরণ, আভরণ মুছে ফেলেছেন
বাক। চাবুকের দাগের মতো উজাগর রেখেছেন কন্ঠের চন্দন, রোজ চর্চিত করেন নতুনভাবে। আগলে
রেখেছেন ভেতরের আগ্রাসী দানবকেও, যার একটিমাত্র মুখব্যাদানে এই শ্যামল দেশের শান্ত
জীবনচর্যা তছনছ হয়ে যেতে পারে... স্মরণে আসামাত্রই শিউরে উঠলেন বাক। এক ফুঁয়ে নিভিয়ে
ফেললেন প্রদীপ।মনে পড়ে গেল প্রদীপ নির্বাপণের পরে নিষিদ্ধ কক্ষে দ্রুতসঞ্চরণশীল এক
তীব্র কিশোরীর কথা... নিজের ভাবনার কণ্ঠরোধ করতে চাইলেন বাক... বাইরে হঠাৎ পায়ের শব্দ…
বাক মস্তিষ্কচর্চার কাজ থামিয়ে মেষপালকদের সঙ্গে প্রকৃতির অন্ধিসন্ধি চিনতে বেশি সময় ব্যয় করতে থাকেন। তাঁদের দেশ এমন সুজলাশ্যামলা ছিল না... এখানে প্রকৃতির কত রূপরসগন্ধ। ফুলের পাপড়ি, নতুন পাতা, জলের লতা তুলে এনে একা বসে বসে দেখতে থাকেন তাদের ঢাল, গড়ান, গন্ধ, স্পর্শ। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করেও চিনে নিতে পারেন নিকটের লতাপাতা শেকড় মাটির টুকরো...নতুন এক জগত আবিষ্কারের উত্তেজনায় বাক শাপগ্রস্ত অতীত আস্তে আস্তে পিছনে ঠেলে দিতে শুরু করেন। একদিন স্নান সেরে এসে প্রবল উত্তেজনায় খল নুড়ি ছেঁচে একের পর এক কুড়িয়ে আনা এতোলবেতোল থেকে নির্যাস বের করে মেশাতে আরম্ভ করেন একটার সঙ্গে আরেকটা, তার সঙ্গে অন্য এক। ভুলে গেলেন রাজপুত্র কন্যাদের শিক্ষাদানের কথা, মেষপালকদের সঙ্গে ইতিউতি আলাপ। দিন গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামল বাকের চোখ উত্তেজনায় চকচক করছে শিশুর মতো। পরপর সারিবদ্ধ পাত্রে তিনি ভরে ফেলেছেন কুটিরময় নতুন সুগন্ধী... এযাবৎ অনাঘ্রাত। অন্তত বাকের ইন্দ্রিয়াতীত। উত্তেজনা শান্ত হলে বাক উপলব্ধি করলেন, এই আনন্দ ভাগ করে নেবার মতো ইহজগতে একটিও মানুষ নেই তাঁর। এবং নতুন এই রাজ্যের অচেনা অর্ধচেনা মানুষের পক্ষে সম্ভবত, অবান্তরও।
সবার অগোচরে বাকের দ্বৈতজীবনযাপন
শুরু হল। দিনের বেলায় চিরাচরিত অধ্যাপনা। এবং রাত্রিবেলা, অধ্যাপকের পক্ষে ইতরজীবিকা,
নতুন গন্ধ অন্বেষণ। বাক শিশু হয়ে যেতেন আবিষ্কারের নেশায়, প্রত্যহ। এক এক করে বাকের
প্রত্যেক স্নায়ুরন্ধ্র যেন সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করল, আগে কখনও হয়নি এমন। ইন্দ্রিয়াতীত
বহুকিছুর স্পর্শে যেন প্রত্যেক কোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করল। খেলায় পেয়ে বসল তাঁকে।
কোন নতুন গন্ধ পেলে, তাকে নিজস্ব রসায়নে বোতলবন্দী না করা অবধি শান্তি হত না যেন। সেনাধ্যক্ষের
শতসহস্র মানুষের রক্তপায়ী তরবারির নিজস্ব গন্ধ হোক, বা স্বঘোষিত চিরকুমার রাজগুরুদেবের
কটিবস্ত্র থেকে রমণীয় উরুসন্ধির নির্যাসঘ্রাণ। আজকাল রাজসভাও ব্রাত্য লাগে না তাঁর।
নিত্যনতুন গন্ধের অফুরন্ত আকর সভাগৃহ।
ঊণ সূত্রঃ সৃষ্টির পূর্বেই ছিলেন বাক্। ঈশ্বরের সঙ্গেই বাক্ ছিলেন বিরাজমান। বাক্ ও ঈশ্বর ছিলেন অভিন্নসত্তা। ঋগ্বেদের নবম মন্ডল পর্যন্ত সবই পুরুষ দেবতা। প্রথম দেবীর কথা পাওয়া যায় দশম মন্ডলে। এই দেবীর নাম বাক্। কবিরা এই বাকেরই সাধনা করেন। কবিতা তাই অতলরহস্যময়ী দেবী। কবিতা তাই গূঢ়তমা নারী। কবিতা তাই ছায়ার মতই; দৃশ্যমান অথচ অধরা। কবিতা কায়াহীন, শুধু তার আভাসটুকুই ছুঁতে পারি আমরা।
দেবী কখনো কারো নিজস্ব হন না যে!
-- সৃষ্টির পূর্বেই ছিলেন বাক্।
ঈশ্বরের সঙ্গেই বাক্ ছিলেন বিরাজমান। বাক্ ও ঈশ্বর ছিলেন অভিন্নসত্তা।
(২)
জঙ্গলের জল ও মাটি
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে বোধ হয় আমার পূর্বপুরুষেরা দাঁড়িয়ে সেখানে; আমি যেন বা এক নবজাতক এই গাছেদের দঙ্গল আমায় হাতে তুলে দোল দেয়... কেউ ফুলের ঝুমঝুমি বাজায় হাত দিয়ে কেউ চোখে সুগন্ধের পিচকারি ছিটিয়ে মারে বুড়ো, একদম থুত্থুড়ে এক দেড়েল বটগাছ এসে আমায় কোলে নেয়, নিয়ে অবাক মানে… বলতে থাকে-
'কেমন হাঁটতে শুরু করে দিয়েছ তুমি!
এই আমাদের মতো তো ছিলে তুমিও, মাটিতে শেকড় গাঁথা; নিজের বীজের মধ্যে সূর্য গেঁথে ফেলার
সে কি আকুল চেষ্টা তোমার! প্রথমে মাটিতে এলে, চোখের সামনে দেখলাম হামাগুড়ি দিতে...
আমাদের ডালপালায় চড়তে, চড়ে ফের ঝাঁপ দিতে মাটিতে… চঞ্চল কত লাফঝাঁপের দিন গিয়েছে। তারপর
নিজের দুপায়ে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলে যেদিন, আর ফিরলে না! ওই পাহাড়ের ওই পাথরের হয়ে রয়ে গেলে
সেখানেই… তবুও, তবুও তোমার শরীরে জল রয়েছে মাটি রয়েছে শরীরে তোমার… আমাদেরই একজন। আমাদের
মধ্যেই আমার রুয়ে যাবে তুমি (উপ্ত হবে তুমি), তুমি ফিরবেই।’
(৩)
কুড়চি বনের ফুল
একটা অরণ্য, তার সব সম্পত্তি সব জ্যান্ত সচল অচল মিলে আস্ত একটা চলমান। আত্মা। তাকে সেভাবে ছুঁলে নড়ে ওঠে ব্রহ্মাণ্ডের মতো। ঠিক যত টুকু ছোঁবে ততটুকু জ্যান্ত হয়।
পাহাড়ের একটা হেয়ারপিন বাঁকের পরে
খাদ, আর সেখানে অরণ্য বসে থাকে যেন ঝুপসিমাথা মেয়ে।
তো প্রজন্ম নতুন মাথাগুলোকে সেফটিপিন
এঁটে কুইকস্টিকের রাজ্য বানিয়ে ফেলছে, খুব মরিয়া। প্রথমে শেখাচ্ছে ঝুঁকে পড়ে নমন বেতসলতার
মতো, তারপর আরো নি:শর্ত নমন, তারপর মস্তিষ্কের খাঁজে বসিয়ে দিচ্ছে এমন, যে কোষগুলো
নড়াচড়া করার আগেই শুধোচ্ছে যান্ত্রিক, "আজ্ঞা দিলে?" প্রশ্ন স্বর বদলে অথচ
বেরোচ্ছে পূর্বজগৃহ থেকে এভাবে, "শিখলে নম্রতা, বিনয়?"
তার্কিক হও, কিন্তু ছাপ্পামারা
তার্কিক, পূর্বজদের যজ্ঞোপবীত যত দূর স্বাধীনতা দেয়, ঠিক ততদূর তারপর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর,
বোধে গাঁথার আগেই আজ্ঞারূপে শিরায় বাহিত হচ্ছে মানবতাবাদ। এত তীব্র আরোপ, যে ভবিষ্যতে
এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার আগেই অপরাধবোধে মরে যাচ্ছে নতুন মন মাতৃত্বের মতো প্রশ্নহীন।
কেন প্রশ্নহীন। মাতৃত্ব তো খাদহীন নয়, হতে পারে না। উপাসকের দিকটা বলি। উপাসক এই চক্রব্যূহের
বাইরে থাকা মস্তিষ্ক এক, স্বনির্মিত স্বশিক্ষিত। কিন্তু নির্মম একা।
অজস্র বোধ অযুত সত্যোপলব্ধি লক্ষ বীজমন্ত্র আহরণ করে একাকীত্বের ভারে যেন ন্যুব্জ অল্প। ধারক চাই। আধার। অরণ্যের গহীন বড়ো পছন্দ উপাসকের, অরণ্যও আস্তে আস্তে জ্যান্ত হয় প্রত্যেক সত্যের উন্মোচনে, সাধকের সাথে, বছরের পর বছর। কিন্তু উপাসকের কাছে অরণ্য শুধু গভীর এক প্রেক্ষাপট। বদলে গেলেও আমূল ওই গহীনখানি অক্ষত রেখে, কিছু যেত আসত না তাঁর
প্রখর জ্ঞানের ভারে বোধের যন্ত্রণায় জর্জরিত উপাসক একদিন অস্তরাগের আলোকবর্তিকার কাঁধে তুলে দিলেন নিজের সমস্ত নিবেদন আচমন অরণ্য ঝাপসা হয়ে স্বনির্মিত শিশমহলের বিভ্রম ছাড়া আর কোনভাবে বোধক্ষেত্রে পৌঁছায়না তাঁর। নিজের অহমকে দেখে প্রতিফলনে, ভাবলেন বুঝি বা উত্তর পেলেন এতদিনে। আরাধ্যা। ঈশ্বরী তাঁর নিজস্ব কুড়চির উন্মোচন খেয়ে গেল সন্ধ্যারাতের বৃষ্টি।
[কুড়চি- তৃতীয় কোন নয়ন, কেউ তৃতীয়
অস্তিত্ব, দূর থেকে দেখল ওই উপাসক আর উপাস্যের বলয় থেকে দূরে, অরণ্যের জ্যান্ত বুক
ঘেঁষে তুলোর ফল ফেটে ছড়িয়ে পড়লেন ঈশ্বর।প্রত্যেক আঁশে, অযাচিত, অনায়াস।]
(৪)
ঈশ্বর / ঈশ্বরী
তুলির বেমক্কা টানের মতো উর্ধ্বশ্বাস বাঁকে যেখানে খাদ রেখে বিরতি নিয়েছে পাহাড়, ছায়াটান গাছ কিছু জানালা রেখেছে অগাধ অট্টালিকায়, যার ছুরি নামানো প্রত্যঙ্গ শেষ হয় আশেপাশে ঘুরন্ত হাওয়ামহল রেখে, ওপরে শ্বাস ফেলতে থাকে ধুকপুকি প্রায়ার্ধ ক্রন্দসী যেন সরীসৃপ কোন নীলাঙ্গী জানোয়ার...
জানালার গর্দানে চোখ সেধে যদ্দূর
চাই বাড়িয়ে নিলে দৃশ্যঘর, ঠিক যেখানে নদীর সুতো ভ্রম হবে যেন কালাচ সাপের বিড়ে, তার
যোজন কয়েক আগে কাঁচা সবুজের গা ঘেঁষে উবু হয়ে বসে উপাসক, হাঁটুর পাথরে তার রোদের ফলক
নকশা লিখছে প্রাচীন ক্যালাইডোস্কোপে।
তীব্র সূর্যের হাত খোপ কাটছে আতসকাচের
ফোকাসে, অনড় গাছের ঝাঁকড়া মাথা নেড়ে পরক্ষণেই আবছা করে দিচ্ছে তাকে,
"মৃদু হও" যুগান্তরের
সখ্য ধমক মারে।
বাতাস গলে ঝাঁঝ চৌচির আটকে পড়ছে
পাহাড়ে-উপত্যকায় কিশোরের ঘ্যানঘেনে দুপুরপাঠের মতো…
দুলে দুলে একমন রপ্ত করছে পূর্বজ
সব দেখা,
-"নুয়ে পড়ো বেতসলতা, নম্র
হলে?"
-"হলাম।"
-"তর্ক করো খাঁজে খাঁজ, ওই
দেখো শুভ্র সীমানা পূর্বসূরির যজ্ঞোপবীত…"
-"শিরোধার্য।"
-"চিরন্তনী কিছু মানববন্ধনী,
সভ্যতার গর্বগাথা, কুড়িয়ে নাও ঠোঁটে রেফ হসন্ত যতিচিহ্ন সমেত, নির্ভুল।
মাতৃত্বের মতো প্রশ্নহীন।"
-"ঠোঁটস্থ। মাতৃত্বের মতো
প্রশ্নহীন।"
-"ধ্রুবক।"
-"…ধ্রুবক।"
উপাসকের কুণ্ডলিনী পদ্ম করে ওঠে।
রোম রোম তন্ত্রেরা মন্দ্র ছেঁকে ধরে উপাসকের ঋজু, বিদ্যা এলোচুল নিতম্বঝাঁকি দিয়ে খোঁজেন
ধারণের পিঠ, বৈরাগ্যের কৌশিকী দিনান্তে খুলবে ভাবে নিজস্ব কুড়চির ভাঁজ।
ফিরোজা ফিকে থেকে গাঢ়ে ঠেলে দেন
সম্ভবী আলো, গৌড় মল্লারের ছন্দে পাতালতা দুলকি করে আঙুলে ধরেন অরণ্যানীর গহন…
"আরাধ্যা.."
"দেবী, আপনিই সেই, সেই কি
তবে?…"
প্রজ্ঞা এলোপাথাড়ি বাতিদান খোঁজে
যেন মৃত্যু আউড়ে না ফেলে শ্বাস…
"ঈশ্বরী…!"
রাগ বদলে আসে মধুবন্তীয়,
অরণ্য কোন শিশমহল যার ফলকে প্রতি
কাচ নিজের মুখ পেতে ধরে অনন্ত আমি,
বরিষণ খেয়ে যায় অব্যাহত যতেক কুড়চির
ডানা,
পাখির পাগল থেকে নিভে আসে পালকেরা
আদিত্যরঙ।
আর তৃতীয় নয়ন
দেখে আলোময় সে উপাসনাঘড়ি থেকে বলয়
উপরে
আশঘর পাশঘর ছেয়ে তুলোর কাহনে
গুল্মফল ফেটে চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লেন
ঈশ্বর
রোয়াঁশ রোয়াঁশ।
(৫)
বাবা আদমের গাছবিচার
পৃথিবীর এখনতম মস্তিষ্ক তারপর ধূ ধূ একা হয়ে যাচ্ছে
তুমিহীন গম গম করছে স্বরদালান...
র গড়তে গেলে রগড় ঘটে যাচ্ছে খালি,
বরাত নিয়ে রীতিমতো লীলাঠাকুরণ আমা হতে গলিয়ে ফেলছেন আকার।
চাঁদহারানোর আরবার।
স্বরে আহ নিয়ে গলা বাড়িয়ে ধরে না
কোনো উত্তরের অধিকার।
সেই থেকে সেই
না-বালিকার কোঁচড়ময় ফুটে উঠছে অজস্র
বাবা আদমের গাছবিচার, খই খই রবে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন