কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


ফুলদানী

ভাঙ্গার মধ্যে, ফুলদানীটাই ভেঙ্গেছে। অথচ, অনেক কিছুই ভাঙতে পারত। টেবিলের ওধারে রাখা কাটগ্লাসের ফোটোফ্রেম, পোর্সিলিনের মেরী, লাভ বার্ডস, উল্টোদিকের দেওয়ালে টেরাকোটার ম্যুরেল, এরকম আরো কত কী! গেল তো গেল, ঐ ফুলদানীটাই! টুকরোগুলো সযত্নে  কুড়িয়ে নিতে গিয়ে চোখে পড়ল, আলমারির  তলায় পড়ে আছে একটা ছবি। উবু হয়ে, হাত ঢুকিয়ে বের করার চেষ্টা করে মেঘলা বুঝল, এই উত্তরচল্লিশে, এসব ম্যানুভার তত সহজ নয় যতটা কিছুদিন আগেও ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে ঝুল ঝেড়ে ছবিটা উলটে দেখল ও। তিস্তার ধারে কুড়ি বাইশ বছরের মেঘলা আর রঙ্গীত! এইট্টি ফাইভ টাইভ হবে! কত স্লিম ছিল মেঘলা! রঙ্গীতের গায়ে সেই সোয়েটের জ্যাকেটটা! হ্যান্ডসাম ছিল রঙ্গীত মানতেই হবে!

“কী হল মা?”

পাশের ঘর থেকে টুপুর ছুটে এসেছে।

“তোমার লাগেনি তো?”

“না, না! এই ফুলদানীটা –

ছবিটা টেবিলের ওপর রেখে সোফার  হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেঘলা।

“বেশ জোর ছিল কোয়েকটা!”

টুপুর মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে।

“সেই কাটগ্লাসের ফুলদানীটা! শিট! এনোয়ে মা, আমরা আর একটা নিয়ে আসবো ফোরাম থেকে, মন খারাপ কোরো না, কেমন!”

মেঘলার দু কাঁধে ভর দিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে  বলল টুপুর, ওর ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি! বড় হয়ে গেছে মেয়েটা! মেঘলা টুপুরকে দেখছিল। লাস্ট টু-থাউসেন্ড ওয়ানে এসেছিল রঙ্গীত, দুজনে বেরিয়েছিল। শপিং ছিল টুকিটাকি, ব্যাঙ্কের কাজ! মলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ফুলদানীটা। ভীষণ স্মার্ট আর বাকিগুলোর থেকে একদম আলাদর! একটু দোনামনা করে, তুলেই নিয়েছিল মেঘলা। পে করতে যেতে রঙ্গীত হঠাত বলল,

ওটা, আমার তরফ থেকে!”

তারপর আর আসেনি রঙ্গীত। টুপুর বোধহয় ওর সেন্টিমেন্টের ব্যাপারটা জানে! মেয়েটা বলে কম কিন্তু বোঝে অনেক বেশী!

টুকরোগুলো কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে যাবে, কলিংবেল বেজে উঠল। অনুভব? এত তাড়াতাড়ি!

“কি, সব ঠিকঠাক তো তোমরা? মাম ঠিক আছে?”

জুতো খুলতে খুলতে কথা বলছিল অনুভব।

“আমাদের শহরটা নাকি সিসমিক জোনের মধ্যে পড়ছে, বুঝলে? নিউজটা খোল তো - বাই দ্যা ওয়ে রীত কোথায়? বাড়ি ফেরেনি?”

“ও তো এই সময় টিউশানে, ফোন করেছিল, ঠিক আছে”।

“যাক তবু তাড়াতাড়ি চলে আসতে বল। যা জোর জার্ক হল একটা!”

কী অদ্ভুত! অনুভব টুপুর আর রীতকে সত্যি ভালোবাসে, মেঘলা জানে। টুপুরকে ও মাম বলে ডাকে।

“বাড়িতে কোন ক্ষতি হয়নি তো? আই মিন ড্যামেজ?”

অনুভবের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল মেঘলা।

“থ্যাঙ্ক গড!”

অনুভব চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িংরুমে। এই সময় মেঘলা সাধারণত, টুকিটাকি কাজ সেরে রাখে পরেরদিন অফিসের জন্য। আবার অনেক সময় রিল্যাক্স করে গান শুনে। আজ কোনটাই ভাল লাগছে না। ডাস্টবিনের কাছে ফুলদানীর টুকরোগুলো পড়ে আছে, ফেলা হয়নি । নাঃ! ফেলতে হবে, ছেলেমানুষী করে লাভ নেই বরং ও থেকে এক্সিডেন্ট হতে পারে, কারও পা’টাও তো কেটে যেতে পারে! একরকম জোর করেই ড্রইংরুমের দিকে এগোলো মেঘলা। কোথায় গেল টুকরোগুলো! এখানেই তো ছিল এইমাত্র! রাধা কি তবে? তা কী করে হবে! রাধা তো সেই বিকেলেই ঘর ঝাঁট দিয়েছে!

“মাসী মাসী --”

মেঘলার চিৎকারে নমিতামাসী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল!

“কী বৌদি?”

“তুমি কি ঐ ওখানে, ফুলদানীর টুকরোগুলো –

“কোন ফুলদানী? কই জানি না তো!”

মাসী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!

“কী হল বনি? হোয়াটস রং! চিৎকার করছ কেন?”

অনুভব টিভি বন্ধ করে উঠে এসেছে, ওঘর থেকে টুপুরও!

“না, মানে তেমন কিছু নয়, ফুলদানীর টুকরোগুলো…” নিজের মনেই বলতে থাকে মেঘলা!

“ওঃ! ঐ টুকরোগুলো  তুমি রেখেছিলে? হোয়াই ডিডন্ট ইউ থ্রো দেম? আশ্চর্য! কারো পায়ে তো ফুটতে পারত! আমি ভাবলাম তুমি বোধহয় লক্ষ্য করনি। ডোন্ট ওরি, আমি ওগুলো ফেলে দিয়েছি”।

“কোথায়?”

প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মেঘলা।

“কেন? প্যাকেট করে ডাস্টবিনে!”

অনুভব ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছে তাও আধঘন্টা হবে। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে এল মেঘলা। কিছুতেই ঘুম আসছে না। অথচ ঠিকই তো করেছে অনুভব, যে কোন স্বাভাবিক মানুষ হলেই যা করত তাই করেছে। তাহলে? অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে কোথাও! কোথায়? জানে না মেঘলা। ফুলদানীর টুকরোগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে অনুভব! ডাস্টবিনে! না ফেললে কী করত মেঘলা? ওগুলো জুড়ে কি আবার তৈরি করতে পারত ফুলদানীটা! অসম্ভব! একটা বাচ্চাও সেটা জানে! কিন্তু কেন! অনুভব কেন ফেলে দিল ওগুলো! একবার বলার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে হল না ওর! অবশ্য কীই বা বলত! ভাঙ্গা টুকরোগুলো ফেলবে কিনা? হাউ সিলি! এসব কী ভাবছে মেঘলা! পাশের ঘরে টুপুর আর রীত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ব্যালকনিতে দাঁড়াল মেঘলা। সমস্ত শহরটা এখন আশ্চর্য নিরীহ নিঝুম ঘুমে ডুবে আছে। অনুভব পারফেক্ট জেন্টলম্যান, ওর কোন প্রাইভেসিতে কখনো হস্তক্ষেপ করে না। অথচ আজকে কী এত দরকার পড়ল ওর! নিচে তাকিয়ে দেখছে মেঘলা। এখানেই কোথাও ঘুমোচ্ছে রঙ্গীত, নিজের সংসারের নিশ্চিন্ততায়।

এ সব কী উল্টোপাল্টা ভাবছে মেঘলা! আচ্ছা ঘরের কোণটা ঝাঁট দেওয়া হয়নি তো! যদি কোন ছোট কুচি কাল সকালে – নাঃ! এখনই দেখতে হবে। ড্রয়িংরুমের আলো জ্বেলে, নিচু হয়ে টেবিলের তলায় হাত ঢোকাল মেঘলা, হাত বোলাতে লাগলো মেঝেতে! খুব ছোট কাঁচের কুচি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু স্পর্শ  পাওয়া যায়।

“বনি! কী করছ? হাত কাটবে নাকি! দেখি দেখি –

“উঃ অনুভব! লিভ মি এলোন!”

ওকে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়েছে অনুভব। বারবার দেখেছে হাতে কোন কাঁচের কুচি ফুটেছে কিনা! মেঘলা প্রতিবাদ করেনি।

ভোর হতে আর ঘন্টা দুয়েক বাকি। কাঁচের কুচি ফুটেছে কিনা, কোথায় ফুটেছে জানে না মেঘলা, তবে ব্যথা করছে! পাশ ফিরে শুলো অনুভব, আর খাটটা নড়ে উঠতেই চমকে উঠল ও! চোখ বুজতেই মনে হল, শহরটা সিস্মিক জোনের মধ্যে বেঁচে আছে!

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন