মহাজীবনের চিত্রনে ‘পার্থিব’
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’ এক মহাজীবনের আবহ সঙ্গীত। গভীরতর জীবনবোধ ও জীবন দর্শনই এই উপন্যাসের মূল কথা। এই উপন্যাসে শীর্ষেন্দু সমকালকে কখনো গতানুগতিকতার সঙ্গে কখনো বিচিত্র চরিত্র চিত্রনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। মহাজীবনের বিশ্বাসের ভূমি, একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের সমস্যা এই উপন্যাসের আকর হয়ে উঠেছে। গভীর মনন ও সহানুভূতিশীল লেখক সত্তাকে সম্পূর্ণ বিকশিত করে শাশ্বত এই জীবনের অন্বেষণ করেছেন।
এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি কম বেশি প্রত্যেকেই জীবনের মানে খুঁজে পেতে চেয়েছে। অন্তহীন তাদের অন্বেষণ। এই উপন্যাসে দুই ধরনের চরিত্র আছে - গ্রাম্য ও শহুরে। বিভিন্ন কাহিনী ও উপকাহিনীর আঙ্গিকে চরিত্রগুলি বিবর্তিত হয়েছে। জীবনের কাছে চাওয়া অথচ না পাওয়ার অনির্দেশ্য বেদনাবোধ, কিছু কিছু চরিত্রের বহুমুখি মানসিক জটিলতা উপন্যাসটিকে চালিত করেছে। এই প্রসঙ্গে চরিত্রগুলির ব্যাপ্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা যেতে পারে।
উপন্যাসের শুরু হয়েছে এক অজ পাড়াগাঁয়ে, যেখানে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদ তার ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে তার মেজ ছেলের অর্ধসমাপ্ত পাকা বাড়িটির দিকে আগ্রহ ও প্রত্যাশা নিয়ে চেয়ে থাকে। একদিকে বিষ্ণুপদর তিন পুত্র কৃষ্ণজীবন, রামজীবন, বামাচরণ এবং কন্যা বীণাপানি ও তার স্বামী নিমাই গ্রাম জীবনের দ্যোতক। অন্যদিকে মেট্রোপলিশড শহুরে শিক্ষিত চরিত্র হেমাঙ্গ, চারুশীলা, চয়ন, ঝুমকি, অনু, মনীশ, অপর্ণা, অনীষ, আপা ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও বহু চরিত্রের কোলাহলে মুখর এই উপন্যাস।
গ্রামীণ জীবনের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদকে কেন্দ্র করে। পৈতৃক কিছু জমিজমা ও বাড়িকে কেন্দ্র করে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি করে। কিন্তু কোনো ঘটনাই খুব বেশি প্রভাবিত করে না বিষ্ণুপদকে। উপন্যাসে সে অনেকটা নিরাসক্ত নির্বিকার। সমস্ত ঘটনার সাক্ষী এই পৌনে একশ বছরের বৃদ্ধ। তার সহধর্মিনী নয়নতারা তার সঙ্গে পঞ্চাশ বছর ধরে সহাবস্থান করছে। চোখের সামনে চরম অন্যায় দেখা সত্বেও বাবা হয়েও সে যথেষ্ট শাসন করতে অপারগ তার সন্তানদের।
বিষ্ণুপদ যেন বড় বেশি ভাবুক ও দার্শনিক। সে যেন বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য। সে হতদরিদ্র হলেও দর্শন ভাবনায় ভাবিত হয়ে এই জগৎ ও জীবনের তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করে। তাই সে আতাগাছের তলায় গিয়ে বসে থাকে। গ্রাম্য কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন এই বৃদ্ধ কালঘড়ি স্বপ্নে দেখে ভাবে, তার মৃত্যু আসন্ন। জীবনের শেষ কটা দিনে সারা জীবনের না মেটা সাধ মিটিয়ে নিতে চায়। রসনায় চায় পরিতৃপ্তি। বিষ্ণুপদ একজন মাটি ছুঁয়ে থাকা মানুষ। স্মৃতিমেদুর এই বৃদ্ধ বাবাকে কৃষ্ণজীবন দেশের বাড়ি থেকে একটা মধুকুলকুলি আমের পল্লব এনে দেয়। সেই আমপল্লব হাতে পেয়ে তার অপার্থিব হাসি আনন্দ অবাক করেছিল কৃষ্ণজীবনকে। দেশের বাড়িতে হয়তো অদ্ভুত কিছুই নেই। কিন্তু এখানেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন মাটির টান আর নাড়ির টান কী জিনিস!
এই উপন্যাসে সব থেকে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো কৃষ্ণজীবন, যে শহুরে শিক্ষিত হলেও তার শেকড় পোঁতা থাকে গ্রামের মর্মমূলে। এক একটা মানুষকে সারাজীবন ধরে নিজস্ব একটা যন্ত্রণার ভাষা খুঁজে ফিরতে হয়। কৃষ্ণজীবন সেই ভাষার সন্ধান পেয়েছে কিনা বলা শক্ত। মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই। একটা ওয়েল এস্টাব্লিজড জীবন পেতে হলে যা যা দরকার, তার সব কিছুই কৃষ্ণজীবনের ঝুলিতে ছিল।
ছোটবেলা থেকেই সে ভালো ছাত্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কেরিয়ার গড়তে গিয়ে সে নিজের ভাই-বোনদের প্রতি কর্তব্যেও অবহেলা করেছে। বাবা-মাকেও প্রথম জীবনে বাড়তি যত্ন কিছু করেনি। চৈতন্যের উদয় হয় অনেক পরে। বড় বড় ডিগ্রী, মোটা মাইনের চাকরি, যোগ্য জীবনসঙ্গিনী, সন্তান, প্রতিপত্তি, সম্মান - এই সব কিছু থেকেও অনেক বেশি কিছু ছিল কৃষ্ণজীবনের সংগ্রহে - জাতীয় অধ্যাপক হওয়া থেকে বিদেশী টাকা, খেতাব সব কিছু। একটা মানুষ তার জীবনে যা কিছু চায়, তার সবটুকু থাকা সত্বেও কেন কৃষ্ণজীবন কিছুতেই সুখী হতে পারল না? জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সেই মানুষটিরও সব কিছু থাকা সত্ত্বেও সে লাশকাটা ঘরে কেন শুয়ে ছিল, তার কোনো উত্তর আমরা আজও পাইনি। একই ভাবে কৃষ্ণজীবনের অসুখী হবার কারণও আমাদের অজানা। একমাত্র ছোটছেলে দোলন ছাড়া আর কারও সঙ্গেই তার সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়নি। এমন কী নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও নয়।
স্ত্রী রিয়ার সঙ্গেও কৃষ্ণজীবনের মানসিক সেতুবন্ধন তৈরি হয় না। রিয়ার কাছে টাকার মূল্য জীবনের চেয়েও বেশি। টাকা না পাওয়ার ক্রোধে সে তার স্বামীকে মারতেও পিছপা হয় না। মেট্রোপলিশড শহুরে শিক্ষিত মানুষের অবক্ষয়িত বিবর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। কৃষ্ণজীবন গ্রাম-শহর দ্বান্দ্বিকতার শিকার। পাষাণকারী এই নগরীর উদাসীনতার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে ওঠে। কী অসহ্য তার যন্ত্রণা। এই পৃথিবীর মানুষের মগ্ন চৈতন্যকে সে সজাগ করে তুলতে চায়। এই পৃথিবী মহাকাশ সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত, ধারণা যাতে মানুষকে স্পর্শ করে তার জন্যই সে বই লিখছিল। কিন্তু সাফল্য পেয়েছিল কতটুকু? এই পৃথিবী তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পৃথিবীর জন্য কীই বা করতে পারল! সারাজীবন ধরে সে বুঝতেই পারেনি, আসলে সে কী চায়?
একটা সময় মাটির টান ও নাড়ির টানকে উপলব্ধি করে ফিরে গেছে নিজের গ্রামে। পাকাবাড়ি করে দিয়েছে বাবা-মা ও ভাইয়ের জন্য। জীবনের যাবতীয় দর্শনের সন্ধান সে পেয়েছিল তার বাবার কাছে। তাই বিষ্ণুপদর মৃত্যুতে কৃষ্ণজীবনের মনে বিষণ্নতার বড় করুণ রং লাগিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বিষ্ণুপদর মৃত্যুর পর খালের নোংরা জলে স্নান করে যখন উঠে আসছে কৃষ্ণপদ, তখন তার বুক পাথরের মতো জমে গেছে, উষ্ণ রক্তপ্রবাহ যেন থেমে গেছে - “ব্রাহ্মমুহূর্তের বৈরাগ্যের রং চারদিকে। জীবন ও মৃত্যুর অর্থহীনতার মাঝখানে কি মহান এই পার্থিব জীবন। ক্ষণস্থায়ী, অথচ কত বর্ণময়।”
গ্রামীন জীবনে আবর্তিত হয়েছে নিমাই এবং নটী বিণাপানির চরিত্র। নিমাই ধর্মভীরু ও সৎ। কিন্তু শুধু এইটুকু নিয়েই যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না, তার জন্য আরও অনেক কিছু প্রয়োজন, তা বিণাপানি বুঝিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সমাজের কদর্যতা যে কী ভীষণ বীভৎস, তার পরিচয় পাওয়া যায় এই সম্পর্কের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্বল আত্মবিশ্বাস ও সততা। সেইটুকুকে সম্বল করেই নিমাই নিজের পায়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীর অন্নে প্রতিপালিত এবং আত্মবঞ্চিত নিমাই নিজেই নিজের অবস্থা ফেরায়। স্বামী হিসাবে স্ত্রীকে যাবতীয় অসম্মান ও ধরা পড়ার হাত থেকেও বাঁচায়।
বাস্তুহীন, গৃহচ্যুত বীণাপানি নিমাইকে ত্যাগ করে একা লড়াই করে বাঁচতে চায়। কিন্তু নানা রকম প্রতিকূলতা ও একাকীত্ব তাকে গ্রাস করে। কিন্তু ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয় এবং শুভবোধ যে এখনো পৃথিবীতে আছে, তার পরিচয় বীণাপানির শেষ পর্যন্ত নিমাইয়ের কাছে ফিরে আসার মধ্যে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক ক্রান্তিকালের শিল্পী। তিনি অস্থির কিন্তু অনিকেত নন। দুঃখ ক্লান্ত কিন্তু দুঃখ রিক্ত নন-
আবার রামজীবন অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে শুধু বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। এই উপার্জনে তার কোনো আত্মগ্লানি নেই। কারও কাছে কোনো প্রত্যাশাও নেই। আছে শুধু বাবা-মায়ের প্রতি অপরিসীম ভক্তি। এও এক অদ্ভুত জীবন দর্শন। অন্তরের টানের কাছে সমস্ত সৎ ও অসৎ তুচ্ছ হয়ে যায়। একপিঠে আলো অপর পিঠে অন্ধকার। তার বৃদ্ধ বাবাকে সে তার সামর্থ্য মতো সেবা করেছে। প্রবল আর্থিক অনটন সত্ত্বেও বাবাকে জন্মদিনে কেক খাইয়েছে। খাইয়েছে ক্ষীরও - শুধু বাবার মুখে সেই অপার্থিব হাসি দেখার জন্য।
এই উপন্যাসে পটল ও গোপাল -- এই দুই ভাইয়ের মেলবন্ধনের একটি অপরূপ ছবি পাওয়া যায়। গোপাল কথা বলতে পারে না। তার যাবতীয় অস্ফুট কথা ও ইঙ্গিত বুঝতে পারে এক মাত্র পটল। সে তার ছোট ভাইটিকে খুব ভালোবাসে। সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। পটল জীবনে বড় হতে চায় তার জেঠু কৃষ্ণজীবনের মতো। কৃষ্ণজীবন তার কাছে আদর্শ। জেঠুর বড় হয়ে ওঠার সংগ্রামময় জীবনের কাহিনী সে শোনে তার দাদুর কাছ থেকে।
সংসারের যাবতীয় অশান্তি ঐটুকু ছেলের মনের গভীরে প্রবেশ করে। আগে সে অসহিষ্ণু ছিল, এখন সংসারের অবস্থা সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তার এক মাত্র বন্ধু পটল। সে মুখে কিছু না বললেও দাদার সমব্যথী। গ্রাম্য এই দুটি বালক চরিত্রকে বড় যত্ন সহকারে এঁকেছেন শীর্ষেন্দু। সাধারণ মানুষের ছোটখাটো সুখ-দুঃখের কাহিনী রচিত হতে থাকে পাড়াগাঁয়ে দ্বীপজ্বালা আধো আলো ছায়া, শান্ত নিরালা গৃহকোণে।
শহুরে চরিত্রগুলির মধ্যে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার দ্বান্দ্বিক রূপটি ফুটে উঠেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাওয়া, পাওয়া, রুচি, জীবনযাত্রার ধরন সবই পাল্টাতে থাকে। এরকম একটি চরিত্র হেমাঙ্গ। সে কোলাহলমুখর জীবন পছন্দ করে না। তাই বাড়ির যৌথ পরিবার ছেড়ে এসে সে আশ্রয় নেয় একটি নির্জন বাড়িতে। চাটার্ড একাউন্টে চাকুরিরত হেমাঙ্গ হাতে টাকা পেলেই জীবনকে আরও বেশি স্বচ্ছন্দ করার উপকরণ কিনতে থাকে। যেমন এসি, ফ্রীজ, মিক্সি, মাইক্রোওয়েভ প্রভৃতি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার পছন্দের বেড়াতে যাবার স্থান হলো বড় বড় শপিং মল।
প্রবাসী সুন্দরী রশ্মির সঙ্গে সে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু কোনো ভাবেই শেষ পর্যন্ত রশ্মিকে বিয়ে করতে পারে না। বিয়ে করে ঝুমকিকে-
তরুণ সমাজের এক দুঃসাহসী চরিত্র আপা যে কোনো চোখ রাঙানোকে ভয় পায় না। অপরিসীম তার সাহস, অনিঃশেষ তার আগ্রহ-
আত্মভীরু চরিত্র চয়ন। সে মৃগী রোগে আক্রান্ত। ভীষণ ভাবে পরনির্ভরশীল। যখন তখন সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। দাদার আশ্রয়ে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এক অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসবাস করে। এইজন্য তার ভাগ্যে জোটে দাদা-বৌদির অপমান ও বঞ্চনা। মা মারা যাবার পর তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। ভাড়াটিয়া অনিন্দিতাকে কেন্দ্র করে তার দুর্নাম ছড়ায়। এই অবস্থায় সে সাহচর্য ও ভরসা পায় চারুশীলার কাছে। আত্মবিশ্বাসহীন অসহায় এই চরিত্রটি পাঠকেরও সহানুভূতি আদায় করে।
অসংখ্য চরিত্রের উত্থান পতনের কাহিনীকে গোলাকার বৃত্তে মিলিয়ে দিয়ে শুভবোধের দিকেই যাত্রা করেছেন শীর্ষেন্দু। উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে যে জীবনদর্শন উঠে এসেছে, তা মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়। নিজের মুখোমুখি নিজেকে বসিয়ে দেয় - সেখানে থাকে না কোনো বনলতা সেন। উপলদ্ধি করতে শেখায় এই মহাজীবনকে। তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। জীবন মহান ও মূল্যবান; প্রতিটি মুহূর্ত এমন ভাবে বাঁচতে শেখায়, যেন এই মুহূর্তটাই জীবনের শেষ মুহূর্ত। তাই সেই মূল্যবান মুহূর্তকে উপভোগ করতে শেখায়। এই জীবন অবহেলার নয়। এই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতি মুহূর্তে শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়।
জীবনকে আরও গভীর আরও সত্য রূপে অনুভব করার জন্যই কৃষ্ণজীবন প্রকৃতির সান্নিধ্য চেয়েছে। প্রকৃতি ও অধ্যাত্ম চেতনার পটভূমি উপন্যাসের মধ্যে থাকলেও কোনো রচনাই জীবন সচেতনতা হারায় না। নগর সভ্যতা মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও দিতে পারেনি শান্তি। প্রাত্যহিকতার ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ছুটে যায় সেই গ্রামেই, যেখান থেকে তার যাত্রা পথ শুরু হয়েছিল। ছোটখাটো ঘটনা, আপাত তুচ্ছ সৌন্দর্যের ভেতর থেকে লেখক আনন্দময় এক অনন্ত জীবনের আশ্বাস পান। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ধূলির আসনে বসি’ ধ্যান দৃষ্টিতে ভূমার উপলদ্ধি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’ এক মহাজীবনের আবহ সঙ্গীত। গভীরতর জীবনবোধ ও জীবন দর্শনই এই উপন্যাসের মূল কথা। এই উপন্যাসে শীর্ষেন্দু সমকালকে কখনো গতানুগতিকতার সঙ্গে কখনো বিচিত্র চরিত্র চিত্রনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। মহাজীবনের বিশ্বাসের ভূমি, একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের সমস্যা এই উপন্যাসের আকর হয়ে উঠেছে। গভীর মনন ও সহানুভূতিশীল লেখক সত্তাকে সম্পূর্ণ বিকশিত করে শাশ্বত এই জীবনের অন্বেষণ করেছেন।
এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি কম বেশি প্রত্যেকেই জীবনের মানে খুঁজে পেতে চেয়েছে। অন্তহীন তাদের অন্বেষণ। এই উপন্যাসে দুই ধরনের চরিত্র আছে - গ্রাম্য ও শহুরে। বিভিন্ন কাহিনী ও উপকাহিনীর আঙ্গিকে চরিত্রগুলি বিবর্তিত হয়েছে। জীবনের কাছে চাওয়া অথচ না পাওয়ার অনির্দেশ্য বেদনাবোধ, কিছু কিছু চরিত্রের বহুমুখি মানসিক জটিলতা উপন্যাসটিকে চালিত করেছে। এই প্রসঙ্গে চরিত্রগুলির ব্যাপ্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা যেতে পারে।
উপন্যাসের শুরু হয়েছে এক অজ পাড়াগাঁয়ে, যেখানে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদ তার ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে তার মেজ ছেলের অর্ধসমাপ্ত পাকা বাড়িটির দিকে আগ্রহ ও প্রত্যাশা নিয়ে চেয়ে থাকে। একদিকে বিষ্ণুপদর তিন পুত্র কৃষ্ণজীবন, রামজীবন, বামাচরণ এবং কন্যা বীণাপানি ও তার স্বামী নিমাই গ্রাম জীবনের দ্যোতক। অন্যদিকে মেট্রোপলিশড শহুরে শিক্ষিত চরিত্র হেমাঙ্গ, চারুশীলা, চয়ন, ঝুমকি, অনু, মনীশ, অপর্ণা, অনীষ, আপা ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও বহু চরিত্রের কোলাহলে মুখর এই উপন্যাস।
গ্রামীণ জীবনের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদকে কেন্দ্র করে। পৈতৃক কিছু জমিজমা ও বাড়িকে কেন্দ্র করে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি করে। কিন্তু কোনো ঘটনাই খুব বেশি প্রভাবিত করে না বিষ্ণুপদকে। উপন্যাসে সে অনেকটা নিরাসক্ত নির্বিকার। সমস্ত ঘটনার সাক্ষী এই পৌনে একশ বছরের বৃদ্ধ। তার সহধর্মিনী নয়নতারা তার সঙ্গে পঞ্চাশ বছর ধরে সহাবস্থান করছে। চোখের সামনে চরম অন্যায় দেখা সত্বেও বাবা হয়েও সে যথেষ্ট শাসন করতে অপারগ তার সন্তানদের।
বিষ্ণুপদ যেন বড় বেশি ভাবুক ও দার্শনিক। সে যেন বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য। সে হতদরিদ্র হলেও দর্শন ভাবনায় ভাবিত হয়ে এই জগৎ ও জীবনের তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করে। তাই সে আতাগাছের তলায় গিয়ে বসে থাকে। গ্রাম্য কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন এই বৃদ্ধ কালঘড়ি স্বপ্নে দেখে ভাবে, তার মৃত্যু আসন্ন। জীবনের শেষ কটা দিনে সারা জীবনের না মেটা সাধ মিটিয়ে নিতে চায়। রসনায় চায় পরিতৃপ্তি। বিষ্ণুপদ একজন মাটি ছুঁয়ে থাকা মানুষ। স্মৃতিমেদুর এই বৃদ্ধ বাবাকে কৃষ্ণজীবন দেশের বাড়ি থেকে একটা মধুকুলকুলি আমের পল্লব এনে দেয়। সেই আমপল্লব হাতে পেয়ে তার অপার্থিব হাসি আনন্দ অবাক করেছিল কৃষ্ণজীবনকে। দেশের বাড়িতে হয়তো অদ্ভুত কিছুই নেই। কিন্তু এখানেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন মাটির টান আর নাড়ির টান কী জিনিস!
এই উপন্যাসে সব থেকে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো কৃষ্ণজীবন, যে শহুরে শিক্ষিত হলেও তার শেকড় পোঁতা থাকে গ্রামের মর্মমূলে। এক একটা মানুষকে সারাজীবন ধরে নিজস্ব একটা যন্ত্রণার ভাষা খুঁজে ফিরতে হয়। কৃষ্ণজীবন সেই ভাষার সন্ধান পেয়েছে কিনা বলা শক্ত। মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই। একটা ওয়েল এস্টাব্লিজড জীবন পেতে হলে যা যা দরকার, তার সব কিছুই কৃষ্ণজীবনের ঝুলিতে ছিল।
ছোটবেলা থেকেই সে ভালো ছাত্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কেরিয়ার গড়তে গিয়ে সে নিজের ভাই-বোনদের প্রতি কর্তব্যেও অবহেলা করেছে। বাবা-মাকেও প্রথম জীবনে বাড়তি যত্ন কিছু করেনি। চৈতন্যের উদয় হয় অনেক পরে। বড় বড় ডিগ্রী, মোটা মাইনের চাকরি, যোগ্য জীবনসঙ্গিনী, সন্তান, প্রতিপত্তি, সম্মান - এই সব কিছু থেকেও অনেক বেশি কিছু ছিল কৃষ্ণজীবনের সংগ্রহে - জাতীয় অধ্যাপক হওয়া থেকে বিদেশী টাকা, খেতাব সব কিছু। একটা মানুষ তার জীবনে যা কিছু চায়, তার সবটুকু থাকা সত্বেও কেন কৃষ্ণজীবন কিছুতেই সুখী হতে পারল না? জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সেই মানুষটিরও সব কিছু থাকা সত্ত্বেও সে লাশকাটা ঘরে কেন শুয়ে ছিল, তার কোনো উত্তর আমরা আজও পাইনি। একই ভাবে কৃষ্ণজীবনের অসুখী হবার কারণও আমাদের অজানা। একমাত্র ছোটছেলে দোলন ছাড়া আর কারও সঙ্গেই তার সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়নি। এমন কী নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও নয়।
স্ত্রী রিয়ার সঙ্গেও কৃষ্ণজীবনের মানসিক সেতুবন্ধন তৈরি হয় না। রিয়ার কাছে টাকার মূল্য জীবনের চেয়েও বেশি। টাকা না পাওয়ার ক্রোধে সে তার স্বামীকে মারতেও পিছপা হয় না। মেট্রোপলিশড শহুরে শিক্ষিত মানুষের অবক্ষয়িত বিবর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। কৃষ্ণজীবন গ্রাম-শহর দ্বান্দ্বিকতার শিকার। পাষাণকারী এই নগরীর উদাসীনতার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে ওঠে। কী অসহ্য তার যন্ত্রণা। এই পৃথিবীর মানুষের মগ্ন চৈতন্যকে সে সজাগ করে তুলতে চায়। এই পৃথিবী মহাকাশ সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত, ধারণা যাতে মানুষকে স্পর্শ করে তার জন্যই সে বই লিখছিল। কিন্তু সাফল্য পেয়েছিল কতটুকু? এই পৃথিবী তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পৃথিবীর জন্য কীই বা করতে পারল! সারাজীবন ধরে সে বুঝতেই পারেনি, আসলে সে কী চায়?
একটা সময় মাটির টান ও নাড়ির টানকে উপলব্ধি করে ফিরে গেছে নিজের গ্রামে। পাকাবাড়ি করে দিয়েছে বাবা-মা ও ভাইয়ের জন্য। জীবনের যাবতীয় দর্শনের সন্ধান সে পেয়েছিল তার বাবার কাছে। তাই বিষ্ণুপদর মৃত্যুতে কৃষ্ণজীবনের মনে বিষণ্নতার বড় করুণ রং লাগিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বিষ্ণুপদর মৃত্যুর পর খালের নোংরা জলে স্নান করে যখন উঠে আসছে কৃষ্ণপদ, তখন তার বুক পাথরের মতো জমে গেছে, উষ্ণ রক্তপ্রবাহ যেন থেমে গেছে - “ব্রাহ্মমুহূর্তের বৈরাগ্যের রং চারদিকে। জীবন ও মৃত্যুর অর্থহীনতার মাঝখানে কি মহান এই পার্থিব জীবন। ক্ষণস্থায়ী, অথচ কত বর্ণময়।”
গ্রামীন জীবনে আবর্তিত হয়েছে নিমাই এবং নটী বিণাপানির চরিত্র। নিমাই ধর্মভীরু ও সৎ। কিন্তু শুধু এইটুকু নিয়েই যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না, তার জন্য আরও অনেক কিছু প্রয়োজন, তা বিণাপানি বুঝিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সমাজের কদর্যতা যে কী ভীষণ বীভৎস, তার পরিচয় পাওয়া যায় এই সম্পর্কের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্বল আত্মবিশ্বাস ও সততা। সেইটুকুকে সম্বল করেই নিমাই নিজের পায়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীর অন্নে প্রতিপালিত এবং আত্মবঞ্চিত নিমাই নিজেই নিজের অবস্থা ফেরায়। স্বামী হিসাবে স্ত্রীকে যাবতীয় অসম্মান ও ধরা পড়ার হাত থেকেও বাঁচায়।
বাস্তুহীন, গৃহচ্যুত বীণাপানি নিমাইকে ত্যাগ করে একা লড়াই করে বাঁচতে চায়। কিন্তু নানা রকম প্রতিকূলতা ও একাকীত্ব তাকে গ্রাস করে। কিন্তু ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয় এবং শুভবোধ যে এখনো পৃথিবীতে আছে, তার পরিচয় বীণাপানির শেষ পর্যন্ত নিমাইয়ের কাছে ফিরে আসার মধ্যে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক ক্রান্তিকালের শিল্পী। তিনি অস্থির কিন্তু অনিকেত নন। দুঃখ ক্লান্ত কিন্তু দুঃখ রিক্ত নন-
অন্যদিকে বামাচরণ ধূর্ত ও লোভী, তার সঙ্গে বেশ কিছুটা বোকাও। শ্রীহীন রুক্ষ এই মানুষটা সারাজীবন ধরে নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থেকে গেল। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া ও বাবা-মাকে গালিগালাজ থেকে শুরু করে যাবতীয় অপকর্মে তার জুড়ি মেলা ভার।“ঘরেও নহে পারেও নহে
যে জন আছে মাঝখানে”
আবার রামজীবন অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে শুধু বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। এই উপার্জনে তার কোনো আত্মগ্লানি নেই। কারও কাছে কোনো প্রত্যাশাও নেই। আছে শুধু বাবা-মায়ের প্রতি অপরিসীম ভক্তি। এও এক অদ্ভুত জীবন দর্শন। অন্তরের টানের কাছে সমস্ত সৎ ও অসৎ তুচ্ছ হয়ে যায়। একপিঠে আলো অপর পিঠে অন্ধকার। তার বৃদ্ধ বাবাকে সে তার সামর্থ্য মতো সেবা করেছে। প্রবল আর্থিক অনটন সত্ত্বেও বাবাকে জন্মদিনে কেক খাইয়েছে। খাইয়েছে ক্ষীরও - শুধু বাবার মুখে সেই অপার্থিব হাসি দেখার জন্য।
এই উপন্যাসে পটল ও গোপাল -- এই দুই ভাইয়ের মেলবন্ধনের একটি অপরূপ ছবি পাওয়া যায়। গোপাল কথা বলতে পারে না। তার যাবতীয় অস্ফুট কথা ও ইঙ্গিত বুঝতে পারে এক মাত্র পটল। সে তার ছোট ভাইটিকে খুব ভালোবাসে। সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। পটল জীবনে বড় হতে চায় তার জেঠু কৃষ্ণজীবনের মতো। কৃষ্ণজীবন তার কাছে আদর্শ। জেঠুর বড় হয়ে ওঠার সংগ্রামময় জীবনের কাহিনী সে শোনে তার দাদুর কাছ থেকে।
সংসারের যাবতীয় অশান্তি ঐটুকু ছেলের মনের গভীরে প্রবেশ করে। আগে সে অসহিষ্ণু ছিল, এখন সংসারের অবস্থা সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তার এক মাত্র বন্ধু পটল। সে মুখে কিছু না বললেও দাদার সমব্যথী। গ্রাম্য এই দুটি বালক চরিত্রকে বড় যত্ন সহকারে এঁকেছেন শীর্ষেন্দু। সাধারণ মানুষের ছোটখাটো সুখ-দুঃখের কাহিনী রচিত হতে থাকে পাড়াগাঁয়ে দ্বীপজ্বালা আধো আলো ছায়া, শান্ত নিরালা গৃহকোণে।
শহুরে চরিত্রগুলির মধ্যে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার দ্বান্দ্বিক রূপটি ফুটে উঠেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাওয়া, পাওয়া, রুচি, জীবনযাত্রার ধরন সবই পাল্টাতে থাকে। এরকম একটি চরিত্র হেমাঙ্গ। সে কোলাহলমুখর জীবন পছন্দ করে না। তাই বাড়ির যৌথ পরিবার ছেড়ে এসে সে আশ্রয় নেয় একটি নির্জন বাড়িতে। চাটার্ড একাউন্টে চাকুরিরত হেমাঙ্গ হাতে টাকা পেলেই জীবনকে আরও বেশি স্বচ্ছন্দ করার উপকরণ কিনতে থাকে। যেমন এসি, ফ্রীজ, মিক্সি, মাইক্রোওয়েভ প্রভৃতি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার পছন্দের বেড়াতে যাবার স্থান হলো বড় বড় শপিং মল।
প্রবাসী সুন্দরী রশ্মির সঙ্গে সে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু কোনো ভাবেই শেষ পর্যন্ত রশ্মিকে বিয়ে করতে পারে না। বিয়ে করে ঝুমকিকে-
কিন্তু শহরের যন্ত্রণাদীর্ণ জীবন ছেড়ে হেমাঙ্গ বাঁচতে চায় প্রকৃতি মায়ের কোলে। তাই সে নদীর ধারে বাড়ি নেয়। সেখানে সময় পেলেই সে চলে যায়। অন্যদিকে তার সুন্দরী শিক্ষিত দিদি চারুশীলা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী। তথাকথিত উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি চারুশীলা বিলাস ব্যসনে ব্যস্ত।“বড় শক্ত বুঝা
যারে বলে ভালোবাসা
তারে বলে পুজা।”
তরুণ সমাজের এক দুঃসাহসী চরিত্র আপা যে কোনো চোখ রাঙানোকে ভয় পায় না। অপরিসীম তার সাহস, অনিঃশেষ তার আগ্রহ-
অন্যদিকে বুবকা, অপর্ণা, মনীষ, অনু, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ধারক ও বাহক। অনু কিছুটা আল্ট্রা মডার্ণ। বাবার বয়সী কৃষ্ণজীবন হয় তার বয়ফ্রেন্ড। কৃষ্ণজীবনও যেন কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এই মেয়েটির সাহচর্যে।‘আঠার বছর বয়স কি ভয়ঙ্কর’
আত্মভীরু চরিত্র চয়ন। সে মৃগী রোগে আক্রান্ত। ভীষণ ভাবে পরনির্ভরশীল। যখন তখন সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। দাদার আশ্রয়ে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এক অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসবাস করে। এইজন্য তার ভাগ্যে জোটে দাদা-বৌদির অপমান ও বঞ্চনা। মা মারা যাবার পর তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। ভাড়াটিয়া অনিন্দিতাকে কেন্দ্র করে তার দুর্নাম ছড়ায়। এই অবস্থায় সে সাহচর্য ও ভরসা পায় চারুশীলার কাছে। আত্মবিশ্বাসহীন অসহায় এই চরিত্রটি পাঠকেরও সহানুভূতি আদায় করে।
অসংখ্য চরিত্রের উত্থান পতনের কাহিনীকে গোলাকার বৃত্তে মিলিয়ে দিয়ে শুভবোধের দিকেই যাত্রা করেছেন শীর্ষেন্দু। উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে যে জীবনদর্শন উঠে এসেছে, তা মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়। নিজের মুখোমুখি নিজেকে বসিয়ে দেয় - সেখানে থাকে না কোনো বনলতা সেন। উপলদ্ধি করতে শেখায় এই মহাজীবনকে। তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। জীবন মহান ও মূল্যবান; প্রতিটি মুহূর্ত এমন ভাবে বাঁচতে শেখায়, যেন এই মুহূর্তটাই জীবনের শেষ মুহূর্ত। তাই সেই মূল্যবান মুহূর্তকে উপভোগ করতে শেখায়। এই জীবন অবহেলার নয়। এই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতি মুহূর্তে শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়।
জীবনকে আরও গভীর আরও সত্য রূপে অনুভব করার জন্যই কৃষ্ণজীবন প্রকৃতির সান্নিধ্য চেয়েছে। প্রকৃতি ও অধ্যাত্ম চেতনার পটভূমি উপন্যাসের মধ্যে থাকলেও কোনো রচনাই জীবন সচেতনতা হারায় না। নগর সভ্যতা মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও দিতে পারেনি শান্তি। প্রাত্যহিকতার ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ছুটে যায় সেই গ্রামেই, যেখান থেকে তার যাত্রা পথ শুরু হয়েছিল। ছোটখাটো ঘটনা, আপাত তুচ্ছ সৌন্দর্যের ভেতর থেকে লেখক আনন্দময় এক অনন্ত জীবনের আশ্বাস পান। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ধূলির আসনে বসি’ ধ্যান দৃষ্টিতে ভূমার উপলদ্ধি।
“তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা”
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন