কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

শিবাংশু দে

 

অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন হে সুন্দর -৩




 

তুমি সুন্দর তাই

অল্প চড়াই। দুধারে বিশাল বর্তুল মসৃণ পাথরের সাজানো সরণী। মাঝেমধ্যে কিছু প্রত্ন অবশেষ। কোথাও সবুজ, কোথাও একটু জল। গাড়ি এসে দাঁড়ায় একটি সমতল বাঁধানো গাড়ি আড্ডায়। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। সামনের দিকে চাইতেই একটি প্রায় আকাশ ছোঁয়া গোপুরম চোখে পড়লো, যার শিখর অংশটি প্রায় ধ্বস্ত। তবু রাজকীয় তার গরিমা। এগিয়ে যাই, পূর্ব গোপুরটির দিকে। এটাই প্রধান প্রবেশপথ। নীচের অংশটি চিরাচরিত দক্ষিণী পাথরের ভাস্কর্য, কিন্তু শিখরের অংশটি পোড়া ইঁটের গাঁথনি দিয়ে নির্মিত হয়েছিলো। সম্ভবত কম সময়ে কাজ সাঙ্গ করার তাড়ায়। সেই অনুপম ভাস্কর্যগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তালিকোটার যুদ্ধে পরাজয়ের পর। তার চিহ্ন সারা শিখর জুড়ে। গোপুর পেরিয়ে ভিতরের চত্বরে পা দিলেই যেটা চোখে পড়ে, সমগ্র নির্মাণটির জ্যামিতিক ছন্দ। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা নানা মন্দির, মণ্ডপ, কারুকাজ একসঙ্গে আকর্ষণ করতে থাকে চুম্বকের মতো। মূল নির্মাণগুলি, মহামণ্ডপ, কল্যাণমণ্ডপ ও গরুড়রথ।

দুভাবে বিট্ঠল মন্দিরের শিল্প স্থাপত্যের বর্ণনা দেওয়া যায়। কথামৃতের গল্পের দুই বন্ধুর মতো। যারা আমবাগানে গিয়েছিলো। একজন আমগাছ গুনে গেলো, অন্যজন তার স্বাদ নিলো। প্রথমজন পণ্ডিত, দ্বিতীয়জন রসিক। ব্যক্তিগতভাবে আমার দ্বিতীয়জন হবার ইচ্ছেটা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু দেখি বন্ধুরা আমাকে প্রথমজনের ভূমিকায় দেখতেই পছন্দ করেন। তবে সুন্দরের কথা বলতেই আমি সতত ব্যগ্র। বিজয়বিট্ঠল এক পরম সুন্দরের নাম।

বিট্ঠল মন্দিরের বিশাল পরিসরে ঢুকলেই যে ব্যাপারটা চোখে পড়বে তার নিপুণ জ্যামিতিক বিন্যাস। সমগ্র মানচিত্রটি নিখুঁত, সন্তুলিত স্থাপত্যের একটি উদাহরণ। সামনেই দেখা যায় পাথরের রথটি। সম্ভবত হাম্পির সব চেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য চিহ্ন। আয়তাকার পাথরের ভিত্তির উপর তৈরি রথটির ভিতর এক সময় গরুড়ের মূর্তি ছিলো। রথের সামনে দুটি ছুটন্ত ঘোড়ার ভাস্কর্য এখন নষ্ট  হয়ে গেছে। এখন অন্য জায়গা থেকে নিয়ে আসা দুটি পাথরের গজমূর্তি রাখা আছে। হাতিমূর্তি দুটির মাঝখানে একটি ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি রয়েছে। এককালে মন্দিরে ওঠার জন্য সেটি ব্যবহার করা হতো।

এই রথটির মতো এতো নিখুঁত ভাস্কর্য আমাদের মতো শিল্পসমৃদ্ধ দেশেও খুব কমই দেখা যায়। চাকা ও নেমির (Axle) গড়ন অবিশ্বাস্য। যেন একটু ঠেলে দিলেই গড়িয়ে যাবে। পাথরের চাকাগুলি নেমি কেন্দ্র করে ঘোরানো যায়। রথটি বস্তুত একটি গরুড় মন্দির। আমাদের দেশে এর দুটি পূর্বসূরি আমার চোখে পড়েছে। আদিতমটি রয়েছে তামিলনাড়ুতে  মামাল্লাপুরমে পঞ্চরথ সমাহার। পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছিলো কোণার্কের বিপুল সূর্যমন্দিরের রথ। এই রথাকৃতি গরুড়মন্দির বা রথটির আয়তন বিশাল নয়। কিন্তু সৌন্দর্যে লাজওয়াব। গড়নটি চিরাচরিত দ্রাবিড় স্থাপত্য অনুসারী। দেড়শো বছর আগের ছবিতে এর শীর্ষে বিমানের অবশেষ দেখা যায়। পুনর্নিমাণের সময় তা ভেঙে ফেলা হয়েছিলো। দুদিকে দুটি করে রথটির চারটি চাকা রয়েছে। তার সারা গায়ে নয়নাভিরাম বাস রিলিফের মাধ্যমে নানারকম দেবতার প্রতিচ্ছবি আঁকা আছে।

একটা ধারণা আছে, এই নির্মাণটি মনোলিথিক বা একটি পাথর কেটে বানানো হয়েছিলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্থাপত্যটি বহু গ্র্যানাইট পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি। পাথরগুলি এমন কৌশলের সঙ্গে জোড়া হয়েছিলো যে পরস্পরের মধ্যে কোনও ব্যবধান দেখা যায় না। ভিত্তিমঞ্চটিতে যুদ্ধযাত্রার ছবি আঁকা আছে। এককালে গোটা নির্মাণটি প্রাকৃতিক রং দিয়ে রাঙানো ছিলো।

গরুড়রথের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মূল মন্দিরটি। নাম মহামণ্ডপ বা  সভামন্ডপ। একটি বর্গাকার, সমকেন্দ্রিক সম্মিলন স্থল। এই মণ্ডপটির চারটি অংশ আছে। এই নির্মাণটির বিস্ময়কর পর্যায় হলো ছাপ্পান্নটি অপূর্ব স্তম্ভ। এদের ব্যাস, আকার, দৈর্ঘ্য আর তল ভিন্ন ভিন্ন। এগুলিকে সঙ্গীত স্তম্ভ বা মিউজিক্যাল পিলারস বলা হয়। ভিন্ন ভিন্ন স্তম্ভে আঘাত করলে সপ্ত স্বরের পর্দা শোনা যায়। লোকে বলে সভামণ্ডপে নৃত্যগীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হতো।

মহামণ্ডপের ভিত্তিটি পাঁচ ফুট উঁচু। সেটি সজ্জিত আছে নানা কারুকাজে। যোদ্ধা, অশ্ব ও হস্তী বাহিনী, হংসদল এবং পুষ্পলতার মোটিফ। মহামণ্ডপের এলাকার মধ্যে চারটি ছোটো মণ্ডপ আছে। মন্দিরটির ছাদ মোট চল্লিশটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি স্তম্ভ দশফুট দীর্ঘ। মহামণ্ডপের কেন্দ্রীয় অংশটি আয়তাকার এবং ষোলোটি স্তম্ভ পরিবৃত। এই স্তম্ভগুলি অনুপম কারুকার্যময়। মন্দিরের ভিতরদিকের ছাদের কারুকাজও নয়ন মনোহর। পূর্ব মণ্ডপটিকে সঙ্গীতমণ্ডপ বলা হয়। এখানের স্তম্ভগুলিতে গায়ক, বাদক, নর্তকীদের মূর্তি দেখা যায়। দক্ষিণ মণ্ডপটির স্তম্ভগুলি  মূলত ইয়ালি বা বিয়াল মূর্তিশোভিত। উত্তর প্রান্তের মণ্ডপটিতে নৃসিংহ মূর্তির প্রাচুর্য। প্রার্থনারত প্রহ্লাদ ও হিরণ্যকশিপুর আকৃতিসহ। সব অলংকরণের সঙ্গেই নানা ধরনের কমল ও অন্য পুষ্পলতার বিন্যাস অনর্গল চোখে পড়ে। পশ্চিম দিকের মণ্ডপে কিছুটা এগিয়ে গেলে মন্দিরের গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহে কোনও বিগ্রহ নেই। ছোটো  প্রদক্ষিণ পথ দিয়ে ঘেরা। বাইরের দেওয়ালে ‘কুম্ভ-পঙ্কজ’ অর্থাৎ, ফুলদানিতে  সাজানো পদ্ম এবং নান্দী ও হস্তীর বাস রিলিফ দেখা যায়। কেন্দ্রীয় অংশটি দেখলে বিজয়নগর রাজ্যের সমৃদ্ধি  কিছুটা বোঝা যায়। মণ্ডপের চারদিকে প্রদক্ষিণ পথ। পূর্বদিক ধরে এগোলে পরপর কল্যাণমণ্ডপ, দেবীমন্দির, উৎসবমণ্ডপ দেখা যাবে। সীমার প্রাকার ধরে আবৃত বারান্দা রয়েছে। সমগ্র মন্দির চত্বরটির মাপ প্রায় সাড়ে তিন একর। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে টানা পাকশালার নির্মাণ চোখে পড়বে।

সুন্দরকে ভাগ না করে নিলে, শুধু সুন্দরের নয়, নিজেরও অপমান। সেখানে যাই। বারবার যেতে ইচ্ছে করে। ফুরোয় না কখনও।

রক্তের নদীর মতো ভেসে গেলে, তারপর, তবু, এক অমূল্য মুগ্ধতা’

তালিকোট থেকে হাম্পি প্রায় একশো আশি কিমি দক্ষিণে। সুলতানি ফৌজের প্রথম দলটি হাম্পি পৌঁছে গিয়েছিলো তিন দিনের মধ্যে। বাকিদের পৌঁছোতে আরও দিন কুড়ি লেগে গিয়েছিলো। সেকালে ভারতবর্ষের সব চেয়ে সমৃদ্ধ নগরসভ্যতা, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী, হাম্পির লুণ্ঠন ও ধ্বংস পর্ব শুরু হয়েছিলো ১৫৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ঐতিহাসিক ফেরিসতা ও শিরাজের লেখা ইতিবৃত্তে সেই ভয়ানক ধ্বংসলীলার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।

তালিকোটের যুদ্ধকে স্রেফ ‘হিন্দু-মুসলিমে’র লড়াই বলাটা অতি সরলীকরণ হয়ে  যাবে। বিজয়নগর ও দক্কনের সুলতানদের মধ্যে বিরোধের প্রধান কারণটি হয়তো ধর্মগতই ছিলো। কিন্তু যাঁরা এই যুদ্ধের অংশ ছিলেন, তাঁদের ভিতর ফারাকটি শুধু ধর্মীয় পরিচয়সর্বস্ব ছিলো না।  যেমন ইব্রাহিম আদিল শাহ শুধু যে আলিয়া রামারাওয়ের ‘ঘোষিত’ পুত্র ছিলেন, তাই নয়। আদিল শাহ হিন্দু কলাসংস্কৃতির  একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। তাঁর দরবারে স্থানীয় দক্কনি ও মরাঠা হিন্দুদের প্রাধান্য ছিলো। তিনি মরাঠি ভাষায় রাজকাজ সম্পন্ন করতেন। অন্যদিকে রামা রাওয়ের প্রধান শত্রু নিজাম শাহের ফৌজের একটা বড়ো অংশ ধর্মে হিন্দুই ছিলো।

রফিউদ্দিন শিরাজি জানিয়েছেন রামা রাওয়ের দরবারে বহু মুসলিম অমাত্যরা ছিলেন। এঁরা সবাই সুলতানি রাজত্ব ত্যাগ করে বিজয়নগরে অবস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরা যে শুধু উচ্চপদের অধিকারী ছিলেন তাই নয়, রাজার থেকে বিশেষ সম্মানও পেতেন। রামা রাও সিংহাসনের মাথায় পবিত্র কোরান গ্রন্থ রাখতেন। যাতে মুসলিম পাত্র-অমাত্যরা তাঁকে অভিবাদন করার সঙ্গে সঙ্গে কোরানের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। একবার রামা রাওয়ের ভাই থিম্মা রাও রাজাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর রাজ্যে পশুবধ নিষিদ্ধ করার জন্য। রামা রাও তার উত্তরে বলেছিলেন, মুসলিম প্রজারা আমাকে সেবা করার জন্য এখানে এসেছেন। তাঁদের ধর্মত্যাগ করার জন্য নয়। আলিয়া রামা রাও সম্বন্ধে এক শ্রেণীর বহিরাগত লোকজনের প্রচারিত কুৎসাগুলির ভিত্তি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি কখনও।

এটা ঠিক যে রামা রাও বহিরাগত মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করে গেছেন। রাজা হিসেবে তিনি যে খুব একজন নিরীহ ব্যক্তি ছিলেন, তাও নয়। সুলতানি শাসকরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নানা অংশ আক্রমণ করতেন। লুঠতরাজ, গণহত্যা, প্রজাদের ক্রীতদাস করে ধরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সুলতানি শাসকদের প্রচলিত প্রথা ছিলো। তুর্কি ঐতিহাসিকদের মতে তা ছিলো জিহাদের অংশ। রামা রাও এসব ব্যাপার খুব কঠোরভাবে মোকাবিলা করতেন। তাঁর

কাজটি খুবই কঠিন ছিলো।

গোলকোণ্ডা দরবারের ঐতিহাসিক ফেরিশতা, আদিল শাহী দরবারের রফিউদ্দিন শিরাজি ছাড়াও আরও একজনের কলমে হাম্পির ধ্বংসলীলার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন পর্তুগিজ ঐতিহাসিক দিয়োগো ডি কুটো। রামা রাওয়ের ভাই থিম্মা রাও বা থিরুমালা রাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। তিনি বিজয়নগরের ‘যুবরাজ’, ভাইপো সদাশিব রাও ও রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের  সঙ্গে নিয়ে সাড়ে পাঁচশো হাতির পিঠে প্রচুর সোনা, রত্মসামগ্রী, রাজদণ্ড ও রাজসিংহাসনসহ পেনুকোণ্ডা  দুর্গে আশ্রয় নেন। এই আপাতভাবে বিপুল ধনসম্পত্তি হাম্পি কোষাগারের একটা অতি ছোটো অংশ। হাম্পির অসংখ্য প্রাসাদ, গোপন ভূগর্ভ ধনশালা ও টাঁকশালে কী পরিমাণ সোনা ও রত্নসামগ্রী রাখা ছিলো তার আংশিক খোঁজই পেয়েছিলো সুলতানি ফৌজরা।

তালিকোটার যুদ্ধে রামা রাওয়ের মৃত্যুর দুদিনের মধ্যেই হাম্পিতে বিভিন্ন দস্যুদল লুঠতরাজ শুরু করে দিয়েছিলো। ঐতিহাসিক কুটো লিখেছিলেন, দুদিনের মধ্যেই  তারা সমস্ত স্থানীয় দোকানপাট লুটে নিয়ে আবার পাহাড়ে পালিয়ে যায়। তারা ছিলো বনজারা, লম্বানি আর কুরুবা জাতির লোক। সুলতানি ফৌজ আসার আগেই নাগরিকরা সমস্ত ধনসম্পত্তি মন্দির, পাহাড়ের গুহা, প্রাসাদের গোপন ভূগর্ভ আর নদীর গভীরে লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। সুলতানের সৈন্যরা সেই সব সামগ্রী আবার  খুঁড়ে বার করে। অর্থ আর ধনরত্ন এতো পাওয়া গিয়েছিলো যে সুলতানদের সাধারণ সৈন্য, এমন কি ক্রীতদাসরাও প্রভুদের আদেশ মান্য করছিলেন না। তাঁরা সর্বত্র ধনরত্নের জন্য খুনজখম, খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সুলতানি ফৌজ হাম্পির সমস্ত মন্দির ও প্রাসাদ ভেঙেচুরে ধনরত্নের খোঁজ করে যাচ্ছিলেন। বিট্ঠল মন্দিরের উপর তার বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছিলো। কিন্তু শুধু খোঁড়াখুঁড়ি বা ভাঙাচোরা করেই তাঁরা ক্ষান্ত হন না। বিট্ঠল মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ধর্মীয় উন্মাদনা একটা কারণ ছিলো অবশ্যই। কিন্তু তাছাড়া একটা কিংবদন্তিও প্রচলিত আছে।

শিরাজির লেখায় এ বিষয়ে একটা গল্প আছে। শোনা যায়, বুরহান নিজাম শাহ বেরিয়েছিলেন হাম্পি শহর পরিভ্রমণ করতে। তিনি এক জায়গায় দেখেন বিজাপুর ফৌজের কিছু গরিব সিপাহি নিজেদের মধ্যে প্রচুর লুটে আনা অর্থ আর মণিমুক্তো ভাগাভাগি করছেন। তাই দেখে নিজাম শাহী ফৌজের অন্য সিপাহিরাও সেখানে নিজেদের দাবি জানিয়ে কলহে মত্ত। এই অবস্থা দেখে নিজাম শাহ তাঁর অমাত্যদের বললেন যদি এমন চলতে থাকে, তবে এই সিপাহিদের ঝগড়া একদিন সুলতানদের স্তর পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সুলতানি ফৌজের একতা নষ্ট হয়ে যাবে। শত্রুপক্ষ আবার ফিরে আসবে। সেইখানে দাঁড়িয়েই নিজাম শাহ আদেশ করলেন সমস্ত বাড়িঘর, প্রাসাদ, মন্দির, বাজার ইত্যাদি  শুকনো ঘাস, কাঠ আর তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হোক। যাতে ধনসম্পত্তি নিয়ে কলহ আর না বাড়ে। আগুনে হলো আগুনময়। বিজয়  বিট্ঠলের সব গোপুরম আর মন্দিরের গায়ে তার দাগ এখনও লেগে আছে।

অন্য ঐতিহাসিকরা অবশ্য বলেন বুরহান নিজাম শাহ বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতেন। তিনি চেয়েছিলেন এই রাজত্ব আর যেন মাটির উপর না থাকে। এমনিতে সেকালে নিয়ম ছিলো সিপাহিদের লুট করা ধনরত্নের ১/১০ থেকে ১/৪ ভাগ অংশ সরকারি তিজারতে জমা করতে হতো। কিন্তু হাম্পি লুটের পর এতো অগাধ, বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন পাওয়া গিয়েছিলো যে সুলতানরা সিপাহিদের থেকে আর ভাগ চাননি। শুধু লুট করা হাতিগুলি সুলতানকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিলো।  বিজয়নগরের চারদিকে বহু পাহাড়-পর্বত আর গিরিগুহা আছে। বহু স্থানীয় ধনী ব্যক্তিরা সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। সুলতানি সিপাহিরা সেখান থেকেও তাঁদের হত্যা করে ধনরত্ন লুট করেছিলেন। নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিলো। সেই চিরন্তন গল্প, ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি...

চার লাখ পঁচাত্তর হাজার

পুরন্দরদাসের জন্ম হয়েছিলো ১৪৮৫ সাল নাগাদ। সন্ত কবিরের সম সাময়িক। সারা ভারত জুড়ে মানুষের উপলব্ধিতে যে ভক্তিবাদী মন্থন গড়ে উঠেছিলো সেকালে, তিনি ছিলেন কর্ণাটকে তার প্রতিভূ। ছিলেন কবি, সঙ্গীতসাধক। আশ্রয় করেছিলেন আর্যেতর সংস্কৃতির দেবতা বিঠোবা বা বিট্ঠলদেবকে। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির একজন প্রধান পুরুষ, রাজা কৃষ্ণদেবরায়কে প্রেরিত করেছিলেন বিঠোবা দেবতার শরণ নিতে। রাজা ও সাধকের যুগল সম্মিলনে গড়ে উঠেছিলো হাম্পির বিজয়বিট্ঠল মন্দির। আমাদের গর্বিত একটি উত্তরাধিকার।

বলা হয় পুরন্দরদাস কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় চার লাখ পঁচাত্তর হাজার প্রার্থনা সঙ্গীত লিখেছিলেন।  জীবনের প্রথম চার দশক কাটিয়ে ছিলেন একজন অতি সম্পন্ন, অর্থগৃধ্নু কুসীদজীবীর পেশায়। বোধোদয় হবার পর চল্লিশ বছর বয়সে পুরন্দরদাস গৃহত্যাগ করে পরিব্রাজকবৃত্তি গ্রহণ করেন। পদব্রজে ভ্রমণ করেছিলেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত কোণগুলি। সেকালে এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিলো সারা দাক্ষিণাত্য জুড়ে। ভূমিস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবত’'র বাণী। দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত তাঁর ভক্তিগীতি ‘অভঙ্গ’ ছড়িয়ে  পড়েছিলো ধনীর প্রাসাদ থেকে নিঃস্বের কুটিরে। স্বয়ং রাজা কৃষ্ণদেবরায়, সমকালীন ভারতবর্ষের সব চেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিমান নৃপতি, পুরন্দরদাসকে ‘গুরু’ বলে স্বীকার করেছিলেন। শাসন কাজে গাফিলতি দেখলে গুরু প্রকাশ্যে গানের মাধ্যমে শিষ্যকে ভর্ত্সনা করতেন। শিষ্য নতমস্তকে তা মেনেও নিতেন। ‘বড়ো’ রাজা হওয়া খুব  সহজ নয়। পুরন্দরদাস হাম্পিতে থাকলে রাজদরবারে গান শোনাতে যেতেন। রাজার অনুরোধে তিনি বসবাস শুরু করেন বিট্ঠল মন্দিরের একপ্রান্তে। প্রতিদিন ভক্তদের গান শোনাতে আসতেন মন্দিরের ভজনমণ্ডপে। মানুষের বিশ্বাস, পুরন্দরদাসই পরবর্তীকালের কর্ণাট গীতশৈলীর জনক।

মুখমণ্ডপ থেকে সোজা পশ্চিমে তুঙ্গভদ্রার দিকে গেলে সামান্য দূরেই রয়েছে পুরন্দরদাসর মণ্ডপ।  পাথরের স্তম্ভের উপর টানা  নিরাভরণ একটি মণ্ডপ। পাথরের ছাদ। ছোট্টো বিমান। তার উপর পতাকা। ভাঁটার সময়ে নদীতে আধোডোবা। জোয়ার এলে গোটা মণ্ডপটিই জলধারার নীচে চলে যায়। সিঁড়ি নেমে ভিতরে গেলে একটি স্তম্ভে দেখা যাবে পুরন্দরদাসের প্রতিকৃতি। মাথায় কন্নড় পাগড়ি, হাতে তম্বুরা। মানুষজন স্তম্ভের সামনে পুজো দেন। সমবেত দর্শকদের অনেককেই দেখা যায় পাথরের চাতালে বসে কবি রচিত গান গাইছেন। মণ্ডপের পাথরের চাতালটি শীতল, শান্ত, স্নেহময়। সেখানে জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়। নদীর নাম পম্পা, অথবা তুঙ্গভদ্রা। যে নামে ডাকহ তাহারে। নদীর অন্যপারে তাকালে প্রাচীন পাথরের সেতু। মানুষের তৈরি। প্রকৃতির হাতে তৈরি পাথরের পাহাড়ি ভাস্কর্য। দুইই অবাক করে। অঞ্জনেয়াদ্রি, পুরাণকথিত মারুতি হনুমানের জন্মস্থল। পাহাড়ের মাথায় তাঁর মন্দির।

রাজছত্র, রণডঙ্কা, জয়স্তম্ভ, সবই ভেঙে পড়ে একদিন। রক্তমাখা অস্ত্র বা রক্ত আঁখির দৌরাত্ম্য, সবই মিলিয়ে যায় দুঃস্বপ্নের মতো। শিশুপাঠ্য কাহিনীতে মুখ লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই তাদের। একটা ক্ষমতার কেন্দ্র ভেঙে অন্য কেন্দ্রের রোশনাই জ্বলে ওঠে। হাম্পি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো ১৫৬৫ সালে। আকবর ঠিক সেই বছরেই আগ্রা দুর্গ নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন। একটা ভগ্নপ্রায় ইঁটের দুর্গের অবশেষের উপর তৈরি হচ্ছিলো এদেশের ইতিহাসে সর্বকালীন প্রতাপী স্থাপত্যটি। গ্রেট মুঘলদের ক্ষমতার কেন্দ্র। পরবর্তী আড়াইশো বছর। অওরঙ্গজেবের মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যেই ইংরেজরা সেই দুর্গেরও তিনের চার ভাগ ধূলিসাৎ করে সিপাইদের ব্যারাক বানিয়ে ফেলেছিলো। আগ্রা দুর্গের যতোটুকু অংশ দেখে আমরা চমৎকৃত হই, মার্শাল সাহেব না থাকলে হয়তো সেটুকুও থাকতো না।

 

শুধু সুন্দরই বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে সুরের আলাপে, পাষাণমূর্তির লালিত্যে, আকাশ ছোঁয়া স্থপতির স্বপ্নে। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। যেমন থেকে যায় বিজয় বিট্ঠলের মোহন মূরতি। অন্তহীন সুখস্বপ্নে, দুঃখের অনন্ত রাত্রি জয় করে। বেঁচে থাকে…

‘…শুভ কাজ সূচনার আগে এই পৃথিবীর মানবহৃদয়
স্নিগ্ধ হয় — বীতশোক হয়?
মানুষের সব গুণ শান্ত নীলিমার মতো ভালো?’
দীনতা: অন্তিম গুণ, অন্তহীন নক্ষত্রের আলো ।‘

 


2 কমেন্টস্:

  1. অসাধারণ লেখা। ইতিহাস চেতনার সঙ্গে মননের বিশিষ্টতা মিলেমিশে গেলে তবেই এমন লেখা হয়!

    উত্তরমুছুন
  2. চমৎকার! সুন্দর চিত্রণ। অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন