কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

১৫) ইন্দ্রনীল ঘোষ ও অনুপম মুখোপাধ্যায়

বর্ণপরিচয়


তা হলো গিয়ে অনেককাল আগের কথা। বাঙলা ভাষার তখন যেমন নাম, তেমন ডাক। জ্ঞানী গুণী পণ্ডিতদের ব্যাপার তো বাদই দাও, এমনকি জঙ্গলের খুংখার হুঙ্কার দেওয়া বাঘও, বাঙলা শুনলেই থতমত – গালে হাত। ডান গালে হাত দেয় তো বাঁদিকে হেলে পড়ে ঘাড়। আর বাঁদিক সামলাতে গেলেই, ঘাড় গড়িয়ে ডানদিক লুটোপুটি।

“কী হয়েছে বর্কর্তা... কী হয়েছে বর্কর্তা...” বলতে বলতে টিয়া উড়ে যায়।


বাঘের ভাবগতিক দেখে অজগর তার ছোবল ভোলে, ঈগল জলে ভিজিয়ে রাখা ডানা কাচতে ভুলে যায়। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে আনমনা ইঁদুর কট ক’রে কাঁকড় কামড়ে ফেলে দাঁতে। ছুটে আসে কুকুর খরগোস গাধা ঘোড়া চিল ছাগল জিরাফ হরিণ। জলের ধারে ব্যাঙের হল্লা শুনে তিমিরা জড়ো হয়। মহুয়ার গন্ধে সারা গায়ে এলার্জি বেরোয় ভাল্লুকের। দাঁড়কাক তো কা-কা ভুলে এমন হাঁ ক’রে থাকে মগডালে, যে খোলা মুখে ফড়িং ঢুকে সে কী কাশি! আসে নেকড়ে পেঁচা মোষ রাজহাঁস বনবিড়াল শিয়াল ষাঁড় সিংহ হনুমান... ভিড় জ’মে যায়। গোটা জঙ্গলে কোথাও কোনও কথা নেই। সবাই বাঘের সাথে ব’সে একমনে বাঙলা নিয়ে ভাবছে। সেই গভীরতায় শুধু দু’একটা পাতা পড়ে মাঝে সাঝে, শব্দ হয় নিঃশব্দের।

এমন সময় এক ফিচেল কাঠবেড়ালি, এই ভিড় দেখে, কৌতূহল। একে ওকে তাকে সুড়সুড়ি দেয়, কাঁধে চড়ে, কান খামচায়... ব্যাপারটা কী জানার জন্য। কিন্তু কেউই কোনও রা কাটে না। শেষে সাহস ক’রে এগিয়ে গিয়ে বাঘের ঘাড়টা ডানদিক থেকে তোলে। ধুলো-টুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক ক’রে লাগিয়ে, বাঘকেই জিগ্যেস ক’রে বসে,

– তোমরা এত কী ভাবছো, লা? আখরোট খাবা?

আচমকা হেলে পড়া ঘাড় সোজা হয়ে যাওয়ায়, থতমত বাঘ, চিন্তার ঘোর ভেঙে প্রচন্ড জোরে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।

– তবে রে শালা, বাচাল কাঠবেড়ালি! আমরা ভাবছি বাঙলা ভাষার কথা, আর তুমি এয়েচো আমাদের খিল্লি করতে।

– না না, বর্কর্তা, খিল্লি কেন করব, সে কি করতে আছে? আমি জানতে চাইলুম কীসের এত ভাব, আর কীসেরই বা তা-না-না?

বাঘ দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে।

– সেসব তোর ঘটে ঢুকবে না রে আহাম্মক! বাঙলা ভাষার তুই কী বুঝবি বেজম্মা? এই দ্যাখ এখানে যারা এয়েচে, এদের সবার নাম আছে বর্ণপরিচয়-এ। অ-এ অজগর, ই-এ ইঁদুর। এমনকি ওই যে দেকচিস, ওটা কী?

কাঠবেড়ালি তার ছোট্ট ঘাড় আকাশের দিকে তুলে বলে,

– চাঁদ।

– হ। ওই হলো চন্দ্রবিন্দুতে চাঁদ। কিন্তু হালার পো, তোর নাম যে নেই-ই রে বর্ণমালার দেশে। সে আদমসুমারিতে তোর পরিচয় তো গোল্লা। আমাদের মধ্যে তুই কথা বলতে আসিস কী ক’রে?

হেঃ হেঃ ক’রে বাঘ তার হলুদ দাঁত ঝাঁকিয়ে হাসতে থাকে। কাঠবেড়ালি, মাথা চুলকে বলে,

– তা ওই বর্ণপরিচয়টা কী বর্কর্তা?

– আবার কথা? বললুম তো ওসব তোর মাথায় ঢুকবে না। যাঃ পালা।

এই বলেই, বাঘের ঘাড় বাঁদিকে হেলে পড়ে। বাঘ আবার ধ্যানে যায় বাঙলা ভাষার। কাঠবেড়ালি বড় অভিমান নিয়ে বাড়ি ফেরে। কে না কে এই ‘বর্ণপরিচয়’! নাম না রেখে, কাঠবেড়ালিকে একদম পরিচয়হীন ক’রে দিলো হে! এই লজ্জা কোথায় রাখবে সে? নাহ এর একটা বিহিত করা দরকার। সে শহরে যাবে। বর্ণপরিচয়কে ধ’রে শুধোবে, “বাবু হে, ভিড় বাসে আমি কি তোমার পা মাড়িয়েছিলুম, যে এত জন্তু জানোয়ারের নাম এলো, শুধু বিনা দোষে গায়েব হয়ে গেল কাঠবেড়ালি-ই!”

এতদূর একটানা বলে এসে পলাশদা থামল। আমরা সবাই হাঁ করে শুনছিলাম।

হাঁ না বুজিয়েই অনুপম বলল, ‘তারপর?’

ইন্দ্র বলল, ‘দাঁড়া, ওর মনে হয় আর ফ্লো আসছে না। গপ্পোটাকে এতদূর টেনে এনে আর খুঁজে পাচ্ছে না কোথায় যাবে।’

কাজল সেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আগ্রহের সঙ্গে শুনছিলেন। তিনি কাজুবাদাম নামিয়ে রেখে বললেন, ‘তা বললে কী করে হয় ইন্দ্র? ও শুরু যখন করেছে...’

ইন্দ্র মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘তখন শেষ করলেও হয়, না করলেও হয়। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, এটা গপ্পো নয়, এটা ঝুরোগল্প।’

কাজল সেন অবাক, ‘সেটা কী জিনিস? ফারাকটা কী ?’

পলাশদা দিল রামধমক। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘থামো তো সকলে। কাজলদা, আমি ভাবছিলাম একটা ফোন আসছে। প্যান্টের পকেট কাঁপছিল। এখন বুঝলাম...’

ভোদকায় একটা ছোট্ট চুমুক মেরে অনুপম দাঁত বের করে হাসল, ‘সে কী গো? তোমার কি বর্ণপরিচয়ের নামেও...’

পলাশদা অতিশয় গম্ভীর মুখে আবার বলতে শুরু করল।


বর্ণপরিচয়ের চাঁদমারিতে আটকে কাঠবেড়ালি যখন খুব মুষড়ে পড়েছে, দৈববাণী হলো,

--ভাষা একটি অরণ্য, হে কাঠবিড়ালি, তুমি বিষাদ করিও না। সুগম-দুর্গম-অগম্য সেই বনস্থলীতে ‘পরিচয়’ শব্দটি কখনও কখনও বিড়ম্বনা ব্যতীত কিছু দেয় না।

পশুপাখিরা তো সব থ। নেকড়ে পেঁচা মোষ রাজহাঁস বনবিড়াল শিয়াল ষাঁড় সিংহ হনুমান কুকুর খরগোস গাধা ঘোড়া চিল ছাগল জিরাফ হরিণ সকলে ঘাড় তুলে শুনতে লাগল দৈববাণীর কথা,

--বিড়ালের মধ্যে যে কাষ্ঠ, তাহা কি ‘মার্জার’ এবং ‘মেকুড়’-এর সংবাদ রাখে? রাখে না। তোমার নাম যদি কাঠবিড়ালি না হইয়া চিপ অথবা ডেল হইত, প্রকৃতির কোথাও কোনো হেরফের ঘটিত ভাবিও না। বাংলাভাষাও কিছুমাত্র অশুদ্ধ হইত না।

--আপুনি কে বলতিছ কত্তা? ভগমান ?

--এই অশিক্ষাপ্রিয় জাতিকে শিক্ষিত করিবার পণ আমার স্বীয় মুগ্ধতাই প্রতিপাদন করে। বঙ্গভাষা লইয়া এতখানি না মাতিয়া যদি কিছু বঙ্গীয় উপন্যাস লিখিতাম, আর যাহাই হউক, বঙ্কিমের মাস্তানি আমাকে স্বর্গলোকে বসিয়া সহিতে হইত না। কাঠবিড়ালি, দুঃখ করিও না। তুমি আমার নিজ গ্রামবাসীর অধিক প্রিয় হইয়াছ আজ। তোমার নাম আমি বর্ণপরিচয়ে উল্লেখ করি নাই। তবে বিদ্যার বিস্তীর্ণ সাগরে জাহাজের খবর না রাখিলেই কেহ other ব্যাপারি হয় না। যাও, আমার বিখ্যাত জন্মস্থানে প্রবেশের মুখে বিজ্ঞাপন-স্থলটি অবলোকন করো। তথায় সরকার বাহাদুর ‘বীরসিংহ’-এর বানান লিখিয়াছেন ‘বিরসিংহ’। দুঃখ করিও না। আমি স্বয়ং শোকাচ্ছন্ন। ‘বর্ণপরিচয়’ না লিখিয়া কোনো বিদেশীয় উপন্যাসের ছায়ায় একটি কাহিনী খাড়া করিতে পারিলেই বরং আজ আমার শুষ্ক অমরত্বে বারিসিঞ্চনের অভাব ঘটিত না।


ছবিঃ অনুপম মুখোপাধ্যায়


কারো মুখ থেকে কথা সরছিল না। ঈগলের ডানা থেকে একটা পালক খসে পড়ল। সে মুখ ফিরিয়ে দেখলও না। ভাল্লুক চুলকোতে ভুলে গেল। বাঘকে দেখে মনে হচ্ছিল বিস্ময়ের চোটে তার একপাটি দাঁত না খুলে আসে! একমাত্র কাঠবিড়ালিকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। সে সকলের দিকে খোশমেজাজে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,

--থ্যাংক ইউ ভগমান!

--হা হতোস্মি! আরে ব্যাটা, আমি ভগবান নই। আমি ঈশ্বর। বিদ্যাসাগর। আমার লোনা জল ছাড়া তোরা কিছু পেলি না রে স্যালাইনখোরের দল! আমারই কিছু দেওয়া হলো না ঠিকমতো। বিধবাদের কথা এত ভাবলাম, ওদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখে রেখে গেলাম না... হায়!!!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন