কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২৮

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২৮

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১২৮ / ত্রয়োদশ বর্ষ : প্রথম সংখ্যা

 


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালের মার্চ মাসে। আজ প্রকাশিত হলো ত্রয়োদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা। বিগত বারো বছরে প্রকাশিত হয়েছে ১২৭টি সংখ্যা। যদিও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতি বছরে নিয়মিতভাবে বারোটি সংখ্যা প্রকাশের কথা ছিল, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে  বিভিন্ন অসুবিধা ও সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ বারো বছর ধরে কোনো পত্রিকার উপাদান ও তার মান ধরে রাখাও একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। বিশেষত মূল যে বিভাগগুলি নিয়ে পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখনও পর্যন্ত মোটামুটিভাবে তা বজায় রাখতে পেরেছি। দু’একটি বিভাগ অবশ্য অনিবার্য কারণেই সংযোজিত অথবা বিয়োজিত হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি, প্রত্যেকটি বিভাগে যেন তুলনামূলক বিচারে শ্রেষ্ঠ লেখাগুলি প্রকাশ করতে পারি। এবং সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি, অন্যদিকে তেমনি তরুণ ও তরুণতর লেখকদের লেখাও সমান্তরালভাবে প্রকাশ করেছি। প্রসঙ্গত আবার একই বিনীত অনুরোধ জানাই ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের আগ্রহী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে, আপনাদের মধ্যে যাঁরা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক চর্চা করে থাকেন, তাঁরা তাঁদের লেখা পাঠান ‘কালিমাটি অনলাইন’এর নির্দিষ্ট বিভাগগুলির জন্য। আমরা সাদরে সেইসব লেখা গ্রহণ করব এবং মনোনীত লেখা প্রকাশ করব।

২০১৩ সালের মার্চ মাসে ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের সূচনা করে লিখেছিলাম – “২০১১ সালের ১লা জানুয়ারী প্রকাশিত হয়েছিল কবিতার ব্লগজিন ‘কবিতার কালিমাটি’র প্রথম সংখ্যা। আর গল্পের ব্লগজিন ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৩রা মার্চ। এখনও পর্যন্ত ‘কবিতার কালিমাটির ২৩টি সংখ্যা এবং ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’র ৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা অত্যন্ত  আনন্দিত, এই দুটি ব্লগজিনই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁদের সহযোগিতা এবং ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হয়েছে।

‘কালিমাটি অনলাইন’ একটি নতুন ব্লগজিন, যেখানে ‘কবিতার কালিমাটি’ এবং ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ --  এই দুই ব্লগজিনকে সমান্তরালভাবে রাখা হলো। সেইসঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে আরও কিছু সংযোজনের পরিকল্পনাও থাকলো। আমরা নিশ্চিত, প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আমাদের এই নতুন প্রয়াস সাদরে গৃহীত হবে।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অর্ঘ্য দত্ত বক্সী

 

লজ্জাগৌরি: এক দেবীমূর্তির বিবর্তনের নিরিখে সভ্যতার ইতিহাস দেখা




একদা শিব পার্বতীকে একটি কম্বল দিয়ে তা সযত্নে রক্ষা করতে বলেন। পার্বতী তা যত্ন করে রেখে দেন। শিব তার সঙ্গে মজা করার জন্যই ইঁদুরের রূপে এসে সেই কম্বলে ছিদ্র করে দেন। পরে পার্বতী সেই কম্বলের অবস্থা দেখে চিন্তান্বিত হয়ে পরেন যে তিনি শিবকে কী উত্তর দেবেন! এমন সময় দেবীকে পরীক্ষা করবার মানসে শিব এক দরজির বেশ ধারণ করে দেবীর সম্মুখে উপস্থিত হন। পার্বতী তাকে দেখেই কম্বল সারিয়ে দিতে বলেন। দরজি তাতে সম্মত হয়, কিন্তু সে শর্ত রাখে যে, তার বিনিময়ে পার্বতীকে তার সঙ্গে সঙ্গম করতে হবে। দেবী প্রবল লজ্জা পেলেও, কম্বলের অবস্থা আর রুদ্রের সম্ভাব্য রোষের কথা ভেবে একেই সহজ সমাধান ভেবে দরজির শর্তে রাজি হয়ে যান। যখন দরজিরূপী শিব সঙ্গমরত অবস্থায় নিজ রূপে দেবীর কাছে প্রকটিত হন, তখন লজ্জায় দেবীর মাথা কাটা যায় এবং তার জায়গায় এক পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। সেই রূপই লজ্জা গৌরি। দেবীর কামঘনরূপ।

কম্বলও (লজ্জা)বস্ত্র! এবং তাতে ছেদও লজ্জাউদ্‌গীরক।

প্রকৃতপক্ষে নারীশক্তির পূজা এইজন্য হয়নি যে, নারীর ইমেজ খুব মহান ছিল। বরং তার কারণ নারীর প্রজনন ক্ষমতা ও তার ফলে একটি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি। মহামারী-যুদ্ধ-প্রতিকূল প্রকৃতি ইত্যাদি ক্রমাগত জনসংখ্যার ক্ষয় করেছে। তাকে পরিপূরণ করেছে নারীরা, যাদের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ অবিচ্ছিন্ন। পুরুষ চাইলেই তার বীর্যপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার কামবাসনাও তার মধ্যে প্রবলতর। আবার সে নিউট্রাল হয়ে গিয়ে বলতে পারে— সচ্চিদানন্দ শিবোহম! কিন্তু একজন নারী তা পারে না, চাইলেও সে অত পরিমাণে স্বেচ্ছাধীন হতে পারে না। তার ঋতুস্রাব হবেই, তার কিশোরী দশায় সে বড় হতে না চাইলেও প্রথম ঋতুস্রাবের মাধ্যমে প্রকৃতি জানিয়ে দেবে যে সে এখন পূর্ণনারী! প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মতোই তারও হরমোনাল চেঞ্জ হবে প্রতিমাসে! তার মধ্যে প্রকৃতি যেন নিত্য বিরাজিতা। একবার গর্ভবতী হলে দশমাস তাকে শরীরের ভিতরের ঘটে চারা পালনের মতোই লালনপালন করতে হবে বংশের উত্তরাধিকার। এবং শ্রেণিবিভক্ত ব্যক্তিগত মালিকানা ও তার উত্তরাধিকারের সমাজ তাই নারীকে দেবীরূপে পুজো করে তার প্রজননশক্তির জন্য। শস্যও নারীসুলভ ও প্রকৃতির চিরকালীন রীতিতে উৎপাদিত হয়। এই ভাবে নারী-শস্য-মাটি-প্রকৃতি-যৌনতা একত্র হয়ে এক দেবীরূপে পূজিতা হন।

'লজ্জাগৌরি' নামটি অনেক পরে ব্যবহৃত হয় এবং বৈদিক সাহিত্যে তার উল্লেখ নেই। বরং বৈদিক সাহিত্যে তার নাম অদিতি উত্তানপাদ (উত্থিত পদ)।

দেবী দুর্গা বা পার্বতী বা উমা শৈবধর্মের সঙ্গে সংযুক্তা দেবী। শৈবনারী তার প্রজননক্ষমতা দীর্ঘ বয়স অবধি ধরে রাখতে পারেন। দুর্গা তার আইকনগ্রাফি অনুযায়ী খাদ্য-সংগ্রাহক শিকারী ও পশুপালনকারী অবস্থা থেকে মানুষের খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষি সভ্যতায় উন্নীত হবার প্রতীকমহিষকে হত্যা করা হচ্ছে। করছে সিংহ পুরুষ ও দশহস্তা কর্মনিপুণা নারী একত্রে। লক্ষ্মী-সরস্বতী ইত্যাদি বৈদিক দেবী তার থেকে নিচু অবস্থানে থাকছেন (কন্যারূপে)শিবও তার পশুপতিরূপ ত্যাগ করে এখানে শুধুই দ্রষ্টা-যোগী হয়ে উঠছেন। দুর্গাপুজোর আগে নবরাত্রিতে পূজিতা হচ্ছেন দেবীর নয় রূপ শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরি ও সিদ্ধিদাত্রীসতী দেহত্যাগের পর হিমালয় কন্যা পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করেন, তাই তিনি শৈলরাজের পুত্রী, ইত্যাদি পরে আলোচিত হবে। অষ্টমাতৃকা যেমন ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কুমারী, বারাহি, নারসিংহী ইত্যাদি পুরুষ দেবতাদের নারীরূপ, এমনকি গুহ্যদ্বারের রক্ষাকারিণী দেবী গুহ্যেশ্বরীর কথাও পাওয়া যায় দেবী কব্‌চম স্তোত্রে। যাইহোক, লজ্জাগৌরি প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলি যে, দুর্গার বিবিধ রূপ যেমন শাকম্ভরী (শা-সব্জি), পৃথিবী/ভূমি (উর্বরতা শক্তি), রেনুকা (কুমারী মৃত্তিকা), কোটাভী কোট্টামাহিকা (নগ্না কুলদেবী-নিদ্রাদেবী), ইয়ালাম্মা (সকলের মাতা) ইত্যাদি লজ্জাগৌরিরূপেই পূজিতা। ভারতের সর্বত্র এই দেবী আদিকাল থেকে এখনও অবধি পূজিতা হন। রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারতে এই দেবীশক্তি কৃষকশ্রেণির আরাধ্যা। আদিতে সকল প্রজনন ক্ষমতা, যৌনতা, সন্তান উৎপাদন, শস্য উৎপাদন, কৃষি ও প্রাকৃতিক শক্তির উপাস্য ছিলেন দেবী অঙ্গিয়ারা মাতা (উত্তর প্যালিওলিথিক যুগ, মধ্যপ্রদেশ) যিনি আর কিছুই নন, এক ত্রিভুজাকার যোনিমূর্তি! জনপদ-মৌর্যযুগ অতিক্রম করে ৬০০ শতাব্দীতে লজ্জাগৌরি পুজো প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

যাইহোক, আগে আমরা মানবসভ্যতার আদিতে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে সভ্যতাগুলিতে এই মূর্তির সমতুল্য মূর্তিগুলিতে চলে যাই। ধীরে ধীরে দেবীর আইকনগ্রাফিক্যাল পাঠ সম্পূর্ণ করে আবার আমরা ভারত উপমহাদেশে তার মাহাত্ম্য, ঐতিহাসিকতা ইত্যাদি আলোচনায় ফিরে আস

প্রাগাধুনিক মানব সভ্যতায় আদিম প্রজাতির মানুষদের প্রকৃতিপূজা, বস্তুপূজা বা বস্তুতে নরত্বারোপ করে পূজা (পাথর, গাছ, ইত্যাদি), তন্ত্র-মন্ত্র-কালাজাদু পূজার আদিমতম আধার দেবী লজ্জাগৌরি যিনি সৌভাগ্য, প্রাচুর্যতা ও প্রজননক্ষমতার প্রতীক

লজ্জাগৌরিলজ্জাহীনা যৌনচারিণী

লজ্জাগৌরি—নাম-রূপহীনা নারীযৌনতা

লজ্জাগৌরিএক আসন্ন প্রসবরতা মাতা!

তো এই সত্ত্বাটি তো আর স্বাভাবিকভাবেই কেবল ভারতেই পূজিতা হতে পারেন না। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীনতর মেসোপটেমিয়ান সভ্যতাতেওনিওলিথিক যুগের সকল মাতৃতান্ত্রিক ধর্মাচরণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে পূজিতা এই প্রকৃতিদেবী!

তিনি উবু হয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেনসন্তান প্রসবকালীন দেহভঙ্গিমায়হাত হাঁটুর উপর থেকে উপরে বিস্তৃত এবং হাতেও পদ্ম ধরে আছেন। বিবস্ত্রা, তবে মুক্তোজাতীয় নেকলেস, কটিবন্ধ, চুড়ি জাতীয় হস্ত অলংকার পরিহিতা—কোন কোন ক্ষেত্রে হস্ত দ্বারা আপন স্তন মর্দনরত অবস্থায়ঘাড় থেকে মাথার বদলে উত্থিত পদ্মনাল ও পরিপূর্ণ প্রস্ফূটিত পদ্মটি কাঁধে ঈষৎ হেলানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেট সমতল, গর্ভিনী নন এবং যোনি বড় ও অত্যন্ত প্রকট। তার যৌনময়তাকে আরো স্পষ্টভাবে বোঝাতে শিল্পীরা তার ক্লাইটোরিস ও যোনিমুখ অত্যন্ত স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, বহু প্রত্নবস্তুতে তার যোনির নিচে স্পষ্ট উত্থিত লিঙ্গ এবং অণ্ডকোষ আঁকা।

তার এই দেহভঙ্গিমাটি পরিপূর্ণরূপে পুরুষকে যৌনতায় আহ্বান করে আবার প্রসববেদনার মধ্যে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বমুহূর্তেরও প্রতীক এটি। পরবর্তীকালের ভিক্টোরিয়ান বা বলা ভালো পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ তার মাথাকে পদ্ম দিয়ে প্রতিস্থাপন করে যেন তাকে লজ্জিতা প্রতিপন্ন করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাকে পুরুষের যৌনফ্যান্টাসির ডানা মেলে দেওয়া আকাঙ্ক্ষিত নারীদেহে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে তার মুণ্ডটি অ্যানোনিমাস রাখা হয়েছে। এছাড়া লজ্জার সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। (বস্তুত তিন চার হাজার খ্রিঃ পূঃ তে বিশ্বের বেশির ভাগ মূর্তিতেই মুখসংযুক্ত, কিন্তু ভারতে নয়গ্রিক-রোমান-মিশরীয় দেবীরা প্রত্যেকে অত্যন্ত যৌনাকর্ষক মূর্তিতেই পূজিতা, ভারত কিন্তু তার দেবীদের মূর্তি এমনভাবে গড়েছে যাতে কোনোভাবেই তা দেখে যৌনতার উদ্রেক না হয়। চতুর্হস্তা, দশহস্তা, মুণ্ডমালিনীভারত বীরাচারী মতে দেবীকে স্ত্রী-প্রেমিকা দৃষ্টিতে দেখতে কম স্বচ্ছন্দ। তাই ভারতের দেবীমূর্তিরা মাতৃরূপা—স্নিগ্ধা, উগ্র যৌনাকর্ষক নন।)

ফুটনোট- মুণ্ডহীনা দেবীর কথা ভারতীয় মিথেও পাওয়া যায়। সর্বাগ্রে মনে পড়ে ছিন্নমস্তার কথা। কালীর গলায় একান্ন মুণ্ড, একান্ন পীঠ (যদিও মাত্র ৪২টি স্থান) ৫১ বর্ণমালার প্রতীকবর্ণ— রঙ, অক্ষর, জাতি ইত্যাদি বহু অর্থব্যঞ্জনা ধারণ করে। ছাগমুণ্ড দক্ষ, হস্তীমুণ্ড গণেশ, বানরমুণ্ড হনুমান বা কুকুরমুণ্ড আনুবিস সর্বজনবিদিত। রাবণের দশমুখ, হাইড্রার দশমুণ্ড, সহস্রমুণ্ড গ্রিক দানব হেকাটনখিরাস, সেরাবেরাসের তিনমুণ্ড, ব্রহ্মার পাঁচমুণ্ড যার একটি আবার কেটে নেওয়া হয়। মুণ্ডহীনতা বা মনুষ্যমুণ্ডহীন দেবদেবীরা কেউ বোধবুদ্ধিহীন পাশব সত্ত্বার প্রতীক নন। তার পরিবর্তে প্রাচীনতর প্রকৃতিজ প্রজ্ঞার প্রতীকএক পবিত্র ও অলৌকিক ক্ষমতার প্রতীক এক আত্মসমর্পণের প্রতীক পৃথিবীর অসংখ্য দেবদেবীর মুণ্ড মানুষের নয়। মানবচৈতন্য-পশুচৈতন্য-প্রকৃতিচৈতন্য আদিমতরকালে বিচ্ছিন্ন ছিল না। একাকার সত্ত্বা ছিল (যদিও বর্তমানে প্রচলিত মিথ থিওরি অনুযায়ী মিমেকিং মানুষ বর্তমান মানুষের মতোই সমান বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ছিল। প্রাচীন মানুষের কাছে মিবর্তমান মানুষের বিজ্ঞানের সমান কার্যকারিতা সম্পাদন করত)জুফিজ বা পশুকথা সকল ধরনের রূপকথার মধ্যে ও সকল উদ্ভূত মিথের মধ্যে প্রাচীনতম, একথা সর্বজনগ্রাহ্য।

আবার লক্ষণীয় যে, পদ্ম পরবর্তীকালের দৈবিক পবিত্রতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক। পদ্মাসনা গজগেলা লক্ষ্মী, পদ্মযোনি ব্রহ্মা এরা সকলেই কসমিক সৃষ্টির প্রতীক। বেদের শ্রীদেবী পরবর্তীকালে দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী ইত্যাদি দেবীতে বিভক্ত হন। এই শ্রী এর সঙ্গেও পদ্মের প্রবল সংযোগ। সহস্রার ও কুণ্ডলিনীর প্রতিটি চক্রকে আমরা পদ্ম দিয়ে প্রতিকায়িত করি। পদ্ম যেন একটি নারীগর্ভ—ফসল ও প্রজনন প্রাচুর্যের প্রতীকসুতরাং পদ্মমস্তক অবশ্যই অত্যন্ত সদর্থক ইমেজারি)

 

পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ান (খ্রিঃপূঃ সাড়ে চার হাজার বছর)। সমগ্র মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, নীলনদের তী, পার্সিয়া থেকে সিন্ধুসভ্যতার জনগোষ্ঠীর উপর এদের প্রভাব বিস্তর। মেসোপটেমিয়াতেও পূজিতা মহীয়সীমাতা লজ্জাগৌরিকে মাতৃতান্ত্রিক-প্রকৃতিপূজারী দেবী উপাসক সভ্যতাগুলির 'আদিমতম দেবী হিসাবেও চিন্তা করা যায়। নিওলিথিক যুগারম্ভে ৬৫০০ খ্রিঃ পূর্বে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার এল ওবেইদ গ্রামীন সভ্যতায় পাওয়া সরীসৃপ জাতীয় মুখবিশিষ্টা (গিরগিটি) উলঙ্গ, স্তনমর্দনকারিণী এবং যৌনস্থান স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা পোড়ামাটির মূর্তিগুলিই পৃথিবীর প্রাচীনতম দেবীমূর্তি

মেসোপটেমিয়ার পরবর্তীকালের দেবী ইনানা/ইসতার এনারই মার্জিত রূপ এবং ইনানা-দামুজ্জি উর্বরতা মিথে দেখা যায় যে দেবী কীপ্রকার উদগ্রযৌনতাময়ী নারীসত্ত্বা; পরবর্তীকালের পৃথিবীর সকল উর্বরতার দেবীরা এই আদিমতম দেবীরই অবতারস্বরূপাএবং সেই আদিদেবীর সরীসৃপমুখ এবার ইনানাকে পরিবেষ্টন করে অবস্থিত টিকটিকি, কাঁকড়াবিছে ইত্যাদিতে পর্যবসিত হয়েছে। মরুভূমির প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম কাঁকড়াবিছে সুমেরীয়দের কাছে সঙ্গমরত অবস্থার প্রতীক। 


মেসোপটেমিয়ার মিথে পুরুষ পুরোহিতদেরদের মাধ্যমে এ দেবীকে সঙ্গমের জন্য বারবার আহ্বান করা হয়েছে। দেবী নিজের বর্ণনায় বলেছেন, ‘আমি এক বারবণিতা যে পুরুষ যৌনাঙ্গের সঙ্গে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ। আমি পুরুষের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু আবার আমিই এক নারীরও সর্বপ্রিয় সখী!” (নারী-পুরুষের যাবতীয় সেক্সফ্যান্টাসি যৌনাঙ্গের প্রতীকও তিনি)। ইনানা বা ইসতারের বারবণিতা মন্দিরগুলির পূজারিনীরা নারী উর্বরতা-প্রকৃতি উর্বরতা সংক্রান্ত যাবতীয় পূজা আচার অনুষ্ঠান মিথের পালনকারিণী (দেবদাসী?)। শুঁড়িখানাগুলি থেকে মদ্যপ পুরুষদের প্রলুব্ধ করে নিয়ে যাওয়া (অর্থের বিনিময়ে কদাপি নয়) উচ্চপদমর্যাদা সম্পন্ন পবিত্র বারবণিতারা পরতেন মুক্তোর নেকলেস যা বীর্য রজের প্রতীক এবং আচার অনুষ্ঠান করার ক্ষমতাজ্ঞাপক সম্মানজনক পরিধানস্বরূপ (যেমন পৈতে বা রাজদণ্ড)। অর্থ বা জীবননির্বাহের জন্য নয়, কোনো পর্ণোগ্রাফিও নয়, জীবনের জন্য যৌনতার উৎসবকারিণী। নারীর প্রজনন ক্ষমতা ও পুরুষ-নারী সঙ্গমরত মূর্তিগুলিকে বলা হত পবিত্র বিবাহ’ মূর্তি। যা আজ পর্ণোগ্রাফি চার হাজার খ্রিঃ পূর্বে তা ছিল ঐশ্বরিক ক্রিয়া, জীবনের জয়গান। সেইসব চিন্তা আজও প্রাচীন মন্দিরগুলিতে পবিত্র অলঙ্করণরূপে খোদিত আছে।

ব্যাবিলনে প্রাপ্ত সিলগুলিতে প্রেম ও যৌনতার দেবী ইনানার সহচরীদের পা ফাঁক করা লজ্জাগৌরি দেহভঙ্গিমায় যৌনতার জন্য পুরুষদের সরাসরি আহ্বান করতে দেখা যায়। অন্য একটি সিলে, এক নগ্না দাসী অন্য এক নগ্নাকে এক দীর্ঘ শ্মশ্রুধারীর সঙ্গে যৌনতার জন্য অনুমতি চাইছেন ইনানার সহচরী 'লামাশতু'র কাছ থেকে। লামাশতু দেবী সিংহের মস্তক ও পক্ষীর ডানা বিশিষ্টা। এই সিলের কেন্দ্রে রয়েছেন বিশিষ্ট পেঁচকের মতো ডানা ও পদবিশিষ্টা এবং বিরাট ও প্রকট যোনিস্থান যুক্তা ইনানা দেবী যার দেহের নিম্নাংশ চলে গেছে পাতাল লোকে যেখানে কচ্ছপ, হরিণ, কীট ইত্যাদি পশুদেবতাদের অপূর্ব সমাহার।


কোনারকে তোলা এমনই শ্মশ্রুযুক্ত দুজন পুরুষের মূর্তি যারা ফোরসাম ও থ্রিসামে রত। আরও আশ্চর্যের যে তাদের কাউকেই পূর্বভারতীয়দের মতন দেখতে নয় (চৈনিক ও ইউরোপীয়)।





ফুটনোটঃ কোনো ইভলিউশন প্রসেসের তত্ত্ব নয়, পশুপূজার আদিবাসী ধর্মাচরণগুলিকে অঙ্গীভূত করে নিয়েই দশাবতারের ধারণা। ভারতীয় সনাতন ধর্ম অত্যন্ত আগ্রাসী! সে এলিমিনেশনে বিশ্বাস করে না। বিবিধের ও বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন করার রজ্জু তার ধর্ম সনাতন ধর্ম সকল ধর্ম ও তাদের যাবতীয় অদ্ভুতগুলিকে স্বীকৃতি দেয় ও আত্মসাৎ করে নেয়। যে কোন বাহনসেই আদিম জনগোষ্ঠীগুলির পশুপূজা ধর্মাচরণের প্রত্নচিহ্ন। বা তারও বেশি কিছু। সে যুগের মানুষ প্রাণীদের সঙ্গে নিবিড় যৌথ জীবন-যাপনের ফলে প্রাণীদের অভ্যাস-আচরণ-বৈশিষ্ট্য-শুভাশুভ গুণাবলীখবর-তথ্য-তত্ত্ব আজকের অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের প্রাণীবিদদের থেকে সহস্রগুণে বেশি জানতেন-বুঝতেন। তার ভিত্তিতে মানব মনে তৈরি পশুদের মানস-ইমেজকে যে পরবর্তী মূর্তিসৃষ্টিকারীরা অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে দেবদেবীদের মূল থিমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সংযুক্ত করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। তন্ত্র-অঘোর-শৈব বা সাগরসংগমে কপিলাশ্রমের সন্ন্যাসীরা যত প্রজাতির প্রাণীর উল্লেখ করেছেন (সামুদ্রিকও), বর্তমান বিজ্ঞান তত আবিষ্কার করতে পারেনি, তাদের ধারণা হয়তো সেই প্রজাতিগুলি বর্তমানে অবলুপ্ত। যাই হোক যতই হোক, পশুপতি শিব-এর মতো কনসেপ্ট অন্য মিথলজিতে বিরল।

এই ইনানার সহচরীদেবী লামাশতুযার যৌন স্থানে কাঁড়াবিছে (সঙ্গমের প্রতীক), মস্তক সিংহের ও পক্ষীডানা সংযুক্তা, কুকুর ও শূকরের (প্রচুর সন্তান উৎপাদন ও অবাধ ইনসেস্টের জন্য পরিচিত, উর্বরতার প্রতীক) স্তন্যদাত্রী, এবং সর্পস্তা (লিঙ্গের প্রতীক)। পরবর্তীকালে তিনি উপদেবতা-অপদেবতা-গ্রাম্য আঞ্চলিক দেবতায় (যেমন জ্বরাসুর) পরিণত হন; হয়ে যান ব্যাবিলনের অসুখের অপদেবী, গর্ভবতী মেয়েদের রোগ-দৌর্বল্যের জন্য দায়ী অপদেবী। আরো পরবর্তীকালে তিনিই ডাকিনী-হাকিনীসুলভ নারকীয় দেবীদের প্রতীক হন; পুতনা রাক্ষসীদের মতোই প্রজনন-প্রসব-নবজাতকের রো-ক্ষতি-মৃত্যু বিষয়ক অনিষ্টকারী অপদেবী রূপে বিবেচিতা হন। ইনানা যদি মহীয়সী মাতা হন ইনি তার ছায়া’—দেবীর কালোদিক



প্রকৃতিপূজা-উর্বরতার ধর্মবিশ্বাসে অভ্যস্ত মাতৃতান্ত্রিক-নদীমাতৃক সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলিতে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলিতে লজ্জাগৌরির মতো দেহভঙ্গিমার একাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। শোভাযাত্রার সিলে এক নগ্না ও পা ছড়িয়ে বসা নারীর চিত্র পাওয়া যায় যাকে ঘিরে আছে হিষ মস্তক ও ছামস্তক পেট-বড় গর্ভবতী দেবীরা (৩২০০খ্রিঃপূঃ)।



আরও পাওয়া যায় পারদ দিয়ে নির্মিত উজ্জ্বলচক্ষু ব্যাঙের সিল যার বিস্তৃত পায়ের দেহভঙ্গিমাও লজ্জাগৌরির মতো এবং তাকেও ঘিরে আছে কাঁকড়াবিছেরা। (আমরা এখানেই রূপকথাগুলিতে বর্ণিত ব্যাঙরাজপুত্র ও ব্যারাজকন্যা বা সেইজাতীয় নারীর সঙ্গে সাদৃশ্য পাই এবং রূপকথায় সেই ব্যাঙ শেষপর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধানকারী শক্তিরূপে নিজেকে প্রকাশ করেধর্ম ও মিথে ব্যাঙের উল্লেখ মিথগুলিকে প্রাচীন ও রূপকথাগুলিকে মহত্তর পর্যায়ে উন্নীত করে)।

অন্য একটি উত্তরকালের পরিণত হরপ্পা সিলে আমরা আপসাইড ডাউন এক নারীকে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখি ও তার যোনি থেকে একটি চারা গাছ বেরিয়ে এসেছে। আবার ওই সিলেরই উল্টোদিকে এক নারী তার মাথার চুল ছড়িয়ে হাত দিয়ে দুদিকে টানছেন এমন উদ্ভিদ প্রতীক দেখি যেমনকীনা মেসোপটেমিয়ার চিত্রেও দেখেছি। এই উন্নতি থেকে শস্য ও শাক-সবজির (১২০০ খ্রিঃপূ) মস্তকহীনা কৃষিদেবীরূপে লজ্জাগৌরির চরিত্রবদল পরিলক্ষিত হয়।



মৌর্যযুগেরও আগে 'ষোড়শ জনপদ'কালের সময়ে আমরা পাচ্ছি পা ছড়ানো ও মাথার আলু থালু কেশে চন্দ্রশোভিত ও শিবজ অনুষঙ্গসমন্বিত নারীমূর্তিগুলি। চাঁদ সরাসরিভাবে নারীযৌনতার প্রতীক (তার ২৮ দিনের সাইকেল ও ঋতুস্রাব সমার্থক)। এই নারীসত্ত্বাগুলিই পরবর্তীতে ধ্যানী-যোগী শিবের প্রতীকের সঙ্গে একত্র হয়ে দুর্গা/গৌরি/পার্বতীর আদিরূপের জন্ম দেয়। দেবীর মনুষ্যমুণ্ড বিশিষ্ট একটি বিগ্রহের সঙ্গে খোদিত হতে দেখা যায় গণেশ, লিঙ্গ, ত্রিশূল ও ষণ্ড। এভাবেই শৈব ফার্টিলিটি কাল্টের সঙ্গে, শিবলিঙ্গের প্রতীকের সঙ্গে মিশে যান লজ্জাগৌরিমৌর্যযুগের একটি অঙ্গুরীয়ের মধ্যেকার গর্তের ভিতরে বৃত্তাকারে মস্তকহীন পা ছড়ানো নারীমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়, যেখানে গর্তটি স্বয়ং যোনির প্রতীক। তবুও ১০০ খ্রিঃ পূর্বের আগে এই দেবীর পূর্ণাঙ্গ রূপটি সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত হতে পারেনি। ৬০০ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের শুঙ্গ রাজবংশের আমলেই লজ্জাগৌরির মহিমা চরমে ওঠে। নির্মিত হয় একাধিক মন্দির। তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রাবল্যে ঐহিক ভোগবাসনা ত্যাগ ও চরম বৈরাগ্যময় পরিবেশে যখন বংশরক্ষা ও প্রজাউৎপাদন একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে তখন লজ্জাগৌরি যৌনতা ও কৃষির দেবীরূপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মূলত সাংসারিকদের কাছে।

আবার মধ্যযুগে দেবীর অধিকাংশ বিগ্রহের গর্ভবর্তী পেট দেখা যায়। আদিম যৌনতা ছেড়ে দেবী পরিপূর্ণরূপে মাতৃত্বের, সন্তান কামনায় আরাধ্যা দেবীতে পরিণত হন। পূর্বে হয়তো কটিদেশ ও পেট ক্ষীণ করে সুন্দরী মহিলাদের মতো যৌন আবেদনময় করাতেই চরিতার্থ হত শিল্পীর মানস ও সমাজের চাহিদা। আর পদ্মনাল বেয়ে পরিপূর্ণ ভরন্ত প্রস্ফুটিত পদ্ম কাঁধের দিকে হেলে পড়েছে, এই চিত্রকল্পে মেটানো হ তার মাতৃসত্ত্বা ও কৃষিদেবীত্ত্বার চাহিদা। মাতৃসত্ত্বায় ক্রমান্বয়ে উত্তরণের ফলে সন্তান কামনায়, সন্তানের সুস্থতা কামনায় বিবাহিতা নারীদের উপাস্য হয়ে উঠলেন দেবী। সৃষ্টি হল পূজাপদ্ধতি, ব্রাহ্মণ্যমন্ত্র যা উচ্চারিত হত প্রসবকালীন অবস্থায় মা ও শিশুর সর্বতো মঙ্গলকামনায়। তার যোনিতে ও সিঁথিতে সিঁদুর মাখানো মূর্তি কামাখ্যায় আজও পূজিত হয় যা ঋতুস্রাবের প্রতীক দেবীর সঙ্গে যুক্ত হন পুরুষ দেবতারা অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে যাও অতিপ্রাচীন মানতে হবে।

ব্রাহ্মণ্যবাদে আশ্রয় পাওয়া দেবী ক্রমে লক্ষ্মীপ্রতিমার সঙ্গে মিশে যান। বঙ্গে গৃহগুলিতে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপুজোর সন্ধ্যেতে অতিশুভ স্বস্তিকা চিহ্নরূপে ঘটে ও পটে পা ও হাত ছড়ানো এক মানবমূর্তি অঙ্কিত হয়, মনে করা হয় যে তা এই লজ্জাগৌরি দেবীরই নবতম চিহ্ন। যদিও পূর্বেকার মূর্তিতে দেবীকে তার যোনি স্পর্শ করে বেঁকে থাকতেও দেখা গেছে এবং যাকে বেষ্টন করে আছে কাঁকড়াবিছেরা, সেখানেও দেবীমূর্তি স্বস্তিকচিহ্নের মতোই দেখতে লেগেছে।

এইভাবে আদিমতম সভ্যতাগুলির রহস্যময় যৌনদেবী থেকে বর্তমান গৃহস্থালীর শুত্বের স্বস্তিকাচিহ্নে উত্তরণের মাধ্যমে আমরা কি টাইমমেশিনে চড়ে সভ্যতার বিবর্তনকেই প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করি না? দ্বাদশ শতাব্দীর পর ভারতে নতুন করে কোথাও দেবী বিগ্রহ নির্মাণ করা হয়নি। পুরুষতন্ত্র তার বেসিক বর্বর ও উগ্র নারীদেহলোভকে বেশ ভালোভাবেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।  


        


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’; কাল্পনিকতার অন্তঃছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের প্রতিস্থাপন




মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পরিচায়ক মঙ্গলকাব্য। মূলত দেবদেবীদের বন্দনামূলক বিষয় এই কাব্যের উপজীব্য। কবিকঙ্কণের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ থেকে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কিংবা ‘ধর্মমঙ্গল’ সর্বত্রই দেব-দেবীর আখ্যানের পাশাপাশি সমকালীন সমাজের আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্যগুলিতে কাহিনির অন্তরালে শৈল্পিকভাবে কবি বাঙালি জনজীবনেরও পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। যেমন মানিক দত্তের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে বন্যায় বিপর্যস্ত ভাড়ু দত্তের দুরবস্থা বর্ণিত হয়েছে;

‘কার বাড়িতে ঝাটিঝুটি কার বাড়িতে তড়।

ভাড়ু দত্তের বাড়ি হৈল নদীয়া সাগর।...

আদাড়ের বাঁশ কাটি উত্থাড় বান্ধিল।

ধীরে ধীরে বন্যা ভাড়ুদত্তের বাড়িতে আইল।

মালসাট দিয়া বাহিরায় ভাড়ুয়া নাবড়।

শিব জপিয়া খট্টা পাড়িল পিড়ার উপর।।”

আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বর্গি আক্রমণের ফলে বিপর্যস্ত বাংলার বিবরণী প্রসঙ্গে কবি বলেছেন;

‘বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।

আইল বিস্তর সৈন্য বিকৃতি আকৃতি।।

লুঠি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।

গঙ্গা পার হৈল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।

কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।

লুঠিয়া লইল ধন (ঝিউড়ী বহুড়ী)

অনুরূপভাবে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যগুলিতেও তৎকালীন সময়ের প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে। যুগে যুগে নানান বিজাতীয় শাসক ভারত তথা বাংলার শাসনভার নিয়ন্ত্রণ করেছে। পাশাপাশি লুন্ঠিত হয়েছে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের বহু প্রামাণ্য নির্দশন। ইতিহাসের নিরিখে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরব প্রদেশের গজনি প্রদেশের তুর্কি সুলতানরা অবিভক্ত ভারতের উত্তর পশ্চিম দিক অর্থাৎ সিন্ধুদেশ জয় করে। মহম্মদ মাসুদ প্রণীত ‘তারিখ-ই-সিন্ধ্‌’ গ্রন্থে এই ঘটনার বর্ণনা মেলে। যদিও ঐতিহাসিকরা ভারতে তুর্কি আধিপত্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রূপে মহম্মদ ঘুরিকেই চিহ্নিত করেন; “১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ও উচ্‌ জয়ের মাধ্যমে তিনি ভারতভূমিতে ঘুর আধিপত্যের ভিত্তি স্থাপন করেনতারপর একে একে পেশোয়ার, লাহোর ও পশ্চিম পাঞ্জাব জয় করেন

পরবর্তীকালে ‘তরাইনের যুদ্ধে’ আহত হয়ে মহম্মদ ঘুরি প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিজিত স্থানগুলির শাসনভার অর্পণ করেন বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দিন আইবকের ওপর। তার সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ জয় করে সমগ্র পূর্ব ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেন। যা ইতিহাসে ‘তুর্কি বিজয়’ হিসাবে চিহ্নিত। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী ২৪৬ বছর সাহিত্যের নিরিখে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ’ হিসাবে অভিহিত। এই সময়ের মধ্যে কোনো সাহিত্যিক নিদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় না। তাই এই যুগটিকে সমালোচকগণ ‘বন্ধ্যা’ যুগ হিসাবেও নির্দেশায়িত করেছেন। অথচ এই সুবিস্তৃত সময়পর্বে কোনোরকম সাহিত্যকীর্তি রচিত হয়নি তা স্বীকার করাও বেশ দুর্বিষহ বিষয়। মনে করা হয় হয়তো কোনো লেখনী লিপিবদ্ধ হলেও কোনো না কোনো কারণ বশত তা জনসমক্ষে সে পৌঁছায়নি।

এইদিক তৎকালীন সময় লেখার কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদির ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় নাকাগজে লেখার প্রচলন আগে ছিল না। তৎকালীন সময়ের পুঁথিপত্র লেখার কাজে তালপাতা কিংবা তেডেল ব্যবহৃত হত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পোকামাকড়ের আক্রমণ বহুবিধ কারণে সেই পুঁথি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকত কারণ; “বাংলা ভাষায় সবচেয়ে পুরানো কাগজের পুঁথিটা লেখা হয়েছিল চোদ্দশো চার সালে। যদিও কাগজ এদেশে এসে গেছিল এগারো শতকে, কিন্তু সংস্কৃত পন্ডিতরা কাগজকে ভালো চোখে দেখে নি কেননা কাগজ এনেছিল মুসলমানেরা। পণ্ডিতরা বলত ম্লেচ্ছদের বস্তুতে হিন্দু ঠাকুর দেবতার নাম লিখব না। তখন তালপাতাকে পবিত্র মানা হত, তালপাতাকে দুধে কিংবা জলে ফুটিয়ে তাঁর শলাকা দিয়ে লেখা হত। আর তাছাড়া কাগজ শব্দটা বেদ-উপনিষদে ছিল না, তাই সংস্কৃত সাহিত্য কাগজে লিখতে একটু দেরি হয়েছে। ১৪০০-১৫০০ সালে বাংলায় মুসলমান শাসন চলছে, হিন্দুদের অনেক পুঁথি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন মুসলমান প্রভাবেই মূলতঃ কাগছে লেখা শুরু হল’’

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মতে কবি বা সাহিত্যিকদের দৃষ্টি সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিন্ন। তাঁরা চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে সাহিত্যকে পূরণকারক সত্য রূপে প্রদর্শন করে থাকেন। স্ময়-কাল-যুগের সাপেক্ষে ইতিহাসে তথ্যনির্ভর ঘটনাবলি বিবৃত হয়; সাহিত্য সমাজের দর্পণ হিসাবে কালপঞ্জির সঙ্গে সঙ্গে নানা অসঙ্গতি ও ফাঁক থেকে যায়। সাহিত্যিক বা কবি তাঁর কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সেই শূন্যতাকে পরিপূর্ণ করেন। তাই কাব্যকে পূরণকারক সত্য বলা হয়।

‘অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে’র এহেন তথ্যগত অসঙ্গতির পরিপূরক হিসাবে বলা প্রীতম বসু প্রণীত ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ উপন্যাসের কথা। আলোচ্য উপন্যাসে ঔপন্যাসিক তুর্কি বিজয়ের সমকালীন সময়ে রচিত ‘পঞ্চাননমঙ্গল’-এর উদ্ভব ও কাহিনি বিধৃত করেছেন। বলা যায় ‘বন্ধ্যাযুগের’ সঙ্গে পরবর্তী মঙ্গলকাব্যধারার একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে এর মাধ্যমে। আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে মঙ্গলকাব্য প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন; “আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হইতে আরম্ভ করিয়া অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্যের যে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্ম বিষয়ক আখ্যান-কাব্য প্রচলিত ছিল, তাহাই বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। বাংলার পল্লীর জনসভায় ইহার উদ্ভব হইলেও শেষ পর্যন্ত রাজসভায় ইহা প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। কিন্তু  ইহা বাংলাদেশের একটি বিশেষ যুগের সাহিত্যসাধনা হইলেও, ইহার সৃষ্টিপ্রেরণা কোন একটি বিশেষ সাম্প্রদায়িক ধর্মবিশ্বাস হইতে আসে নাই। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হইয়াও বাংলাদেশের লৌকিক ও বহিরাগত বিভিন্ন ধর্মমতের যে অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হইয়াছে, মঙ্গলকাব্যগুলি তাহারই পরিচয় বহন করিতেছে। বিভিন্ন যুগের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আচার-আরচণ, সংস্কার-সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের বিস্তৃত ভিত্তির উপরই ইহাদের প্রতিষ্ঠা।”

আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনি বিধৃত হয়েছে ‘পঞ্চানন’ অর্থাৎ অনার্য দেবতা শিবের বন্দনাকে কেন্দ্র করে। নন্দীধন নামক এক পূর্ববঙ্গীয় পুরোহিত যিনি একাধারে দর্শন, বিজ্ঞান এবং গণিতে পারদর্শী ছিলেন, তিনি এই কাব্যের প্রণেতা। রাজা প্রতাপাদিত্যের সময় তিনি বেত্রবতী তটবর্তী পাঁচমুড়ো অর্থাৎ ‘পঞ্চগ্রামে’ উপনীত হন। শিব-বন্দনার প্রচ্ছন্নতায় বহু গাণিতিক সূত্রাবলি সমৃদ্ধ কাব্যটি রচনা করেন। তবে তুর্কি বিজয়ের সময় এই কাব্যের পুঁথিটি নষ্ট করা হয়। ধ্বংস করা হয় ‘পঞ্চানন মন্দিরটিও’। কারণ আরবীয় শাসকের কাছে এই পুঁথি ‘শয়তানের পুঁথি’ রূপে নির্দেশিত ছিল। কল্পকাহিনির প্রচ্ছন্নতায় ঔপন্যাসিক শ্রী বসু সেই কাহিনিটি তুলে ধরেছেন এই ক্ষেত্রে।

‘মঙ্গলকাব্যের রীতি অনুসারে ভক্ত বিপদে পড়ে ঠাকুরকে ডাকে, তখন ঠাকুর এসে তাকে উদ্ধার করেন”৬, ; আলোচ্য প্রেক্ষাপটে সেইরূপ ঘটনাবলীও পরিলক্ষিত হয়। রামেশ্বর ভট্টাচার্য প্রণীত ‘শিবায়ন’ কাব্যে শিবের লোকায়াত রূপের পরিচয় মেলে। প্রাচীন বাংলার আদি দেবতা রূপে শিব বন্দনার কথা পাওয়া প্রাচীন পাঁচালিকাব্য থেকে নানারকম ছড়া-গাথায়, এমনকি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম প্রণীত ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ও ‘পঞ্চানন’-এর পুজার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। সেখানে কবি বলেছেন;

“এই গীত যেই জন করিবে শ্রবণ

বিপদে রাখিবে দুর্গা আর পঞ্চানন

সমাপত হইল এই ষোল পালা গান

অভয়া চরণে ভণে শ্রীকবিকঙ্কণ।”

অর্থাৎ বহু প্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলায় পূজিত হয় ভগবান শিব। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, “ভারতীয় যে সকল প্রাগ্‌বৈদিক দেবতা পরবর্তী হিন্দুসমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যে শিবই সর্বপ্রধান।”তবে প্রাগবৈদিক যুগের শিবের রূপবর্ণনার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না, তবে “শিবের মধ্যে এই ব্যাপ্তি সম্ভাবনা এত বহু-বিচিত্র ছিল যে, উচ্চ—নীচ হিন্দু-অহিন্দু জৈন-বৌদ্ধ-নাথ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই তিনি স্বীকৃতির শ্রেষ্ঠ আসনটি অনায়াসে অধিকার করতে পেরেছিলেন।”

শ্রীহট্টের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নন্দীধন বল্লাগ্রাম অর্থাৎ ‘পাঁচমুড়ো’ গ্রামে উপনীত হয়ে গড়ে তোলেন ‘পঞ্চমুণ্ডাকৃতি’ শিবের মন্দির। যদিও এহেন শিবমূর্তির প্রচলন বাংলায় আগে ছিল না, বাংলায় প্রচলিত ছিল সদাশিব লিঙ্গমূর্তি।। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট অঞ্চলে পঞ্চমুখী শিবের মূর্তির প্রভূত প্রচলন ছিল। নন্দীধন প্রথম ‘পাঁচফুট’ উচ্চতা বিশিষ্ট পঞ্চমুখী শিবের মূর্তি আনয়ন করেন। এই বিশেষ মূর্তির প্রতিটি মুখের আবার আলাদা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। পঞ্চমুখী শিবমূর্তিতে ‘বাবার চারমুখ চারদিকে আর পঞ্চম মুখ আকাশের দিকে তাকিয়ে’১০। দক্ষিণদিকে থাকা বাবার মূর্তিটি ‘অঘোরা’ রূপ, যার বর্ণ অঞ্জনবর্ণ; “সে রূপ হল ধ্বংসের রূপ, বাবা শ্মশানের মালিক, শুধু সৃষ্টিকে গিলে খাচ্ছে যাতে অন্য সৃষ্টির জায়গা হয়’’১১। আবার যে মুখটি শিবের আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত রয়েছে সেই রূপটির নাম ‘ঈশান’-বর্ণ শুক্ল; “সেইরূপে বাবা সর্বত্র বিরাজমান এবং তিনি সর্বজ্ঞানী চির শ্বাশত শিব। তিনিই সৃষ্টির কারণ।’’১২ এছাড়া পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকা মূর্তিটি ‘তৎপুরুষ’—বর্ণ বিদ্যুৎ; ‘ধ্যান ও জ্ঞানের প্রতীক’’১৩। উত্তরদিকে থাকা মূর্তিটি ‘বামদেব’ নামে পরিচিত। এই রূপটির বর্ণ ‘কুঙ্কুমবর্ণ সদালাবণ্যময়রূপ’; তিনি “মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্য আরোগ্য করেন।’’১৪ সর্বশেষ এবং পশ্চিমদিকে থাকা বাবার মূর্তিটির নাম ‘কর্পূর’-তিনি ইন্দুবর্ণ ‘রুদ্র’ রুপাকৃতি; “ক্রদ্ধ হয়ে তিনি সংহার করেন আবার প্রসন্ন হয়ে রক্ষা করেন।”১৫ এই পঞ্চমুখী শিবমূর্তিটি পাথরের দ্বারা নির্মিত হলেও মূর্তির ‘পাঁচটিমুখ’ নির্মিত হয়েছে স্টিবিয়াম অ্যান্টিমণি দ্বারা, ‘রূপার ন্যায় ইহার ঔজ্জ্বল্য অথচ অম্লে স্বর্ণ বা রূপার ক্ষয় হলেও এর ক্ষয় নেই।’’১৬ সমকালীন সময় বল্লালগ্রামে কালাজ্বরের প্রার্দুভাব দেখা দেয়। সেই সময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই শিবলিঙ্গের পূজিত জলের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ রক্ষা হয়। সেই থেকে বল্লাগ্রাম ‘পঞ্চমুণ্ড’ গ্রাম পরবর্তীতে ‘পাঁচমুড়ো’ হিসাবে পরিচিত হয়।

বাংলার অন্যতম শাসক রাজা গণেশের পুত্র যদু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে ‘জালালুদ্দিন’ নামে পরিচিত হন। ঊর্ধতন শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্যে মক্কায় বেশ কিছু স্থাপত্য নির্মাণ করেন; “১৪২৭ সালে জালালুদ্দিন মিশরের কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি পেল এবং নিজেকে আল সুলতান আল আজম মুজ্জামিন খালিফত আল্লাহ নামে প্রচার করল।’’১৭ জালালুদ্দিনের সময় তুর্কি শাসক খিলজী নালন্দা বৌদ্ধবিহারের পাশাপাশি বেশকিছু বৌদ্ধিক স্থাপত্য ধ্বংস করেন। পাশাপাশি সেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে রক্ষিত সমস্ত পুঁথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আসলে প্রাচীন ভারতে গণিতের প্রভূত গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়। আর্যভট্টীয় পুঁথি, ‘ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত’ পুঁথিতে বেশকিছু গাণিতিক সমীকরণের পরিচয় পাওয়া যায়। পশ্চিমি দুনিয়ায় ‘অ্যালগরিদম’-এর প্রণেতা হিসাবে আরবের  অল-খোয়ারজমিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। “ইতিহাস ঘাঁটলে  দেখা যায় এই অল-খোয়ারজমি ৮৫০ সালে অ্যালগদিরম ব্যবহার করেছিলেন লিনিয়ার ইকুয়েশন এবং কোয়াড্রেটিক ইকুয়েশনের অঙ্কের সমাধান করার জন্য।’’১৮ নন্দীধন বিরচিত ‘পঞ্চাননমঙ্গল কাব্যে’ শিবমন্ত্রের অন্তরালে এই গাণিতিক সূত্রের পরিচয় মেলে; এছাড়া “আলোর গতিবেগ, আলজেব্রার ফরমুলা, পিঙ্গলা, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর বরাহমিহির এদের সকলের বিখ্যাত কাজগুলো পঞ্চাননমঙ্গলের শিবের স্তোত্রের ভিতরে গোপনে ঢুকিয়ে দিলেন এবং যাতে এই পুঁথির লেখা সহজে নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্যে তিনি এগুলোকে পঞ্চমুণ্ড গ্রামের পঞ্চানন্দ দেবতার মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে খোদাই করে লিপিবদ্ধ করে রাখেন।”১৯ যার মধ্যে সুপ্ত থেকে যায় গাণিতিক সমীকরণাদি। যেমন এই কাব্যে বর্ণিত শ্লোকানুসারে দেখা যায় আলজেব্রার রূপ; শিব মাহাত্ম্যসূচক এই অংশটি ‘তোটক ছন্দে’ রচিত-

“বোল শিব শঙ্কর সংকট মর্দন জয়।

শিব কৌলেতে পক্ষেতে নেত্রেতে ক্ষয়।।

শিব কৌলেতে ফল ঋতুচক্র হয়।

শিরে নেত্র তথায় যবেঁ পক্ষতে ক্ষয়।

শিরে সংখ্যারি যোগতে এঁ ক্ষয় কভো নয়।।

শিরে পঞ্চাননের দূতী শঙ্করো জয়।’’২০

বীজগাণিতিক সূত্রানুসারে এই শ্লোকের গূঢ়ার্থটি হল- “শিব ঠাকুর অজানা মানে আননোন কোয়ান্টিটি এক্স। এখন শিবের শিরে নেত্র মানে এক্স এর মাথায় তিন, মানে এক্স টু দি পাওয়ার থ্রি। আর শিবের শিরে পক্ষ মানে এক্স টু দি পাওয়ার টু।...কবিতায় বলেছে তখন শিরে সংখ্যা গুণ না হয়ে যোগ হয়ে যায়। তার মানে এক্স টু দি পাওয়ার সিক্স না হয়ে ফাইভ হয়ে যায়, সেটাই হল শিরে পঞ্চানন।”২১

আবার ‘পিওর জিওম্যাট্রি’র পরিচয় মেলে কাব্যাংশের অন্তর্গত শ্লোকটিতে-

“পৃথুবি যে কালী মাএর খঙ্গ দেখী ত্রস্ত।

শিবের বুকে কালীর চরণ জীহা একহ হস্ত।।

কালীর সিঁদুর, শিবের চরণ, শিবের ভালের নেত্র।

এহি তীনত ঘিরে আছে আমার সগর্গ ক্ষেত্র।।

মুণ্ডমালা কালীমাতে রক্তে রাঙা খড়্গ।

কালী-শিবের গুনে ধরায় দুঅজ ভৈল সগর্গ।’’২২

আপাতভাবে দেখলে মনে হয় এখানে কালিকামূর্তির সঙ্গে সন্নিবিষ্ট শিবমূর্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই কাহিনির মোড়কে ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল নির্ধারক সূত্রটি জ্ঞাপিত হয়েছে। গাণিতিক ব্যাখ্যানুসারে-“ মা কালীর সিঁথির সিঁদুর, শিবের চরণ, আর শিবের কপালের চোখ –এই তিনটে বিন্দুকে কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করলে একটা ত্রিভুজ পাওয়া যায়। সেই ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলকে কবি স্বর্গক্ষেত্র বলেছেন। আমরা জানি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল হল হাফ ভূমি ইনটু উচ্চতা। শিব ভূমিতে শুয়ে আর মা কালী তার বুকে দাঁড়িয়ে। অর্ধেক শিবের লম্বাকে যদি মা কালীর উচ্চতা দিয়ে গুণ করা করি তবে পাওয়া যায় ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল। তার মানে শিবের লম্বাকে মা কালীর উচ্চতা দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যায় ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল-এর দ্বিগুণ অর্থাৎ স্বর্গ ক্ষেত্রের দ্বিগুণ লাভ হয়।’’২৩

ভারতীয় গণিতজ্ঞ তথা জ্যোর্তিবিদ্‌ আর্যভট্ট খ্রিস্টীয় শূন্যের ধারণা প্রণয়ন করেন। সেই সঙ্গে তিনি দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবনও করেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক ব্রহ্মগুপ্ত প্রথম শূন্যের যোগ-বিয়োগের সূত্র আবিষ্কার করেন;  সেই পদ্ধতির পরিচয় মেলে ‘পঞ্চাননমঙ্গল কাব্যে’-

“নাহি তবেঁহো আছহ আহ্মে সহ্মে জানি।

দেব তুহ্মি নিরাকার আন্তরে মানি।।

অব্যয় অক্ষয় দেব সদা শিব মুক্ত।

মায়া মোহ সংসারত হৈবেঁ নাহি যুক্ত।।

জড়ের হনন করী দিলেঁ নিজ থান।

থান পরিহরি বামে দশগুণ দান।”২৪

সাধারণভাবে দেখলে মনে হয় এই শ্লোকটিতে অব্যয়, অক্ষয় নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। যিনি সংসারের মায়ার বাইরে অবস্থান করেন এবং মানবজীবনের পরিসমাপ্তিতে তার চরণে জীবের স্থান প্রাপ্তি হয়। অথচ সেই দর্শনের আড়ালে দশমিক বা আধুনিক ডেসিমলের সূত্র বিবৃত হয়েছে। “৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্ট লিখেছিলেন “স্থানাৎ স্থানম্‌ দশগুনম্‌ স্যাৎ’’ অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেলে আগের থেকে দশগুণ হয়। এই শিববন্দনার আড়ালে শূন্যের কথা বলা হয়েছে।”২৫ আবার শ্লোকাংশে দেখা যায় শূন্য নিরাকার, মানুষের বুদ্ধিতেই কেবল তার অস্তিত্ব, শূন্যের কোনো সংখ্যা যোগ করালে যোগফল বাড়ে না। কারণ শূন্যের কোনো ক্ষয় নেই। অন্যদিকে “হনন মানে গুণ করা। শূন্যের সঙ্গে কিছু গুণ করলেই শূন্যই পাওয়া যায়। আর তারপর আর্যভট্টের সেই বিখ্যাত লাইন— স্থানাৎ স্থানম্‌ দশগুনম্‌ স্যাৎ অর্থাৎ, থান পরিহরি বামে দশগুণ দান। একঘর বামে সরিয়ে খালি ঘরে শূন্য বসালে সংখ্যা দশগুণ হয়ে যায়।”২৬

বিভিন্ন গাণিতিক সূত্রাবলী সমৃদ্ধ ‘পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য’টির দ্বারা ‘পঞ্চানন’-এর প্রস্তর নির্মিত মন্দির স্থাপিত হয় পাঁচমুড়ো গ্রামে। সমাজের সকল শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এই মন্দিরে একত্রিত হয়। তাদের আগমনে ‘নন্দীধন’-এর মন্দির যেন মানুষের মহামিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিন্তু যবন শাসকের আগমনের সময় ভারতীয় হিন্দু জনজাতির ওপর প্রভূত অত্যাচার চালানো হয়। বহু মানুষ সময়ের অস্থিরতায় ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। আর শাসকের রোষানলে ভস্মীভূত হয় বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি থেকে দর্শন প্রায় সমস্ত কিছুই।

পরবর্তী সময়ে শাসক সৈন্যের আক্রমণের পূর্বে মন্দিরের পুরোহিত মন্দিরের সকল পাথর বৌদ্ধ মঠের সেবকদের সাহার্য্যার্থে পার্শ্বস্থ চয়নবিলের গভীরে রেখে আসেন। ফলত তুর্কি শাসক সৈন্য মন্দির ধ্বংস করতে এসে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যায়। বিজাতীয় যবন শাসকের কাছে ‘শয়তানের পুঁথি’ হিসাবে পরিচিত, তাই এই পুঁথির প্রতি প্রবল বিদ্বেষ রয়েছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে বলা যায় গাণিতিক সূত্রের আবিষ্কার; “অঙ্কের দুটো আবিষ্কারের ব্যাপারে আরবরা সারা পৃথিবীর কাছে কৃতিত্ব দাবি করে এসেছে। প্রথমটা হল অ্যালজেবরা আর দ্বিতীয়টা হল অ্যালগদিরম।”২৭ অথচ এই সকল বিষয় প্রায় পাঁচশো বছর পূর্বে ভারতীয় গণিতজ্ঞরা আবিস্কার করেছিলেন। এই সকল বইগুলি থেকে আরবীয় পণ্ডিতরা সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করার জন্য মূল ভারতীয় পুথিগুলি নষ্ট করে দেন। তাই তাঁদের কাছে ভারতীয় গণিতজ্ঞদের আবিষ্কার সম্বলিত ‘পঞ্চাননমঙ্গল’-এর পুঁথি ‘শয়তানের পুঁথি’ রূপে অভিহিত হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত আরবের সুলতানের কাছে কাছে এই পুঁথির খবর পৌঁছে যায়। ফলত শাসকের নির্দেশে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় সেই পুঁথি; “নার্গাজুন, আর্যভট্ট, ধর্মপাল, শীলভদ্র, শান্তরক্ষিত, কমলশীল, ধর্মকীর্তি এদের মহান সব কীর্তি এই সব জ্বলন্ত হিরে সব পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।”২৮

এই ধ্বংসাবশেষের করালগ্রাসে এক প্রগাঢ় অন্ধকারের নিক্ষিপ্ত হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি যুগগত প্রামাণিক কীর্তি। যার ফলে বহু প্রাচীন কাল থেকে প্রবাহিত বাংলা সাহিত্যের ধারা বেশ কিছুটা রুদ্ধ হয়ে আবারো বড়ুচণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-কাব্যের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। সেই রুদ্ধগতির কালগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ইতিহাসের ইতিবৃত্ত আমাদের কাছে কেবল তথ্যের সাপেক্ষে প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক তথ্যের সঙ্গে কাব্যিক সত্যের মেলবন্ধন করে পূরণকারক সত্য নির্মাণ করেছেন; যার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে ‘বন্ধ্যা যুগের’ কালকাহিনি।

 

তথ্যসূত্র;

 

1.    বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত(২য় খণ্ড)’, কলকাতা, মর্ডাণ বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, পৃ ৯৩

2.    বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য্য(সম্পাদিত), ‘ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল’, কলকাতা, মর্ডাণ বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, পৃ ১৫

3.    মুখোপাধ্যায়, জীবন ‘স্বদেশ, সভ্যতা ও বিশ্ব’, কলকাতা, শ্রীধর পাবলির্শাস, পৃ ১৭০

4.    বসু, প্রীতম, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃ ৯৫

5.    ভট্টাচার্য, আশুতোষ, ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, কলকাতা, এ. মুখার্জী অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, সপ্তর্ষি প্রকাশন, পৃ ৯

6.    বসু, প্রীতম, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃ ১৪৮

7.    তদেব, পৃ ১৯৬

8.    চৌধুরী, ভূদেব, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা(১ম পর্যায়), কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, পৃ ৩৪৪

9.    তদেব, পৃ ৩৪৫

10. বসু, প্রীতম, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃ ৫৯

11. তদেব, পৃ ৫৯

12. তদেব, পৃ ৫৯

13. তদেব, পৃ ৫৯

14. তদেব, পৃ ৫৯

15. তদেব, পৃ ৫৯

16. তদেব, পৃ ৬৪

17. তদেব, পৃ ২০২

18. তদেব, পৃ ২০০

19. তদেব, পৃ ২০২

20. তদেব, পৃ ৩৭

21. তদেব, পৃ ৩৮

22. তদেব, পৃ ৫২

23. তদেব, পৃ ৫৩

24. তদেব, পৃ ৫৪

25. তদেব, পৃ ৫৪

26. তদেব, পৃ ৫৫

27. তদেব, পৃ ১৯৭

28. তদেব, পৃ ২০০