কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৮


অপেক্ষা

“তনুদিদি পাখির মত ডানা মেলে চাঁদের দিকে উড়ে গেল”।

টুপাইয়ের এই বাক্যটা দেখে স্নেহাশীষস্যার ঘ্যাচাং করে কেটে দিলেন। “এটা ‘ডানা’ দিয়ে বাক্যরচনা হয়েছে? গরু কোথাকার!” টুপাই চুপ করে থাকে। ও কাউকে বোঝাতে পারে না রোজ সন্ধ্যেবেলা ও যখন পড়তে ব’সে জানলা দিয়ে তাকায়, দেখতে পায়, ছাদের ওপর তনুদিদি…

এর কয়েকদিন পর তনুদিদি একদিন ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে…

স্নেহাশীষস্যার এই এলাকায় থাকেন না। পরদিন স্কুলে এসে শুনলেন। শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। কেয়ারটেকার গোবিন্দকে বললেন, সেভেন বি থেকে তন্ময় রায়কে ডেকে আনতে।

“স্যার, ডাকছেন?”

“তোর খাতায় সেদিন ‘ডানা’ দিয়ে লেখা সেন্টেন্সটা কেটে দিয়েছিলাম না! খাতাটা নিয়ে আয় তো!”

টুপাই নিয়ে এল। স্যার খাতাটা রেখে দিলেন। বললেন, “এটা আমার কাছে থাক”। টুপাই চলে যাচ্ছিল। স্নেহাশীষস্যার ওকে স্টাফরুম থেকে কিছুটা দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কি সত্যিই তোর তনুদিদিকে উড়ে যেতে দেখেছিলি?”

“রোজই দেখতাম, স্যার”।

“কাউকে বলেছিস কখনো?”

টুপাই মাথা নাড়ে। “কাউকে এসব বলবি না। এসব বলতে নেই। মনে থাকবে?”

স্যারের শেষ কথাটায় যে ভয় ধরিয়ে দেওয়াটা ছিল, টুপাই কাঠ হয়ে গেল। যন্ত্রের মত মাথা নেড়ে চলে গেল ক্লাসে।

এরপর টুপাই স্যারের কাছে বাংলা খাতাটা চাইলেই, তিনি বলতেন, “কোথায় যে রাখলাম খাতাটা… তুই বরং আরেকটা নতুন খাতা বানিয়ে নে!”

টুপাই অবাক হয়ে যেত, স্যারও খাতা হারায়! আর মা শুধু ওকেই বকে।

টূপাইয়ের বাংলাখাতা স্যার খুঁটিয়ে চেক করতেন। আসলে এই ছাত্রটি পড়াশোনায় আহামরি ভালো নয়। কিন্তু সবসময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। তিনি ওকে চোখেচোখে রাখতেন। ভাবতেন আর মাত্র তিন বছরই তো পাবেন!  তারপর…

কৌশিকদের বাড়িতে সেদিন পুরনো বন্ধুদের একটা গেট টুগেদার, বহুদিন পর। সৃজন নামে কৌশিকের মাসতুতো ভাইও রয়েছে। জানা গেল সৃজনের একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। ও যার সম্পর্কে যা বলবে, কোন না কোনদিন সেটা ঘটবেই!”

কেউই শুনতে চাইল না। একমাত্র স্নেহাশীষই বলে উঠল, “আমার সম্পর্কে বলো দেখি!” 

সৃজন বেশ কিছুক্ষণ স্নেহাশীষের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার সঙ্গে একদিন এমন একজনের দেখা হবে, যে তোমার মৃত্যুর কথা আগাম জানিয়ে দেবে”। স্নেহাশীষ তো বটেই, বাকীরাও চুপ করে গেছে। আড্ডাটা আচমকাই ভেঙে গেছিল এরপর।

বহু বছর কেটে গেছে। স্নেহাশীষ এখন এই মাধ্যমিক-মান স্কুলে বাংলার টিচার। বন্ধুরাও যে যার মত পেশায় চলে গেছে। সবার মধ্যে যোগাযোগও প্রায় নেই। সৃজনের কবেকার কথা স্নেহাশীষের মন থেকে ফিকে হয়ে এসেছিল। এখানে তন্ময় রায় নামে সেভেন বি-র এই ছেলেটিকে দেখে সৃজনের কথাটা আবার মনের ভেতর থেকে হঠাতই জেগে উঠল স্নেহাশীষের। ছেলেটা ভীষণ অন্যরকম একেকটা বাক্য লেখে, কিছুদিন পর সেগুলো কীভাবে যেন সত্যিও হয়ে যায়!

স্নেহাশীষস্যার অপেক্ষা করে থাকে, কবে তন্ময় স্যারের সম্পর্কে…

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন