কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(পর্ব ২৭)

ছেলেমেয়েকে মানুষ করার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে নিজের শিশুকাল। আমার শৈশবে একটা বিষণ্ণ একাকী মাঠ থাকত আর মাঠের ধারে বেলগাছ। সেখানে বাস করত এক ব্রহ্মদত্যি। কেমন একটা দুঃখি দুঃখি লাগত তাকে, ভয় করত না। ছিল শুনশান স্টেশনে এক স্টেশন মাস্টার অবধারিতভাবেই যে শাকচুন্নির কবলে পড়বে। মহিলা ভূতকে বাংলায় শাঁকচুন্নি কিম্বা পেত্নি বলা হয়, হতো, ছিল গ্রামের রাতে আলেয়ার নাচানাচি এবং পেত্নীর আমন্ত্রণ। একটি বউ লিকলিকে লম্বা হাত বাড়িয়ে জানলার বাইরের লেবুগাছ থেকে পেড়ে আনত লেবু তার বরের জন্য। ছবি আঁকা থাকত পাতায় পাতায়। ছিলেন অবিস্মরণীয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।

ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী আর ডালিমকুমার, লালকমল আর নীলকমল, সুয়োরানী আর দুয়োরানীর কষ্টের গল্প। রাক্ষস খোক্কস দৈত্য দানো বলে একটা বই ছিল। সে সব রাক্ষস আর স্কন্দকাটা, ব্রহ্মদত্তি সবাইকে আজকাল নেহাতই নিরীহ ভালোমানুষ টাইপের মনে হয়। কালো কাপড়ের মাঝখানটা আর পিসবোর্ডের এ-চার  সাইজের বই হতো। পক্ষীরাজ ঘোড়া ছিল, ছিল বোতলের দৈত্য। আমিও কতবার ঘুরে এসেছি সেই রাক্ষসপুরী যেখানে বুড়ি রাক্ষসীকে তেল মাখানো যায় পায়ে আর রানী দেখেছি যার হাড় মুড় মুড়ি ব্যারাম হয় কিন্তু রাত হলে ঘোড়াশালে ঘোড়া আর হাতিশাল থেকে হাতি গায়েব। কেউ কিচ্ছুটি টের পায় না। এখনও এমন রানী রাক্ষুসী আর দত্যি দানো আছে। নেই শুধু ডালিমকুমার আর তার পক্ষিরাজ। রাজকন্যা আর সবাই ঘুমিয়ে পাথর হয়ে থাকে। সেই সময় আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল জাহাজে খালাসীর চাকরি নিয়ে পালাব বাড়ি থেকে। এরকম একপ্রকার যখন পাকা করলাম তখন এলেন হেমেন রায়, নীহাররঞ্জন রায় এবং গুপ্ত তারপরে দেখা ফেলুদার সঙ্গে সব বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে। সেই সময় নেবার লোক কম দেবার লোক বেশি। কাকাইয়া, ছোটোকাকা, ছোটোদাদু আমার সনৎবাবু, এই প্রজাতি এখন বিলুপ্ত। যাইহোক তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টে প্রাইভেট ডিটেক্টিভ হবো ঠিক হলো। ছুটির দিনে আমি আর আমার বন্ধু বনে বাদারে গাছের ফোকরে ক্লু খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। এমনকি ট্রেনে উঠেও ভাবতাম সিটের তলায় নিশ্চিত রয়েছে লাশ। লক্ষ্য পাল্টাতে থাকে জীবনে। বারবার।

একটু বড় হতে পুরী গিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে আলাপ। বালিতে লাল কাঁকড়ার সারি। আমাদের মতো বেড়াতে আসা দু তিনটে পরিবারের অচেনা ছেলেদের সঙ্গে আড়চোখে মাপামাপি। কোথায় থাকা হয় গোছের ইসারা। আমাদের ছোটোবেলায় ভাববাচ্যে কথা বলাটা ফ্লার্টিংএর একটা স্টাইল ছিল। তখন করমচাঁদ নামে একটা ডিটেক্টিভ সিরিয়াল হতো।

ছেলেমেয়ে যখন খুব ছোটো চাকরির প্রয়োজনে ফের ফিরতে হলো সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে, বি এড করতে। এটি একটি স্ট্যাটুটারি ডিগ্রী ছাড়া কিছুই নয় একথা প্রায় সব শিক্ষক ই জানেন। সেখানে যা যা পড়ানো হয় পড়ানোর ব্যাপারে তা মেনে চললে কোনও শ্রেণীর কোনো সিলেবাস শেষ হবে না কোনওদিন। তবে শিক্ষা সম্পর্কে একটা রূপরেখা অবশ্যই তৈরী হয় মনে। স্ট্যান্ডার্ড আর আসলে তো তফাত থাকবেই। নতুন করে বাধাধরা পড়াশোনা ওয়ার্ক প্রজেক্টের গেরো, পিঠে এক শিশু কোলে আরেকটি, গৃহকর্ম যা মহিলাদের জন্যই সংরক্ষিত থাকে পৃথিবী এখান থেকে সেখান চলে গেলেও, সে সব অব্যহত রইল। সব ঝঞ্ঝাটের একটা ভাল দিক থাকেই। হিমশিম খাওয়া একঘেয়ে জীবন থেকে হঠাত আবার এসে পড়লাম সবুজ মাঠ আর ক্যান্টিন প্রাচীন চওড়া সিঁড়ি আর হৈ হৈ কলেজ লাইফ আরো একবার। এই সময় ছিলেন রেক্টর ফাদার ফেলিক্স। দুবছরে দুটো অনুষ্ঠান, দুটি ম্যাগাজিনের কাজ ও লেখা, গিটার এবং গান ফিরল ফের।

পড়াশোনায় পুনর্বার মন ফেরানোর জের টিঁকিয়ে রাখতে কয়েকজন বন্ধু তার পরেও করে ফেললাম  ইংরেজিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স।

অনেক বছর দ্বীপান্তরের পর কালবৈশাখীর মেঘ কালো পার্ক স্ট্রীটৈ বেজে উঠল গমগম করে এলভিস প্রিসলে, ...বিকজ আই লাভ ইউ টু মাচ..:" জীবন বারবার বাঁক বদল করে। পার্ক স্ট্রীটে লাল জলে মেপল পাতার ডিঙি, এলেন্স পার্ক আর কলেজের উল্টোদিকে সিঁড়ির নিচের চা দোকানে ঠেক। দেখা হলো আবার কফি হাউসের যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া ওয়েটার, একাডেমিতে ম্যাকবেথ দেখে ফেরার সময় উড়ে এলো কবিতার পাতা কলম, পেজ পার্সোনাল কম্প্যুটারের ভেতর।

জীবনের দ্বিতীয় পর্ব মুখ্যত লেখা কেন্দ্রিক।

মনে পড়ে শিরদাঁড়া সোজা দীর্ঘ মানুষটি উঠে আসছেন কফি হাউসের সিঁড়ি বেয়ে। এক গোধূলিতে মুখোমুখি বসে আমার একটি সদ্য লেখা কবিতা পড়ে কবি দার্শনিক কালিকৃষ্ণ গুহ বললেন, "আমার সৌভাগ্য আজ এমন একটা কবিতা পড়তে পেলাম"। অনুজের প্রতি এমন প্রশ্রয় অনেক দূর হেঁটে যেতে অনুপ্রেরণা দেয়, যদিও শব্দটি আজ কলুষিত, প্রকৃত অর্থে বিপুল।

ছিল পটলডাঙায় বহু দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রভাত চৌধুরির স্নেহের ভর্ৎসনা, জেঠিমার পাশে এসে কপট রাগ ওকে এত বকছ কেন, চাকরি করে এলো আগে দুটো খেয়ে নিক...। এসব ভালোলাগা ব্যক্তিগত অমনিবাস।

এমন আরো অনেক কথা ভিড় করে। কখনও তমসাবৃত জীবন কখনও আলোকরেখা। চলে যায় প্রিয় মানুষ, হারিয়ে যায় ভালোবাসা, ফড়িঙের প্রজাপতির মতো ভালোবাসা রং পাল্টায় ফের। স্বপ্ন শুধু জেগে থাকে।

সমাজে নারী ও পুরুষ দুটি পৃথক শ্রেণী। এই বিভেদটি চিরকালীন। নারীবাদীরা যতই যুক্তি দেখান তা নিষ্ফল মনে হয় সসাগরা সংসারে। পুরুষ ভালো লাগে, তাদের সঙ্গে ছোটো থেকে বড় হয়ে দেখেছি একেকজনের একেকরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যতদিন কৈশোর শৈশব ততদিন লিঙ্গ বিভেদ নেই। ক্রমে দেখা যায় অধিকাংশ মেয়ের ইনওয়ার্ড আউটলুক, প্রেম আর প্রেম, চুলের কাট, জামার রং, বরের মাসি, ভাতের হাঁড়ি আর দেওয়ালের ঝুল সাফ করায় যত মন, ব্রত আর পুতুল খেলায় যত মন তত নয় দেশ বিশ্ব দর্শন অথবা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞানে, সে চাকুরিরতা হোক বা পরনির্ভর মনে মনে সে সব সময়ই পরনির্ভর, ভগবান নির্ভর প্রভৃতি।

অবশ্যই সর্বত্র আছে ব্যতিক্রম আছে। পুরুষরা এই জায়গাটায় জিতে যায়। তারা সংসারে নিমজ্জিত নয়, গড়পরতা পুরুষ পর্যন্ত নিজের পৃথক ব্যক্তিত্ব সচেতন দেখি। সে ভাল হোক বা খারাপ। অধিকাংশ নারী আজও অপেক্ষায় থাকে, "বিপদে মোরে রক্ষা করো..." এই প্রার্থনায়।

আমার মনে হয়েছে ফেমিনিস্ট কথাটারই তেমন গভীর কোনও অর্থ নেই। যেটা হতে পারে তা হলো সাম্যবাদ। জেন্ডার ভূমিকার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন, নির্যাতিত ও নির্যাতকের মনোভঙ্গীর বদল। একে অপরকে দমন করার প্রবৃত্তি আদিম অনন্ত। পৃথিবীতে শুধুই দুটো শ্রেণী থাকে নিম্ন বা পীড়িত এবং উচ্চ বা নিপীড়ক।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন