কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

শতাব্দী দাশ

সমকালীন ছোটগল্প

স্বর

তারপর একদিন সকালে উঠে কেয়া দেখল, তার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।  কিছুদিন ধরেই গলা বুজে আসছিল। যেন কেউ চেপে ধরেছে। কথা বলতে যেন অনীহা। আওয়াজ বদলাচ্ছিল।

কিন্তু কেয়া এমনিতেই কথা বলে কম। রথী শোনেও কম। স্বরের বদলটা তাই খুব বেশি ঠাহর হয়নি। এই যে রথী শুনতে পায় না, প্রায়শই শুনতে পায় না, একে কি রোগ বলা চলে? রথী কি অফিসে ক্লায়েন্টের কথা শুনতে পায় না? বসের কথা? নিশ্চয়ই পায়। কিন্তু রথী বাড়িতে কানদুটিকে প্রায়শ বন্ধ রাখে। হয়ত ইচ্ছে  করে। হয়ত ততটা সচেতন ইচ্ছা নয়, কিন্তু অবচেতনে শুনতে চায় না। তেমনই কেয়া ভেবেছিল, ওর গলার জড়তাটাও হয়ত বলার মতো কিছু নয়। হয়ত রোগ  নয়, অনীহা। গলায় তেমন ব্যথা নেই। শুধু একটা চাপ। অথচ একদিন সকালে গলা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল।

কেয়া ভয় পেল। মেসেজ করল রথীকে। ‘আর্জেন্ট। লস্ট মাই ভয়েস’। ডেলিভার্ড  হল। এবার নীল টিকের অপেক্ষা। কেয়ার কান্না পাচ্ছে। নেগলেক্ট করা উচিত হয়নি। কবে থেকে হচ্ছিল কষ্টটা? এক সপ্তাহ? পনের দিন? এক মাস? মনে হয়, দিন পনেরই হবে। আশ্চর্য! পনের দিনেও সে কেন বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাল না? একটা লেপ্টে থাকা অস্বস্তি ছাড়া আর কোনো অনুভূতি হল না কেন? কেন তড়িঘড়ি সেরে ওঠার বোধ কাজ করল না?  স্বরের কি তার আদৌ প্রয়োজন আছে?

এই যে এখন সে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ঢোকাচ্ছে, একটু আগে রসুন কুচছিল, তারও আগে সেঁকছিল পাঁউরুটি, স্বর তো কাজে লাগছিল না কোথাও। ওয়াশিং মেশিনটা গোঁ-ও-ও শব্দে চলতে শুরু করল। ওটা কি ওর স্বর? নাঃ, ওটা গা-গতর নাড়ার শব্দ। যেমন কেয়া হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, তাই চটির ফটফট, চুড়ির টুংটাং। তেমনই ওয়াশিং মেশিনটার চলার একটা শব্দ আছে, স্বর নেই। কিংবা মিক্সি। শুনলে মনে হবে খুব তর্জন-গর্জন। আসলে একঘেয়ে কেজো আওয়াজ।  যেটুকু শব্দ মেনে নেওয়া যায়, কাজের স্বার্থে। এর বেশি শব্দ কি প্রত্যাশিত?

স্বর রুদ্ধ হলে, তেমন কিছু বাড়া-কমা হবে কি? টুকরো যা কিছু কথাবার্তা, রথীর সঙ্গে, মেসেজেই সেরে নেওয়া যায়।

আদা এনো।

চা-পাতা ফুরিয়েছে।

ওষুধ।

ফিরতে কত দেরি?

আজ খিচুড়ি খাবে?

এগুলো লিখেই বলা যায়।

শাশুড়ি কথা বলেন না দীর্ঘদিন। বেড রিডেন। ইশারা করেন। দুবেলার দুই নার্স আছে তাঁর। তবু খোঁজ নেয় কেয়া। উনি ইশারা করেন। এবার নাহয় কেয়াও ইশারা করবে। তাতেও খুব একটা অসুবিধে হবে না।

আর আছে বাবা-মা। ফোনে কথা হয়। স্বর বন্ধ হলে, হবে না। বাবা মেসেজ করতে পারে। হোয়াটস্যাপেও। যোগাযোগ থাকবে। মা অবশ্য পারে না ওসব,  কিন্তু বাবা মাকে দেখিয়ে দিতে পারবে। বাবা-মাকে কি বলা উচিত হবে রোগটার কথা? বয়স হয়েছে ওদের। থাক!

মায়ের কথায় মনে পড়ল... তখন মনে হয় ক্লাস ফাইভ। নতুন স্কুল। লোকাল ট্রেনে যেতে হয়। মা নিয়ে যেত-আসত। লেডিজে। কাজের মাসিরা গলা ছেড়ে  গান করে, কোরাসে। ঝগড়াও করে। বড় জোরালো স্বর তাদের। একবার বৃষ্টিদিনে খুব আমোদ হয়েছিল। জানালার ধারে বসে ক্লাস ফাইভের কেয়াও খুব চিল্লিয়ে গান গেয়ে ফেলেছিল। ‘আব কে সাওন’। মা হিসহিস করে বলেছিল, ‘পাব্লিক প্লেসে এত জোরে গাইছ কেন? কাজের মাসিদের মতো?’ সেই প্রথম কেয়া লক্ষ্য  করেছিল, ভদ্র মেয়েরা সত্যি অকারণ জোরে গায় না পাব্লিক প্লেসে।

গান শিখত কেয়া।  মা-ই ভর্তি করেছিল। ভালই গাইত। কিন্তু গান গাওয়ার শালীন স্থান ও কাল সম্পর্কে সচেতন হয়ে যাওয়ার পর থেকে গাইতে ভাল  লাগত না। ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত পরীক্ষা দেওয়া হয়েছিল। এর বেশি কিছু কে-ই বা  চেয়েছিল? তার স্বর চাওয়া হয়নি।

আর একবার বাবা আর জেঠু খেতে বসেছিল। ভীষণ কঠিন আলোচনা। কেয়ার ক্লাস সেভেন। বাজপায়ীর মন্ত্রীসভা। একবার সুযোগ দিয়ে দেখা যাক! সেখান থেকে সামাজিক ইস্যু। ক্রমবর্ধমান ডিভোর্স।  ‘এই যে মেয়েরা এত শিক্ষিত  হচ্ছে, উপার্জন করছে, তাই ডিভোর্সও বাড়ছে’।

কেয়া বাবার ডলপুতুল। জেঠুর চোখের মণি। দাদারা না পারলেও, কেয়া বড়দের মধ্যে কথা বলতে পারে। বেমক্কা বলল, ‘পড়াশোনা করলে যদি ন্যায়-অন্যায়  বুঝতে পারে, তাতে যদি বিয়ে না টেকে, কী করা যাবে?’

বাবা-জেঠুর হাতের নড়াচড়া থামল থালার উপর। বাবা বলল, ‘বড় বেশি কথা বলছ আজকাল!’ তার স্বর চাওয়া হয়নি।

টিক নীল হয়েছে। রথীজিৎ টাইপিং। 

- প্লিজ কাম ক্লিন।

-কথা বলতে পারছি না।

-ঠান্ডা লেগেছে? গলা বসে গেছে?

-নো।

-সিন্স হোয়েন?

-টুডে মর্ন।

-ইউ ডিন্ট টেল মি।

-ডু উই টক? এভার? ইন দ্য মর্নিং?

-দেখছি। ইএনটি অ্যাপো নিচ্ছি।

রথী এরকম। বিষয় অতিনাটকীয় হয়ে ওঠার আগেই থামিয়ে দেয়, ভাগ্যিস! ‘ডু উই টক? এভার?’ অভিমান অভিমান ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণ নাকে এলেই রথী নাক বন্ধ  করে নেয়, কানও। শালীন নির্লিপ্তি প্রতিষ্ঠা পায়।

‘চোকিং অফ ভয়েস’ লিখে গুগল সার্চ করে কেয়া। তারপর ‘লস অফ ভয়েস’ লেখে। ভোকাল নোডিউলস হতে পারে কি? সার্জারি হয়ত লাগবে।

কলিং বেল বাজে। নার্স এল। কেয়া দরজা খোলে। মেয়েটি হাসে। কেয়াও হাসে।  এটুকু বিনিময়েই কাজ চলে যায়। কেয়া লক্ষ্য করে, মেয়েটি যেন ক্লান্ত। প্রথমবার খেয়াল করে, কোনোদিন জানতে চায়নি, তার বাড়িতে কে কে আছে। নার্স বদলে বদলে যায়। সবার খবর রাখা হয় না। কিন্তু হতে পারত। শাশুড়িমাকে ধুয়ে-মুছে মলম লাগিয়ে, ওষুধ খাইয়ে মেয়েটি একা বসে থাকে চেয়ারে। খাবার খায়। কেয়া তখন রাঁধে, ঘর গোছায়, কাপড় ম্যালে। এবং খাবার খায়। তারা মুখোমুখি বসেনি  কখনও, খায়নি একসাথে। যদিও মেয়েটি কেয়ার মতোই ক্লান্ত। কেয়া ভাবে, দু’ দণ্ড গল্প করা হয়নি কেন? ক্লান্তি ভাগ করা হয়নি কেন? স্বর থাকতে থাকতে? অবশ্য মেয়েটিও বড় একটা কথা বলে না। ওর স্বর ভালো আছে? ওর স্বর আছে?

রথীজিৎ এবছর মহিলা প্রজেক্ট-হেড পেয়েছে। খানিক খাপ্পা থাকে আজকাল।  মহিলা নাকি তেরিয়া খুব। তেরিয়া মানে কী? যার স্বর আছে? সুচেতনা ডাক্তারি করে, গাইনো। ওরও স্বর আছে। গলার ব্যাপারে ওকে একবার পিং করলে হয়।স্কু লে দুজন কাছাকাছি নম্বর পেত। সুচেতনা ডাক্তারি পড়তে গেল আর কেয়া নিল কেমিস্ট্রি অনার্স।

কলেজের দ্বিতীয় দিনে সিনিয়ররা এসেছিল। মিছিলে হাঁটতে বলেছিল।  ক্লাসের সামনে দিয়ে মিছিল যাবে যখন, ক্লাস থেকে বেরিয়ে, মিছিলের লেজখানি ধরে দাঁড়াতে হবে। দাদারা যেমন যেমন স্লোগান দেবে, তেমন তেমন আওড়াতে হবে পিছন থেকে। আলাদা স্বর সেখানেও চাওয়া হয়নি। জমি বা মগজ কেন বলপূর্বক অধিগ্রহণ করা জরুরি? এইসব বেখাপ্পা প্রশ্ন অথবা স্বর, যা দ্বন্দ্বমূলক, তা বিপত্তি ডেকে আনে।

ইউনিভার্সিটির সময়েই রথীজিৎ মাকে নিয়ে দেখতে এসেছিল। বিশেষ স্বর না  থাকায় কেয়াকে তাঁদের মনে ধরেছিল। আনতচক্ষু, আড়ষ্ট আর লাজুক। অথচ, কেয়া তো অমনটা নয়, যেমন তাকে দেখায়। তার মাথার মধ্যে কথা ঘোরে। কথা। মতামত। ইচ্ছে। অনিচ্ছে। সেদিনও ঘুরছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল, রথীজিৎ-এর হাসিতে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। কিংবা কেমিস্ট্রি ক্লাসে রান্না শেখায় না।  নিজের মগজের মধ্যে অনবরত কথা বলছিল কেয়া। শুধু সেগুলো  জিভ বেয়ে গড়াচ্ছিল না। অনেকদিনই বন্ধ হয়েছিল কথার ধারা। যেন অন্ধকার ঘরে থেকে থেকে তাদের গায়ে এত মরচে ধরেছে যে, এখন হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলেও  তাদের চিনতে পারবে না স্বয়ং কেয়াও। তবু আফসোস হয়, কেন কথা বলেনি, স্বর হারিয়ে ফেলার আগে?

সুচেতনা ওকে ভোলেনি। চটজলদি উত্তর দিয়েছে।  নিজের হাসপাতালেই ইএনটি-র ডাক্তারের অ্যাপো দিতে চাইছে। কিন্তু রথী যে বলেছে অ্যাপো নেবে অন্য কোথাও! নিজে উদ্যোগী হয়ে ডাক্তার দেখালে কি রথী রাগ করবে? কেয়া থমকায়। সুচেতনার থেকে সময় চেয়ে নেয় একবেলা। রথীকে মেসেজ লেখে, ‘আমি অ্যাপয়মেন্ট অ্যারেঞ্জ করছি, তুমি আর কোরো না’। ব্যাকস্পেস টেপে।

অপেক্ষা করা যাক। যা করতে কেয়া অভ্যস্ত। রথীর কল ব্যাক করার, মেসেজের রিপ্লাই করার, বাড়ি ফেরার। অপেক্ষা একটি নিষ্ক্রিয় ক্রিয়া। অপেক্ষায় স্বর লাগে না। অপেক্ষার অবসরে কেয়া স্নান সেরে নেয়। শাওয়ারের তলায় অনাবৃত কেয়া হাঁ-মুখ হয়। জল তার জিভ বেয়ে গলায় পৌঁছয়। চাতকের প্রায় কেয়া জলকে গ্রহণ করে। জলের লীনতাপ কি বরফ-জমা কথাকে গলাতে পারে? কেয়া কথা বলতে চায়। ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে কান্না বেরোয়। কান্না আর শাওয়ারের জল মিলে সিঞ্চন করে অব্যক্ত কথাদের। 

*****

কেবিনটা ঠাণ্ডা আর আরামদায়ক। টোয়াইন শেয়ারিং। বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার পর ভর্তি হয়েছে কেয়া, যাতে নিরিবিলি পাওয়া যায়। সুচেতনার হাসপাতালেই ব্যবস্থা ৷ রথীকে শেষ পর্যন্ত মেসেজটা পাঠিয়েছিল কেয়া। অবাক হয়েছিল রথী। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বোধ করেছিল। কিন্তু এই নিয়ে বখেড়া খাড়া করতে তার ভদ্রতায় বেধেছিল। একাই গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছিল কেয়া। মেসেজে জানিয়েছিল আসন্ন সার্জারির সংবাদ। রথী আরও  অবাক হয়েছিল। স্বরহীন হওয়ার পরেই কেমন সশব্দ হয়ে উঠেছে কেয়া!

রথী আজ এসেছে অফিস-ফেরত। কথা বলছে সুচেতনার সঙ্গে। সে কর্তব্য-সচেতন, সন্দেহ নেই। কেয়াকে প্রথামতো শুভেচ্ছা জানিয়ে সে বিদায় নেয়। কাল আবার আসবে বিকেলে। ততক্ষণে অপারেশন হয়ে যাবে। ছোট  মাইক্রোল্যারিঞ্জোস্কোপি। তারপর কেয়া স্বর ফিরে পাবে। সম্ভবত। বায়োপসি বাকি থাকবে। কিন্তু ক্যান্সারাস নয় এই বৃদ্ধি। সম্ভবত।  বাড়ি ফিরবে রথীর সঙ্গে কেয়া। সম্ভবত।

রথী চলে গেলে ভারি ডিভাইডার পর্দাটা টেনে দেয় কেয়া। ওপাশের বৃদ্ধা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কী আশ্চর্য, পর্দা টেনে দেওয়ার পর অর্ধকেবিন একান্ত একটি স্পেস হয়ে যায়! একটি খাট, একটি সাইড টেবিল।  টেবিলে নিজস্ব দুটি বই। হ্যাঙারে নিজস্ব টাওয়েল। এক রাতের নিজস্ব ঘর।

আর সে রাতেই অলৌকিক বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টিতে সুদূরের গন্ধ থাকে। সমুদ্র সৈকতের বাতাস বয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে কেয়া ভাবে, স্বর ফিরে পেলে সে কী বলবে? কোন সে কথা, যা বলার জন্য স্বর ফিরে পাওয়া? সম্ভবত ‘না’ বলবে সে। সা আর পা-এর অচলস্বরে স্কেল স্থির ধরে, সে নানা স্বরে 'না'-বলার রেওয়াজ করবে, ভাবে কেয়া।

তাজপুরের সমুদ্রসৈকতে একটা কেয়াগাছ ছিল। গায়ে গন্ধ জেগে উঠলে সে গাছ সাপেদের হাতছানি দিত। তখন তার কাছে ঘেঁষত না কেউ। অথচ কী মাতাল  গন্ধ! বৃষ্টিদিনের বাতাস সেই গন্ধ বয়ে আনলো কি? গন্ধ জেগে উঠলে গাছ অধরা হয়ে যায়।

 

 

4 কমেন্টস্: