কিশোরীকাল
গল্পের বই পড়ার ঝোঁক আমার অনেকদিনের। বাসায় কেউ আউট বই পড়া একদমই পছন্দ করে না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়। বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াতে গেলে ওদের বুকসেলফ ভর্তি সারি সারি বই দেখলে মনে হয়, ইস্, কী মহাসমুদ্র ওদের বাড়িতে লুটোপুটি করছে! পরক্ষণেই আবার মন খারাপ হয়ে যায়, হায় আমি কবে এরকম রাশি রাশি বই পড়ব?
আমাদের বাড়িতে বই নেই বললেই চলে। যে কয়েকটা আছে, ধুলো জমে একাকার। বাবা মায়ের বিয়ের সময় মনে হয় উপহার হিসেবে পাওয়া। প্রায় সবগুলোই ধর্মীয় বই। দুই এক পাতা পড়ে আর পড়তে ইচ্ছা করে না। বইগুলোর সামনে ঘুরঘুর করি তবু। মা দেখলে জোরে জোরে বলেন --
: এ সব পড়ার সময় এখন না। স্কুলের পড়া শেষ কর, ভালো রেজাল্ট কর, তখন ওসব পড়ার অনেক সময় পাবে। সারা জীবন পড়ে আছে আউট বই পড়ার জন্য।
মন খারাপ করে আবার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি। বাসায় আমার আলাদা পড়ার টেবিল নেই। আমি আর আমার ছোটবোন এক টেবিলে বসি। ও ক্লাস এইট, আমি টেন। আমাদের একটাই জ্যামিতি বক্স।
আমি রিনু, ওর নাম ঝিনু।
আমরা দু’বোন হিজাব পরে স্কুলে যাই। বাবার কড়া হুকুম, হিজাব ছাড়া বাইরে বেরোনো যাবে না। হিজাব না পরলে নাকি হাশরের দিন আমাদের মাথার চুল সাপ হয়ে আমাদের দংশন করবে। হিজাব পরতে আমার একটুও ভালো লাগে না। ঝিনু্রও না। গরমের দিন তো দমবন্ধ লাগে।
একদিন বাবার সেল্ফে আচানক একটা বই আবিষ্কার করি। ‘আদর্শ যৌন জীবন। কয়েক পাতা উল্টিয়ে আমার হাত পা কাঁপতে থাকেশ। অসভ্য অসভ্য ছবি। উফফ্! বইটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে রাখি আমার বালিশের নিচে। ঝিনু আর আমি এক খাটে ঘু্মোই। ও যেন না দেখ। সারাদিন কেমন যেন জ্বর জ্বর ভয় ভয়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।
আমাদের ক্লাসের বেস্ট গার্ল সুপ্রীতির সাথে আমার বেশ ভাব। ও আমাকে একটা চিঠি পড়তে দেয়। ওকে নাকি ওদের পাশের বাসার ছেলেটা দিয়েছে। সুপ্রীতি শর্ত দিয়েছে, চিঠিটা পড়া শেষ হলে আবার ফেরত দিতে হবে। কাউকে বলা যাবে না। চিঠিটা মলাটের ভেতরে করে বাসায় নিয়ে আসি। রাতে ঝিনু ঘুমোলে আমি আস্তে আস্তে পড়তে থাকি। ওমা চিঠি কই, এ যে কবিতা!
নিজের সাথে লেপ্টে থাকা আমার সমস্ত শরীর, যত্ন করে করে তৈরি সমস্ত অবয়ব বইয়ের পাতার সাথে সাথে হুটহাট খুলে যেতে থাকে। অবাক লাগে বাঁকে বাঁকে জমিদার বাড়িগুলোর খিলানের মতো খাঁজ, নিভাঁজ। পরতে পরতে রসুনের সাদা আলতো টইটই পর্দা...
অনেক আগে টিভিতে দেখা সার্ক প্রোগ্রামে সংযুক্তা পাণিগ্রাহী’র শাস্ত্রীয় নাচ আমার সামনে খেলে গেল তবলার বোলের ছন্দে। মনে হতে থাকে যে, আমি বড় হচ্ছি, বড় হচ্ছি। রিনু তুই বড় হচ্ছিস।
পরদিন আর আমার ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন জ্বর জ্বর। মা একবার এসে কপালে হাত দিয়ে দেখে বললেন, থাক আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই। শুয়ে থাকি যেন!
মা আলুভর্তা দিয়ে গরমভাত খেতে দিলেন। রুচি নেই। খেলাম না। খেতে ইচ্ছে করছে না।
বিকেলে ব্যালকনীতে চুপ করে বসে রইলাম। আমার মুক্তির আনন্দ, খোলা পৃথিবী তো ঐটুকু এক চিলতে ব্যালকনী। হরেক রকম পাতাবাহারের গাছ। বিকেল বেলাটুকু সাঁওতাল মেয়েদের মতো সুন্দর তন্বী লাগে। আমাদের পাড়ার দিলুভাই সার্টের বোতাম খুলে টিংটিং বেল বাজিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। আমাকে দেখে তার উৎসাহ যায় বেড়ে।
দিলু ভাইয়ের ঢঙ দেখে আমার হাসি পায়। সুপ্রীতির চিঠিটার কথা মনে পড়ে।
দেখতে দেখতে ঝুপঝাপ সন্ধ্যা নামে আমাদের এবেনটি বায়স্কোপ মফস্বলে। আমার ঘাম হতে থাকে লবণ রোয়ার মতো চিনুচিনু...
কী যে সুন্দর সন্ধ্যা! কী যে সুন্দর লবণদোল এই সাইকেল ধ্বনিতে...
গল্পের বই পড়ার ঝোঁক আমার অনেকদিনের। বাসায় কেউ আউট বই পড়া একদমই পছন্দ করে না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়। বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াতে গেলে ওদের বুকসেলফ ভর্তি সারি সারি বই দেখলে মনে হয়, ইস্, কী মহাসমুদ্র ওদের বাড়িতে লুটোপুটি করছে! পরক্ষণেই আবার মন খারাপ হয়ে যায়, হায় আমি কবে এরকম রাশি রাশি বই পড়ব?
আমাদের বাড়িতে বই নেই বললেই চলে। যে কয়েকটা আছে, ধুলো জমে একাকার। বাবা মায়ের বিয়ের সময় মনে হয় উপহার হিসেবে পাওয়া। প্রায় সবগুলোই ধর্মীয় বই। দুই এক পাতা পড়ে আর পড়তে ইচ্ছা করে না। বইগুলোর সামনে ঘুরঘুর করি তবু। মা দেখলে জোরে জোরে বলেন --
: এ সব পড়ার সময় এখন না। স্কুলের পড়া শেষ কর, ভালো রেজাল্ট কর, তখন ওসব পড়ার অনেক সময় পাবে। সারা জীবন পড়ে আছে আউট বই পড়ার জন্য।
মন খারাপ করে আবার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি। বাসায় আমার আলাদা পড়ার টেবিল নেই। আমি আর আমার ছোটবোন এক টেবিলে বসি। ও ক্লাস এইট, আমি টেন। আমাদের একটাই জ্যামিতি বক্স।
আমি রিনু, ওর নাম ঝিনু।
আমরা দু’বোন হিজাব পরে স্কুলে যাই। বাবার কড়া হুকুম, হিজাব ছাড়া বাইরে বেরোনো যাবে না। হিজাব না পরলে নাকি হাশরের দিন আমাদের মাথার চুল সাপ হয়ে আমাদের দংশন করবে। হিজাব পরতে আমার একটুও ভালো লাগে না। ঝিনু্রও না। গরমের দিন তো দমবন্ধ লাগে।
একদিন বাবার সেল্ফে আচানক একটা বই আবিষ্কার করি। ‘আদর্শ যৌন জীবন। কয়েক পাতা উল্টিয়ে আমার হাত পা কাঁপতে থাকেশ। অসভ্য অসভ্য ছবি। উফফ্! বইটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে রাখি আমার বালিশের নিচে। ঝিনু আর আমি এক খাটে ঘু্মোই। ও যেন না দেখ। সারাদিন কেমন যেন জ্বর জ্বর ভয় ভয়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।
আমাদের ক্লাসের বেস্ট গার্ল সুপ্রীতির সাথে আমার বেশ ভাব। ও আমাকে একটা চিঠি পড়তে দেয়। ওকে নাকি ওদের পাশের বাসার ছেলেটা দিয়েছে। সুপ্রীতি শর্ত দিয়েছে, চিঠিটা পড়া শেষ হলে আবার ফেরত দিতে হবে। কাউকে বলা যাবে না। চিঠিটা মলাটের ভেতরে করে বাসায় নিয়ে আসি। রাতে ঝিনু ঘুমোলে আমি আস্তে আস্তে পড়তে থাকি। ওমা চিঠি কই, এ যে কবিতা!
“তুমি যে কেমন করে ডাসা পেয়ারা খাওআমার কান লাল হয়ে যায়। ঘুমের মাঝে ঝিনু এপাশ হতে, আবার চটজলদি চিঠিটা লুকিয়ে রাখি। কিছুক্ষণ পর আমার ধুকধুকানির শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘড়ির সময় হামাগুড়ি দেয়। রাত ঘোড়ার খুড়ের মতো টকটক বাড়তে থাকে। আমার ঘুম নেই, কসম ঘুম নেই। বালিশের নিচ থেকে সেই গোপন বইটি বের করি...
আমার তোমাকেই সবুজ পেয়ারা মনে হ্য়।
কেমন করে চুমুকে গ্লাসের পানি কর সাবাড়
তোমার ঠোঁটে লেগে থাকে জলের রেণু
এসো, শুষে নেই জলজ বাষ্প...
তুমি হেঁটে যাও, তোমার নরম পাছা দুলে ওঠে
আমাকে শরাহত কর, আমি মরে যাই শরীরে, জমিনে।
তুমি স্নানঘরে গোলাপি টাওয়েল নাকি বাদামী পরো
যখন খুলে নাও সব জলের মায়ায়
আমি জলকে ঈর্ষা করি...”
নিজের সাথে লেপ্টে থাকা আমার সমস্ত শরীর, যত্ন করে করে তৈরি সমস্ত অবয়ব বইয়ের পাতার সাথে সাথে হুটহাট খুলে যেতে থাকে। অবাক লাগে বাঁকে বাঁকে জমিদার বাড়িগুলোর খিলানের মতো খাঁজ, নিভাঁজ। পরতে পরতে রসুনের সাদা আলতো টইটই পর্দা...
অনেক আগে টিভিতে দেখা সার্ক প্রোগ্রামে সংযুক্তা পাণিগ্রাহী’র শাস্ত্রীয় নাচ আমার সামনে খেলে গেল তবলার বোলের ছন্দে। মনে হতে থাকে যে, আমি বড় হচ্ছি, বড় হচ্ছি। রিনু তুই বড় হচ্ছিস।
পরদিন আর আমার ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন জ্বর জ্বর। মা একবার এসে কপালে হাত দিয়ে দেখে বললেন, থাক আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই। শুয়ে থাকি যেন!
মা আলুভর্তা দিয়ে গরমভাত খেতে দিলেন। রুচি নেই। খেলাম না। খেতে ইচ্ছে করছে না।
বিকেলে ব্যালকনীতে চুপ করে বসে রইলাম। আমার মুক্তির আনন্দ, খোলা পৃথিবী তো ঐটুকু এক চিলতে ব্যালকনী। হরেক রকম পাতাবাহারের গাছ। বিকেল বেলাটুকু সাঁওতাল মেয়েদের মতো সুন্দর তন্বী লাগে। আমাদের পাড়ার দিলুভাই সার্টের বোতাম খুলে টিংটিং বেল বাজিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। আমাকে দেখে তার উৎসাহ যায় বেড়ে।
দিলু ভাইয়ের ঢঙ দেখে আমার হাসি পায়। সুপ্রীতির চিঠিটার কথা মনে পড়ে।
দেখতে দেখতে ঝুপঝাপ সন্ধ্যা নামে আমাদের এবেনটি বায়স্কোপ মফস্বলে। আমার ঘাম হতে থাকে লবণ রোয়ার মতো চিনুচিনু...
কী যে সুন্দর সন্ধ্যা! কী যে সুন্দর লবণদোল এই সাইকেল ধ্বনিতে...
বড় হওয়ার চমৎকার গল্প। ভালো।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী।
aha!!! ki sohoj kotha ... sohoj prokash ...
উত্তরমুছুন