কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস


একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী



 

 (১)

 স্বপ্ন

What I am going to tell you would appear to be impossible: but that is how men are, and I know men. (Rudyard Kipling)

হৃদয়পুর দ্বীপের সবচেয়ে প্রাচীন, ভাঙাচোরা, পরিত্যক্ত ক্যাথিড্রালে ঢোকার মুখে ঠিক মাথার ওপর যে মস্ত ঘড়িটা রয়েছে, তার দিকে একবার তাকাল হৃদয়। ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। কয়েক মুহূর্ত সেই ঘড়িটার দিকে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে রইল হৃদয়। তারপর ঢুকে গেল ভেতরে। একসময় আলো ঝলমল করত ভেতরে। এখন জায়গাটা অন্ধকার, ঠাণ্ডা আর স্যাঁতস্যাতে। যদিও সূর্য ও চাঁদের আলো দিন-রাতের বিভিন্ন সময় নানাভাবে ভেতরে এসে পড়ে আর আলোছায়া তৈরি করে অদ্ভুত এক রহস্যময়তার সৃষ্টি করে। এই রহস্যময়তাকেই ভালোবাসে হৃদয়। ছোটোবেলা থেকেই এই ক্যাথিড্রালের স্বপ্ন দেখে সে। যখন-তখন সেই ক্যাথিড্রালের ভেতর ঢুকে পড়ে। কখনও স্বপ্নের মধ্যে, কখনও বাস্তবে, আবার কখনও বুঝতেই পারে না কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব। সে শুধু ভেতরে ঢুকে পড়ে আর নিজের খেয়ালে ঘুরে বেড়ায়।

উদ্ভাস জানতে চেয়েছিল, কেন তুই এত ক্যাথিড্রালের স্বপ্ন দেখিস?

আমি গথিক স্থাপত্য ভালোবাসি। কী অপরূপ সৌন্দর্য এই স্থাপত্যের! আমি সৌন্দর্য ও উচ্চতা, আলো আর পবিত্রতা খুঁজতে আসি ক্যাথিড্রালে।

উদ্ভাস পুলিশের ইউনিফর্ম পড়ে আছে। ঝলমলে এক যুবক। হৃদয়েরই বয়সী। ক্যাথিড্রালের ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে ওর জিপ। সে সিগারেট খায় না। মদ খায় না। ঘুষ নেয় না। আদর্শবাদী ও সৎ পুলিশ অফিসার। তার খুব শখ, ফুলের। ফুলের বাগানের। উদ্ভাসের হাতে একটা প্লাস্টিকের ফুল। হৃদয়পুর দ্বীপের একমাত্র ফুলের বাগানটি রয়েছে এই ক্যাথিড্রালের পিছন দিকে। সেদিকেই হাঁটতে থাকে সে। পোড়া গন্ধ পায়।

ক্যাথিড্রালটা রয়েছে একটা উঁচু টিলার ওপর। এখন বাইরেটা কুয়াশায় ঢাকা। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। ক্যাথিড্রালের ঠিক পিছনেই রয়েছে একটা পাইন বন। বিরাট উঁচু উঁচু স্তম্ভ এই ক্যাথিড্রালে। খাড়া উঠে গেছে আকাশের দিকে আর তাদের সূঁচের মতো মুখ দিয়ে যেন বিদ্ধ করে দিতে চায় আকাশটাকে। উচ্চতা, এই উচ্চতাই মুগ্ধ করে হৃদয়কে, বিশেষ করে যে উচ্চতার তীক্ষ্ণ সূচাগ্র আরও উঁচুতে উঠতে চায়। ভেতরে ঢুকে সে হাঁটতে থাকে অন্যমনস্কভাবে। দিনের আলো এমনভাবে ঢুকে এসেছে যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। চারপাশে উঁচু উঁচু দেওয়াল, দেওয়ালের গায়ে বিচিত্র সব নকশা, ছবি, ফ্রেসকো, ধনুকাকৃতির খিলান, ছাদের গায়ে থাকা অদ্ভুত অদ্ভুত সব মূর্তি এই সবই প্রিয় হৃদয়ের। কিন্তু আজ কোনও দিকেই তাকাচ্ছে না সে। শুধু মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাথিড্রালের পিছনদিকে আসে সে। সামনে লাইব্রেরি দেখে সেখানেই ঢুকে পড়ে। এই লাইব্রেরিতে একসময়ে প্রায় দশ হাজার বই আর পুঁথি ছিল। চামড়া দিয়ে বাঁধানো ছিল সে সব। এখন একটাও নেই। কিন্তু সেই শূন্য লাইব্রেরিও খুব পছন্দ হৃদয়ের। ওখানে চুপচাপ বসে থাকলেই সে ফুলের গন্ধ পায়। লাইব্রেরির ওপাশেই ফুলের বাগান। ওর নিজের হাতে তৈরি।

ধূ ধূ করছে লাইব্রেরির ভেতরটা। পরিত্যক্ত একটা সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল হৃদয়। মাথায় একইরকম ধনুকাকৃতি খিলান। চেয়ার-টেবিল-বইয়ের র‍্যাক যা ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছিল, কিছুই নেই এখন। মেঝেতে নানারকম নকশা করা, যার রঙ এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। গোটা লাইব্রেরিতেই স্থাপত্য আর শিল্পের কারুকাজ।  আর রয়েছে মার্বল পাথরের একটি মূর্তি। সামনের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল হৃদয়। এখান থেকে বাইরের সেই ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে কেউ বা কারা এসে এই ফুলের বাগানটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। গভীর রাতে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয়। একটা ফুলও আর বেঁচে নেই। সেখানে এখন শুধু পোড়া গন্ধ আর ছাইয়ের উঁচু ঢিবি।

হঠাৎ খুব একা লাগতে শুরু করে ওর। বহুদিন একা থাকার অভ্যাস নেই। গত দশমাস ধরে সব সময়ে ওর চারপাশে ছেলেমেয়ের ভিড়। হৃদয় হয়ে ওঠে ওদের বন্ধু, নেতা, পথপ্রদর্শক, অভিভাবক। কিন্তু সবার আগে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব কী, এটাই ছিল ওর মূল প্রশ্ন। এটাই ও জানতে চেয়েছিল। নানা ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশে এটারই ও খোঁজ করেছিল। আর এই ভাবেই ওর একা থাকার অভ্যাসটা চলে যায়। পুরোপুরি। আস্তে আস্তে এমন হল, একা থাকতে ওর ভয় করত। ও ঠিক নিরাপদ বোধ করত না। কোনও কারণ ছাড়াই আশেপাশে ঠিক কাউকে না কাউকে জুটিয়ে নিত। আর অন্ধের মতো ভরসা করত তাকে। অন্তত তার জন্য ও একা নেই, এটাই বোঝাতো নিজেকে।

একে একে বন্ধুদের মুখগুলো মনে পড়ছিল ওর। টানা দশমাস। বেশ ভিড় জমেছিল ওর চারপাশে। সারাদিন ধরেই কেউ না কেউ ফোন করত। ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পরই ও দেখত, কেউ না কেউ এসে হাজির হয়েছে। তারপর সে চলে গেলেও অন্য কেউ আসত। এইভাবে সারাদিনই কেউ না কেউ থাকত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বন্ধুদের আসা-যাওয়ার কোনও বিরতি ছিল না। সারাদিন ধরে তাদের জন্য নানা সুখাদ্যের ব্যবস্থা করতেন হৃদয়ের মা। বাড়িতে প্রচুর জায়গা, ঘরের অভাব নেই, ফলে কারও দরকার হলে সে একটু শুয়ে জিরিয়ে নিতে পারত। এছাড়া ছিল তাদের মনমেজাজ ভালো রাখার নানা ব্যবস্থা। বাড়িতে প্রচুর বই, গান, পেইন্টিং, সিনেমা। যে যেমন খুশি সেগুলো ব্যবহার করতে পারত। সেইসঙ্গে ছিল ঘন ঘন চা  আর তুমুল আড্ডা। অবশ্য বক্তা মূলত হৃদয়। তার মাথায় সব সময়ে নানা আইডিয়া। প্রশ্ন। বন্ধুদের সেগুলো না জানাতে পারলে সে ছটফট করত। বন্ধুরা বেশির ভাগ সময়েই নীরব শ্রোতা। এইভাবে হৃদয় একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিল।

উদ্ভাস বলছিল, তুই কথা বলতি খুব আবেগের সঙ্গে। জোর দিয়ে। তোর কথা বলার ধর সবাইকে আকৃষ্ট করত। তুই ওভাবে কথা বলতিস, কারণ তুই ওদের মন বদলাতে চাইতি। সেই মনকে আলোকিত ও সংস্কারমুক্ত করতে চাইতি। সৌন্দর্য, মেধা, জ্ঞান, প্রেম অর্থাৎ জীবনের যা কিছু সম্পদ, সেগুলোর প্রতি ওদের মনকে আগ্রহী করে তুলতে চাইতি। শিল্পের যা কিছু মহৎ, তাই নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতি। তোর কথা শুনে সবাই অল্পবিস্তর ওসব নিয়ে চর্চা করতে শুরু  করেছিল। তুই বলতি, সব মহৎ শিল্পেরই মূলে আছে আধ্যাত্মিকতা। ফুলই তোর  কাছে ছিল সেই আধ্যাত্মিকতা। ফুলের চর্চা করে আসলে তুই সেই আধ্যাত্মিকতার চর্চা করতে চাইতি। যে মানুষ খুব গভীর আধ্যাত্মিক নয়, তার পক্ষে কখনই শিল্পের মহত্বকে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। কেন বলতি তুই ওসব? পরবর্তীকালে তুই যা বলতি, তার বেশিরভাগই ওদের মন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছিল।  ছিটেফোঁটাও মনে রাখেনি কেউ! তুই বলে যেতি নিজের খেয়ালে। একবারও ভাবতি না কাদের বলছিস। শ্রোতা হিসাবে তারা কোন স্তরের। কেনই বা এসব  কথা তুই বলছিস তাদের। তুই থাকতি কল্পনার রাজ্যে। আর ওরা থাকত মুখ বন্ধ  করে। ওদের নীরবতাকে তুই ওদের মুগ্ধতা বলে ভুল করতি। ওদের সমর্থন বলে  মনে করতিস। তোর ভারি ভারি কথা কিছুক্ষণের জন্য ওদের মনকে আলোড়িত করত। তারপর আবার যে যার গর্তে ফিরে যেত। আর নিজেদের গর্তে ঢোকার পর ঐসব শব্দ ওদের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে মনে হতো। সুযোগ পেলেই সেই শব্দগুলোকে ওরা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ নির্ভার হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসত।

আর এইভাবেই দিনে দিনে হৃদয় একজন হোমড়াচোমড়া গোছের লোক হয়ে উঠেছিল। লোকে ওকে সমীহ করত। বিশেষ গুরুত্ব দিত। সূক্ষ্মভাবে স্তাবকতাও জুটতে শুরু করেছিল।

(ক্রমশঃ)



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন