কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

শতরূপা সান্যাল

 

সমকালীন ছোটগল্প


বন্ধু

আমাদের গ্রামটা ছিল কাঁসাই নদীর তীরে। সারাবছর শুখাভুখা থাকলেও, কোন কোন বর্ষায় ফুলে উঠত নদী, খেপে উঠত জল। পাক খেতে খেতে ছুটে আসত ধানখেত ভাসিয়ে। আমাদের ঠাঁই হত তখন স্কুলবাড়িটায়। সেখানেই তখন এজমালি উনোনে রান্না হত চালে-ডালে খিচুড়ি। বন্যা আমাদের গা-সহা হয়ে গেছিল এমন যে, গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার কথা কেউ ভাবেনি। আমি শহরে চাকরি করতাম। তাই, আমি এসব বিপদ নিয়ে চিন্তা করিনি। ছুটিছাটাতেই তো গ্রামে আসা!

একবার বন্যায় সব ভেসে যাওয়া একটা পরিবারের বারো বছরের একটি জড়বুদ্ধি মেয়ে ছাড়া কেউ বাঁচলো না। মেয়েটিকে আমার মা নিজের বুকে আগলে নিয়ে এলেন আমাদের ভিটেয়, জল নেমে যাবার পরে। মেয়েটি আধো আধো কথা বলত - তাও যখন তার মর্জি হত। মা ওকে সকালবেলা বাড়ির সামনেটায় খাবার দিয়ে বসিয়ে দিতেন। সে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ঐ মুড়ি চিড়ে বা রুটি, পান্তাভাত খেতো। মিনি বলে ডাকলে মেয়েটি সাড়া দিত।

মাঝেমাঝেই আমাদের গ্রামে হানা দিত বুনোহাতির পাল। তারা আসত খাবারের সন্ধানে। একদিন শুনি, একটা বাচ্চাহাতি নাকি দলছুট হয়ে গ্রামের এখানে সেখানে ঘুরছে। মাকে বললাম সে কথা। মা বললেন, এত ভয় পাবার কী আছে? মিনি তো রোজ ঐ হাতিটাকে খাওয়ায়। হাতিটা রোজ সকাল হলে চলে আসে। খানিক  থাকে, তারপর চলে যায়। আমি বললাম, হাতিটা কিন্তু বুনো। পোষা না। কোন বিপদ হবে না তো?

মা আমাকে আশ্বস্ত করলেন, আরে না না। ওরা তো বন্ধু! হাতিটা এলে মিনির বাটি থেকে খাবার খায়। মিনিও গোঁ গোঁ করে কত কী বলে! শুধু বুঝতে পারি ‘বন্ধু বন্ধু’ শব্দটা।

আমি নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখলাম। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারলাম না। হাজার হলেও, বুনোহাতি। ও কি আর  মনুষ্য সমাজের নিয়মকানুন জানে?

ভরা আষাঢ় মাস। বন‍্যার আশংকা শুরু হয়েছে। মা ফোনে জানালেন, এখন গ্রামে আসিস না বাবু, বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণে কাঁসাই নদীর কূল ছাপিয়ে গেছে।

আবার যথারীতি সবাই আশ্রয় নিল স্কুল বাড়িটায়। মা মিনিকে নিয়ে সেখানে যাবার জন্য দরকারি কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়েছেন। মিনির মন ভার। সে বাড়ি ছেড়ে মোটেই আসতে ইচ্ছুক ছিল না। গোমড়া মুখে জল ঠেলে স্কুল বাড়িতে আসতে গিয়ে কখন সাপের কামড় খেয়েছিল, কখন সে নেতিয়ে পড়ছিল, কেউ টের পায়নি। যখন সবাই বুঝলো, দেরি হয়ে গেছে অনেক। মা এখানে সেখানে ফোন করছেন পাগলের মত, যদি কেউ এসে মিনিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু চতুর্দিক জলে জল। কে আসবে, কোথায় গাড়ি, কোথায় রাস্তা!

হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাতির বৃংহন! সেই হাতিটা জল পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে স্কুলটার সামনে। না, খাবারের খোঁজে নয়, বন্ধুর খোঁজে! সেই বুনোহাতি শুঁড় বাড়িয়ে পিঠে তুলে নিল অচেতন মিনিকে। লোকজন হায় হায় করে উঠলো। হাতিটা জল ঠেলে চলেও গেল কোথায়!

জল নেমে গেছে কবেই। মানুষের জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মিনিও আমাদের ভিটেয় মায়ের সঙ্গেই থাকে। শুধু ঐ হাতিটা আর আসে না। হয়তো আসবেও না। মিনি সকালবেলা অপেক্ষা করে ওর বন্ধুর জন্য। অপেক্ষাই সার। হাতিটা আর আসে না।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন