কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

পি.শাশ্বতী

 

নারীদের পৈতা ও বেদ অধ্যয়নের অধিকার

 


সে অনেক কালের কথা। তখন অযোধ্যার সিংহাসনে কীর্তিমান রাজা দশরথ আসীন। তাঁর যশোকীর্তিতে সসাগরা পৃথিবী মুখরিত। সেই দশরথ নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাসের শিকার হলেন। বাকসত্যরক্ষার্থে রাজ্যাভিষেকের আগের দিন পুত্রকে বনবাসের আদেশ দিলেন চৌদ্দবছরের জন্য। গোটা রাজ্য এক মুহূর্তে আনন্দসাগর থেকে শোকের সাগরে নিমজ্জিত হল।

কৈকেয়ীর শর্তানুসারে পিতৃসত্যরক্ষার্থে পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বনবাসের জন্য। কৌশল্যার অনুমতি নিতে রাম মাতা কৌশল্যার ঘরে চলেছেন। কৌশল্যা  তখনো  জানেন না যে তাঁর একমাত্র পুত্র রাম চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যাবেন। রামচন্দ্র তাঁর মায়ের ঘরে প্রবেশ করলেন। রামচন্দ্র দেখলেন, তাঁর মা কৌশল্যা পট্টবস্ত্র পরিধান করে একেবারে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে যজ্ঞে আহুতি দিচ্ছেন। আহুতির জন্য অনেক দ্রব্যই সেখানে আছে। যেমন ঘি, আতপচাল, খৈ, জল, মোয়া, তপায়েস, খিচুড়ি, সাদামালা, সমিধ মানে যজ্ঞের কাঠ এবং পূর্ণকুম্ভ। আর তিনি রীতিমতো দেবতাদের তর্পণও করছিলেন-

-"সা ক্ষৌমবসনা হৃষ্টা নিতাং ব্রতপরায়ণা।

অগ্নিং জুহোতি স্ম তদা মন্ত্রবৎ কৃতমঙ্গলা।। ১।।

প্রবিশ্য তু তথা রামো মাতুরন্তঃপুরং শুভম্।

দদর্শ মাতরং তত্র হাবয়ন্তীং হুতাশনম্।। ১৬।।

দেবকার্যনিমিত্তং চ তত্রাপশ্যৎ সমুদ্যতম্।

দধ্যক্ষতঘৃতং চৈব মোদকান্ হবিযস্তথা।। ১৭।।

লাজান্ মাল্যানি শুক্লানি পায়সং কৃসরং তথা।

সমিধঃ পূর্ণকুন্তাংশ্চ দদর্শ রঘুনন্দনঃ।। ১৮।।

তাং শুরুক্ষৌমসংবীতাং ব্রতযোগেন কর্শিতাম্।

তপর্যয়ন্তীং দদর্শান্তির্দেবতাং বরমণিনীম্।। ১৯।।

[বাল্মিকী রামায়ণম্-অযোধ্যাকান্ড-সর্গ-২০]

কৌশল্যা রীতিমতো বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে যজ্ঞ করছেন, আহুতিও দিচ্ছেন, পট্টবস্ত্র ধারণ করেছেন,তর্পণও করছেন পুজোও করছেন। তাহলে কি ঐ সময়ে নারীরা যজ্ঞোপবীত ধারণ করতেন? যজ্ঞ করতেন? বেদমন্ত্র অধ্যয়ন করতেন? বিস্ময় জাগে!

পুরাণ বলছে নারীরা এইসব কিছুই করতেন, করতে পারতেন। বৈদিকশাস্ত্রের গভীরে গেলে, এই সত্য আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে "নারীদেরও পইতা/পৈতা হতো, তাঁরা বেদঅধ্যয়ন যজ্ঞ এসব করতেন।

মহর্ষি গোভিলচার্য্য, তাঁকে সামবেদীয় কৌথুমী শাখার আাচার্য্য পুরুষ এবং স্রষ্টা বলা হয়। তিনি যখন বৈদিককালে তাঁর আশ্রমের কোনো এক বৃক্ষের ছায়ায় বসে সামবেদীয়দের জন্য বিয়ের বিধিবিধান লিখতে বসলেন, সেদিন তিনিও সেই সত্যটাই লিখে গেলেন-

-"প্রাবৃতাং যজ্ঞোপবীতিনীমত্যুদানয়ন্ত্রণেৎ সোমোহ দদগন্ধর্ব্বায়েতি পশ্চাদয়েঃ সংবেষ্টিতং কটমেবং জাতীয়ং বাংল্লৎ পদা প্রবর্তয়ন্তীং বাচয়েৎ প্র মে পতিযানঃ পন্থাঃ কল্পতামিতি স্বয়ং জপেৎ।”

[গোভিল গৃহ্যসূত্রম্ :২|১|১৯-২১]

অর্থাৎ  বস্ত্রাবৃতা এবং যজ্ঞোপবীতিনী কন্যাকে ভাবি-পতি তাঁর সামনে আনার পর "সোমহদদ গন্ধর্ব্বার" ইত্যাদি মন্ত্র পাঠ করবেন।

এখানে স্পষ্টভাবে কন্যাকে বা নারীকে যজ্ঞপোবীতধারিনী বলে ডাকা হয়। অর্থাৎ মহর্ষি গোভিলের সময়কালেও যে মেয়েরা যজ্ঞোপবীত বা পইতা/পৈতা পরতেন বা তাঁদের যে উপনয়ন সংস্কার হতো তা স্পষ্ট। এছাড়া গোভিল আরো বলছেন, -"দেখুন মশাই! কন্যারা শুধু উপনয়ন সংস্কার বা পৈতা পরবে তা নয় বরং বিবাহিত নারীরা সকাল সন্ধ্যায় হোম /যজ্ঞও করবে।

"কামঃ গৃজেংয়ৌ পত্নী জুহুয়াৎ সায়ং

প্রান্তর্তহোমৌ গৃহাঃ পত্নী গৃহ্ন যোহয়ির্ভবতীতি।”

[গোভিল গৃহ্যসূত্রম্: ১|৩|১৫]

মাধবাচার্য্য। একজন প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার এবং পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি তাঁর পরাশর সংহিতার ভাষ্যে নারীদের উপনয়ন বিষয়ে লিখলেন-

"দ্বিবিধা স্ত্রীয়ো ব্রহ্মবাদিন্যাঃ, সদ্যো বধ্বশ্চঃ।।

তত্র ব্রহ্মবাদি- নীনাং উপনয়নং অগ্নীন্ধনং

বেদাধ্যয়নং স্বগৃহে ভিক্ষ। ইতি।।

অর্থাৎ তিনি বলেছেন স্ত্রী অর্থাৎ নারী দুই ধরনের। একদল হলেন ব্রহ্মবাদিনী, আরেকদল হলেন সদ্যবধূ।ব্রহ্মবাদিনী যাঁরা হবেন তাঁরা অবশ্যই উপনয়ন সংস্কার করবেন, যজ্ঞ করবেন, বেদ পাঠ করবেন এবং করাবেন। আর যাঁরা সদ্যবধূ হবেন তাঁরা উপনয়ন গ্রহণ করবেন না।

বিষয়টা সহজ ভাষায় বললে, যে মেয়েরা পড়ালেখা করতে চায় তাঁরা পৈতা গ্রহণ করে বেদপাঠ করুক, লেখাপড়া করুক। আর যাদের ওসব লেখাপড়ায় মন নেই তাঁদের ওসব ব্রহ্মবাদিনী হয়ে লাভ নেই বাবা। তাঁরা সদ্যবধূ হয়ে সংসার ধর্ম করুক।

মাধবাচার্য্যের ভাষ্যে উল্লিখিত বক্তব্যটা পাওয়া যায় বেদাঙ্গশাস্ত্রে। বেদাঙ্গের মধ্যে অন্যতম হলো কল্পসূত্র। কল্পসূত্রের মধ্যে অন্যতম হলো ধর্মসূত্র। ধর্মসূত্র আর ধর্মশাস্ত্র এক নয়। ধর্মসূত্র হলো সরাসরি বেদাঙ্গ। ধর্মশাস্ত্র কিন্তু বেদাঙ্গ নয়, স্মৃতিশাস্ত্র।

ধর্মসূত্রগুলোর মধ্যে মহর্ষি হারিতের ধর্মসূত্র এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর ধর্মসূত্রে সেই কথাটিই লিখলেন এবং ভাষ্যকার মাধব এই ধর্মসূত্র থেকেই পরাশর সংহিতার ভাষ্যে  লিখেছেন-

"দ্বিবিধা স্ত্রীয়ো ব্রহ্মবাদিন্যাঃ, সদ্যো বধ্বশ্চঃ।।

তত্র ব্রহ্মবাদি- নীনাং উপনয়নং অগ্নীন্ধনং

বেদাধ্যয়নং স্বগৃহে ভিক্ষচর্যা ইতি।।

[হারীত ধর্মসূত্র, নির্ণয়সাগর প্রেস: ২১.২৩]

মহর্ষি হারীত নারীদের উপনয়নের বিষয়ে বললেন- "দেখো বাবা, বিয়ে না হয় করলে ঠিক আছে, কিন্তু তার পরেও তুমি অর্থাৎ নারী, উপনয়নটা দাও এবং অবশ্যই বেদ অধ্যয়ন করো"।

তথৈব য প্রথমাত উপনয়নাং ক্রুত্ব সদ্য ইব

বিবাহম ততঃ বেদমধিতে স সদ্যবধুঃ।।

[হরিত ধর্মসূত্র ৩০.২১-২২]

এই নারীদের উপনয়ন দেওয়ার এবং বেদ পাঠ করার বৈদিক রীতি তা কিন্তু স্মৃতিশাস্ত্রের যুগ থেকে বিশেষ করে মনুসংহিতা যুগের সময় থেকে ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকো। হয়তো পুরুষতান্ত্রিকা বা স্বার্থের বেড়াজালে কিংবা অন্যকোনো কারণে। তাই দেখা যায় স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণের যুগে এসে নারীদের উপনয়ন, বেদমন্ত্র  উচ্চারণ এমনকি ওঁকার উচ্চারণের উপর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

বৈদিক কালে নারীদের পৈতা হতো, সেই সত্য স্মৃতিশাস্ত্রের কড়াকড়ির যুগেও প্রকাশ করেছেন মহর্ষি যম। তিনি তাঁর সংহিতায় লিখছেন-

"পুরা কল্পে তু নারীণাং মৌঞ্জীবন্ধনমিষ্যতে।

অধ্যপনং চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা।

পিতা পিতৃব্যো ভ্রাতা বা নৈনামধ্যাপয়েৎ পরঃ।

স্বগৃহে চৈব কন্যায়া ভৈক্ষচর্যা বিধীয়তে।

বর্জয়েদজিনং চীরং জটাধারণমেব চ।

[যম সংহিতাঃ নির্ণয় সাগর প্রেস]

বাংলায় প্রাপ্ত যম সংহিতার এডিশনে এই বচনটি নেই। আরেক জন প্রখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকার হলেন দেবন ভট্ট। তিনিও তাঁর স্মৃতি চন্দ্রিকাতে নিরপেক্ষভাবেই নারীদের উপনয়নের সমর্থন করে হারীত এবং যমের বচনগুলো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে তুলে বলেছেন, নারীদের পৈতা, পৌরোহিত্য ও বেদাধ্যয়ন হতো।

[স্মৃতিচন্দ্রিকাঃদেবন ভট্টঃ vol :1, সংস্কার কান্ড:পৃ:৬২]

অর্থাৎ পুরাকালে নারীদের মৌঞ্জিবন্ধন বা উপনয়ন সংস্কার হতো, তাঁরা বেদ অধ্যয়ন করতেন, সাবিত্রীমন্ত্র পাঠ করতেন। তাঁদের পিতা ও ভাইয়েরা তাঁদেরকে এসব কিছুই শেখাতেন। তাঁরা তাদের বাড়িতেই নিয়ম অনুসারে ভিক্ষা করতেন। তবে তাঁরা ছেলেদের মতো অজিন, চীর আর জটাধারণ করতেন না।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন উপন্যাস হলো বানভট্টের লেখা ‘কাদম্বরী’ উপন্যাস। সম্ভবত খ্রীষ্টীয় ৫ম শতাব্দীর মধ্যেই এটি লিখিত। সেই উপন্যাসেও উল্লিখিত আছে মহাশ্বেতানামে এক নারী উপনয়ন সংস্কার হয়ে অন্যান্য ছেলেদের সাথে গুরুগৃহে বেদ পড়তে যাচ্ছেন-

"মন্ডলীকৃতেন ব্রহ্মসূত্রেন পবিত্রীকৃতকায়াম"

[ কাদম্বরীঃ হরিদাস:পৃষ্ঠা :৪৫৪

মহর্ষি শৌনকের লেখা বিখ্যাত একটি বৈদিক গ্রন্থ হলো ‘বৃহদ্দেবতা’। বেদের দেবতত্ব ও ঋষিতত্ব বুঝতে হলে  পণ্ডিতগণ এই গ্রন্থের সাহায্য নেন। এটি অত্যন্ত প্রাচীন গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ইদানীং একজন বিদগ্ধ বাঙ্গালী  নারী পণ্ডিত অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন।

সেই প্রাচীন ‘বৃহদ্দেবতা’ গ্রন্থে  বিখ্যাত সব নারী ঋষির নামের একটি তালিকা পাওয়া যায় যাঁরা কিনা উপনয়ন বা পইতা/পৈতা নিয়েছেন, গুরুগৃহে থেকে বেদ-অধ্যয়ন করেছেন, যাগ-যজ্ঞের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন, তাঁরা ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী, তাঁদের অনেকে আবার সরাসরি বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকা ছিলেন এবং তাঁরা বিভিন্ন গুরুকুলগুলোতে বেদ পড়াতেন। তাঁরা হলেন ঘোষা, গোধা, বিশ্ববারা, অপালা, উপনিষৎ, নিষৎ, জুহুনানন্মী ব্রহ্মজায়া, অগস্ত্যের ভগ্নী অদিতি, ইন্দ্রাণী, ইন্দ্রমাতা সরমা, রোমশা, উর্বশী, লোপামুদ্রা, নদীসকল, যমী, নারী শাশ্বতী, শ্রী, লাক্ষা, সার্পরাজ্ঞী, বাক্, শ্রদ্ধা, মেধা, দক্ষিণা, সূর্যা ও সাবিত্রী।

"ঘোষা গোধা বিশ্ববারা অপালোপনিষনিষৎ।

ব্রহ্মজায়া জুহুর্ণাম অগস্তস্য স্বসাদিতিঃ। ২.৮২

ইন্দ্রাণী চেন্দ্রমাতা চ সরমা রোমশোবশী।

লোপমুদ্রাচ নদ্যশ্চ যমী নারী চ শশ্বতী। ২.৮৩

শ্রীলার্ক্ষা সার্পরাজ্ঞী বাক্ শ্রদ্ধা মেধা চ দক্ষিণা।

রাত্রী সূর্যা চ সাবিত্রী ব্রহ্মবাদিন্য ঈরিতাঃ। ২.৮৪

[বৃহদ্দেবতাঃ ২|৮২-৮৪]

দুর্গামহাপূজায় বিখ্যাত দেবীসূক্ত পঠিত হয়-

"অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।

অহংমিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোমা।।

[ঋগ্বেদ:১০|১২৫|১]

এই পুরো সুক্তটাই কিন্তু একজন ঋষিকা অর্থাৎ নারী ঋষির লেখা। তিনি অম্ভৃণ ঋষির কন্যা অম্ভৃণী। তাঁর অন্য নাম হলো বাক্। এমন অনেক সূক্তের কথা বলা যায় শুধুমাত্র বেদ থেকেই যেগুলোর দর্শন করেছেন নারীরা।

একজন নারী ঋষির দর্শন করা মন্ত্র পড়ে একজন নারীদেবীকে পূজো করে যদি নারীদের বেদপাঠ নিষেধ করা হয়, ওঁ উচ্চারণ নিষেধ করা হয়, যজ্ঞ পৌরোহিত্য নিষেধ করা হয়, তখন বলার আর কিছু থাকে না।

নারীরা যে শুধুমাত্র উপনয়ন দিতেন, যজ্ঞ করতেন, বেদ পাঠ করাতেন তা কিন্তু নয়। তাঁরা সেইসময় বড় বড় ঋষিদের সঙ্গে বেদ-বেদান্তের উপর তর্ক বিতর্কও করতেন।

বৃহাদারণ্যক উপনিষদে এরকম একটি বিতর্ক দেখা যায়। সেখানে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির মতো ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষির সঙ্গে একঘর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত ঋষিদের সামনে বসেই নারী ঋষি গার্গী ব্রহ্মবিদ্যা বিষয়ক তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন। তর্কের একপর্যায়ে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য রাগ করে বলে উঠলেন-

"এবার থামো বাপু তুমি, এরপর প্রশ্ন করলে মাথা তোমার খসে পড়বে"

[বৃহদারণ্যক উপনিষদ:হরফ প্রকাশনী]

কী তেজ সেই ব্রহ্মজ্ঞানী নারী ঋষির। যিনি যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির মতো মহাপণ্ডিতকে তর্কে নাজেহাল করে চলেছিলেন। শুধু কি নারীরা তর্ক করতো? তাঁরা বিচারকের আসনেও বসতো। আদি জগদগুরু ভগবান  শংকরাচার্যের সঙ্গে যেদিন মণ্ডন মিশ্রের বিতর্ক হলো সেদিন তাঁদের বিচারকের দায়িত্ব নেওয়ার মতো  মহাপণ্ডিত কেউ ছিলেন না। তখন সেই ব্রহ্মবিদ্যার আসরে বিচারক হিসেবে ছিলেন মহাপণ্ডিতা, বিদুষী নারী সরস্বতী ভারতী। তিনি টানা আঠারোদিন ধরে এই দুইজন পণ্ডিতের বিতর্কের বিচার করে শেষ রায় দিয়েছিলেন।

[আচার্য শংকর- স্বামী অপূর্বানন্দ-পৃষ্ঠা ৭৭-৮৮]

এমন অনেক শাস্ত্র বেদ-বেদাঙ্গের উদাহরণ দেওয়া যায় নারীদের উপনয়ন সংস্কার, পৌরোহিত্য, বেদ পাঠের পক্ষে। বেদ-বেদাঙ্গের মত স্মৃতি পুরাণ  গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ব্রাহ্মণ মহাশয়দের পুজো করার সময় দেবীকে সোপবীত বস্ত্র অর্পণ করার রীতি আছে। এটি সেই পরম্পরারই একটি অংশ। মনসাদেবীর ধ্যানমন্ত্রে পাওয়া যায়-

"শ্বেতচম্পকবর্ণাভাং রত্নভূষণভূষিতাম্। বলিশুদ্ধাংশুকাধানাং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্ ।

[ব্রহ্মবৈবর্তপু:প্রকৃতিখ: ৪৬ অ]

অর্থাৎ মা মনসা তাঁর নাগ বা সাপকেই যজ্ঞোপবীত হিসেবে ব্যবহার করে, যজ্ঞোপবীত পরেন। এই শ্লোকেই দেবীদের উদ্দেশ্য পৈতা অর্পণ এবং নারীদের উপনয়নের সরাসরি ইঙ্গিত পাওয়া যায় পৌরাণিক যুগেও।

মহিলাদের পৌরহিত্যের, বেদমন্ত্র উচ্চারণের ও ওঁকার উচ্চারণের বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলা যায়,  শুধুমাত্র স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ ও পুরাহিতদর্পণকে যদি কেউ সনাতন ধর্ম মনে করেন তাহলে তাঁর জ্ঞান অসম্পূর্ণ! বেদ বেদাঙ্গের উপর সনাতন প্রতিষ্ঠিত। তাই বেদ বেদাঙ্গ সর্বপ্রথম স্থানে।

অতএব  একথা প্রমাণিত যে-

১| বৈদিককালে নারীদের উপনয়ন হতো। (বেদ-বেদাঙ্গ থেকেই প্রমাণিত)

২| বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় নারীদের যাঁরা উপনয়ন করাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, সেটা যেন সমাজের নজর কাড়ার জন্য না হয়।

৩| নারীদের পৌরহিত্য করার যে অধিকার বৈদিক যুগ থেকেই আছে তা যেন তামাশার পর্যায়ে নিয়ে না আসা হয়।

 

তথ্যসূত্রঃ

১| শতপথ ব্রাহ্মণ-রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন।

২| হারীত ধর্মসূত্র-নির্ণয়সাগর প্রেস।

৩| যম সংহিতা-নির্ণয়সাগর প্রেস।

৪| বৃহদারণ্যক উপনিষদ-হরফ প্রকাশনী।

৫| আচার্য শংকর-উদ্বোধন কার্যালয়-কলকাতা।

৬| রামায়নম্-গীতাপ্রেস গোরক্ষপুর-উত্তর প্রদেশ।

৭| গোভিল গৃহ্যসূত্র-সংস্কৃত পুস্তকভান্ডার।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন