‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’; কাল্পনিকতার
অন্তঃছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের প্রতিস্থাপন
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পরিচায়ক
মঙ্গলকাব্য। মূলত দেবদেবীদের বন্দনামূলক বিষয় এই কাব্যের উপজীব্য। কবিকঙ্কণের
‘চণ্ডীমঙ্গল’ থেকে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কিংবা ‘ধর্মমঙ্গল’ সর্বত্রই
দেব-দেবীর আখ্যানের পাশাপাশি সমকালীন সমাজের আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক
দৃষ্টিকোণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্যগুলিতে কাহিনির অন্তরালে শৈল্পিকভাবে কবি
বাঙালি জনজীবনেরও পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। যেমন মানিক দত্তের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে
বন্যায় বিপর্যস্ত ভাড়ু দত্তের দুরবস্থা বর্ণিত হয়েছে;
‘কার বাড়িতে ঝাটিঝুটি কার বাড়িতে তড়।
ভাড়ু দত্তের বাড়ি হৈল নদীয়া সাগর।...
আদাড়ের বাঁশ কাটি উত্থাড় বান্ধিল।
ধীরে ধীরে বন্যা ভাড়ুদত্তের বাড়িতে আইল।
মালসাট দিয়া বাহিরায় ভাড়ুয়া নাবড়।
শিব জপিয়া খট্টা পাড়িল পিড়ার উপর।।”১
আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে
বর্গি আক্রমণের ফলে বিপর্যস্ত বাংলার বিবরণী প্রসঙ্গে কবি বলেছেন;
‘বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।
আইল বিস্তর সৈন্য বিকৃতি আকৃতি।।
লুঠি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।
গঙ্গা পার হৈল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।
লুঠিয়া লইল ধন (ঝিউড়ী বহুড়ী)।”২
অনুরূপভাবে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যগুলিতেও তৎকালীন সময়ের
প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে। যুগে যুগে নানান বিজাতীয় শাসক ভারত তথা বাংলার শাসনভার
নিয়ন্ত্রণ করেছে। পাশাপাশি লুন্ঠিত হয়েছে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের বহু
প্রামাণ্য নির্দশন। ইতিহাসের নিরিখে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরব প্রদেশের গজনি প্রদেশের
তুর্কি সুলতানরা অবিভক্ত ভারতের উত্তর পশ্চিম দিক অর্থাৎ সিন্ধুদেশ জয় করে। মহম্মদ
মাসুদ প্রণীত ‘তারিখ-ই-সিন্ধ্’ গ্রন্থে এই ঘটনার বর্ণনা মেলে। যদিও ঐতিহাসিকরা
ভারতে তুর্কি আধিপত্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রূপে মহম্মদ ঘুরিকেই চিহ্নিত করেন;
“১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ও উচ্ জয়ের মাধ্যমে তিনি ভারতভূমিতে ঘুর আধিপত্যের
ভিত্তি স্থাপন করেন। তারপর
একে একে পেশোয়ার, লাহোর ও পশ্চিম পাঞ্জাব জয় করেন।”৩
পরবর্তীকালে ‘তরাইনের যুদ্ধে’ আহত হয়ে মহম্মদ ঘুরি
প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিজিত স্থানগুলির শাসনভার অর্পণ করেন বিশ্বস্ত অনুচর
কুতুবউদ্দিন আইবকের ওপর। তার সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী
বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ জয় করে সমগ্র পূর্ব ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেন। যা ইতিহাসে
‘তুর্কি বিজয়’ হিসাবে চিহ্নিত। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী ২৪৬ বছর সাহিত্যের
নিরিখে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ’ হিসাবে অভিহিত। এই সময়ের মধ্যে কোনো সাহিত্যিক
নিদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় না। তাই এই যুগটিকে সমালোচকগণ ‘বন্ধ্যা’ যুগ হিসাবেও
নির্দেশায়িত করেছেন। অথচ এই সুবিস্তৃত সময়পর্বে কোনোরকম সাহিত্যকীর্তি রচিত হয়নি
তা স্বীকার করাও বেশ দুর্বিষহ বিষয়। মনে করা হয় হয়তো কোনো লেখনী লিপিবদ্ধ হলেও
কোনো না কোনো কারণ বশত তা জনসমক্ষে সে পৌঁছায়নি।
এইদিক তৎকালীন সময় লেখার কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদির
ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। কাগজে
লেখার প্রচলন আগে ছিল না। তৎকালীন সময়ের পুঁথিপত্র লেখার কাজে তালপাতা কিংবা তেডেল
ব্যবহৃত হত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পোকামাকড়ের আক্রমণ বহুবিধ কারণে সেই পুঁথি
নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকত কারণ; “বাংলা ভাষায় সবচেয়ে পুরানো কাগজের পুঁথিটা
লেখা হয়েছিল চোদ্দশো চার সালে। যদিও কাগজ এদেশে এসে গেছিল এগারো শতকে, কিন্তু
সংস্কৃত পন্ডিতরা কাগজকে ভালো চোখে দেখে নি কেননা কাগজ এনেছিল মুসলমানেরা।
পণ্ডিতরা বলত ম্লেচ্ছদের বস্তুতে হিন্দু ঠাকুর দেবতার নাম লিখব না। তখন তালপাতাকে
পবিত্র মানা হত, তালপাতাকে দুধে কিংবা জলে ফুটিয়ে তাঁর শলাকা দিয়ে লেখা হত। আর
তাছাড়া কাগজ শব্দটা বেদ-উপনিষদে ছিল না, তাই সংস্কৃত সাহিত্য কাগজে লিখতে একটু
দেরি হয়েছে। ১৪০০-১৫০০ সালে বাংলায় মুসলমান শাসন চলছে, হিন্দুদের অনেক পুঁথি
জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন মুসলমান প্রভাবেই মূলতঃ কাগছে লেখা শুরু হল।’’৪
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মতে কবি বা সাহিত্যিকদের
দৃষ্টি সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিন্ন। তাঁরা চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে সাহিত্যকে
পূরণকারক সত্য রূপে প্রদর্শন করে থাকেন। স্ময়-কাল-যুগের সাপেক্ষে ইতিহাসে
তথ্যনির্ভর ঘটনাবলি বিবৃত হয়; সাহিত্য সমাজের দর্পণ হিসাবে কালপঞ্জির সঙ্গে সঙ্গে নানা
অসঙ্গতি ও ফাঁক থেকে যায়। সাহিত্যিক বা কবি তাঁর কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে
সেই শূন্যতাকে পরিপূর্ণ করেন। তাই কাব্যকে পূরণকারক সত্য বলা হয়।
‘অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে’র এহেন তথ্যগত অসঙ্গতির পরিপূরক
হিসাবে বলা প্রীতম বসু প্রণীত ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ উপন্যাসের কথা। আলোচ্য
উপন্যাসে ঔপন্যাসিক তুর্কি বিজয়ের সমকালীন সময়ে রচিত ‘পঞ্চাননমঙ্গল’-এর উদ্ভব ও
কাহিনি বিধৃত করেছেন। বলা যায় ‘বন্ধ্যাযুগের’ সঙ্গে পরবর্তী মঙ্গলকাব্যধারার একটি
যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে এর মাধ্যমে। আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’
গ্রন্থে মঙ্গলকাব্য প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন; “আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী
হইতে আরম্ভ করিয়া অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্যের যে
বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্ম বিষয়ক আখ্যান-কাব্য প্রচলিত ছিল, তাহাই বাংলা সাহিত্যে
মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। বাংলার পল্লীর জনসভায় ইহার উদ্ভব হইলেও শেষ পর্যন্ত
রাজসভায় ইহা প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। কিন্তু ইহা বাংলাদেশের একটি বিশেষ যুগের সাহিত্যসাধনা
হইলেও, ইহার সৃষ্টিপ্রেরণা কোন একটি বিশেষ সাম্প্রদায়িক ধর্মবিশ্বাস হইতে আসে নাই।
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হইয়াও বাংলাদেশের লৌকিক ও বহিরাগত বিভিন্ন
ধর্মমতের যে অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হইয়াছে, মঙ্গলকাব্যগুলি তাহারই পরিচয় বহন
করিতেছে। বিভিন্ন যুগের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আচার-আরচণ, সংস্কার-সংস্কৃতি ও
ধর্মবিশ্বাসের বিস্তৃত ভিত্তির উপরই ইহাদের প্রতিষ্ঠা।”৫
আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনি বিধৃত হয়েছে ‘পঞ্চানন’
অর্থাৎ অনার্য দেবতা শিবের বন্দনাকে কেন্দ্র করে। নন্দীধন নামক এক পূর্ববঙ্গীয়
পুরোহিত যিনি একাধারে দর্শন, বিজ্ঞান এবং গণিতে পারদর্শী ছিলেন, তিনি এই কাব্যের
প্রণেতা। রাজা প্রতাপাদিত্যের সময় তিনি বেত্রবতী তটবর্তী পাঁচমুড়ো অর্থাৎ
‘পঞ্চগ্রামে’ উপনীত হন। শিব-বন্দনার প্রচ্ছন্নতায় বহু গাণিতিক সূত্রাবলি সমৃদ্ধ
কাব্যটি রচনা করেন। তবে তুর্কি বিজয়ের সময় এই কাব্যের পুঁথিটি নষ্ট করা হয়। ধ্বংস
করা হয় ‘পঞ্চানন মন্দিরটিও’। কারণ আরবীয় শাসকের কাছে এই পুঁথি ‘শয়তানের পুঁথি’
রূপে নির্দেশিত ছিল। কল্পকাহিনির প্রচ্ছন্নতায় ঔপন্যাসিক শ্রী বসু সেই কাহিনিটি
তুলে ধরেছেন এই ক্ষেত্রে।
‘মঙ্গলকাব্যের রীতি অনুসারে ভক্ত বিপদে পড়ে ঠাকুরকে
ডাকে, তখন ঠাকুর এসে তাকে উদ্ধার করেন”৬, ; আলোচ্য প্রেক্ষাপটে সেইরূপ
ঘটনাবলীও পরিলক্ষিত হয়। রামেশ্বর ভট্টাচার্য প্রণীত ‘শিবায়ন’ কাব্যে শিবের লোকায়াত
রূপের পরিচয় মেলে। প্রাচীন বাংলার আদি দেবতা রূপে শিব বন্দনার কথা পাওয়া প্রাচীন
পাঁচালিকাব্য থেকে নানারকম ছড়া-গাথায়, এমনকি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম প্রণীত
‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ও ‘পঞ্চানন’-এর পুজার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। সেখানে কবি
বলেছেন;
“এই গীত যেই জন করিবে শ্রবণ
বিপদে রাখিবে দুর্গা আর পঞ্চানন
সমাপত হইল এই ষোল পালা গান
অভয়া চরণে ভণে শ্রীকবিকঙ্কণ।”৭
অর্থাৎ বহু প্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলায় পূজিত হয়
ভগবান শিব। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, “ভারতীয় যে সকল প্রাগ্বৈদিক দেবতা পরবর্তী
হিন্দুসমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যে শিবই
সর্বপ্রধান।”৮ তবে প্রাগবৈদিক যুগের শিবের রূপবর্ণনার কোনো পরিচয় পাওয়া
যায় না, তবে “শিবের মধ্যে এই ব্যাপ্তি সম্ভাবনা এত বহু-বিচিত্র ছিল যে, উচ্চ—নীচ
হিন্দু-অহিন্দু জৈন-বৌদ্ধ-নাথ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই তিনি স্বীকৃতির
শ্রেষ্ঠ আসনটি অনায়াসে অধিকার করতে পেরেছিলেন।”৯
শ্রীহট্টের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নন্দীধন বল্লাগ্রাম
অর্থাৎ ‘পাঁচমুড়ো’ গ্রামে উপনীত হয়ে গড়ে তোলেন ‘পঞ্চমুণ্ডাকৃতি’ শিবের মন্দির।
যদিও এহেন শিবমূর্তির প্রচলন বাংলায় আগে ছিল না, বাংলায় প্রচলিত ছিল সদাশিব
লিঙ্গমূর্তি।। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট অঞ্চলে পঞ্চমুখী শিবের মূর্তির প্রভূত প্রচলন
ছিল। নন্দীধন প্রথম ‘পাঁচফুট’ উচ্চতা বিশিষ্ট পঞ্চমুখী শিবের মূর্তি আনয়ন করেন। এই
বিশেষ মূর্তির প্রতিটি মুখের আবার আলাদা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। পঞ্চমুখী
শিবমূর্তিতে ‘বাবার চারমুখ চারদিকে আর পঞ্চম মুখ আকাশের দিকে তাকিয়ে’১০।
দক্ষিণদিকে থাকা বাবার মূর্তিটি ‘অঘোরা’ রূপ, যার বর্ণ অঞ্জনবর্ণ; “সে রূপ হল
ধ্বংসের রূপ, বাবা শ্মশানের মালিক, শুধু সৃষ্টিকে গিলে খাচ্ছে যাতে অন্য সৃষ্টির
জায়গা হয়’’১১। আবার যে মুখটি শিবের আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত রয়েছে সেই
রূপটির নাম ‘ঈশান’-বর্ণ শুক্ল; “সেইরূপে বাবা সর্বত্র বিরাজমান এবং তিনি
সর্বজ্ঞানী চির শ্বাশত শিব। তিনিই সৃষ্টির কারণ।’’১২ এছাড়া পূর্বদিকে
তাকিয়ে থাকা মূর্তিটি ‘তৎপুরুষ’—বর্ণ বিদ্যুৎ; ‘ধ্যান ও জ্ঞানের প্রতীক’’১৩।
উত্তরদিকে থাকা মূর্তিটি ‘বামদেব’ নামে পরিচিত। এই রূপটির বর্ণ ‘কুঙ্কুমবর্ণ
সদালাবণ্যময়রূপ’; তিনি “মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্য আরোগ্য করেন।’’১৪ সর্বশেষ
এবং পশ্চিমদিকে থাকা বাবার মূর্তিটির নাম ‘কর্পূর’-তিনি ইন্দুবর্ণ ‘রুদ্র’
রুপাকৃতি; “ক্রদ্ধ হয়ে তিনি সংহার করেন আবার প্রসন্ন হয়ে রক্ষা করেন।”১৫
এই পঞ্চমুখী শিবমূর্তিটি পাথরের দ্বারা নির্মিত হলেও মূর্তির ‘পাঁচটিমুখ’ নির্মিত
হয়েছে স্টিবিয়াম অ্যান্টিমণি দ্বারা, ‘রূপার ন্যায় ইহার ঔজ্জ্বল্য অথচ অম্লে
স্বর্ণ বা রূপার ক্ষয় হলেও এর ক্ষয় নেই।’’১৬ সমকালীন সময় বল্লালগ্রামে
কালাজ্বরের প্রার্দুভাব দেখা দেয়। সেই সময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই
শিবলিঙ্গের পূজিত জলের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ রক্ষা হয়। সেই থেকে বল্লাগ্রাম
‘পঞ্চমুণ্ড’ গ্রাম পরবর্তীতে ‘পাঁচমুড়ো’ হিসাবে পরিচিত হয়।
বাংলার অন্যতম শাসক রাজা গণেশের পুত্র যদু মুসলমান
ধর্ম গ্রহণ করে ‘জালালুদ্দিন’ নামে পরিচিত হন। ঊর্ধতন শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ
করার জন্যে মক্কায় বেশ কিছু স্থাপত্য নির্মাণ করেন; “১৪২৭ সালে জালালুদ্দিন মিশরের
কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি পেল এবং নিজেকে আল সুলতান আল আজম মুজ্জামিন খালিফত আল্লাহ
নামে প্রচার করল।’’১৭ জালালুদ্দিনের সময় তুর্কি শাসক খিলজী নালন্দা
বৌদ্ধবিহারের পাশাপাশি বেশকিছু বৌদ্ধিক স্থাপত্য ধ্বংস করেন। পাশাপাশি সেই
প্রতিষ্ঠানগুলিতে রক্ষিত সমস্ত পুঁথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আসলে প্রাচীন ভারতে গণিতের
প্রভূত গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়। আর্যভট্টীয় পুঁথি, ‘ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত’
পুঁথিতে বেশকিছু গাণিতিক সমীকরণের পরিচয় পাওয়া যায়। পশ্চিমি দুনিয়ায়
‘অ্যালগরিদম’-এর প্রণেতা হিসাবে আরবের অল-খোয়ারজমিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। “ইতিহাস ঘাঁটলে
দেখা যায় এই অল-খোয়ারজমি ৮৫০ সালে
অ্যালগদিরম ব্যবহার করেছিলেন লিনিয়ার ইকুয়েশন এবং কোয়াড্রেটিক ইকুয়েশনের অঙ্কের
সমাধান করার জন্য।’’১৮ নন্দীধন বিরচিত ‘পঞ্চাননমঙ্গল কাব্যে’
শিবমন্ত্রের অন্তরালে এই গাণিতিক সূত্রের পরিচয় মেলে; এছাড়া “আলোর গতিবেগ,
আলজেব্রার ফরমুলা, পিঙ্গলা, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর বরাহমিহির এদের সকলের
বিখ্যাত কাজগুলো পঞ্চাননমঙ্গলের শিবের স্তোত্রের ভিতরে গোপনে ঢুকিয়ে দিলেন এবং
যাতে এই পুঁথির লেখা সহজে নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্যে তিনি এগুলোকে পঞ্চমুণ্ড
গ্রামের পঞ্চানন্দ দেবতার মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে খোদাই করে লিপিবদ্ধ করে রাখেন।”১৯
যার মধ্যে সুপ্ত থেকে যায় গাণিতিক সমীকরণাদি। যেমন এই কাব্যে বর্ণিত শ্লোকানুসারে
দেখা যায় আলজেব্রার রূপ; শিব মাহাত্ম্যসূচক এই অংশটি ‘তোটক ছন্দে’ রচিত-
“বোল শিব শঙ্কর সংকট মর্দন জয়।
শিব কৌলেতে পক্ষেতে নেত্রেতে ক্ষয়।।
শিব কৌলেতে ফল ঋতুচক্র হয়।
শিরে নেত্র তথায় যবেঁ পক্ষতে ক্ষয়।
শিরে সংখ্যারি যোগতে এঁ ক্ষয় কভো নয়।।
শিরে পঞ্চাননের দূতী শঙ্করো জয়।’’২০
বীজগাণিতিক সূত্রানুসারে এই শ্লোকের গূঢ়ার্থটি হল-
“শিব ঠাকুর অজানা মানে আননোন কোয়ান্টিটি এক্স। এখন শিবের শিরে নেত্র মানে এক্স এর
মাথায় তিন, মানে এক্স টু দি পাওয়ার থ্রি। আর শিবের শিরে পক্ষ মানে এক্স টু দি
পাওয়ার টু।...কবিতায় বলেছে তখন শিরে সংখ্যা গুণ না হয়ে যোগ হয়ে যায়। তার মানে এক্স
টু দি পাওয়ার সিক্স না হয়ে ফাইভ হয়ে যায়, সেটাই হল শিরে পঞ্চানন।”২১
আবার ‘পিওর জিওম্যাট্রি’র পরিচয় মেলে কাব্যাংশের
অন্তর্গত শ্লোকটিতে-
“পৃথুবি যে কালী মাএর খঙ্গ দেখী ত্রস্ত।
শিবের বুকে কালীর চরণ জীহা একহ হস্ত।।
কালীর সিঁদুর, শিবের চরণ, শিবের ভালের নেত্র।
এহি তীনত ঘিরে আছে আমার সগর্গ ক্ষেত্র।।
মুণ্ডমালা কালীমাতে রক্তে রাঙা খড়্গ।
কালী-শিবের গুনে ধরায় দুঅজ ভৈল সগর্গ।’’২২
আপাতভাবে দেখলে মনে হয় এখানে কালিকামূর্তির সঙ্গে
সন্নিবিষ্ট শিবমূর্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই কাহিনির মোড়কে ত্রিভুজের
ক্ষেত্রফল নির্ধারক সূত্রটি জ্ঞাপিত হয়েছে। গাণিতিক ব্যাখ্যানুসারে-“ মা কালীর
সিঁথির সিঁদুর, শিবের চরণ, আর শিবের কপালের চোখ –এই তিনটে বিন্দুকে কাল্পনিক রেখা
দিয়ে যোগ করলে একটা ত্রিভুজ পাওয়া যায়। সেই ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলকে কবি
স্বর্গক্ষেত্র বলেছেন। আমরা জানি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল হল হাফ ভূমি ইনটু উচ্চতা।
শিব ভূমিতে শুয়ে আর মা কালী তার বুকে দাঁড়িয়ে। অর্ধেক শিবের লম্বাকে যদি মা কালীর
উচ্চতা দিয়ে গুণ করা করি তবে পাওয়া যায় ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল। তার মানে শিবের
লম্বাকে মা কালীর উচ্চতা দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যায় ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল-এর দ্বিগুণ
অর্থাৎ স্বর্গ ক্ষেত্রের দ্বিগুণ লাভ হয়।’’২৩
ভারতীয় গণিতজ্ঞ তথা জ্যোর্তিবিদ্ আর্যভট্ট খ্রিস্টীয়
শূন্যের ধারণা প্রণয়ন করেন। সেই সঙ্গে তিনি দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবনও করেছিলেন। তাঁর
সমসাময়িক ব্রহ্মগুপ্ত প্রথম শূন্যের যোগ-বিয়োগের সূত্র আবিষ্কার করেন; সেই পদ্ধতির পরিচয় মেলে ‘পঞ্চাননমঙ্গল কাব্যে’-
“নাহি তবেঁহো আছহ আহ্মে সহ্মে জানি।
দেব তুহ্মি নিরাকার আন্তরে মানি।।
অব্যয় অক্ষয় দেব সদা শিব মুক্ত।
মায়া মোহ সংসারত হৈবেঁ নাহি যুক্ত।।
জড়ের হনন করী দিলেঁ নিজ থান।
থান পরিহরি বামে দশগুণ দান।”২৪
সাধারণভাবে দেখলে মনে হয় এই শ্লোকটিতে অব্যয়, অক্ষয়
নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। যিনি সংসারের মায়ার বাইরে অবস্থান করেন এবং
মানবজীবনের পরিসমাপ্তিতে তার চরণে জীবের স্থান প্রাপ্তি হয়। অথচ সেই দর্শনের আড়ালে
দশমিক বা আধুনিক ডেসিমলের সূত্র বিবৃত হয়েছে। “৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্ট
লিখেছিলেন “স্থানাৎ স্থানম্ দশগুনম্ স্যাৎ’’ অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে
গেলে আগের থেকে দশগুণ হয়। এই শিববন্দনার আড়ালে শূন্যের কথা বলা হয়েছে।”২৫ আবার
শ্লোকাংশে দেখা যায় শূন্য নিরাকার, মানুষের বুদ্ধিতেই কেবল তার অস্তিত্ব, শূন্যের
কোনো সংখ্যা যোগ করালে যোগফল বাড়ে না। কারণ শূন্যের কোনো ক্ষয় নেই। অন্যদিকে “হনন
মানে গুণ করা। শূন্যের সঙ্গে কিছু গুণ করলেই শূন্যই পাওয়া যায়। আর তারপর
আর্যভট্টের সেই বিখ্যাত লাইন— স্থানাৎ স্থানম্ দশগুনম্ স্যাৎ অর্থাৎ, থান পরিহরি
বামে দশগুণ দান। একঘর বামে সরিয়ে খালি ঘরে শূন্য বসালে সংখ্যা দশগুণ হয়ে যায়।”২৬
বিভিন্ন গাণিতিক সূত্রাবলী সমৃদ্ধ ‘পঞ্চাননমঙ্গল
কাব্য’টির দ্বারা ‘পঞ্চানন’-এর প্রস্তর নির্মিত মন্দির স্থাপিত হয় পাঁচমুড়ো
গ্রামে। সমাজের সকল শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এই মন্দিরে একত্রিত হয়।
তাদের আগমনে ‘নন্দীধন’-এর মন্দির যেন মানুষের মহামিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিন্তু
যবন শাসকের আগমনের সময় ভারতীয় হিন্দু জনজাতির ওপর প্রভূত অত্যাচার চালানো হয়। বহু
মানুষ সময়ের অস্থিরতায় ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। আর শাসকের রোষানলে ভস্মীভূত হয় বাঙালির
নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি থেকে দর্শন প্রায় সমস্ত কিছুই।
পরবর্তী সময়ে শাসক সৈন্যের আক্রমণের পূর্বে মন্দিরের
পুরোহিত মন্দিরের সকল পাথর বৌদ্ধ মঠের সেবকদের সাহার্য্যার্থে পার্শ্বস্থ চয়নবিলের
গভীরে রেখে আসেন। ফলত তুর্কি শাসক সৈন্য মন্দির ধ্বংস করতে এসে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে
যায়। বিজাতীয় যবন শাসকের কাছে ‘শয়তানের পুঁথি’ হিসাবে পরিচিত, তাই এই পুঁথির প্রতি
প্রবল বিদ্বেষ রয়েছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে বলা যায় গাণিতিক সূত্রের
আবিষ্কার; “অঙ্কের দুটো আবিষ্কারের ব্যাপারে আরবরা সারা পৃথিবীর কাছে কৃতিত্ব দাবি
করে এসেছে। প্রথমটা হল অ্যালজেবরা আর দ্বিতীয়টা হল অ্যালগদিরম।”২৭ অথচ এই
সকল বিষয় প্রায় পাঁচশো বছর পূর্বে ভারতীয় গণিতজ্ঞরা আবিস্কার করেছিলেন। এই সকল
বইগুলি থেকে আরবীয় পণ্ডিতরা সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন।
পরবর্তীতে তাঁরা নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করার জন্য মূল ভারতীয় পুথিগুলি নষ্ট করে
দেন। তাই তাঁদের কাছে ভারতীয় গণিতজ্ঞদের আবিষ্কার সম্বলিত ‘পঞ্চাননমঙ্গল’-এর পুঁথি
‘শয়তানের পুঁথি’ রূপে অভিহিত হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত আরবের সুলতানের কাছে কাছে এই
পুঁথির খবর পৌঁছে যায়। ফলত শাসকের নির্দেশে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় সেই পুঁথি;
“নার্গাজুন, আর্যভট্ট, ধর্মপাল, শীলভদ্র, শান্তরক্ষিত, কমলশীল, ধর্মকীর্তি এদের
মহান সব কীর্তি এই সব জ্বলন্ত হিরে সব পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।”২৮
এই ধ্বংসাবশেষের করালগ্রাসে এক প্রগাঢ় অন্ধকারের
নিক্ষিপ্ত হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি যুগগত প্রামাণিক কীর্তি। যার ফলে বহু
প্রাচীন কাল থেকে প্রবাহিত বাংলা সাহিত্যের ধারা বেশ কিছুটা রুদ্ধ হয়ে আবারো
বড়ুচণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-কাব্যের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। সেই রুদ্ধগতির
কালগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ইতিহাসের ইতিবৃত্ত আমাদের কাছে কেবল তথ্যের সাপেক্ষে
প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক তথ্যের সঙ্গে কাব্যিক সত্যের
মেলবন্ধন করে পূরণকারক সত্য নির্মাণ করেছেন; যার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে
‘বন্ধ্যা যুগের’ কালকাহিনি।
তথ্যসূত্র;
1. বন্দ্যোপাধ্যায়,
অসিতকুমার, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত(২য় খণ্ড)’, কলকাতা, মর্ডাণ বুক এজেন্সি
প্রাঃ লিঃ, পৃ ৯৩
2. বন্দ্যোপাধ্যায়,
ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য্য(সম্পাদিত), ‘ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল’, কলকাতা,
মর্ডাণ বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, পৃ ১৫
3. মুখোপাধ্যায়,
জীবন ‘স্বদেশ, সভ্যতা ও বিশ্ব’, কলকাতা, শ্রীধর পাবলির্শাস, পৃ ১৭০
4. বসু,
প্রীতম, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃ ৯৫
5. ভট্টাচার্য,
আশুতোষ, ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, কলকাতা, এ. মুখার্জী অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ,
সপ্তর্ষি প্রকাশন, পৃ ৯
6. বসু,
প্রীতম, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃ ১৪৮
7. তদেব,
পৃ ১৯৬
8. চৌধুরী,
ভূদেব, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা(১ম পর্যায়), কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, পৃ ৩৪৪
9. তদেব,
পৃ ৩৪৫
10. বসু,
প্রীতম, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃ ৫৯
11. তদেব,
পৃ ৫৯
12. তদেব,
পৃ ৫৯
13. তদেব,
পৃ ৫৯
14. তদেব,
পৃ ৫৯
15. তদেব,
পৃ ৫৯
16. তদেব,
পৃ ৬৪
17. তদেব,
পৃ ২০২
18. তদেব,
পৃ ২০০
19. তদেব,
পৃ ২০২
20. তদেব,
পৃ ৩৭
21. তদেব,
পৃ ৩৮
22. তদেব,
পৃ ৫২
23. তদেব,
পৃ ৫৩
24. তদেব,
পৃ ৫৪
25. তদেব,
পৃ ৫৪
26. তদেব,
পৃ ৫৫
27. তদেব,
পৃ ১৯৭
28. তদেব,
পৃ ২০০