কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল

            

(দ্বিতীয় পর্ব)

 

উত্তরা-পূরবী-ঊজ্জ্বলা

 

ঊজ্জ্বলা




মা’র স্মৃতিচারণের খাতা থেকে জানতে পারলাম যে ১৮ই জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে ‘সখের চোর  দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভবত এটিই আমার ‘দেখা’ প্রথম বাংলা ছবি, যদিও আমার কিছুই মনে  নেই! প্রেক্ষাগৃহ হয়তো কালিঘাট অঞ্চলে অধুনালুপ্ত ঊজ্জ্বলা, যেখানে উত্তরা ও পূরবীর সঙ্গে ছবিটি ঐ বছরের ৩০শে জুন মুক্তি পায়। সাম্প্রতিক ছবিটি আমার শ্যালকের কল্যাণে কম্পিউটারে দেখেছি। ইংরেজী ভাষায় কৌতুক রচনার সম্রাট পি জি উডহাউসের A Gentleman of Leisure (বিকল্প নাম The Intrusion of Jimmy) উপন্যাসের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি রূপান্তর। মুখ্য চরিত্রে উত্তমকুমার যথারীতি মুগ্ধ করেছেন। নায়িকা (বাসবী নন্দী)-র সঙ্গে তাঁর পরিণয়ের পথে দুই বাধা হিসেবে, নায়িকার বাবা (কমল মিত্র) আর নায়িকার ভগ্নীপতি (ছবি বিশ্বাস) তো দুজনেই তুখোড় অভিনেতা। এছাড়া সখের চোর উত্তমের পাশাপাশি পেশাদার চোর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপভোগ্য অভিনয় করেছেন।

বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার জন্য ১৯৫৯ থেকেই আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল ভবানীপুর-কালিঘাট। আর সেখানকার বাংলা ছবির পাড়ায় রবিবার সকালে দেখানো হতো, পূর্ণ আর বসুশ্রীতে, ইংরেজী ছবি, ঊজ্জ্বলায় সাধারণত দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। ব্যতিক্রম-হিসেবে ঊজ্জ্বলা এক রবিবার আনে আমার দেখা প্রথম Western: ১৯৫৮ সালের The Lone Ranger and the Lost City of Gold । ‘লোন রেঞ্জার-এর কমিক্স বাড়িতে প্রচুর  ছিল, দাদা সেগুলোর থেকে ছবি দেখিয়ে আমায় গল্প বলতেন। তিনিই ছবিটি দেখতে আমায় নিয়ে যান, আমার বয়স তখন ৫ বা ৬। মনে আছে পর্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোন রেঞ্জারের সাদা ঘোড়া ‘সিলভার’  আর নেপথ্যে দরাজ গলায় গান হচ্ছে, “Hi yo Silver Away!” তারপর লোন রেঞ্জার সিলভারের পিঠে চেপে ধাওয়া করেছে আততায়ীদের, বার করেছে তার রূপোর বুলেট-ভরা রিভলভার, দাদা বলছেন, “দেখ, দেখ, লোন রেঞ্জার বন্দুক বার করেছে!” তার পরেই রিভলভারের নল দিয়ে ধোঁয়া আর “দুম!” কাহিনির মূল প্রতিপক্ষ এক মহিলা, যিনি স্বর্ণনগরের খোঁজে নিজের দলের লোককেও পেছন থেকে pickaxe ছুঁড়ে নির্দ্বিধায় খুন করেন! সবশেষে লোন রেঞ্জার আর তার লাল-মানুষ বন্ধু টোন্টো আবিস্কার করবে সোনার শহর! এক চমকপ্রদ দৃশ্য!

১৯৬৭-র আগস্টে ঊজ্জ্বলায় মা’র সঙ্গে দেখি বাংলা ছবির তিন কৌতুক-তারকা ভানু-জহর-হরিধন  অভিনীত মিস প্রিয়ম্বদা। তরুণকুমারের প্রেমিকা লিলি চক্রবর্তী। তাঁদের মধ্যে অন্তরায় মেয়ের মামা হরিধন। মামাকে রাজী করাতে লিলির গৃহশিক্ষিকা ‘মিস প্রিয়ম্বদা সেজে আসেন ভানু। হায়, ‘প্রিয়ম্বদা’ নিজেই প্রেমে পড়ে যান লিলির বান্ধবী দীপিকা দাসের! আর মামা হরিধন প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন ‘প্রিয়ম্বদা’-র! শেষে, ‘প্রিয়ম্বদা’ তাঁকে বিয়ে করবে, এই আশ্বাস পেয়ে মামা ভাগ্নীর  বিয়েতে মত দেন। জোড়া বিয়ের দিন গাঁটছড়া-বাঁধা ‘প্রিয়ম্বদা’-র দিকে পেছন ফিরে মামা যখন ভক্তিভরে ঠাকুর প্রণাম করছেন, সেই সুযোগে গাঁটছড়া খুলে চম্পট দেন ভানু, আর স্থানীয় ছেলেদের একজন (নাকি জহর রায়? ঠিক মনে নেই!) মামার গাঁটছড়ায় বেঁধে দেয় একটি তরুণ কদলী! উদভ্রান্ত মামাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আর তরুণ-লিলির বিয়ে হয়ে যায়। ছবিটি কিন্তু তেমন দর্শকানুকূল্য পায়নি। যেদিন দেখতে যাই, হয় সেদিনই, বা অব্যবহিত পরে প্রিয়ম্বদা-কে তুলে নিয়ে, নতুন ছবি আনার আগে কিছুদিনের জন্য দেখলুম আনা হবে, সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, ১৯৫৮ সালের পুরনো ছবি।

ঐ ১৯৬৭তেই দেখেছি সেই ঊজ্জ্বলায় ‘৮০তে আসিও না’। আমার দেখা বাংলা হাসির ছবির মধ্যে  বোধহয় এটিকেই আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বলব (জানুয়ারীতে মুক্তি পায়)। বৃদ্ধ পিতামহ ভানু এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পুকুরের জলে পড়ে গিয়ে তাঁর যৌবন ফিরে পাবেন, যার ফল তাঁর পরিবারের পক্ষে হবে দর্শকের পক্ষে দম-ফাটা হাসির খোরাক। ভানুর দুই পুত্রের চরিত্রে কমল মিত্র এবং অসিতবরণ, ভানুর বিমূঢ় স্ত্রী রুমা গুহঠাকুরতা। এছাড়া আছেন জহর রায়, রবি ঘোষ, তরুণকুমার, শ্যাম লাহা প্রমুখ। অবশ্য শেষে দেখব সবটাই সংসারে অবহেলিত, পূত্রবধূ / নাতিদের দুর্ব্যবহারের শিকার ভানুর স্বপ্ন!১৯৬৭ সাল নাগাদ আমার ইস্কুল সেন্ট লরেন্সে আমাদের থেকে উঁচু ক্লাসে পড়া এবং এখন প্রয়াত রমাপ্রসাদ বণিক ইস্কুলে সাড়া ফেলে দেন ‘পান্না ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় ক’রে। মার্ক টোয়েনের ‘টম সয়ার’ উপন্যাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত এই দারুণ ছবিটিতে ডাকাত অঘোর সর্দারের  ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত শম্ভু মিত্র। দশ বছর বয়েসে তাঁকে ওই চেহারায় এত ভয়ঙ্কর লেগেছিল যে পরে অন্য অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখে বিশ্বাস হয়নি যে তিনিই সেই খুনে ডাকাত! ছবিটি দেখি ঊজ্জ্বলায়। এরপর, বোধহয় ১৯৬৮-তে ইস্কুল থেকেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি  দেখানোর ব্যবস্থা হয়। তখন ওটি দ্বিতীয়বার দেখি।

১৯৭১-এ প্রথম বাংলা ছবি ঊজ্জ্বলায় ‘ধন্যি মেয়ে’, এবং জয়া ভাদুড়ীর চেয়েও নজর কেড়ে মুগ্ধ করেছিলেন হাসির চরিত্রের ভূমিকায় উত্তমকুমার! ফুটবল-পাগল বড় ভাই, ঘুমে মহাদেব এবং হবু-বেয়ানের (যদিও শেষ অবধি বগলা-রূপী ভাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে হবে মনসা-রূপী জয়া ভাদুড়ীর সঙ্গে!) সঙ্গে খেলতে-খেলতে মারবেন শট, খাট থেকে ছিটকে পড়বেন স্ত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, আর তারপর স্বামীর প্রশ্নের – “তুমি পড়লে কি করে?” – উত্তর দিতে লজ্জাবোধ করবেন। উত্তমকুমারের টিমের কাছে এক ডজন গোল খেয়ে হাড়ভাঙা গ্রামের ক্ষিপ্ত জমিদার ন্যাংটেশ্বর চৌধুরীর ছেলে (রূপায়ণে জহর রায়) বন্দুক উঁচিয়ে বগলার বিয়ে দেবেন ভাগ্নী (বা ভাইঝি) মনসার সঙ্গে, বিয়েতে তোতলা পুরোহিত রবি ঘোষ (তিনি ম্যাচের রেফারীও ছিলেন) মন্ত্রের লং-প্লে রেকর্ড বাজাতে গিয়ে ভুল করে যেদিকে বিয়ের মন্ত্র আছে, তার বদলে উল্টোদিকের শ্রাদ্ধের মন্ত্র বাজাবেন, এই জবরদস্তী বিয়েকে ভাসুর উত্তমকুমার আখ্যা দেবেন “অফসাইডে গোল!” – এককথায় অনবদ্য!

আর একটি বিশেষ ‘এপিসোড’ চিনতে পেরে মজা পেয়েছিলাম। মনে করুন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের  অসুস্থতার জন্যে বাড়ীতে ডেকে আনা হয়েছে ডাক্তাররূপী তরুণকুমারকে। রুগীর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর মাঝে-মাঝেই দরজা খুলে ডাক্তার চাইছেন হাতুড়ী, করাত, শাবল। ক্ষেপে গিয়ে উত্তমকুমার হুংকার ছাড়লেন, “বৌটাকে কেটে ফেলবে নাকি!” প্রত্যুত্তরে ডাক্তার, “আরে দূর মশাই! ওসব চাইছি আমার ব্যাগটার জন্যে! কিছুতেই খুলতে পারছি না যে!” এতো পূজাবার্ষিকীতে পড়া শিবরাম চক্রবর্তীর ‘রাম-ডাক্তারের ব্যায়রাম’! তাছাড়া এ ছবিতে আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এতে অবশ্য উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দী দেখিনি!

আমার মা ছিলেন শ্রীঅরবিন্দের ভাবধারার অনুগামিনী। এর জন্যে একাধিকবার তিনি গেছেন পণ্ডিচেরীর আশ্রমে। ১৯৬৯ সালে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অতএব ৭১-এর অক্টোবরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’ তো ঊজ্জ্বলায় দেখতেই হবে! ছবিটি দর্শকানুকুল্য পায়নি, এবং  বোধহয় শেষ দিনেই দেখতে যাওয়া হয়েছিল। ঢোকার সময় উৎসাহিত হলাম দেখে যে সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! তাঁর কণ্ঠে ছিল একাধিক গান, ‘বন্দে মাতরম’, রবীন্দ্রসঙ্গীত, এবং সুনীলবরণের লেখা দেশাত্মবোধক গান। কিন্তু ছবিটি মনে ধরেনি কারুরই, কারণ পরিবারের ঝোঁক ছিল ঋষির  আধ্ম্যাতিক জীবনের দিকে, আর ছবিটি, বাণিজ্যিক কারণেই, জোর দিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা নিয়ে। সেখানে, বাঈজী শমিতা বিশ্বাসকে স্বদেশী আন্দোলেনের সঙ্গে যুক্ত করা, তার জন্যে অত্যাচারী পুলিস অফিসার শেখর চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তার লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হওয়া, এসব ঠিক মনে ধরে নি, আর এসব দেখিয়েও ছবিটি বাজার পায়নি।

সত্তরের দশকে, মা’র উৎসাহেই ঊজ্জ্বলায় দেখেছিলাম প্রাক-উত্তম যুগের ছবি ‘শেষ উত্তর’, অভিনয়ে প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, যমুনা বড়ুয়া, অহীন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ। কানন দেবীর ভক্ত হিসেবে তাঁর অভিনয় ও স্বকণ্ঠে গান (ছোটবেলা থেকে রেকর্ডে শোনা ‘তুফান মেল’, ‘লাগুক দোলা’, আর আমার কাছে সর্বোপরি ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাকো কারও ছবি’) খুব ভালো লেগেছিল। এর  বাড়া নজর কেড়েছিলেন এক আপাত উগ্র-আধুনিকা অথচ অন্তরে আত্মত্যাগী, হৃদয়বতী মহিলার ভূমিকায় যমুনা বড়ুয়া।

সম্ভবত ১৯৭৬-এ মধ্য কলকাতা ছেড়ে লবণ হ্রদ / বিধান নগরে বাড়ি বদলাবার আগেই ঊজ্জ্বলায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর মাসে আমার এক পিসতুতো বোনের সঙ্গে দেখেছিলাম ১৯৫৭ সালের ‘কাবুলিওয়ালা’, নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস এবং পরিচালনায় তপন সিংহ।

উত্তরা




১৯৮০তে হাতিবাগান-শ্যামবাজারে অধুনালুপ্ত উত্তরায় দেখেছিলাম তপন সিংহের ‘বাঞ্ছারামের বাগান’।  সম্পূর্ণ নতুন ধরণের, অভিনব গল্প, আর মনোজ মিত্রের অবিস্মরণীয় অভিনয় নাম-ভূমিকায়! অবাক এবং বিরক্ত হয়েছিলাম যখন শুনলাম যে এই ছবিতে অভিনয়ের জন্যে পুরষ্কার পেয়েছেন ন’কড়ি-ছ’কড়িরূপী দীপঙ্কর দে! আর খুব কষ্ট হয়েছিল যখন জানলাম যে উক্ত দু’টি চরিত্র করার কথা ছিল উত্তমকুমারের! উত্তম-মনোজের যুগলবন্দী বাংলা ছবিতে ইতিহাস সৃষ্টি করত! তবে মাধবী দেবী বড্ড মোটা দাগের ভাঁড়ামি করেছিলেন, যা রবি ঘোষ, নির্মলকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাশে বেশ বিসদৃশ লেগেছিল।

পূরবী




১৯৮৯-তে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, এবং তখন আমারই মতো অধ্যাপনা-রত, স্বপন শীলের সঙ্গে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে পূরবী সিনেমায় দেখি সতীদাহ নিয়ে ছবি ‘অন্তর্জলি যাত্রা’। ছবির অভিনবত্ব, বাংলা সিনেমায় শত্রুঘ্ন সিংহের উপস্থিতি। তা’তে অবশ্য, বন্ধুবরের ভাষায়, অন্তর্জলি জলাঞ্জলিতে পরিণত হওয়া আটকায়নি! মিনারে ‘সতী’ দেখে এর আগের পর্বে যা লিখেছিলাম তাঁর পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হচ্ছিঃ সতীদাহের মতো জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে দুই ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ ছবির পরিচালক যে কীভাবে দুটি দেখার অযোগ্য ছবি বানালেন তা সত্যিই সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের উদ্রেক করে!

আজ এই পর্যন্ত। এর পরের পর্বে শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা।

 

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন