কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

০১) সন্দীপ দত্ত


লিটল ম্যাগাজিনের শতবর্ষ


‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে (দেশ, মে ১৯৫৩) বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষার প্রথম ‘লিটল ম্যাগাজিন’। এই কথাকে যদি মান্যতা দিতে হয়, তবে এই বছর প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’র (প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ ১৩২১, ইংরেজি মে ১৯১৪) একশ বছর হলো এবং সেই হিসেবে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনেরও শতবর্ষ।

বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাস যাত্রা ১৯৬ বছর আগে শুরু হয়েছিল। উনিশ শতকে ১৮১৮র ‘দিগদর্শন’ থেকে ১৮৯৯র ‘উদ্বোধন’ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি ছোট বড় পত্রিকার সন্নিবেশ। বিশ শতকের সূচনা ঘটল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশে। এই সময়ের পত্র পত্রিকার দিকে তাকালে দেখব, পত্রিকাগুলি নানা বিচিত্রধর্মী – সংবাদধর্মী কিংবা ধর্ম, সাহিত্য বিষয়ক। চরিত্রে সজ্জায় প্রায় একই। ‘সবুজপত্র’ গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – প্রায় এককযাত্রা। সমকালের পত্রিকাগুলির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেইসব পত্রিকাগুলি নিছকই চলযাত্রা বিশেষ ছিল। অনেকটা মালগাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতোই। কোনো প্রত্যয় নেই, কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই। ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্র’ সাময়িকপত্রের জগতে নিয়ে এলো নতুন ভাবনার কথা। বিজ্ঞাপনবিহীন সাদা এ্যান্টিক কাগজে ছাপা পত্রিকাটি চলিত গদ্য সাহিত্যকে বরণ করে নিল সাদরে। ফর্মাবিরল, চিত্র ও বিজ্ঞাপনবিহীন ‘সবুজপত্র’কে লিটল ম্যাগাজিন বলার যুক্তি কি, তা আমরা আলোচনা করে নেব। প্রথমত, ‘সবুজপত্র’ মননশীল, চিন্তনঋদ্ধ পত্রিকা। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী ও নবীন লেখক অন্বেষণ। তৃতীয়ত, চলিত গদ্য আন্দোলন প্রবর্তন করে সমকালের গদ্যরীতির বদল। চতুর্থত, রবীন্দ্রনাথের মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখকেরও গদ্যরীতি বদলে দেওয়া। পঞ্চমত, সমকালের প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখাকে প্রাধান্য না দেওয়া। ষষ্ঠত, গতানুগতিকতার চিরায়ত রীতিকে পালটে দেওয়া। সপ্তমত, বিজ্ঞাপন ভারাক্রান্ত নয়। অষ্টমত, বিষয় বৈচিত্র। নবমত, পত্রিকাকে চলতে হয়েছে কোনো বাণিজ্যিক ভাবনাকে থোরাই কেয়ার করে। দশমত, বিশ্বসাহিত্য ভাবনা উপেক্ষিত নয়।

এই দশদিশি নিরিখে বলা যায়, ‘সবুজপত্র’র মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট। ‘সবুজপত্র’র পর একশ বছরে বহু গুরুত্বপূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। ‘কল্লোল’, ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’, ‘কবিতা’, ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি হয়ে ‘উত্তরসূরী’, ‘একক’, ‘নিরুক্ত’, ‘প্রগতি’, ‘শতভিষা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘কবিপত্র’, ‘কবিতা পরিচয়’। তারপর ছ’য়ের দশকের হাংরি, শাস্ত্রবিরোধী, ধ্বংসকালীন, প্রকল্পনা প্রভৃতি ইস্তেহার ভিত্তিক সাহিত্য আন্দোলন। সেইসঙ্গে সারস্বত প্রকাশনায় কবিকন্ঠ, সুন্দরম, এবং, দর্শক, নান্দীমুখ, অমৃতলোক, কালিমাটি, খনন, মায়ামেঘ, একা এবং কয়েকজন, দিগঙ্গন, সাহিত্য, জনপদপ্রয়াস, জিগীষা, বিজ্ঞাপনপর্ব, নাইনথ কলম, ফিনিক্স, আজকের যোধন, পূর্বা, ঐক্য, ঐক্যতান, বোবাযুদ্ধ, প্রথমত, গ্রাফিত্তি, হান্‌ড্রেড মাইলস, তাঁতঘর, একুশ শতক, একুশের চর্যা, বর্তিকা, আলোচনাচক্র, কবিতীর্থ, কোরক, এবং মুশায়েরা, চর্চা, অনুবর্তন, দলছুট, অনুভাব, উজাগর – কত শত লিটল ম্যাগাজিনের চলমান যাত্রাপথ – কত আত্মত্যাগে, কত নিষ্ঠায়, কত পরিশ্রমে এই কাজ প্রতিনিয়ত করে যাওয়া। বহুরৈখিকতার প্রকাশ -- সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবাদ, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, মানবাধিকার, প্রকৃতি-পরিবেশ, নারীবাদ, যৌনতা, জীবন-যাপন, চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত, আবৃত্তি, অনুবাদচর্চা, আঞ্চলিক ইতিহাস – শত শত ভাবনার স্রোতে দীপ্যমান লিটল ম্যাগাজিন চির সবুজপত্র। সজীবতাই তার ধর্ম। শতবর্ষের যাত্রাপথের গৌরব নিয়ে তার পথ চলা – চলার পথ খোঁজা। এ খোঁজার কোনো শেষ নেই!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন