কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

১৩) অলোকপর্ণা

ঘুম নেই ২


জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে নীলার মনে পড়ে না এইমাত্র কেন সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে মনে ছিল, রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসার সময়েও, কিন্তু জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে... কিছু মনে করতে পারে না নীলা। রাস্তা দিয়ে দূরে চলে যাওয়া গাড়িদের আলো নিষিদ্ধ হাতের মতো ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে তার সারা গায়ে। সেই আলোতেই স্পষ্ট হচ্ছে কাঁটাতার, আর তার ওপারের জঙ্গল।

পায়ে পায়ে হেঁটে এসে নীলা কাঁটাতারের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তার দুর্বল দৃষ্টিতে মিশমিশে ঘন হয়ে আছে ওপাশের অন্ধকার। আহ্‌ অন্ধকার এত ভালো লাগে কেন তার! নীলা বোঝে, অন্ধকারই একমাত্র এমন যাকে কষ্ট করে বিশ্বাস করতে হয় না, যাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে হয় না। নিজের চোখ দুটোকে আঁধারে বিলিয়ে দিয়ে কাঁটাতারে হাত রাখতেই তার হাতে চিনচিনে ব্যথাটা আলোর মতো জ্বলে উঠল।

অন্ধকারে সে কবজির ক্ষতর দিকে আড়চোখে তাকায়। সেখান থেকে এখন টিপ টিপ রক্ত পড়ছে। অন্ধকারে সেই রক্ত ঠিক কোথায় গিয়ে জমছে, নীলা ঠাহর করতে পারে না। তবে সে জানে, ক্ষতটা কবজির ঠিক ঘড়ি পরার জায়গা বরাবর হয়েছে, যাকে সহজে ঢেকে ফেলা যায়, কারণ নীলা জানে সে এখনই মরছে না।

গলি থেকে দু’একটা কুকুর বেরিয়ে এসে নীলাকে দেখে সন্দেহবশে ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে। নীলা ভারী চোখে ওদের দিকে তাকায়। ওরা মহল্লা পাহারা দেয়। ওরাও নীলার মতো রাত জাগে। ওরা জানে, নীলা গত একমাস ঘুমোয়নি। কেন, তা ওরা জানে না। ভাল্লুকের মতো লোমওয়ালা টমি চারপায়ে নীলার কাছে এগিয়ে এসে তার জঙ্ঘার গন্ধ শোঁকে। নীলা ব্যথার হাত তার মাথায় রাখে। টমি রক্তের গন্ধ শুঁকে নীলার ক্ষততে আলতো জিভ বুলিয়ে দিতেই, নীলা তাকে তাড়িয়ে দেয়।

নীলা দেখে, কুকুরটা ধুঁকতে ধুঁকতে গলিতে ফিরে যাচ্ছে, রক্তের গন্ধে যেন তার চোখে ঘুম ঢলে এসেছে। নীলা নিজের কবজির দিকে তাকায়। অন্ধকার আর রক্ত মিশে যাওয়ায় তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। আচমকাই কী ভেবে যেন ক্ষতটা নিজের মুখে চেপে ধরে নীলা। রক্তের স্বাদ পেলে যদি তার ঘুম চলে আসে, -- টমির মতো! ঠান্ডা হাওয়ায় দুলে ওঠে জঙ্গলের গাছ। নীলা রক্ত মাখা মুখে আবার অন্ধকারের দিকে তাকায়। অন্ধকার মানেই ঘুম, -- নীলার মনে পড়ে না, কেন সে জঙ্গলের কাছে এসেছে!

নীলার মনে পড়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উথলে ওঠা দুধের গন্ধে ঘর ভরে আসছিল। এতক্ষণে ওভেনে পোড়া দুধের দাগ বসে গেছে। সে ভাবে, তার কি ফিরে যাওয়া উচিত? ওভেন জাঁকিয়ে বসা দুধের দাগের জন্যই কি নীলার ফিরে যাওয়া উচিত? অন্ধকারে প্রশ্নটা ছুঁড়তেই জঙ্গলের ভেতর থেকে রাতপাখি নীলাকে চমকে দিয়ে ডেকে ওঠে। ঘোলাটে লালচে চোখে নীলা অন্ধকারের মধ্যে পাখিটাকে খোঁজে, -- পায় না। হাতের চেটো দিয়ে চোখ কচলায় নীলা, ছোটবেলার মতো। তবু রাতপাখিকে দেখতে পায় না সে। তখনই ঘুমের মতো আবার ডেকে উঠল পাখিটা। হঠাৎ নীলার মনে হলো, পাখিটার চোখ ওই গাছের ফাঁকে লেগে আছে! চলে যাওয়া গাড়ির আলো সমর্থন জানিয়ে যায় নীলার চোখদের। কাঁটাতারে হাত চেপে ধরে নীলা।

চিলতে রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে তার হাতের পাতায়, তবু তার মনে পড়ে না, কেন সে আজ অন্ধকারে এসেছে! পাখিটা ডেকেই চলেছে তখন থেকে। নীলা তার নাম দেয়, -- ঘুম। তবে কি, ওপারে গেলেই ঘুমকে পাওয়া যাবে? কাঁটাতার ধরে অল্প অল্প দুলে ওঠে নীলা, দ্বন্দ হয় তার। দু’হাতে আঁকড়ে ধ’রে সে কাঁটাতার পার করে ফেলে। টান লেগে কুর্তি ছিঁড়ে যায় তার। কাপড়ের একটা ছোট্ট টুকরো লেগে থাকে তারে।

এপারে এসে নীলা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকায়। তার তখনও মনে পড়ে না, কেন সে বাড়ি ছেড়ে এসেছে! কিন্তু অন্ধকারে তাকিয়ে সে টের পায়, এই জঙ্গলেই কোনো গাছে ঘুম বসে আছে তার জন্য, -- ঘুম নামের পাখি। পাখিটার আবছা ডাক কানে আসে তার। ঘুমের খোঁজে নীলা অন্ধকারে হেঁটে চলে যায়।

গাড়ির যাতায়াত লাইটহাউসের মতো ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে কাঁটাতারের ওপর। কুর্তির ছেঁড়া টুকরোটা বারবার আলো লেগে জেগে গিয়ে জ্বল জ্বল করতে থাকে।

1 কমেন্টস্: