‘অজন্তা’র সুবর্ণজয়ন্তী ও শতবর্ষের জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
দিল্লির বাংলা পত্রিকার ইতিহাসে ‘অজন্তা’ ১৯৬২ সালে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে প্রাচীর পত্রিকা হিসেবে। দিল্লীর করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ-এর প্রাণপুরুষ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, যিনি ‘বটুকদা’ নামে ঘনিষ্ঠ মহলে সুপরিচিত, তিনিই এই প্রাচীর পত্রিকাটির নামকরণ করেন ‘অজন্তা’।
১৯৬৫-তে প্রদীপ বন্দ্যোপাধায়ের উৎসাহে এবং বিশ্বপতি ঘোষের উদ্যোগে দিল্লির প্রাচীনতম বাংলা ছাপাখানা আই. এম. এইচ. থেকে প্রথম বাৎসরিক পত্রিকা হিসাবে ‘অজন্তা’ মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন হীরেন চৌধুরী। এরপর ষান্মাসিক এবং বর্তমানে চতুর্মাসিক ‘অজন্তা’ আজও দিল্লি থেকে প্রকাশিত নিয়মিত বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকা। এই ঋদ্ধিমান পত্রিকায় বহু বিশিষ্ট কবি, লেখক লিখেছেন। যেমন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, রানি চন্দ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ইন্দিরা গোস্বামী, শিশিরকুমার দাশ, পবিত্র সরকার, নীলরতন সেন, নবেন্দু সেন, রবীন্দ্র গুহ, সুমিতা চক্রবর্তী, জয়ন্তী চটোপাধ্যায়, চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী, কবিরুল ইসলাম, রাম বসু, শামসুর রহমান। এছাড়া আরও অনেক প্রবীণ ও নবীন ব্যক্তিত্ব। অজস্র মননশীল রচনায় ‘অজন্তা’ আলোকিত হয়েছে এবং এখনো আলোকিত হয়ে চলেছে। টানা দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত ‘অজন্তা’-র আর একটি কাজ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেটা হলো, ‘অজন্তা’ গত ২৪ বছর ধরে বার্ষিক সেমিনারের আয়োজন করে চলেছে। সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে এই আলোচনাসভায়। যেমন বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ইত্যাদি ইত্যাদি। ২০১১ সালের সেমিনারের বিষয় ছিল ‘লিটল ম্যাগাজিন’।
বর্তমানে ‘অজন্তা’র সম্পাদকমন্ডলীতে আছেন নবেন্দু সেন, বাণী গাঙ্গুলী, গোপা দে, স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়, অতনু সরকার, রমেন রায়, বিপ্রজিৎ পাল, রবীন চন্দ, মনোজিত মিত্র। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ নবেন্দু সেন-এর সম্পাদনায় ‘অজন্তা’-র কবিতা সংকলন, গদ্য সংকলন ও প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা দিল্লি তথা বাংলাভাষাপ্রেমী সকল মানুষের কাছেই আদরণীয় এবং গর্বের বিষয়।
‘অজন্তা’-র যিনি নামকরণ করেছিলেন, সেই জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র এখন জন্মশতবর্ষ চলছে। ‘অজন্তা’-র পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে তাঁর কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ছে। এই স্বল্পপরিসরের নিবন্ধে এই প্রসঙ্গে আমি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, আমাদের প্রিয় ‘বটুকদা’কে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর সম্পর্কে দু’একটি কথা আলোচনা করি।
আমরা সুরস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে বাংলার তথা ভারতের সংস্কৃ্তিতে সার্থক একজন রবীন্দ্র-অনুসারী হিসেবে পাই। রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধুই সুরস্রষ্টা ছিলেন না, জ্যোতিরিন্দ্রও তাই। কবিতা ছাড়াও নিবন্ধ-প্রবন্ধ, আলোচনা প্রভৃতি সাহিত্যের কয়েকটি দিকে তিনি শাখা বিস্তার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিমন্ডলে যেমন সংগীত একটা প্রধান নিয়ামক ছিল, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রেরও তাই। তাঁর পিতা যোগেন্দ্রনাথ পাখওয়াজ বাজাতেন। জ্যোতিরিন্দ্র নিজেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিমপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর সুর এবং গানে বিভিন্ন প্রাদেশিক লোকগান ও পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সংগীতের আত্মীকরণ লক্ষ্য করা যায়। কথা, সুর ও ভাবের যে ত্রিবেণী সংগম আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পেয়ে থাকি, সেই ত্রিবেণী সংগম জ্যোতিরিন্দ্রের মধ্যেও দেদীপ্যমান ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে জ্যোতিরিন্দ্র-র মধ্যেই বেশি করে এবং সার্থকরূপে ‘অপেরা’ বা ‘গীতিনাট্যে’র আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তাঁর মধ্যেই তথাকথিত গণসঙ্গীতের ধারাটির প্রথম একটি রূপ স্পষ্টরূপে ধরা দিয়েছিল।
চল্লিশের দশকে কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র রচনা করেন কয়েকটি অপেরাধর্মী কম্পোজিশন : ‘নবজীবনের গান’, ‘ঝঞ্ঝার গান’, ‘পাহাড় নদী ও মানুষের গান’ ও ‘গাজন’। কবির ভাষায় : “এলো ১৯৪৩ সাল, বাংলার ১৩৫০। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে, বিশেষ করে শহর কলকাতায়, মহামন্বন্তরের করাল ছায়া চারদিক অন্ধকার করে দিল ।... চৌরঙ্গী, কালীঘাট, লেক মার্কেটের মোড়, বালিগঞ্জ... ওদিকে শেয়ালদা, শ্যামবাজার মোড়। সর্বত্র এক দৃশ্য -- শত সহস্র কঙ্কাল। ‘ফেন দাও ফেন দাও’ বলে চিৎকার করছে।... গরু-ছাগলের খাদ্য নিয়ে মানুষে-মানুষে কাড়াকাড়ি। ডাস্টবিনের পচা এঁটোকাঁটা নিয়ে কুকুরে-মানুষে মারামারি।... এর প্রচণ্ড অভিঘাত আমার গোটা অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিল।... সুর আর কথা মনের বেদনা ও যন্ত্রণার উৎস মুখ থেকে ঝরনার মতো বেরিয়ে এলো। শুরু হলো নবজীবনের গান”। ‘নবজীবনের গান’ অপেরা বা গীতিনাট্যের কুশীলব ছিল মন্বন্তর-আক্রান্ত কলকাতার বিভিন্ন নাগরিকবৃন্দ ও দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের দল।
দিল্লির শ্রীরাম ভারতীয় কলাকেন্দ্রের সংগীত পরিচালক রূপে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র হিন্দি ও সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন কাব্য অবলম্বনে রচনা করেন অনেকগুলি গীতিনাট্য, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘রামলীলা’। সুরকার জ্যোতিরিন্দ্রর প্রতিভার প্রকাশ এর চেয়ে বেশি বোধহয় আর কোনো রচনায় হয়নি। শুধু সংস্কৃত ও হিন্দি সাহিত্যের বিভিন্ন রচনায় তিনি সুর দিয়েছেন তা নয়, সমসাময়িক বিভিন্ন কবির রচনাতেও তিনি সুরারোপ করেছিলেন। দিল্লির করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ প্রযোজিত পরশুরামের ‘লম্বকর্ণ পালা’ নাটকটিতে অসাধারণ সুরারোপ করেন তিনি। তিনি বেশ কিছু উন্নত মানের চলচ্চিত্রেও সংগীত পরিচালনা করে গেছেন, যেমন, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘কোমল গান্ধার’ প্রভৃতি। এছাড়া সংগীত পরিচালনা করেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ‘আমার লেনিন’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রেও।
কবি, সংগীতজ্ঞ, গীতিকার, সংগীত-নির্দেশক জ্যোতিরিন্দ্রের সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরাই পেয়েছেন অবিশ্বাস্য এক নির্মল প্রতিভার ছোঁয়া, সেইসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও গণসংস্কৃতির প্রতি একনিষ্ঠ ও প্রগাঢ় বিশ্বাসের আলো। গণনাট্যের সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে তিনি ছিলেন একজন উজ্জ্বল সৃষ্টিশীলতার প্রতীক, মানুষ যাঁর ওপরে আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল। তাঁর রচিত কবিতা ও গান একসময় কেবলমাত্র বাঙালিদের কাছেই নয়, সমগ্র ভারাতবাসীর হৃদয় হরণ করেছিল।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন