কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

শুভ মৈত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


 

নভেম্বর

পা’দুটো যে কবে এমন ছোট বড় হয়ে গেল, জানতে পারেনি প্রভাতী। বাড়ির ভেতর ঘর-উঠোনের মেঝে নিজেরাই উঁচুনিচু মানিয়ে নেয়। এখন এই বড় রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে টের পেল, দুটো পা আর সমান নেই। হাঁটতে গিয়ে ঝুঁকে পড়তে হয় একদিকে।

কতটুকু আর রাস্তা! ওই তো বড় রাস্তায় উঠে ডানদিকের ফুটপাথ ধরে খানিক যাওয়া, তারপর রাস্তা পেরোলেই ব্যাঙ্কের দরজা।

সে পথটুকুই অনেক বড় লাগছে। পা দুটো আর একভাবে পড়ে না। বড়রাস্তা অবধি পৌঁছতেই অনেকটা সময়। এর মধ্যে ঘাম মুছতে হলো দুইবার। অবশ্য আঁচল দিয়ে মুখ মোছার ফাঁকে, এক মুঠিতে শক্ত করে ধরে রেখেছে কাগজ। খোকা কোন নেতাকে দিয়ে সই করিয়ে এনেছে। ওটার যেন ক্ষতি না হয়।

রাস্তায় অজস্র মানুষ, গাড়ি-অটো-টোটো-বাইক। সবার তাড়া। বিচিত্র সব শব্দে কানে তালা লেগে যায়। এর মাঝে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এক বৃদ্ধার দিকে নজর পড়ে না কারও। তাঁর চিন্তা এই পা নিয়েই ওই মোড়টায় পৌঁছুতে হবে।

--কালা নাকি? হরেন মারছি, শুনা যাচ্ছে না? ফের রাস্তায় বেরিয়েছে?

ধমক খেয়ে সম্বিত ফেরে প্রভাতীর। এইখানটায় বাজার বসে, দুপাশ দিয়ে চেপে ধরেছে বড় রাস্তাকে, পায়ে চলা মানুষ, গাড়ি, টোটো সব এইটুকু জায়গা দিয়ে। আর একটু হলেই টোটোটা ধাক্কা মেরে বসেছিল।

খোকার বাবা প্রভাতীকে কখনও একা বেরোতে দেয়নি। ওই মানুষটার হাত ধরেই টাউন দেখা, নাইট শো’তে সিনেমা। কয়েকবার খোকাকে নিয়েই। ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসের ভেতরগুলো কিরকম জানতেই পারেনি প্রভাতী। ওর অফিসের ঠিকানাও জানতো না। মানুষটা চোখ বুঁজে প্রভাতীর গায়ে সাদা শাড়ি আর হাতে একটা ব্যাঙ্কের বই ধরিয়ে দিয়েছিল। শাড়িটা নিজেই সামলায়, বইটা খোকা। শুধু বছরে এই একটা দিন ব্যাঙ্কে দেখাতে হয় নিজের মুখ।

এগোচ্ছে বুড়ি। পালংশাকের ঝুড়ি সামলে, পেছনের মানুষের বিরক্তি গায়ে না মেখে, গাড়ির হর্ণ শুনতে না পাওয়ার অছিলায় এগোচ্ছে। এখন তাকিয়ে থাকতে হবে, রাস্তা পার হওয়ার জন্য। গাড়ি ঘোড়া একসময় থামে সিগন্যালে। হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়লো সবাই, এত লোকের অপেক্ষা ছিল রাস্তা পার হওয়ার? ওকে ধাক্কা দিয়েই পার হচ্ছে সবাই।

ব্যাঙ্কের মুখটায় এত মানুষ কেন? সবাই ওর মতোই বুড়োবুড়ি, তবে অনেকের সাথেই জোয়ান ছেলে বা মেয়ে আছে। খোকাকে বড় মুখ করে বলেছিল, ‘ও আমি একাই পারবো, তুই ভাবিস না। একটু বেরনোও হবে’। ও জানে খোকা নিশ্চিন্তও হয়েছিল!

--ও মাসী হেঁটে হেঁটে চললেন কোথায়? আব্দার নাকি! দেখছেন না লাইন আছে? পেছনে এসে দাঁড়ান। --ধমক খেয়ে থমকে দাঁড়ায় প্রভাতী।

ও বাবা, এত বড় লাইন! কখন পৌঁছাবে ব্যাঙ্কের ভেতরে? ওসব ভেবে লাভ নেই, প্রভাতী বোঝে। একদম পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে সামনে কতগুলি মাথা। এখানে কোনও ছায়া নেই। এবারে অঘ্রাণ মাসেও শীত আসার নাম নেই। আঁচল দিয়ে আরেকবার মুখ মোছে। কপালের ভাঁজগুলি মোছার চেষ্টা করে, যদি সাথে থাকা ছবির সাথে না মেলে!

ব্যাঙ্কের দরজা অবধি পৌঁছুতে এখনও কয়েকটা মাথা বাকি, ওখানে একটু ছায়া আছে। হাতের কাগজটা বেশ কয়েকবার দেখে নিয়েছে, যক্ষের ধন।

উফফ, লাইনটা যেন এগোতেই চায় না, সবারই কি পা ছোট-বড় হয়ে গেল? ভিড় আর গরমে যেন দমবন্ধ হয়ে আসে প্রভাতীর। ঘরে এই সময়টায় নাতিটাকে ধরতে হয়, বৌমা’র অনেক কাজ থাকে। আজকে নিজে নিজেই সামলাতে হবে।

--মাসীমা, এগোন-- লাইন এগিয়ে গেছে। খেয়াল করেনি প্রভাতী। তাড়াতাড়ি সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর একটু এগোলেই ছায়া।

--হবে হবে সবার হবে, ব্যাঙ্কের কি আর কাজ নেই? --কাউন্টারের ওপার থেকে গম্ভীর গলা ভেসে আসে। ঢুকেছে ভেতরে, এখানে কলের ঠান্ডা আছে, তবু প্রভাতীর ঘাম শুকোয় না। চোখে পড়ে কাউন্টারের ওপারের ছেলেটা ফোনে ব্যস্ত। খোকার বয়সীই হবে বোধহয়। একসময় ফোনে কথা বলতে বলতে উঠেও গেল। কাউন্টারের বাইরে দাঁড়ানো সবাই অপেক্ষা করে। অধৈর্য হয়, নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে, প্রভাতী জানে না কী বলতে হয়। মেনে নেওয়াটাই তো শিখেছে সারাজীবন ধরে।

এই তো আবার এসে বসেছে, একে একে ডাকছে। কী সব জিজ্ঞাসা করছে। তারপর ঘটাং করে কাগজের ওপর ছাপ দিয়ে দিল। পরের জন। লাইনটা এগোচ্ছে কাউন্টারের দিকে। আর একজনের পরেই।

প্রভাতী সরকার? ফর্ম নম্বর ২৩১? আর একবার দেখে নেয় প্রভাতী। এর আগেরবার নম্বর ছিল ২৩৪। মাঝের তিনজন মুছে গেছে, ব্যাঙ্কের খাতা থেকে, জীবনের খাতা থেকেও। এগিয়ে এসেছে প্রভাতী।

সারাদিনের সব চেষ্টা সত্ত্বেও ভাঁজ পড়ে গেছে কাগজটায়। বারবার টান করার চেষ্টা করে। ছোট-বড় পা’দুটোর ওপর ভর করেই যতটা সম্ভব সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কাউন্টারের সামনে। এগিয়ে দেয় কাগজ... আছি।

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন