ড্যানিয়েল কোলোবেয়ার, মগ্ন বিষণ্ণ কবি…
ডায়েরি লিখতেন তিনি। ১৯৬০ সালের জানুয়ারির কোন এক দিনের দিনলিপি ছিলো এমনটা - “আমি আর কিছুই শিখতে চাই না - শুধু মানুষদের চাই - আমি তাদের সাথে বিছানায় অন্তরঙ্গ হতে চাই – ওদের নগ্নতায় ওদেরকে বুঝতে চাই শরীরী মুদ্রায়! ওদের চাহনি, শীৎকার, কথোপকথনের চেয়ে ওদের চেনার এটা অনেক ভালো উপায় - অনেক এমন মানুষই তো এলো জীবনে…”।
সেই সালের মার্চের এক রাতে তিনি লেখেন – “কী অদ্ভুত রাত, কোয়াই দ্যা ফ্লুয়ার্সের উপর কী প্রশান্তিতে নামে রাত। গত কিছুদিন ধরে এই এলাকায় থাকছি। এ্যাপার্টমেন্টগুলো কী সুন্দর! চারপাশে কী শুনসান। সবাই ঘুমিয়ে। জানালার পাশে লেখার টেবিলটাতে বসলে সেই নদীকে দেখা যায়। জল আর আলোর কী মাতামাতি! স্রোতের চূড়োয় আলোর নাচন। জলমাখা আলো ধেয়ে আসে ল্যাম্পপোষ্টের অস্পষ্ট জ্যোতির বলয়ে, ঠিক যেন স্বপ্নভেদী বাস্তবতার মত। নীরবতা, এক অলীক শান্তিময়তা, আজ অনেকদিন পরে একটি অসম্ভব শান্তি আমাকে যেন আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে... আমি যেন ক্রমশ অনন্তলোকের খুব কাছাকাছি, মৃত্যু, সেই অবধারিত গন্তব্য... হয়তো...!”
তাঁর কবিতা যেন তাঁর মনেরই আয়না। একটা চাপা বিষণ্ণতা কবিতার মননে! নীরবতা তাকে যেন হন্ট করে।
“voice no response sometimes articulate words
only silence response to other ear never
if in mute the world no noise
rushes into the blue cosmos
no question but vertical voyage”
- Survival
তাঁর কাছে মৃত্যুই হলো নীরবতার চরম স্বরূপ। আর তাই তিনি বলে চলেছেন এমন ভাবে। ঠিক যেন বাইবেলের পংক্তির মত। তিনি নিজেই নিজেকে মৃত্যুর নীরব বাণী শোনাচ্ছেন।
“no way to get the sounds out from beyond death just
strain the nerves to raise the sound the lips higher”
- Survival
ড্যানিয়েল কোলোবেয়ার। ফ্রেঞ্চ লেখিকা, কবি ও সাংবাদিক। ১৯৪০-এ ২৩শে জুলাই ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর রস্ট্রেন কোর্টস-দ্যা-আর্মারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ছিলেন একজন শিক্ষিকা। বাবা ছিলেন না। মাকে শিক্ষকতার কাজের সূত্রে পাশের গ্রামে থাকতে হতো, আর তাই ড্যানিয়েলের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে নানির উপর। রস্ট্রেনের অপরূপ পরিবেশে কাটে তাঁর শৈশব। ছোট্ট এই গ্রামে তিনি বেড়ে ওঠেন নিঃসঙ্গতায়। কারণ তাঁর বয়েসী কোন কিশোরী নানির বাড়ি অথবা পাড়ায় ছিলো না।
১৯৬১-তে ড্যানিয়েল কোলোবেয়ার ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি লাভ করেন। সেই বছরে তিনি লেখেন ‘টোটেম’, যা তিন বছর পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘মার্ডার’। সেই বছরের এপ্রিলে তিনি প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ওয়ার সং’ প্রকাশ করেন নিজের খরচে। কিন্তু কয়েক বছর পরে এই বইয়ের সব কপি পুড়িয়ে ফেলেন। তাঁর পাঁচটি বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। বইগুলো হলো ‘মার্ডার’, ‘সে-১’, ‘সে-২’, ‘ইট দেন’ এবং ‘সারভাইভাল!’
১৯৬২'র জানুয়ারিতে ড্যানিয়েল ইটালিতে স্বেচ্ছানির্বাসনে যান। সেই সালের আগস্টে ফিরে আসেন আলজেরিয়াতে এবং একটা আলজেরিয়ান ম্যাগাজিনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পত্রিকাটির নাম - ‘রেভ্যাউলশন আফ্রিকেইন’। তিনি এই পত্রিকাটি চালিয়ে যান যতদিন না এটি বন্ধ করে দেয়া হয়, আহমেদ বেন বেলা ক্ষমতায় আসার পরে। ১৯৬৮-তে ড্যানিয়েল রাইটার্স ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত একটানা ভ্রমণ করেন। তাঁর জার্নালে এই ভ্রমণবৃত্তান্ত বিশদ ভাবে এনেছেন। এই সময় তিনি লেখেন ‘সারভাইভাল’। ড্যানিয়েল চাইছিলেন খুব তাড়াতাড়ি ‘সারভাইভাল’ প্রকাশ করার জন্য। অনেক ঝক্কি ঝামেলার পরে ১৯৭৮এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয় বই আকারে।
ড্যানিয়েল মূলত একজন এক্সপেরিমেন্টাল লেখিকা ছিলেন। তাঁর গদ্য যেন একটা ঘোরলাগা বোধ থেকে উৎসারিত। তাঁর গদ্যে অবধারিত ভাবে চলে আসে মৃত্যু যা তাঁর কাছে মনে হয় মানব সমাজের শেষ গন্তব্য। তাঁর কবিতাগুলোও যেন ঘোরলাগা বোধ থেকে উৎপত্তি হয়। তিনি যেন এই সমাজ এবং সময় সম্পর্কে হতাশ। আর সেই বিপন্ন বোধকে কবিতায় আঁকেন ডার্ক ইমেজ দিয়ে। ‘Say II’-তে তিনি এমন ভাবেই পাঠকদের তার রিয়েলিটিতে নিয়ে নেন –
“without an image — without a reflection — only to hear oneself — the breath — the cry — the words — sometimes — before vanishing — to trace out something — somewhere — for nothing — certainly without necessity — to be there — yet — still — to try.”
ড্যানিয়েলের কাছে ভালোবাসার পথটা খুব সংকীর্ণ। তাঁর কাছে মানুষের জেন্ডার বিভেদ যেন অস্পষ্ট। ড্যানিয়েল যেন স্কেটযোফ্রেনিক। তাঁর কাছে মনে হয়েছে মৃত্যুই যেন একমাত্র মানুষের শিকড় ও সব জীবন্ত স্পেসিসের শেষ আশ্রয়। তাঁর বোধ ভরাক্রান্ত হয় এক কসমিক বিষণ্ণতায়। তিনি তাঁর চারপাশের বাস্তবতাকে নাকচ করতে থাকেন। তিনি মনে করতে থাকেন যে তাঁর চারপাশের বাস্তবতা হলো অলীক অথচ তিনি যে জীবনকে প্রত্যক্ষ করেননি অথবা যে সময়কে তিনি প্রত্যক্ষ করেননি সেটাই যেন তাঁর কাছে পরমবাস্তবতা। তিনি বিচ্ছিন্ন। যা তাঁর কবিতা ও ডায়েরিতে সমান ভাবে প্রতিফলিত। তাঁর কবিতার শিরোনাম ‘সারভাইভাল’ যেন তাঁর এই ভাবনার একটা জলন্ত আইরনি। শিরোনাম আশার প্রতীক হলেও ড্যানিয়েল সম্পূর্ণ হতাশার কাব্য লিখে গিয়েছেন। একটা চরম অস্থিরতা কাজ করছিলো তাঁর মনোজগতে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন পার্থিব জগৎ থেকে । তিনি যেন এক কাব্যিক আত্মবিনাশের ছবি এঁকে যান এভাবে-
“engulfed in lava flow skin-tight word wall within which
no way to get the sounds out from beyond death just
strain the nerves to raise the sound the lips higher
the bone skull rang out
aching strangulation remain beyond death just
or not smile of smile devoid in reflections in black
extinguished face
scarcely light of distant view
gone for the seven days of circular hell
creation torture and rest included
sleep of full earth and dreams included”
-Survival
তিনি নিজের সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী ক’রছেন। তাঁর কাছে আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয় আর লেখাও সম্ভব নয়। প্লাথের পরে নিজের আসন্ন আত্মহননের কথা খুব কম কবিই আগাম বলেছেন তাঁদের লেখায়। ড্যানিয়েল যেন প্লাথেরই উত্তরসূরি!
হতাশা ড্যানিয়েলের মনে গভীর স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তিনি না চাইলেও তাঁর হতাশা, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ লেখায় চলে আসে। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কিছুতেই তাঁর সৃষ্টিকর্ম থেকে আলাদা করে রাখতে পারেন না। তাঁর মনে যে ভয়ঙ্কর ইচ্ছেটি ক্রমাগত বেড়ে উঠছিলো সেটা বাস্তবায়নের কথা তাঁর লেখাতেই প্রকাশ করে ফেলেন এইভাবে-
“One does not know, one has never learned, how to write that
word, End,” – Murder
ড্যানিয়েল তাঁর জীবনের ইতি টানতে চান অথচ তিনি জানেন না ঠিক কীভাবে তা করতে হবে। মন্টেগ তাঁর দর্শনে দেখতে চেয়েছিলেন কেমন ভাবে একজন ব্যক্তির পার্থিব জগতের ইতি ঘটে। তিনি যেন মন্টেগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। অন্তত মানুষের জীবনের এই চরম সত্যের খোঁজে।
ড্যানিয়েল উপন্যাস ‘মার্ডার’এ ব্যবহার করেন বাস্তব-ইমেজ এবং তাঁর বাক্যের গঠন হলো একেবারে সোজাসাপ্টা। তিনি খুব কম অলংকার ব্যবহার করেন তাঁর এই উপন্যাসটিতে। মার্ডারের একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো তিনি ন্যারেশন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তিনি ন্যারেটরের লিঙ্গ মাঝেমাঝেই পরিবর্তন ক'রে একটা ইম্পার্সোনাল ন্যারেটর হিসেবে নিজেকে প্রতিয়মান করেন। তিনি নিজেকে ব্যক্তিসত্তা থেকে মুক্ত করে মানবসত্তায় যুক্ত করেন। ড্যানিয়েল তাঁর আসন্ন মৃত্যুর ঘোষণা আগেই দিয়ে দেন আর বলেন কেমন ভাবে তাঁর শব্দের জগৎ বদলে যায়। তিনি জীবনের এই সন্ধিক্ষণে কারো কাছ থেকে কোন কিছুর জন্য উত্তর চান না। তিনি অন্যসব অনন্তলোকের যাত্রীদের নিয়ে চলে যেতে চান।
I leaving voice without response to
articulate sometimes words
that silence response to other ear never
if to muteness world not a sound
plunges into blue cosmos
no more question that vertical journey
I leaving slide to horizon
all equal all mortal leaving starting
with the I
at full speed fleeing the horizon
at last to hear only music in the screams
enough enough
exit.
ড্যানিয়েলের কাছে মরণশীলতার শুরু হয় ‘আমি’ থেকে আর শেষ 'আমাদের'-এ। ড্যানিয়েল ব্যক্তিবাদের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে চান। তাঁর প্রথম দিকের লেখা প্রচন্ডভাবে আত্মবাদী! শেষের দিকে এসে তিনি তাঁর লেখা থেকে নিজের ছায়া আস্তে-আস্তে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। তিনি যেন নীরবে তাঁর একক অস্তিত্বকে ভাঙছিলেন। এই ধারা যুদ্ধ পরবর্তী ফ্রান্সের অন্য কবি সাহিত্যিকের মাঝেও দেখতে পাওয়া যায়। ইভস বনফয়, পিয়েরে আলবেয়ার জর্ডিন বা ফিলিপ জ্যাকোর্টের মত লেখিয়েরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ থেকে বের হয়ে এসে সামষ্টিক চিন্তায় উন্নীত হন।
ড্যানিয়েল বাঁধাধরা ছক থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চান। নাতালি সরাটের মত তিনি মানবিক হয়ে উঠতে চান তাঁর কবিতায়, তাঁর লেখায়। তিনি এই ধারণায় এসে পৌঁছান যে মানুষ, তার কোন ব্যক্তি পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে না। মানুষের পরিচয় সামষ্টিক আর তাই একজন ব্যক্তি অবশ্যই এক নৈর্ব্যক্তিক অস্তিত্ব। তাঁর বিশ্বাসের এই পরিবর্তন হয়তো তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্যও হতে পারে। ১৯৬১-১৯৬৩ পর্যন্ত তিনি আলজেরিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সাথে যুক্ত থাকেন। হয়তো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য তিনি তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ যেটা তাঁর ব্যক্তিসত্তার উগ্র প্রকাশ ছিলো, সেটা পুড়িয়ে ফেলেন।
১৯৬৩’র পরে ড্যানিয়েল ড্রাগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে তিনি আলজেরিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই সময়টাতে তিনি সারা ফ্রান্স এমনকি ফ্রান্সের বাহিরে অনেক দূর্গম এলাকা ভ্রমণ করছিলেন। তিনি ভ্রমণ বৃত্তান্ত আর ড্রাগের ঘোরে দেখা হ্যালুসিনেসন তাঁর নোটবুকে লিখে রাখছিলেন। তিনি এই সময়ে লিঙ্গভেদ ভুলে যান। তাঁর উপন্যাসের ন্যারেটরের নাম বা লিঙ্গের কোন সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। তাঁর উপন্যাস ডায়ার-২ [Dire-II] ন্যারেটর এমনই একজন নামহীন, লিঙ্গপরিচয়হীন অস্তিত্ব।
ড্যানিয়েলের নোটবুক তাঁর ভ্রমণের দারুণ দলিল। তিনি দেশভ্রমণ করছেন কিন্তু কোন দেশেই সুস্থির বোধ করেন না। একটা অস্থিরতায় ভোগেন। তাঁর এই অস্থিরতা ডায়েরি লেখার ধরনে প্রতিভাত হয়। তিনি ডায়েরি [নোটবুক] লিখতে গিয়ে ব্যবহার করেন না কোন কমা, ফুলস্টপ বা পাংচুয়েশন, কোন লেখারই নেই শিরোনাম। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর ১৪-তে লেখা এমন এক নোটস-
“always on the move — a bag — not much gear no things — no books — only an old copy of Têtes-mortes had for years — Bing Bing // unnecessary this house — bag suffices . . .”
এই সময়ে তাঁর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার এবস্ট্রাক্ট বর্ণনা পাই ‘It Then’ -এ। তিনি লেখেন –“always movement // from the violent to the imperceptible — the immobile — immobility never — a semblant settling at best!” ড্যানিয়েল তাঁর মনোজগতের অবস্থা যেন সরাসরি প্রতিফলন করান তাঁর লেখার স্টাইলে। পাঠকরা দু’ভাবে তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। একটা তাঁর টেক্সটে দেয়া বর্ণনার মাধ্যমে আর একটা তাঁর অনিয়মিত পাংচুয়েশনে লেখার স্টাইলে। এই দুয়ের মিশ্রণে পাঠকরা পেয়ে যান ড্যানিয়েলকে - এক অসাধারণ মেন্টালিস্ট লেখিকাকে।
ড্যানিয়েল কোলোবেয়ার ১৯৬৭ সাল থেকেই চেষ্টা করছিলেন স্যামূয়েল বেকেটের সাথে দেখা করতে। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক বেকেটের প্যারিসে অবস্থানের সময় তাঁর সাথে দেখা করতে পারেননি ড্যানিয়েল। অবশেষে ১৯৭৬ সালে বার্লিনে তাঁর সাথে দেখা হয়। ড্যানিয়েল কোলোবেয়ার তাঁর নোটবুকে এই এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর নোটবুকের উজ্জ্বল অংশ হলো সামুয়েল বেকেটের সাথে তাঁর দেখা হবার ঘটনা।
“To Berlin — to see Sam …….with Sam // at the moment of
speaking — death.”
ড্যানিয়েলের লেখার স্টাইল তাঁর একান্ত নিজের। তিনি কারো লেখার স্টাইলকে এডোপ্ট করেননি। তিনি তাঁর লেখায় নিজের একটা জগৎ তৈরি করেন। তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সর্বনামের সীমিত ব্যবহার ও ন্যারেটরের নামহীনতা, এমন কি তাদের লিঙ্গ পরিচয়হীনতা। এটা যেন ড্যানিয়েলের লেখার সিগনেচার। ‘ডায়ার-১’ ও ‘ডায়ার-২’এর এর মুখবন্ধে জাঁ পিয়রে ফয় উল্লেখ করেন এই বলে যে, ‘ড্যানিয়েল কোলবার্টের সংলাপ উঠে আসে তাঁর চরিত্রদের নীরবতা থেকে। ‘ডায়ার’ ১ ও ২ এর বর্ণনায় ‘e’ অক্ষর যা নারী সর্বনাম ‘she ‘ শেষ অক্ষর তা ব্যবহার না করেই তিনি টেনে নিয়ে যান তার বর্ণনা। ব্যাকরণের রীতি এমন না মেনে চলা ড্যানিয়েলের লেখায় অন্য মাত্রা যোগ করে। তিনি সাহিত্য পণ্ডিতদের বাধ্য করেন তাঁর লেখা নিয়ে ভাবতে এবং তিনি যে ক্লু ছেড়ে যাচ্ছেন তা বের করতে। পণ্ডিতরা মানতে বাধ্য হন যে ড্যানিয়েলের এই ব্যাকরণ না মেনে লেখা তাঁর উচ্চমার্গের কল্পনা ও চেতনা প্রসূত যা সাহিত্যে অনবদ্য শিল্পমূল্যে মহিমান্বিত। ফ্রেঞ্চ পাঠকরা যখন ‘ডায়ার-১’ পাঠ করেন তখন তারা যেন ধন্ধে পড়ে যান। তাদের কাছে মনে হয় লেখাটার প্রথম প্যারাগ্রাফে কিছু ভূল প্রিন্ট আছে। ড্যানিয়েল চার নম্বর বাক্যে এসে ন্যারেটরকে উপস্থাপন করেন ‘উত্তম পুরুষে।‘ যেহেতু লেখিকা একজন নারী, পাঠকদের মনে প্রাথমিক ভাবে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, বর্ণনাকারী একজন নারী। কিন্তু পাঠ কিছুদূর এগোলে পাঠকদের এই ধারণা পাল্টে যায়, তাঁরা মনে করতে থাকেন, ন্যারেটর নারী নয় বরং পুরুষ। কিন্তু পাঠ আরো এগোলে পাঠক আবারো ধন্ধে পড়ে যায় এটা দেখে যে তিনি বর্ণনা করছেন কখনো ‘আমি’ আবার কখনো ‘তুমি’ ব্যবহার করে। তিনি প্রচ্ছন্নভাবে কার্ল ইউং এর পুরুষের মাঝের নারীসত্তা তত্ত্বকে নিয়ে খেলছেন। তার এই এ্যাবসার্ড ন্যারেশনের টেকনিককে সাইকোলসিজস্টরা দেখেন লেখিকার স্কেটজোফ্রেনিক স্পেলের প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
সাল ১৯৭৮। ড্যানিয়েল কোলোবেয়ারের নোটবুক ভরে উঠতে থাকে ব্লাক ইমেজারিতে। তার লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো যে মানুষের শেষ গন্তব্য মৃত্যু। তিনি ভাবছিলেন যদি মৃত্যুই মানুষের শেষ গন্তব্য হয়ে তবে এই লৌকিক জীবনের আদৌ কি কোন প্রয়োজনীয়তা আছে? ক্রমবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি তাঁর পরিচিতজনদের সাথে। ডায়ার-২-তে তিনি বলেন- ‘keep living — to appear to oneself perhaps from time to time still — without an image — without a reflection — only to hear oneself — the breath — the cry — the words — sometimes — before vanishing — to trace out something — somewhere — for nothing — certainly without necessity — to be there — yet — still — to try’.
তিনি জেন্ডার পার্থক্য নিয়ে ধন্ধে পড়েন, তাঁর লেখার প্রতিটি ছত্রে মৃত্যু, এ্যাবসার্ডিটি ও ইলিউসন। ড্যানিয়েল স্বেচ্ছানির্বাসনে নিজেকে বিচার করতে থাকেন। তিনি আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়েন নিজ সম্পর্কে এটা বের করতে পেরে যে তাঁর ভালোবাসার কোন মানুষ নেই যে যার সাথে তিনি মানসিক কষ্ট ভাগাভাগি করে নেবেন। ঠিক যেন প্লাথের মত। প্লাথের জীবনে স্বামী থাকা অবস্থায় মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান যখন টেড হিউজ তাদের ভাড়াটের বান্ধবীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং প্লাথের কাছে সেটা যখন ধরা পড়ে। ড্যানিয়েলের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও এক জায়গায় তাঁদের বেশ মিল সেটা হলো তার বিচ্ছিন্নতা এবং তাদের পাশে এমন কোন সঙ্গী নেই যার সাথে তাদের কষ্ট ভাগ করে নেয়া যায়।
ড্যানিয়েলের প্রথম উপন্যাস ‘মার্ডার’ তাঁর জীবনের প্রতিফলন। অটোবায়গ্রাফিক্যাল। প্লাথের উপন্যাস ‘বেলজারের’ মত অনেকটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্রেন্স রেসিটেন্স আর্মির কন্যা তার জীবনে যা দেখেছেন তার কিছু অংশের বর্ণনা হলো ‘মার্ডার।‘ ফর্ম ও কন্টেটের দিকে তাকালে নিঃসন্দেহে ‘মার্ডার’ একটি অনন্য উপন্যাস। ‘মার্ডারে’ ড্যানিয়েল কোলবার্ট গদ্যের সাথে ব্যবহার করেন অনবদ্য কাব্য। পাঠকরা ভিন্ন স্বাদের একটি উপন্যাসের জগতে হারিয়ে যান। হারিয়ে যান পদ্য, গদ্য ও অনিয়মিত পাংচুয়েশনে। ড্যানিয়েল যেন তাঁর আবেগের দরজা খুলে দেন, যে আবেগ ‘স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের’ স্রোতে পাঠকদের ভাসিয়ে দেয়। ভার্জিনিয়া উলফের স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের মত অনেকটা। ডানিয়েলের ব্যাকরণ না মেনে লেখার স্টাইল অনেকটা জয়েসকে মনে করিয়ে দেয় প্রচ্ছন্ন ভাবে। ড্যানিয়েলের আবেগ যেন ভাসমান জাহাজের মত ভেসে চলে - “All of this has the appearance of a drifting ship, quiet and without importance, but we are not completely confiden…! ”
ড্যানিয়েল ‘মার্ডার’এ তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা এবং কষ্টকে এক অনবদ্য মিশ্রণে উপস্থাপন করেন। ড্যানিয়েল তাঁর এই উপন্যাসে পাঠকদের সামেনে নিজেকে তুলে ধরেন একজন চরম বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে। এটা যেন ৩৬০ ডিগ্রি টার্ণ। যে নারী আলজেরিয়ান লিবারেশন ফ্রন্টে সক্রিয় ছিলেন, যিনি ভেবেছেন সামষ্টিক জীবনের কথা আর তিনিই কিনা বিচ্ছিন্ন! পাঠকরা এটাও বুঝতে পারেন যে ড্যানিয়েলের বিচ্ছিন্নতা তাঁর এই লৌকিক জগতের সাথে প্রতীকী বিচ্ছিন্নতা, তিনি অসীম সময়ের জগতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। তিনি বলেন - “this eye, doesn't know whether it's looking into the emptiness, into the air, into the other, or into a distant landscape, which it brought life, like a memory, a wanted decor, chosen, an elemental power, that could be the background of its life.” এই “a distant landscape” ইমেজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে তিনি কোথায় যেতে চান। তাঁর গন্তব্য অসীমে।
ড্যানিয়েল তাঁর বিচ্ছিন্নতা থেকে কি বের হতে চাননি? চেয়েছেন। কিন্তু যখনই চেয়েছেন তাঁর চারপাশের পরিবেশ তাঁকে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বিচ্ছিন্নতায়। তিনি যেন একটা ফাঁদে পড়ে গেছেন, যে ফাঁদ থেকে বের হতে পারছেন না। ‘Caught in a trap—we've been caught in a trap... Fear. All the possibilities for destroying us. They have all the possibilities, against us. Our powerlessness--our voiceless howls—our too burning flesh, too entangled. A single breath... To kill us all—or else to refine our torture, to kill only one—to show us.” ডানিয়েল নিজেকে অন্য মানুষদের সাথে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেন প্রকৃতির ক্ষমতার কাছে। মানুষ হিসেবে নিজেকে তিনি অসহায় মনে করেন। মৃত্যুর কাছে নিজেকে ক্ষমতাহীন মনে করেন।
ড্যানিয়েল যুদ্ধ করছেন কষ্টের সাথে; বেঁচে থাকার জন্য। উপন্যাস ‘মার্ডারে’ তিনি তার কষ্টের কারণগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করে পাঠকদের দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন কেমন ভাবে পরিবেশ তার মনে অন্তর্গত কষ্টের জন্ম দেয়, কীভাবে সেটা ক্যান্সারের মত তাঁর মনের শরীরে বিস্তার লাভ করে এবং প্রতিনিয়ত কেমন ভাবে ড্যানিয়েল কোলোবেয়ারকে সেটা মেরে ফেলে। তিনি আজকের মত টেকনোলজিকাল মার্ভেলের সন্তান না। তিনি টেকনোলোজির চরম উন্মেষের সময়ের মানুষ। যখন সমাজ এগোচ্ছে আল্ট্রা টেকনোলোজির দিকে। এই সন্ধিক্ষণে আশেপাশের মানুষরা যে ক্রাইসিসে ভুগছিলো তিনি সেই শ্রেণীতে পড়েন না। বরঞ্চ তাঁর ক্রাইসিস অন্য কোন সময়ের। সেই সময়ের, যে সময়ে সামষ্টিক মানুষদের যেন নাকচ করা হচ্ছে, যেখানে ব্যক্তিবাদীতার জয় জয়াকার, তিনি যেন একটা চলন্ত চাকার মত এই ব্যক্তিবাদী সময়ে হারিয়ে যাচ্ছেন একটা চরম কনফিউশন নিয়ে। তিনি যে আদর্শ নিয়ে আলজেরিয়ান লিবারেশন ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন তাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন কী ভয়ানক ভাবে তিনি ডুবে যাচ্ছেন এল এস ডির নেশায়, কীভাবে স্কেটজোফ্রেনিয়া তাঁকে গ্রাস করছে ক্রমাগত। তিনি হ্যালুসিনেশন দেখছেন। তিনি নিজেকে ভাবছেন – ‘the wheels of a machine.' তিনি অনেক প্রশ্ন করছেন অথচ তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন না।
‘সার্ভাইভাল' লেখা শেষ। আটত্রিশতম জন্মদিনের চারমাস আগে। ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করছিলেন কবিতাটার ইংরেজী অনুবাদ করার। এবং তা খুব সত্ত্বর। বন্ধু ওক্সিও এস্পজেটোকে তাগিদ দেন কবিতাটি দ্রুত অনুবাদ করে ফেলার জন্য। সে সময় তিনি নিজেকে খুব বিচ্ছিন্ন রাখছিলেন। শুধু ওক্সিওর সাথে ক্ষীণ যোগাযোগ ছিলো, তাও ‘সারভাইভালের’ অনুবাদ নিয়ে। বন্ধু ওক্সিও ড্যানিয়েলের কথা রেখেছিলেন। তিনি মার্চের মধ্যেই শেষ করে ফেলেন অনুবাদ। বই আকারে বের হয় এপ্রিলের শেষে। ড্যানিয়েল খুব খুশি হন বই হাতে পেয়ে।
সেদিন ছিলো রবিবার। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে প্যারিসের রু-ডাউফিনে। রুম সার্ভিস শ্যাম্পেন রুমে সার্ভ করার সময় তাকে দেখতে পায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। স্থির। মূর্তির মত। ফিরেও তাকাননি তিনি সার্ভিসবয়ের দিকে। রোববার, জুলাই ২৩, তাঁর জন্মদিন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধের দিকে দিন। দিনের সবচেয়ে বিষণ্ন সময়। হোটেলের নীচে জটলা, এক তরুণীর থেতঁলে যাওয়া মৃতদেহকে ঘিরে। ড্যানিয়েলের মরদেহ। ছয়তলার রুমের জানালা গলে পা বাড়িয়েছিলেন তাঁর সেই অনন্তলোকে যাবার জন্য। জন্মদিনে কী নির্মম উপহার দিলেন ড্যানিয়েল কোলোবেয়ার নিজেকে, মাত্র আটত্রিশ বছর বয়েসে কবি ছেড়ে গেলেন পৃথিবী। কিন্তু কার উপর অভিমান করে? সেটা এখনো অজানা।
তথ্যসূত্র -
১। Reading Daniel. C by John Taylor
২। Reviews and an Excerpts of Murder by Nathanel
৩। Murder by Danielle Collobert
Beautiful translation with spreads. Never seamed translated.. an image of unique womanly spirit.
উত্তরমুছুন