কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

মধুবন চক্রবর্তী

 

সলিল চৌধুরী ও গণসংগীত

 


..."পৃথিবীর গাড়িটা থামাও আমি নেমে যাব

আমার টিকিট কাটা অনেক দূরে

এ গাড়ি যাবে না, আমি অন্য গাড়ি নেবো"...

ছেলেবেলায় একাধিকবার এই গান শুনেছিলাম রেডিওতে। অন্যান্য মেলোডির সঙ্গে এই গানের যেন বিস্তর তফাত। তফাতটা ঠিক কোথায়, সেটাই বুঝতে পারিনি, বলতে পারিনি কাউকে, এমনকি বোঝাতেও পারিনি। কিন্তু শৈশবের সেইসময়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত গানটা। গানটি শুনে মনে হয়েছিল, এটা নিছক বাংলা গান নয়। এই গানের সুর ঠিক যেন বাংলার নিজস্ব সুরও নয়, এর সঙ্গে জুড়ে আছে কথা, সংলাপ, নাটকীয়তা। মিশেছে বিদেশি কোনও সুর। সত্যিই তাই, পরে দেখেছি, এই গানটি আমেরিকান সোলো মিউজিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুর সংযোজন করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ১৯৫০-এর দশকে মডার্ন সিভিল রাইট মুভমেন্টে ব্যবহৃত হত এই মিউজিক। আমেরিকান সোলো মিউজিকে  অনুপ্রাণিত হয়ে, বহু গান রচনা করেছেন পরবর্তী কালে। বরাবরই প্রথা ভেঙে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বাংলা গানের নবরূপকার। সার্থক গণসঙ্গীতের স্রষ্টা তিনি। গানে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যা বাংলাগানকে সমৃদ্ধ করেছে। নতুন দিগন্ত দেখিয়েছেন বাংলা গানকে। ১৯৪৯ সালে সলিল চৌধুরীর কথায় সুরে প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে মাইলফলক ‘গাঁয়ের বধূ’। ওই বছরই সিনেমা নির্মাতা সত্যেন বসুর 'পরিবর্তন' ছবিতে সংগীতপরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত। ১৯৫১ সালে 'বরযাত্রী' এবং পরের বছর 'পাশের বাড়ি’ ছবিতেই তাঁর সুরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একের পর এক গান। এরপর তো ইতিহাস। চলচ্চিত্র সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন সলিল চৌধুরী। প্রাথমিক পর্বে সাহিত্য রচনায় আকৃষ্ট হয়ে সঙ্গীতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করার পরেও,   সাহিত্যের হাত ধরেই পেয়েছিলেন মেজর ব্রেক। বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক বিমল রায় চৌধুরীর লেখা গল্প নিয়ে তারই চিত্রনাট্যের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিটি তৈরিতে আগ্রহী হয়েছিলেন বলেই ওর সঙ্গে মুম্বাই জগতের যুগ  স্থাপিত হয় এবং পরবর্তী সময় আমরা সবাই জানি, এই ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে সলিল  চৌধুরী পেয়েছিলেন লন্ডনের এশিয়াটিক ফিল্ম সোসাইটির পুরস্কার। 'দো বিঘা জমিন’ হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে ছিল একটি ল্যান্ডমার্ক। ছবিতে সলিল চৌধুরীর সংগীত পরিচালনায় লতামঙ্গেশকার ও মান্না দে’র কন্ঠে 'মৌসম ভি তাজা হ্যায়', ‘ধরতি কাহে পুকার', 'আজা রে নিন্দিয়া তু’ গানগুলি সলিল চৌধুরীর সংগীতপরিচালক ভাবমূর্তিতে জুড়েছিল আরোও এক নতুন পালক। এই সূত্র ধরেই মুম্বাইতে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের সিংহভাগই কেটে যায়।

হিন্দি ছবিতে বাঙালি সংগীত পরিচালকদের ধারাবাহিক কৃতিত্বের তালিকায় তিনি তাঁর নিজের নাম যেরকম সংযোজন করেছিলেন, সেরকম জনপ্রিয় গানের সৃষ্টিতে শ্রোতা দর্শকদের হৃদয়ে যে সমীহ জাগাতে পেরেছিলেন, তার কিছু নমুনা প্রতিফলিত হয়েছিল ‘বোম্বে ইউথ কয়ার'-এর আয়নায়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি 'বম্বে ইউথ কয়ার' প্রতিষ্ঠা করেন সলিল চৌধুরী। গণসংগীতের ক্ষেত্রে কোরাস গায়ন পদ্ধতি নিয়ে নানারকমের পরীক্ষানিরীক্ষা করে এই কয়ার সংগীতের ধারাকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। সম্মলিত সংগীত একসময় গাওয়া হতো একতানে। সলিল চৌধুরীর একমাত্র সঙ্গীতশিল্পী যিনি সমবেত অর্কেস্ট্রার ব্যবহার করে অপূর্ব ছন্দ লয়ের সমন্বয়ে ঘটিয়ে, অন্যান্য ধারার সাংগীতিক আবহের সৃষ্টি করেন। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই 'হেই সামালো হেই সামালো' গানটির কথা। আবার 'ও আলোর পথযাত্রী' অথবা ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’র মত সব কালজয়ী গানের কথা। তাঁর রচিত গণসঙ্গীতগুলিতে একদিকে ছিল দেশজোড়া  আন্দোলনের ধারালো হাতিয়ার। অন্যদিকে সাংগীতিক উৎকর্ষে এক চিরকালীন আবেদন রেখে গেছে বাংলা সংগীতজগতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্ববৃহৎ কৃষক অভ্যুত্থানের মধ্যে চল্লিশের দশক থেকে মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে উপজীব্য করার জন্য, সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে যেন আবির্ভাব সলিল চৌধুরীর। তৈরি করেছিলেন গণসংগীত যা হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। তেভাগা আন্দোলনের শুরু হওয়ার আগে থেকে সলিল চৌধুরী কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ত্রাণকার্যের জন্য দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন সুন্দরবন কাকদ্বীপ সহ আরোও বহু জায়গায় তিনি চলে যেতেন। সেই সময় কৃষকদের  দুঃখ দুর্দশা দেখে তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁর কলমে সৃষ্টি হতে থাকে একের পর এক প্রতিবাদের গান। সেই সব গান দলবেঁধে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে গেয়ে বেরিয়েছেন দলের সদস্যদের সঙ্গে। (সূত্র পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা সংখ্যা মার্চ ২০০০)। গণসংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি অনুকরণ করেছিলেন অনেকটাই জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ধারা।

সলিল চৌধুরী ছাড়াও, সেই সময় তেভাগা আন্দোলনের ওপরে গ্রাম্য ভাষায় যারা গান লিখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন  হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিনয় রায়। এছাড়া আরো অনেক সংগীত রচয়িতা ছিলেন যারা এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু সলিল চৌধুরী যেন সকলের থেকে আলাদা হয়ে উঠলেন। তিনি গণসংগীতে মেশালেন প্রাদেশিক সুর। সেই সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটালেন বিদেশি সুরেরও। শুধু তাই নয়, লোকায়ত সুরকে গ্রহণ করে পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তার মধ্যে নিয়ে এলেন দৃঢ়তা। আর এখানেই  তিনি একেবারে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠলেন। ১৯৪৫ সালে সলিল চৌধুরী তাঁর প্রথম গণসংগীত সৃষ্টি করলেন (সূত্রঃ পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা বাংলা সংগীত সংখ্যা)... এই গানগুলিকে তিনি ‘The Mass songs of consciousness and  awakening’ বলে অভিহিত করেছেন।

তেভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লিখেছেন একাধিক গণসংগীত। তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় কালজয়ী গানটি হল

"হেই সামালো হেই সামালো

হেই সামালো ধান হো

কাস্তেটা দাও শান হো

জান কবুল আর মান কবুল

আর দেব না আর দেব না

রক্তবোনা ধান মোদের প্রাণ হো"

তেভাগা আন্দোলনের সময় সলিল চৌধুরী রচনা করলেন আরও একটি গান, যা সেই সময় জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

"ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে

জীবন ও মরণে তোমায় চাই না ভুলিতে"

বিদ্যাধরী নদীর বানভাসি অঞ্চলে কৃষকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ১৯৪৫-৪৬ সালে তিনি রচনা করলেন-

"দেশ ভেসেছে বানের জলে

ধান গিয়েছে মরে

কেমনে বলিব বন্ধু পরানের কথা মোর

ঘরেতে ছাউল নাই পরনে পিরান নাই

অনাহারে দিবা নিশি ভাসি নয়ন লোরে

কেমনই বলিব বন্ধু

পরানের কথা তোরে"

এই গানটি কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত তাঁর প্রথম গান। সেই সময় হরিনাভি, সোনারপুর ও বারুইপুরের কৃষকরা এই গানের দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। মূলত ভাটিয়ালি সুরে আন্দোলিত এই গানটিতে কৃষকদের দুঃখ দুর্দশার কথাই তুলে ধরা হয়েছে।

স্বাধীনতা লাভের পর বেশ কিছু অঞ্চলে বিশেষত কাকদ্বীপ বড়াকমলপুর, ডুবিরভেরি ইত্যাদি এলাকায় তেভাগা আন্দোলন চলে বেশ কিছুদিন। স্বাধীন দেশের সরকারের পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারও ছিল সীমাহীন। আর সেই শোষণ অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি আবার লিখে ফেললেন-

"ও আয়রে ও আয়রে

ভাইরে ও ভাইরে

ভাই বন্ধু চলো যাই রে"

এক বিশেষ অধ্যায়কে কেন্দ্র করে, একটা সময়কে কেন্দ্র করে সেই গানগুলি লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেই অত্যাচার এবং শোষণ রুখে দাঁড়াতে আজোও এই গণসংগীত ব্যবহৃত হয়। কেটে গেছে এতগুলো বছর, সময় বদলেছে কিন্তু শরীর চৌধুরীর সৃষ্টি গণসঙ্গে আজব প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী। কারণ তাতে রয়েছে চিন্তা ও চেতনার সম্যক কালজয়ী উপাদান।

সলিল চৌধুরীর জন্যই গণনাট্য সংঘের গণ সংগীতের বর্ণময় ইতিহাস অধ্যায় রচিত হয়েছে। আধুনিক বাংলা গানে গণসংগীত এর যে বিশাল ভূমিকা, সেই ভূমিকা রচনা করেছিলেন সলিল চৌধুরী। তার অবদানের কিছুটা কাছাকাছি রাখা যেতে পারে আরো একজন প্রতিভা সম্পন্ন গীতিকার ও সুরকার সুধীন দাশগুপ্তকে। ১৯৪৪ এর ২৪শে অক্টোবর শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে, পরে যা বিশ্বরূপা নামে পরিচিত হয়, যখন শম্ভু মিত্র এবং বিজন ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ‘নবান্ন’ প্রথমবার মঞ্চস্থ হয়েছিল সেখানে সলিল চৌধুরীর নাম ছিল না। গৌর   ঘোষ নামের একজনকে দেওয়া হয়েছিল সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব। একবার সলিল চৌধুরীকে গাইতে দেওয়া হয়নি, শুধু বাঁশি বাজাতে দেওয়া হয়েছিল।

গণসংগীত-এর আঙ্গিক বা ফর্ম নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে শরীর চৌধুরীর বিতর্ক ছিল।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পর আধুনিক বাংলা গানের যোগ্য উত্তরসূরী বলা যেতে পারে সলিল চৌধুরীকে। সাম্য, বিপ্লব, প্রেম, আধুনিক সমাজ চেতনায় উজ্জীবিত তাঁর গানের কথা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সংগীতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যে কথার মধ্যে আছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রীতির প্রভাব। একজন বাঙালি তরুণ, বাংলা সংগীতকে পৌঁছে দিচ্ছেন বিশ্বের দরবারে। প্রচলিত সুর, প্রচলিত গান, বাংলা গানের প্রবাহিত যে ধারা সেই ধারায় নিজেকে আবদ্ধ না রেখে, দেশজ সুরের সঙ্গে পাশ্চাত্য ভাবনা মিশিয়ে অনবদ্য সংগীত রচনা করে গেছেন তিনি। লিখেছেন খেটে খাওয়া মানুষের গান বা শ্রমজীবী মানুষের গান। নিষেধের রক্তচক্ষু পেরিয়ে, প্রগতি এবং মুক্তির স্বপ্নযাপন করে গেছেন দিনের পর দিন। বাংলা গানের মাধ্যমে সেই স্বপ্নযাপন করেছেন। মানুষের অন্তরের স্বপ্নকে জাগরিত করেছেন। স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন। হাতিয়ার সেই সংগীত। তাঁর তার সম্পর্কে তার গণসঙ্গীত সম্পর্কে বলতে গেলে অবশ্যই উঠে আসে তাঁর ছেলেবেলা।

ব্রিটিশ মালিকানাধীন চা বাগানের ডাক্তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রমোহন চৌধুরীকে একদিকে দেখেছেন সারাদিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যাবেলায় পাশ্চাত্য সংগীতের রেকর্ড চালিয়ে নিজের ক্লান্তি লাঘব করছেন। আবার অন্যদিকে দেখেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। দেখেছেন, ব্রিটিশ ম্যানেজারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। আবার কখনও দেখেছেন চা বাগানের আয়রিশ ডাক্তারের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীত নিয়ে আলোচনা করতে, কখনও-বা চা বাগানের মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিকতার অর্জন নিয়ে বা মজুর পুরুষ-নারীদের নিয়ে নাটক করতে। এইসময় থেকেই তাঁর এই দেখাগুলো তাকে শ্রমজীবী মানুষের হয়ে কথা বলতে শিখিয়েছে। মামার বাড়ি ছিল কোদালিয়ায়, সেখানে গান-বাজনা ছিল নিষিদ্ধ। সব নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে গানের চর্চা করতেন এই মামার বাড়িতে। চা শ্রমিকদের কাছেই শিখেছিলেন বাঁশি বাজানো। তবে মামার বাড়ির অন্দরমহলে বাঁশি বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। তাই কোমরে বাঁশি ঝুলিয়ে বেরিয়ে যেতেন বাইরে। রেল লাইনের ধারে পুলের ওপর বসে একান্তে বাঁশি বাজাতেন। এই বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। আশপাশের মানুষজন তাঁকে কেষ্ট ঠাকুর বলে ডাকতেন।

সলিল চৌধুরীর সাংস্কৃতিকজীবনের উন্মেষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। ব্রিটিশ ভারতের অধীনস্থ সেইসময়ের অসমের মিকির পাহাড়, সীমান্তের চা বাগানের প্রকৃতি জনজীবন থেকে বেরিয়ে এসে আবার কলকাতার রাজনৈতিক পটভূমিকায় কেটেছে তাঁর শৈশব যৌবন। মামার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে গান-বাজনা যতই নিষিদ্ধ হোক না কেন, একদিন সেই নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে বাড়ির ভিতরই শুরু হয়েছিল সংগীতচর্চা, সাহিত্যচর্চা। ছোড়দা নিখিল চৌধুরীর ছিল অর্কেস্ট্রার দল। ‘মিলন পরিষদ’ নামে ওই দলটি বিকেল থেকেই মহড়া দিত গানের। সুখিয়া স্রিটের বাড়িতে মিলন পরিষদের ওই মহড়ার ঘর থেকে নানা সংগীত যন্ত্রের সমবেত ঐক্যতান, তাঁর কানে আসত। মহড়া ঘরের দিকে পা বাড়াতেই এসেছিল নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধের বেড়া ভেঙে ওই ঘর লাগোয়া জায়গাটুকুতে বসে তিনি দীর্ঘ সময় গান শুনতেন। এমনকি যন্ত্রের ধ্বনিও মুখস্থ করে নিতেন। একদিন তাঁর ছোড়দা নিখিল চৌধুরী শিশু সলিলের কণ্ঠে সেই সমস্ত যন্ত্রের নিখুঁত অনুকরণ শুনে মুগ্ধ হয়ে যান! তার নিষ্ঠা দেখে বিস্মিত হন। অবশেষে ঘরে প্রবেশের অনুমতি মেলে তাঁর। ধীরে ধীরে দাদার উদ্যোগে বিভিন্ন যন্ত্রের পাঠ নেওয়া শুরু হয়। এবং পরবর্তী কালে নির্বাক সিনেমায় দাদার অর্কেস্ট্রার দলে প্রথম পেশাদার শিল্পী হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একটু একটু করে শিখে নিয়েছিলেন নিষেধের বেড়াজালকে কীভাবে টপকে এগিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে।

'মিলন পরিষদ' অর্কেস্ট্রার দলে সদস্য হওয়ার পরপরই শিখলেন পিয়ানো বাজানো। এমনকি এসরাজ, বেহালা বাজানোর শিক্ষা, বিক্ষিপ্তভাবে তবলা বাঁশির খানিকটা তালিমও হয় তাঁর। এই অর্কেস্ট্রা সংগীতের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা যে নিবিড় করে দিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকী কোদালিয়ার গ্রামের পাঁচালি যাত্রাগান, আখড়ায় ঢপ, দেশি সুরের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। সেইসঙ্গে পঙ্কজ মল্লিকের গান শেখানোর আসর এবং রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর মগজে পুষ্টি এনে দেয়। সেইসময় পারিপার্শ্বিক সামাজিক দায়বোধ, সতীর্থদের উৎসাহ এবং জীবনযাপনের ধারা থেকে সলিল চৌধুরী তাঁর গান বাঁধার প্রেরণা পান। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি তাঁকে গান বাঁধতে অনুপ্রেরণা জোগায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আচ্ছন্নতা, দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী জমিদারদের শোষণ অত্যাচার মিলে রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক সংকটের যে পটভূমি তারই প্রভাবে সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব হিসেবে সলিল চৌধুরীর কলম হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের উজ্জ্বল ভাষা। কি সাহিত্যে কি সঙ্গীতে। চা শ্রমিকদের লোকসংগীত, নৃত্য, বাঁশি ঢোল দূর পাহাড় থেকে  আসা পাখিদের কলকাকলি, নদীর কলতান, তার শৈশবকে সংগীতময় করে তুলেছিল।

স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল আইপিটিএ অর্থাৎ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যোগদান করেন সলিল চৌধুরী। রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে লিখতে শুরু করেন গান। এবং বিভিন্ন গানের সুরও দিতে থাকেন। এরকম সময় আইপিটিএ দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন গানের মধ্যে দিয়ে। তাঁরা গান বাঁধতেন। সলিল চৌধুরীও লিখলেন, রানার, বিচারপতি, গাঁয়ের বধুর মত কালজয়ী সব গান।

১৯৫৩ সালে মুম্বাই পাড়ি দিলেও 'আজ সন্ধ্যায়', ‘রাতভোর’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’ ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। প্রত্যেকটা গান হয়ে উঠেছিল একেবারেই আলাদা। ব্যতিক্রমী। একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, অন্যদিকে হিন্দি ছবিতে বাঙালি সংগীত পরিচালকদের ধারাবাহিক  কৃতিত্বের তালিকায় নিজের নাম সংযোজন করে হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক। এই সবকিছুর পরেও মানুষ তাকে মনে রাখবে গণসংগীতের স্রষ্টা হিসেবে। মনে রাখবে এক প্রতিবাদী সংগীত স্রষ্টা হিসেবে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন