স্মরণের সরণিতে – ২
[এই স্মৃতিকাহিনীর লেখক শ্রীঅনিল শেঠের জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর শৈশব কাটে জামশেদপুরে, সেখানে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি যান কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। বিজ্ঞানে স্নাতক হবার সঙ্গে সঙ্গে বিগত শতকের চল্লিশের দশকের কলকাতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার সেই সব ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন আর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর ঝুলিতে জমা হয় বিচিত্র ও বর্ণময় সব অভিজ্ঞতা। গণনাট্যের প্রসারে তিনি সফর করেন অবিভক্ত বাঙলাদেশের নানা স্থানে। পরে তিনি জামশেদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম শাখা। তারপর শহরের নানা বিদ্যায়তনে শিক্ষকতার পেশায় অতিবাহিত হয় তাঁর জীবনের অনেকগুলি বছর। বিজ্ঞান-প্রদর্শনী, সায়েন্স ক্লাব ইত্যাদি নানা অভিনব কর্মধারার মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরূপে। বর্তমানে সেই পেশা থেকে অবসর নিয়েও এই বর্ষীয়ান শিক্ষাব্রতী আজও নানা ধরনের সৃষ্টিশীল মননে ও চর্চায় নিযুক্ত। তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণময় জীবন-খাতার পাতা থেকে কিছু আকর্ষণীয় কাহিনী আমরা মাঝে মাঝে এখানে পরিবেশন করব। প্রথম পর্ব আগেই প্রকাশিত হয়েছে, এবার তার দ্বিতীয় পর্ব।]
তালাইপাট
জামশেদপুর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সিংভূমের হলুদপুকুরের কাছে ব্যাসল্ট শিলায় তৈরি এক ছোট পাহাড় তালাইপাট। সেখানে একটি গুহা আছে, যা ভেতর দিকে গভীর এবং এর একটি মুখ রয়েছে পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি। এটি ছিল একটি বাঘের গুহা ও পাহাড়ের নিচের দিকে কোথাও এর আরেকটি প্রবেশমুখ ছিল। ওপরের মুখটি খোলা থাকায় বায়ু চলাচলে সহায়তা হতো। ওপরের সেই খোলা মুখটির কাছের পাথরগুলো ছিল খুব মসৃণ। লোকের বিশ্বাস ছিল, বহু শতাব্দী ধরে ঐ পথে যাতায়াত করত শেয়ালেরা, যারা ঐ গুহায় বিশ্রাম নিত এবং সেটাই ঐ মসৃণতার কারণ।
আমি এই জায়গাটিতে যাই ১৯৪৩ সালে, তখন আমি নবম মানের ছাত্র। সে-সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। বোমা পড়েছে কলকাতায়। বিপুল সংখ্যায় লোকজন চলে যাচ্ছে শহর ছেড়ে, পালিয়ে যাচ্ছে দূরের কোনো গ্রামের উদ্দেশ্যে। জামশেদপুরেও সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলগুলো দখল করেছে মিলিটারি। পুরো শহরটা বিমান আক্রমণরোধী বেলুন-ব্যারেজ আর গভীর ট্রেঞ্চে ভর্তি। রাতে চলছে নিষ্প্রদীপ, আর দিনের বেলায় ঘন ঘন ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করে শহরের ওপর পর্দা তৈরি করা হচ্ছে। বাবা ছাড়া আমাদের বাড়ির সবাই চলে এসেছি হলুদপুকুরে, সেখানে আমাদের কিছু জমি-জমা ছিল। এই সময়ই আমি এই তালাইপাট সম্পর্কে জানতে পারি।
এক সঙ্গীকে নিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে আমি ওই গুহামুখে পৌঁছেছিলাম। ঐ খোলা মুখের ভেতর দিয়ে আমি প্রায় ন’দশ ফুট পর্যন্ত নেমেছিলাম। সেই গভীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আরও নিচে নামা সম্ভব ছিল না। আমার সঙ্গীও ওপর থেকে আমাকে ক্রমাগত তাগিদ দিচ্ছিল ফিরে যাবার জন্য। গুহার গভীরতা থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধ সেখানে মাংসাশী জানোয়ারের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এখন অবশ্য জামশেদপুরের আশেপাশে পাহাড়গুলোতে বাঘ নেই, যদিও হাতি আর অন্য কিছু বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়।
আমার সঙ্গী বলেছিল, সে আর একটি মজার জিনিস দেখাবে – একটি ‘গান গাওয়া পাথর’! আমরা আর একটি খাড়াই বেয়ে উঠলাম। সেখানে দেখতে পেলাম, গভীর এক খাতের ওপর বসানো রয়েছে বড় সড় এক পাথরের টুকরো। পাথরের আকৃতি অনেকটা গোলাকার, শুধু ওপরের অংশটি প্রায় চ্যাপটা। আমরা যখন ছোট একটা পাথরের টুকরো দিয়ে ঐ শিলাখন্ডে আঘাত করলাম, একটা সুরেলা আওয়াজ বেরিয়ে এলো। কি আশ্চর্য ব্যাপার! আমি পরে জানতে পারি যে, ছোটনাগপুর গেজেটে ব্রিটিশ সরকার এই পাথরটিকে ‘সিংভূমের গান গাওয়া শিলা’ বলে উল্লেখ করেছিল। একথাও শুনেছিলাম যে, কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম থেকে একটি দল এসে এই শিলাখন্ডটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে গেছে।
এইসব স্থানগুলিকে সংরক্ষণ করে এগুলিকে পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে তোলা উচিৎ। অনুসন্ধানের জন্য অভিযানও সংগঠিত করা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর এতগুলি বছর পার হয়ে গেলেও কিছুই করা হয়নি। এইসব ছোট ছোট আশ্চর্যগুলি চিরায়ত আশ্চর্যগুলির সোচ্চার ঢক্কানিনাদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
[মূল ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : অলক বসু চৌধুরী]
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন