কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

পায়েল চ্যাটার্জি

 

সমকালীন ছোটগল্প


শপিং কার্ট


এই মাসেই ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবে সায়ন। নতুন টিউশনটা কাল থেকে শুরু হয়েছে। বেশ বিত্তবান বাড়ি। মাইনে বারোশো টাকা। পরের মাসে শুরুতে হাতে কিছু এক্সট্রা টাকা আসবে ভেবেই মধ্যবিত্ত মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ওই মাসের টাকাটা দিয়ে নিশ্চয়ই বইগুলো কিনতে পারবে। মেলুহা সিরিজের তিনটে ভাগ। সিরিজটার দাম সাড়ে সাতশ টাকা। সেদিন ইউনিভার্সিটির ক্লাসের পর শুভঙ্করদের বাড়ি গিয়েছিল সায়ন কিছু নোটস নিয়ে আসতে। ওদের বাড়ির ওয়াল শেল্ফে দেখেছিল বইগুলো। বই সায়নের কাছে নেশার মত। সাদা কালো অক্ষরগুলো চুম্বকের মতো টানে ওকে। একবার ওতে ডুব দিতে পারলে অন্য জগতে পৌঁছে যায় ও। যেখানে ওর মন অবুঝ হতে পারে। ডানা মেলতে পারে। প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের মধ্যে এক ঝলক টাটকা বাতাস। শুধু পকেটের দিকে তাকালে মনে হয়  সবই মায়া। মেলুহা সিরিজটা পড়ার ইচ্ছে ওর অনেক দিনের। সেদিন শুভঙ্করদের বাড়িতে বইগুলো দেখে যেন ইচ্ছের কোটরের তালাটা খসে পড়ল। শুভঙ্করের কাছ  থেকে বইগুলো চাওয়ার কথা ভেবেছিল। ওর কুণ্ঠিত মন সায় দিলো না। ঝকঝকে ইন্টেরিয়ার ডেকরেশন করা দেওয়ালের তাক থেকে বইগুলো চাওয়ার আগেই মনের ভিতরের অস্বস্তিটা ওর মুখ বন্ধ করিয়েই রাখল। আসলে এভাবে বই পড়ায় আনন্দ নেই। এদিকে প্রযুক্তি আর আধুনিকীকরণের মেলবন্ধনে লাইব্রেরীর খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। মায়ের প্রেসার বাবার সুগার আর নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে মাসের  শেষে পকেট বলতে গড়ের মাঠ। মাঝে মাঝে আবার হিয়ার লিপস্টিক, কাজলের বায়নাও সায়নের ইচ্ছেগুলোকে ভেংচি কাটে। ‘সবাই তো মোবাইলেই বই পড়ে  দেখেছি, ওতে বোধহয় টাকা পয়সাও লাগে না’। বাবার হিসেবি উপদেশ। ‘বই কিনলে রাখবি কোথায়!’ মাও হিসেব কষে। সায়ন ওদের বোঝাতে পারে না, বই পড়ার ইচ্ছে ঘরে রাখার জায়গার সঙ্গে সমানুপাতিক হয় না। প্রযুক্তি তার নিয়ম মত আধুনিকতার উচ্চতায় পৌঁছলেও সাদা পাতায় কালো অক্ষরের গন্ধে, পাতা উল্টানোর শব্দে যতটা নস্টালজিয়া থাকে, মন তাতে যতটা তৃপ্ত হয় তার কোন হিসেব হয় না।

মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অনলাইন বুক স্টোরে গিয়ে খুঁজে নানান বই পছন্দ করে শপিং কার্টে সযত্নে জমা করে সায়ন। স্বপ্ন জমানোর মত। মাঝেমাঝেই সেই কার্ট ঘুরে দেখে আসে। ‌ ইচ্ছেগুলো আউট অফ স্টক হয়ে যায়নি তো! মাসের শেষে সায়নের আর্থিক অবস্থা দেখে বইগুলো বোধহয় নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে। বাবার চা জলখাবারের দোকানের পাশে একটা ছোট্ট বইয়ের দোকান আছে। ‘বইঘর’। শ্যামলকাকু ধার-বাকিতে দেয় মাঝে মাঝে। কিন্তু সব বই দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। হিয়াকে কলেজ থেকে নিয়ে ফেরার পথে কখনো কখনো পুরনো বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে আসে। তবে জীবন সব সময় ওকে অপশন বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় না। কখনো শুধুই চয়েস। হিয়ার পছন্দ। আইসক্রিম। এডজাস্টমেন্ট, প্রেম। সায়ন দেখতে পায়।  আইসক্রিম গলে গলে পড়ছে। বইয়ের পাতা ঝরে পড়ছে।

আজই নতুন টিউশনের টাকাটা হাতে এসেছে। দিদি এসেছে। সন্তানসম্ভবা। খরচ  বেড়েছে। হিয়া ফোন করেছিল। চিকেন কাবাব খাবে। মেলুহা সিরিজের একেকটা বই যদি একেক মাসে কেনা যায়! দিদির মেসেজ। ‘হেলথ ড্রিংক আনিস উইথ ডিএইচএ’, ডক্টর বলেছে। আরেকবার শপিং কার্টটা ঘুরে আসে সায়ন। কোন  ডিসকাউন্ট টিসকাউন্ট যদি! নাহ্! লক্ষ্য রাখতে হবে। অপেক্ষা। তবে আউট অফ স্টক না হয়ে যায় স্বপ্নলোকে!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন