![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
সবুজ শাওন উৎসব
-অ দিদি আমার কাছে ত সবুজ শাড়ি একখান আছে। কিন্তু তার লগে ম্যাচিং সবুজ সায়া ব্লাউজ নাই।
-তাহলে এতোদিন শাড়িটা পড়তেন কী
করে?
-মিক্সি করে।
-মিক্সি?
-ঐ হলুদ লাল যা হোক একটা কনটাস
কালার পইড়া। ঐটাও তো ফ্যাশান।
-এখানে ওসব চলবে না। এটা শাওন উৎসব।
এখানে সবকিছু সবুজ লাগবে।
-অই জন্যই তো কইতে ছিলাম। আমারে
বাদ দেন। আপনেও বা এতে ভিড়সেন কেনো? বিহারি গো ব্যাপার। এটা তো বাঙ্গালির উৎসব নয়।
-বিহারি বাঙালি নয় শম্পাদি। এটা
আবাসনের উৎসব। আবাসনের সবার উৎসব। আবাসনের সব মহিলাদের জন্যই এই উৎসব। আর তাতে প্রধান
আকর্ষণ। "হরাভরা ফেসন প্যারেড"। গতবছর ছিলেন না। এবছর তো আপনাকে কিছুতেই
বাদ দেওয়া যাবে না।
-আমার দ্বারা কিস্যু হইবো না। ডাহা
ফেল হমু। মাঝখান থিকা আপনের দুইশ টেকা জলে।
-সে আমি বুঝবো। আপনি যেভাবেই পারেন
প্যারেডের দিন "হরা ভরা" হয়ে আসবেন। এটাই আপনার কাছে আমার দাবি।
-আইচ্ছা। দেখি কি করন যায়।
আমাদের এই আবাসনটি মিশ্র জাতির। তাতে বাঙালির সংখ্যা কম। তা বলে তো একলসেরে হয়ে থাকা যায় না। আবাসনের দূর্গাপূজা যেমন সবার মিলিত উৎসব। তেমন বাকি উৎসবগুলোও সার্বজনীন হওয়া উচিত। শম্পাদি এখনো বিশুদ্ধ বাঙ্গাল। বহুবছর এরকম একটা মেট্রোপলিটন শহরে থেকেও কেবল বাঙ্গাল ভাষাতেই কথা বলেন।
-কি হইসে তাতে। হক্কলেই তো বোঝে
আমার কথা। কইতে না পারলে কি হইসে। আমিও তো হিন্দি বুঝি।
শম্পাদির রান্নার হাত দারুন। সাধারণ
দিনেই পাঁচ সাতটা পদ রাঁধেন। হাজবেন্ড ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের বড়বাবু। মোটা উপড়ি
ইনকাম। সেরকম তার দৈনিক থলে ভরা বাজার। যদিও অনেকেই মুখ বেঁকিয়ে বলে থাকে।
-দূর দূর সব ঝোপ ঝাড় জঙ্গল। বাঙ্গালরা
তো ঐ সবই খায়।
-কখনো খেয়ে দেখবেন। ঐ ঝোপ ঝাড়ই
শম্পাদির হাতের গুণে অমৃত হয়ে যায়।
শম্পাদির এমনিতে দারুন সুখের সংসার।
একটিমাত্র ছেলে। হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। শম্পাদির কথায়।
-জলপানি পায়।
-জলপানি? সেটা আবার কি?
-ঐ যে ইংরাজিতে যারে কলার কি যেন
বলে।
-ও কলারশিপ?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই।
তবে শম্পাদির বর শম্পাদিকে হাতখরচ
দেন না।
-কি হইবো হাত খরচের? সবই তো উনি
কিন্যা দেন।
এ হেন শম্পাদিকে এবছর শাওন উৎসবের
হরাভরা ফেশন প্যারেডে সামিল করেছি আমি। এন্ট্রি ফি নিজের থেকে দিয়ে। তারপরেও তাগাদা
ও উৎসাহ দিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতিদিন।
-মনে আছে তো শম্পাদি। সব সবুজ।
নেল পালিশ থেকে মাথার টিপ, সব সবুজ।
-হুঁ। দেখতাসি। জোগাড় হইতেসে সব
একটু একটু কইরা। মনে তো লাগে হইয়া যাইবো।
আবাসনের মধ্যেই কিছু কিছু জায়গায় বাগান আছে। তাতে নানারকম ফুলের গাছ আছে। দেখাশোনার জন্য মালি আছে। তার আসল নাম কেউ জানে না। সবাই ডাকে বনমালী বলে। সদাহাস্যমুখ। এবং আজ্ঞাকারী। মানে কথা শোনে।
লোকের আব্দার শুনে সে ফুলগাছের
ফাঁকে ফাঁকে অন্য কিছু গাছও লাগিয়েছে। তারমধ্যে কারিপাতার গাছটা বেশ ডাগর হয়েছে।
আবাসনের সাউথ ইন্ডিয়ান আবাসিকরা সে পাতা রান্নায় ব্যবহার করে।
একদিন দেখি শম্পাদি একগোছা কারিপাতা
হাতে নিয়ে চলেছেন।
-ওমা শম্পাদি। আপনি সাউথ ইন্ডিয়ান
ডিস ও রাঁধতে শিখে গেছেন?
-আরে না না। নিছিলাম এক কাজে। কিন্তু
কাজডা হইলো না। তাই এখন এগুলা মিসেস রাওরে দিমু। সে তাগো রান্নায় দিবো। নষ্ট তো করা
উচিত নয়।
-আপনি কি কাজের জন্য নিয়েছিলেন?
-আছে আছে। এখন কমু না। যাই বনমালীরে
কইয়া দেখি। অন্য কি গাছের পাতা পাওয়া যায়।
শম্পাদি হন হন করে চলে গেলেন।
দেখতে দেখতে শাওন উৎসবের দিন এসে গেল। এবং এসে গেল হরাভরা ফেসন প্যারেড-এর দিন।
সবার সাথে শম্পাদিও হাজির।
এই হরাভরা ফেসন প্যারেড টি আসলে
একটি প্রতিযোগিতা। সবাইকে সবুজ পোশাক টোশাক পরে মঞ্চে উঠতে হবে। মঞ্চে বিচারকরা আছেন।
তারা গুনে গেঁথে দেখেন। প্রতিযোগি মহিলাদের পরনে কটা সবুজ আইটেম। যার নাম্বার অফ আইটেম
বেশি হবে সেই বিজয়িনী।
একে একে প্রতিযোগিনীরা মঞ্চে উঠছেন।
গোনা গাঁথার জন্য সময় লাগছে। হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস।
-আমারে ডাকবো কহন। আমি যে জ্বালায়
মরতেসি। ঢোক গিলতে পারতাসি না।
-কেন কি হলো? ঢোক কেন গিলতে পারছেন
না?
-একবার গিলসি। কিইইই তিতা।
অবশেষে শম্পাদির ডাক এসে গেল। উনি হড়বড় করে মঞ্চে উঠে গেলেন। তার সাজগোজের সবুজ গোনা শুরু হলো।
গোনা গাঁথার পর উনি একরকম ছুটতে
ছুটতে ঘরে চলে গেলেন।
একসময় প্রতিযোগিতা শেষ হলো। কি
আশ্চর্য। বিজয়ী হয়েছেন শম্পা সাহা। অর্থাৎ আমাদের শম্পাদি। তার সবুজ আইটেমের সংখ্যাই
সবচেয়ে বেশি। প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই বাজিমাত। কিন্তু কোথায় তিনি? বারবার এনাউন্স
করেও তাকে পাওয়া গেল না। পুরষ্কার একটি ফিতে বাঁধা মেডেল। আর একটা দশহাজার টাকার চেক।
মঞ্চে উঠে সভাপতির হাত থেকে নিতে হবে। সভাপতি সন্মানীয় নাগরিক। তাকে এই অনুষ্ঠানের
জন্য ডেকে আনা হয়েছে। তার সময়ের দাম আছে। বারকয়েক শম্পাদির নাম ডেকে অনুষ্ঠান পরিচালকরা
রানার্স আপ মালিনী আহুজাকে ডেকে নিলেন। সর্দারণী সবুজ পাগড়ি মাথায় জড়িয়ে বাকিদের
টেক্কা দিয়েছেন।
কিন্তু এতো সবের মধ্যে শম্পাদি
কোথায়? তিনি কোথায় উধাও হয়ে গেলেন?
অনুষ্ঠান শেষে গেলাম তাদের ফ্ল্যাটে।
বেল বাজাতেই ভেতর থেকে সাড়া পেলাম। তার মানে ঘরেই আছেন। তাহলে প্রাইজ নিতে গেলেন না
কেন?
দরজা খুললেন মুখভর্তি ফেনা আর হাতে
টুথব্রাশ নিয়ে শম্পাদি দেখা দিলেন।
-একি প্রাইজ নিতে গেলেন না কেন?
কতোবার আপনার নাম ডাকা হলো।
-শুনসি তো। কিন্তু যামু কেমনে?
আমার যে পেটের আঁইত শুদ্দো তীতা হইয়া গেছে। কতোবার যে দাঁত মাজসি। মুঠা মুঠা চিনি
খাইসি। কিছুতেই কমে না। বনমালী হারামজাদা কি পাতা যে দিল?
-পাতা?
-হ। পাতা দিয়াই তো সব করসি। সবুজ
টিপ, সবুজ কানের দুল, নোখের নেইলপলিশ। মাথার ওপরের সাজ। আর লিপস্টিকও।
-লিপস্টিক?
- হ্যাঁ। ভালো কইরা সবুজ পাতাবাটা
ঠোঁটে মাখাইয়া লিপস্টিক করসি। আর হেইডাই তো কাল হইসে। ঠোঁট ভালোই সবুজ হইসে। কিন্তু হালার কিইইই রাম তীতা।
বুঝলাম কিভাবে শম্পাদির সবুজের
সংখ্যা সবার চেয়ে বেশি হয়েছে।
বনমালী কে ধরতেই সে বললো-
-মৈনে তো কারিপত্তা, তুলসীপত্তা
সব দিয়া থা। সব বেকার হো গয়া তো অন্তমে য়হ পাত্তা দিয়া।
তার আঙ্গুলের দিশা দেখে গাছটাকে
চেনা গেল।
কালমেঘ গাছ।
উরিব্বাস এ তো যম তীতা।
তা হোকগে। শম্পাদি কালমেঘের তীতা
সহ্য করে প্রতিযোগিতায় বিজয়িনী তো হয়েছেন।
সুতরাং হিফ হিফ হুররে শিরিমতি শম্পা
সাহা। হিফ হিফ হুররে কালোমেঘ।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন