![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
রাখোমণি মুন্ডাদের গ্রামে যখন বাঘ এসেছিল
(১)
রাখোমণি মুন্ডাদের গ্রামে যেবার প্রথম বাঘ আসে, তখন তার বয়স আটের মত আর তার ছোট ভাইয়ের পাঁচ। দুদিন আগে থেকেই গ্রামে সবাই ভয় পাচ্ছিল। কারণ গত দেড় মাসে প্রায় জনা ছয়েক মানুষ পরপর মারা গেছে। বনের খুব ভেতরেও যায়নি তারা। এই ত’ চুনা নদীটা গ্রামের কোল ঘেঁষেই, রাখোমণিদের বাড়ির পাশ দিয়েই তিরতির করে বয়ে চলেছে-আর নদীটুকু পার হলেই ওপারে বন। সুন্দরবন। বাবা জনমজুরির কাজে বের হবার পর রাখোমণি মায়ের সাথে তাদের মাটির ঘরের ঢাল বেয়ে নদীর তির পর্যন্ত নামতো- মা যদি বড় বড় থালা-বাসন নদীর জলে ছাই দিয়ে মাজতো ত’ রাখোমণিও মাঝে মাঝে মা’কে সাহায্য করতো। তারপর হাঁসগুলোকে নদীতে ছেড়ে দেওয়া বা সন্ধ্যায় যখন ওরা নদী থেকে উঠে, গা ঝেড়ে হেলে-দুলে তিরে হাঁটতে থাকে, তখন ওদের ডানা ধরে এনে নদীর ঢাল বেয়ে তাদের মাটির কুঁড়ের সামনে এসে হাঁসগুলোকে একটি পাতলা লোহার জালির নিচে রেখে দেওয়া... রাখোমণি সেই কত অল্পবয়স থেকে এসব কাজ করে এসেছে।
তু মোর বিটি বঠে! বিটিমানুষের কুনো
বসিয়া খাওয়া নাহি। সেয়ান হলেই সোসুরাল যেতে হব্যেক! মা হাসতো।
ও মা-মোক তু বনে কবে লিয়্যা যাহিবি
বল্!’
যে যে সকালে বাবার দিনমজুরির কাজ
না থাকলে বা কাজ না পেলে আর মা রাখোমণি আর তার ছোট ভাইকে বাবার মা বুড়ির কাছে রেখে
যায়, সেসব সকালে রাখোমণিরও খুব মন চায় বাবা আর মার সাথে ছোট্ট ডিঙ্গিটায় উঠে বসে। ওদের
সাথে অল্প দূরের বনের কাছে চলে যাবে... নদী থেকে তুলবে মাছ কি কাঁকড়া আর তারপর আবার
গ্রামে ফিরে এসে হাটে সেই মাছ বিক্রি করতে যাবে! মাছ আর কাঁকড়া বিক্রির পয়সায় আনবে
চাল-ডাল-তেল-নুন আর রাখোমণি ও তার ভাইয়ের জন্য কয়েকটা জিলিপি কি বাতাসা, মাটির পুতুল
কি চুল বাঁধার রিবন!
’ওহ্-জঙ্গল বুঝি খুব আরামের ঠেকিছে?
উ বাবা- উখানে বাঘ আছে, কুমির আছে- না- আরো সেয়ান হ। তারপর জঙ্গলে যাস কেনে?’
কিন্ত এমন এক সকালে রাখোমণির বাবা
যেদিন জনমজুরির কাজ পায়নি, মা আর বাবা মিলে ডিঙ্গি নৌকা চেপে বনে যাবার আগে পান্তা
ভাত আর পেঁয়াজ-মরিচ ডলে উঠানের রোদে খাচ্ছিল- মা ত’ বন থেকে ফিরে এসেই রান্না করে আবার
হাত মেশিনে পাড়ার মেয়েদের সায়া-ব্লাউজ সেলাইয়ে বসবে আর মনের দুখে গান গাবে গুনগুনিয়ে...
কি যে মার এত দু:খ সেটা সেই বয়সে বুঝতো না রাখোমণি তবে সেই সকালে মা আর বাবা পান্তা
ভাত খেয়ে বনের দিকে যাবার তোড়জোর করার মূহুর্তেই এলো এই পাড়ার মোড়ল ভজহরি মুন্ডা,
’ওরে ও বাবুরাম- বলি কি আজ তুদের
জঙ্গলে যিয়ে কাম নাই!
’জঙ্গলে না গেলে খাব কি? এই কার্তিক
মাসটায় জন খাটার কাজ আছে কুনো- সর্দার?’
’ওরে একটা বাঘ গত রেতে এ শালা চুনা
গাঙ্গের ওপারে খাড়া ছিল!’
’যাও সর্দার- হাঁড়িয়া টেনেছিলে
কাল? হামাদের ডাকোনি?’
’বটে- সর্দারের সাথে মস্করা? টাইগার
কমিটি থিকে হামাদের সাবধান হতে বলিছে। টাইগার কমিটির ইদ্রিস আলী কাল রাতেই হামাকে ফোনে
সাবধান হতে বলিছে!’
সেই শুরু হলো সারা পাড়ায় ফিসফাস
থেকে ভয়ার্ত চেঁচানি। সত্যিই কি বাঘ আসবে? বাবা-মা আর নৌকা নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলো না। মা
সায়া-ব্লাউজ বানানোর হাত মেশিনটাও বের করলো না। ঘরে ঘরে সবাই ভয়ে কেমন কাঁটা হয়ে আছে। চুলায় দুপুরের রান্না চাপাতেও
যেন ভুলে গেছে মা-কাকিরা!
’আজ কি ইস্কুলে যাবক নাই’? স্কুল
কামাই করতে পারার আনন্দে খলবল করে উঠেছিল রাখোমণি।
’যাহার যা চিন্তা- হামার বিটি শুধু
স্কুল যাইবার না চায়!’ রাখোমণির মা ফুলমণি ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল। আর সে সময়েই শোনা গেল
দূর থেকে ফরেস্ট বিভাগের মাইকিং:
’সাবধান - সাবধান! শ্যামনগর উপজেলার
দাতিনাখালি মুন্ডাপাড়া সহ অত্র এলাকার সকল নর-নারীকে জানানো যাইতেছে যে একটি ম্যান
ইটার বা নরখাদক বাঘ লোকালয়ের খুব কাছে চলিয়া আসিয়াছে। সাবধান – সাবধান - নরখাদকটিকে
লোকালয়ের খুব নিকটবর্তী, বিপজ্জনকভাবে নিকটবর্তী হইতে দেখা যাইতেছে! আপনারা প্রাণে
বাঁচিতে অনতিবিলম্বে
আপনাদের এলাকার সাইক্লোন শেল্টারে
চলিয়া যান।’
এমন ঘোষণার পরও গ্রাম জুড়ে সবার
দ্বিধা। যাবে কি যাবে না? ঘরে ঘরে সবার কত কাজ! সব ফেলে দুই মাইল হেঁটে সত্যিই কি ঐ
সাইক্লোন শেল্টারে যেতে হবে? দু’মাস আগে একবার এমন বাঘের ভয়ে তারা সবাই মিলে সাইক্লোন
শেল্টারে গেছিল ঠিকই কিন্তÍ বাঘ আসেনি।
’সবাই সাবধানে থাকো- কুড়া-বাচ্চাদের
স্কুলে যাইয়া কাজ নাই- কিন্তÍ ঘরেই থাকো! বাঘ আসিবে না!’
বুড়ো-বুড়িরা তামাকপাতার গুঁড়ো দাঁতের
নিচে ঘষে। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে থাকে। রাখোমণি স্কুল না যাওয়ার আনন্দে এবং বাবা-মা-ও
ঘরে থাকার সুখে ছোট ভাইটার সাথে এবেলা ঝগড়া করা বাদ দিয়েছিল যদিও মা থেকে থেকে বলছিল,
স্কুল না গেল্যি তবু বই-খাতা লিয়া বৈঠ যা- নাকি হামার মত দর্জি হবি আর বাবার মত জোন
খাটিবি!’ আর তখনি একদম যে শান্ত, নিস্তরঙ্গ চুনা নদীতে রাখোমণি নিজেই থালা-বাসন মাজতে
নেমে যায় কি হাঁস চরাতে নেমে যায় সেই অল্প জলের নদীতে দেখা গেল দুপুরের ঝলমলে আলোয়
উজ্জ্বল হলুদ-কালো ডোরাকাটা এক বিশাল বাঘ সাঁতার কেটে আসছে।
’ও ভগমান!’
রাখোমণির পিতামহী মরণপণ আর্ত স্বরে
চেঁচিয়ে ওঠে, ‘উ বাঘাটার বনের ঐপার যাবার কথা ছিল্য। ও ভুল করিয়া নদীর এই পারে চলিয়া আসিবার লাগিছে- এখনি পাড়ে
সাঁতার দিয়া উঠিয়া হামাদের সব ক’টাকে খাব্যেক!’
এক লহমায় গোটা পাড়ার শ দেড়েক মানুষ
থালা-বাসন, আনাজ কোটার বটি-চুবড়ি, মশলা বাটার শিল-নোড়া, ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি সব ফেলে
দৌড়তে থাকে। তিন বছরের শিশু থেকে তিরাশি বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা- সবাই দৌড়াতে থাকে। রাখোমণিও
ছুটতে থাকে বেদম।
(২)
’তোমার নাম কি, আম্মু?’
জামিল স্যার রাখোমণির ময়লা মোজা
আর তেল চিটচিটে চুলে বাঁধা রাবার, গত বছর এ গ্রাম থেকে বিয়ে হয়ে যাওয়া শিউলি মুন্ডা
দিÕর পুরনো ইউনিফর্ম গায়ে ঢলঢল রাখোমণির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
রাখোমণি তখন মাত্রই ‘দাতিনাখালি
উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’-এ ষষ্ঠ বনাম সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীদের ফুটবল খেলায় ক্লাস সেভেনের পক্ষে দু/দুটো গোল দিয়ে ক্লাসকে
জয়ী করার ক্লান্তি ও আনন্দে হাঁপাচ্ছিল।
’আমার নাম, স্যার? আমার নাম রাখোমণি
মুন্ডা।’
’তুমি এত ভাল দৌড়াও- আগে কোথাও
খেলা শিখেছো?’
রাখোমণি এই কথার উত্তর কি দেবে
বোঝে না। গতকালই সে শুনেছিল যে স্কুলে মেয়েদের একটি ফুটবল প্রতিযোগিতা হবে। মাধ্যমিক
বিভাগে ক্লাস সিক্স আর সেভেনের মেয়েদের লড়াইয়ে ভাল খেললে বা একটা গোলও কেউ করতে পারলে
একদম পাঁচশো টাকা প্রাইজ মিলবে। মার একটা কাশি হচ্ছে আজ প্রায় এক মাস। তাকে ডাক্তারের
কাছে নিয়ে বুকের ছবি তুলবার, কফ-থুতু-রক্ত পরীক্ষার টাকাও বাসায় নেই। তাই না রাখোমণি
ভাবলো সে খেলবে। অবশ্য প্রায় এক মাস হয় তাদের স্কুলের মহিলা স্পোর্টস টিচার জাহানারা
ম্যাডম অবশ্য মেয়েদের ফুটবল খেলা শেখাচ্ছিলেন। তিনি নাকি আগে ঢাকাতেও খেলেছেন। জামিল
স্যার আজই প্রথম ক্লাস সিক্স বনাম সেভেনের মেয়েদের খেলার রেফারি হিসেবে ছিলেন।
রাখোমণি বোকার মত মাথা নাড়ে। জামিল
স্যারের প্রশ্নগুলো সে বোঝেও না।
’এই দৌড় তুমি কোথায় শিখলে?’
একথায় রাখোমণি হাসে, আগে অত দৌড়াইতে
পারিতাম না, স্যার! কিন্তÍ দুই বছর আগে যখন বাঘি আসিলো হামাদের গ্রামে, তখন যা দৌড়
দৌড়াইতে হইলো- তাই আর দৌড়াইতে মোর ভয় করে না!’
’সাবাশ!’
(৩)
’ঐ জামিল স্যার না কে- ও যেন না আসে। হামি বেটা মানুষ বলিয়া জানি যে কুনো বেটা মানুষকে বিশ্বাস নাই! হামার লেড়কি ফুটবল খেলিবে না- বেটা মানুষের মত শার্ট-প্যান্ট পরিবে না- এটাই সাফ কথা!’
বাবুরাম মুন্ডা চেঁচিয়ে উঠে রাখোমণির
মার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকায়, তুর এত লোভ? পয়সার লোভ? বিটিকে সবার সামনে উদলা করিয়া পয়সা
কামাবি? ফির যদি তুর মেয়ে ফুটবল খেলিয়া বাসায় ফিরে ত’মার দিয়া হাড্ডি গুঁড়া করিয়া দিব!’
ক্রুদ্ধ রাখোমণি সেবার প্রথম বাবার
মুখে মুখে জবাব করেছিল, মাওটা হামার আজ একমাস ধরিয়া বিমারে মারা যায়। তু কেমন মানুষ
যে একটা ডাক্তার দেখাইলি না? হামি যদি ফুটবল খেলিয়া খারাপও হই তবু হামার মাওকে হামি
ডাক্তারের কাছে লিয়া যাব!
বাবা উত্তরে আরো এক দফা গালাগালি
করে বের হলেও ঘন্টা দুই পরে বাড়ি ফেরে খুব নরম মুখে। হাতে তার একটা নিউজ পেপার: ‘দৈনিক
সাতক্ষীরা সংবাদ।’ গতকালের পেপার। সেখানে রাখোমণি মুন্ডার ছবি ছাপা হয়েছে সাতক্ষীরার
উদীয়মান কিশোরী ফুটবলার প্রতিভা হিসেবে। স্থানীয় ক্রিড়া-বোদ্ধারা এই কিশোরীর পায়ে প্রতিভার
দ্যুতি আবিষ্কার করেছেন জাতীয় কঠিন বাংলায় লেখা পেপার সহজ ভাষায় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে
হাটের জনতা।
’হামাকে মাপ করিয়া দে- মা! হামি
তোর জনমজুর খাটা বাপ আছি। আজ হাটে সবাই হামাকে কত খাতির করিলো! খোদ ইউপি চেয়ারম্যান
ডাকিয়া কথা কহিলো। চা খাওয়াইলো- হামাকে তুই মাপ করিয়া দে!’ বাবা অঝোরে কাঁদতে থাকে।
(৪)
’তাহলে এই মেয়েটার কথাই বলছিলে?’
’জি- ভাই।’
’তুমি তাহলে সব ছেড়ে এখন এই সুন্দরবনের
কাছে এসে ফুটবলের কোচিং করাচ্ছো?’
’আপনি ত’ জানেন সবই। কেরিয়ারের
ভাল সময়টায় কয়েকবার ইনজুরি, ক্লাব ফুটবলের পলিটিক্স ট্যাকল করতে না পারা- নিজের যখন
কিছু হলোই না, দেশের বাড়িতে কিছু ভাল ছেলে-মেয়েকে যদি অন্তত: বড় করতে পারি-আপনি ওর
খেলাটা- ভিডিও তুলছিলাম আমার মোবাইলে- একবার দ্যাখেন।’
’আচ্ছা-দেখছি- আরে মেয়ে, বসো! নাম
কি তোমার?’
রাখোমণি খানিকটা বিব্রত হয়ে উত্তর
দেয়, হামার নাম- স্যার- আমার নাম রাখোমণি মুন্ডা।’
সামনের ক্লিন শেভ, ঝকঝকে নীল জিন্সের
শার্ট-প্যান্ট পরা, সাহেব সাহেব চেহারার লোকটির দিকে মোবাইল এগিয়ে দিলেন জামিল স্যার।
সাহেব সাহেব চেহারার লোকটি খানিকটা উদাসীন ভঙ্গিতেই মোবাইলের দিকে চোখ রাখেন। চোখ রাখতে
রাখতে তাঁর ভ্রু কুঁচকে যায়।
’বাপসরে- এ ত’ওয়েন্ডি রেনার্ডের
মত ওম্যান ডিফেন্ডার হতে পারবে। কোন্ ক্লাসে পড়ো তুমি?’
’ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠ্যেছি।’
’বাবা কি করেন তোমার?’
রাখোমণি এক মুহূর্ত দমে যায়। তারপর
সটান সত্য কথাই বলে, ‘দিন মজুরি করে।’
’ওহ্- আর মা?’
’দর্জির কাজ করে।’
সাহেব সাহেব চেহারার লোকটি আরো
চমকে যান, এত ভাল দৌড়াও তুমি! এই দৌড় কার কাছে শিখেছো?’
অবাক রাখোমণি পুনরায় উত্তর করে-
ভেতরের সত্য কথাটাই বলে ফ্যালে, ‘সেই যে তিন বছর আগে একবার হামাদের গ্রামে একটি বাঘ
ঐ চুনা নদী সাঁতরাইয়া আসিতে লাগিলো, তখন হামারা সবাই দুই মাইল দূরের সাইক্লোন শেল্টারের
দিকে দৌড়াইলাম বঠে! সি থিকে হামি ভালা দৌড়াই!’
’সাবাশ!’
সাহেব সাহেব চেহারার লোকটি উঠে
দাঁড়িয়ে এবার প্রথমে রাখোমণি আর তারপর জামিল স্যারের পিঠ চাপড়ে দেন, কিন্ত একে ত’ এখানে
রাখলে চলবে না। কিছুদিন সাভারে বিকেএসপিতে ট্রেনিং পাক। একে ঢাকায় নিতে হবে।”
(৫)
বিকেএসপিতে আসার আগের রাতে মা কত কি যে রেঁধেছিল! তাদের গরীব ঘরে যতটা সম্ভব। নদী থেকে ধরা অনেক জ্যান্ত পুঁটি আর টেংরা ভাজি। তাল পিঠার বড়া। মা রান্না করে আর গুনগুনিয়ে দু:খের গান গায়। সেই কবে বিহারের রাঁচি আর ছোট নাগপুর থেকে দুশো বছর আগে এই বাদা বনে তাদের বাপ-দাদাদের পাঁচঘর মানুষের এখানে চলে আসার গল্প। পাঁচ বিঘা জমির আশায় এখানে এসে সুন্দরবনে বাঘ আর কুমীরের সাথে লড়াই করিয়া করিয়া বাদা সাফ করিয়া ধান চাষ করা। কিন্তÍ সে ধান গেল ত’জোতদারের গোলাতেই। তারা সেই ভূমিহীনই রহিলো।
’দু:খ করিস কেনে মা? হামি তোর বেটি
বলিয়া কি বেটার কাজটাও করিতে পারিব না?’
’তুই আমার বিটি আবার বেটা। ওরে
বেটি- মহাভারতে শিখন্ডিনী যদি ভীষ্মঠাকুরের সাথে অস্ত্র না ধরিতো, তবে কুনোদিন ধর্মের
জয় হইতো? সে নারী হইয়া অস্ত্র হাতে লয় নাই?’ বলতে বলতেই রাখোমণির মা ফুলমণি মুন্ডা
আবার চিন্তিত হয়ে পড়ে। শিখন্ডিনীর জীবনটা কি ভাল ছিল? সারাজীবন ও আগের জনমের অবিচারের
শোধ নিতে নারী হইয়া নারীর জীবন না কাটাইয়া ঘোড়া চড়িলো আর পুরুষের পোশাকে যুদ্ধ করিলো।
বিহা-শাদি, মরদের সোহাগ-ভালবাসা কিছুই না পাইলো বটেক। তাহার মেয়ে রাখোমণির কপালেও কি
তাহাই হইবে? শুধু খেলিবে আর কাপ হাতে ছবি তুলিবে? গলায় মেডেল, হাতে কিছু টাকার খাম
আর ক্যামেরা হাতে সামনে সাংবাদিক? ছেলেদের মত জামা-কাপড় গায়ে... উহার চোখে কাজল, কপালে
বিন্দিয়া, হাতে কঙ্কণ উঠিবে না? কিন্তÍ তাহাতেই বা কি লাভ? রাঁধো-বাড়ো, মরদের মন ভাল
থাকিলে আদর-সোহাগ করিবে আর মন খারাপ হইলে পিটাইবে। বাচ্চার জন্ম দাও, তাহাকে বড় করো
না... যাহা হয় হবে। বেটির তাহার কপালে যা লিখন তাই হবে।
’বুঝিলি মা?’ সত্যবতী মুন্ডা এক
আকাশ নক্ষত্রের নিচে সেই চুনা নদীর তিরে মাটির উঠানে বসে মেয়েকে বলে, ’পাঞ্চালী আর
শিখন্ডিনী একই বাপের দুই মেয়ে। শিখন্ডিনী ত’সারা জীবন পুরুষের বেশে থাকিলো আর যুদ্ধ
করিলো। পাঞ্চালী ঠিক সময়ে বিহা-শাদি করিতে গেলো লেকিন উহার এক স্বামীর জায়গায় পঞ্চ
স্বামী-উহারও কপাল সুখের হইলো না। বিটি মানুষের কপাল আর সুখের হয়ই না!’
এটুকু বলে কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকে
ফুলমণি মুন্ডার, থাক- ব্যাগ গুছা- বেটি। কাল সকালে ঢাকা যাবি!
(৬)
কাঠমান্ডুতে যখন বিমান থামলো, হতভম্ব রাখোমণির তখনো মনে হচ্ছিলো যে তবে যা কিছু ঘটেছে সবই সত্য? তার এই সবুজ একটা পাসপোর্ট হওয়া, এই উড়োজাহাজের খোলের ভেতর ঢুকে আনাড়ি হাতে সিট বেল্ট বাঁধা, মোমের পুতুলের মত দেখতে বিমানবালাদের এসে হাসি মুখে খাবার আর জ্যুস দেওয়া, এই মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া- এসবই সত্যি?
কাঠমান্ডুতে নামতেই গায়ে খেলে গেলো
একটু হিম হাওয়া। তাদের হোটেলে নিয়ে যাবার বাসে উঠে বসতেই দেখা গেল শহরের কোল ছুঁয়ে
যাওয়া হিমালয় পাহাড় যার নাম আগে শুধু সে নিউজপ্রিন্টের কাগজের ভুগোল বইয়ে পড়েছে। তারপর
বাসে চেপে যে আলিশান হোটেলে তাদের নামানো হলো- যে দুধে ধোওয়া ঘরের ভেতর তাদের থাকতে
দেওয়া হলো- হায়, তার মা-ছোট ভাই-বাপ এখন কেমন আছে? কিন্তÍ এখন যেন কারোর কথা ভাবারও
সময় নেই। আগে ত’ ফ্রেশ হয়ে খাওয়া, তারপর কোচের সাথে বসা- সকাল থেকেই প্র্যাক্টিস।
’শরীরকে ফিট রাখতে দৌড়ের বিকল্প
নেই। রোজ সকালে উঠে সবার আগে দৌড়!’
ট্রেনার স্যার আর ম্যাডামরা যখন
রোজ ভোরে এটা বলতে থাকেন, রাখোমণির শুধু মনে পড়ে পাঁচবছর আগের এক শীতে তাদের গ্রামের
কোল ঘেঁষা চুনা নদীতে যখন বাঘ এলো- আর সে দৌড়াতে থাকলো- বাঘ আসিছ্যে- বাঘ আসিছ্যে-রাখোমণি,
তুই দৌড়া-বাম দিক থেকে সামনে এগিয়ে এসেছে ভারতের ফরোয়ার্ড তন্নিষ্ঠা কুমারী- তাকে আলতো
পাশ কাটিয়ে বল সামনে এগিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ম্যা ম্যা চিং- ম্যা ম্যা চিংয়ের পা থেকে
বল চলে গেলো সুরভি আক্তারের কাছে- সুরভি পাস বাড়ালেন ফারজানাকে- ফারজানার কাছ থেকে
বল চলে গেল রাখোমণি মুন্ডা- তিনি ডিফেন্সে খেললেও এই মুহূর্তে দৌড়ে যাচ্ছেন মিড-ফিল্ড
ছাড়িয়ে আরো সামনে- রাখোমণি মুন্ডা- দৌড়া- রাখোমণি- নয় বাঘ আসিয়া কামড়াবে তোকে- ই গ্রামের
সকল মানুষকে- সাইক্লোন শেল্টারের দিকে সিধা ছুটতে থাক!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন