কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

উপল মুখোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


তিল বাড়ি

এখানে শীতেও সূর্য দেখা যায়। ফুল ফোটে তখনও। ফল হয়। তাই বসন্ত আর গরমের দিনে সংগ্রহ করে রাখতে হয় না শীতের দিনে গরম থাকার, ভালো থাকার ফল। গরমে এখানে হাঁসফাঁস করতে দেখা যাচ্ছিল সবাইকে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি এল। তখন মায়া বাগানে যাচ্ছিল মামীর সঙ্গে। বাগানে গরমের নানারকম ফল আছে সে সব খেলে শরীর ঠাণ্ডা হবে। সেগুলোকে গরমের সব্জি বলে যা গরমে মেলে আর গরমেই খেয়ে ফেলতে হবে তবে শরীর জুড়োবে। মামীমার ঠোঁটটা পুরু হতে গিয়ে তারপর কেমন যেন পাতলা হয়ে গেছে। সে সুন্দর হাসে আর হাসলে ঝকমকে দাঁত দেখা যায়। মায়া মাঠে যাবে বলে বড়ো ধরেছে মামীমাকে। তারা হাঁটা আরম্ভ করে দিল আর সে সময়ই বাজ পড়ল, কালো কালো আকাশ দিয়ে চিরে গেল গা। আওয়াজ বড়ো কথা নয় ঠাণ্ডা হাওয়াটাই বড়ো কথা ছিল তবে বৃষ্টিও তাড়াতাড়ি এসে পড়ায় ওরা একটু আটকে গিয়েছিল। সেটা দেখে ফেলল বড়ো কত্তা। সে এই বিয়ে বাড়ির তদারকিতে বেরিয়েছিল বিকেলে।  তার গায়ে একটা ফুল হাতা গেঞ্জি ছিল। এইরকম  গেঞ্জি গায়ে  তাকে   সকালে একবার, বিকেলে একবার বেরতে দেখা যায়। সে আলের উপর দিয়ে এইরকম ভাবে হাঁটে। দিনের বেলা তার মাথায় একটা টুপি দেখা যায়। ক্রিকেটের টুপি। সেটা ছেলে কিনে দিয়েছে। আর সেটা রোদ্দুর শুষে নিতে পারে। তখন বড়ো কত্তার অনেকটা হাল্কা লাগে। সে আলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে নানান জমির হাল হকিকৎ দেখে তার মধ্যে তার নিজের জমিও আছে। মায়া আর মামীমাকে দু একটা ফোঁটা বৃষ্টিতে একটু ভিজতে  দেখে বড়ো কত্তা বলে, 'তোমার কী আক্কেল জ্ঞান নেই গো?' মামীমা বলল, 'কেন?' আর সেই সময় বাজ পড়ায় বড়ো কত্তা আরো চমকে গেল। সে উঁচু হয়ে আঙুলের ওপর ভর দিয়ে গোড়ালি তুলে দেখছে কোথায় বাজ পড়েছে। বাজ পড়ে মাটিতে সেধিঁয়েছে আবার বাজ পড়ার অপেক্ষা, মামী বলল, “কেন আক্কেল থাকবে না কেন?” বড়ো কত্তা বলল, “দেখে তো মনে হচ্ছে না। এই চিড়িক বাজ পড়ছে আর তুমি মেয়েটাকে নিয়ে চললে। ভালোমন্দ হলে আমি কী জবাব দেব?” মামী চুপ থাকে আর মায়া বোঝে তাকে নিয়েই যখন কথাবার্তা হচ্ছে একটু কইলে হয়, সে বলল, “কিছু হবে না মেসোমশাই।” বড় কত্তা বলে, “তুমি বুঝবে না মায়া। তোমরা শহরের লোক। আকাশ দেখেই আমরা বুঝি।  আজ খুব ঘনিয়ে এসেছে, এর মধ্যে মাঠে ঘাটে ঘুরতে নেই।” মামী অস্ফুটে বলল, “বুড়োটা এলো কোত্থেকে”। বড় কত্তা শুনতে না পেরে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে চলল সামনের জলাজমির দিকে। মামী বলে, “এসো দেখি পুকুরের ও পাড়টা ধরি।” মায়া বলল, “দেখে ফেলবে না তো?”

-বুড়ো গেছে আলু বাড়িতে।

-আলুর বাড়ি হয় না কি?

-হয় হয়।

-আমি তো জানতাম না।

-শহরে থাক বলে সব জানবে?

-জানব না?

-না, মাঠ ঘাটের, চাষের জানবে কী করে?

-তা বটে।

মায়া, মামীমার নেওটা হয়ে গেছে।দূর গ্রামে আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে এসেছে গাড়ি করে। তিন চার ঘন্টার দূরত্ব। আসতে আসতে সাদা সাদা ফুল দেখেছিল। মাঠে, মাঠে ফলে আছে। অনেক ফুল দেখতে দেখতে আবার ফুল হাওয়া হয়ে যায়। তখন আর ফুল দেখা যাবে না। তখন মাঠও হাওয়া হয়ে যেতে পারে। তখন দেখা যাবে খুব হাওয়া দিচ্ছে আর বাড়ি ঘর দোকানপাট এসবের মধ্যে দিয়ে হাওয়া পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলছে, “ফুল দেখাবো এক, ফুল দেখাবো না।” এই করতে করতে ঘর বাড়ি দোকানটাও পালিয়ে যাচ্ছে গাড়ির গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে। বাজারের দল চলে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে দ্রুত। কেবল গাড়ি চলছিল খুব জোরে বলে খানিকক্ষণ দেখা দিয়েই আবার সাদা সাদা ফুল পালিয়ে যাচ্ছিল। মায়া তার বরকে বারবার বলে উত্যক্ত করছিল, “কী ফুল বল না।”

-কই?

-ওই তো

-কই কিছু দেখতে পেলাম না।

-তোমার দ্বারা হবে না। ওই দেখ, দেখ।

-কই?

-যাঃ। দেখলে না তো।

-দেখতেই পাচ্ছি না।

-কিস্যু হবে না তোমার দ্বারা।

-ওটা সরষে ফুল।

-তোমার মুণ্ডু। সরষে ফুল হলদে হয়। হলদে হলদে।

-তা হলে ওটার নাম সাদা ফুল।

-সাদা ফুল ?

-হ্যাঁ, যার রঙ সাদা। সেটার নাম সাদা ফুল। যার রঙ কালো তার নাম কালো ফুল।

-তা হয় নাকি, তুমি চেনোই না।

-চেনার দরকার নেই। সাদা ফুল। ওটা সাদা ফুল বলে সাদা।

মামীমাকে এই বিয়ে বাড়ির এক কোণে দেখেছে মায়া। সে দেখেছে মামীমা বসে আছে। সে দেখেছে ও কোনো কথা না বলে কাজ  করে চলে। তারপর দরজার বাইরে গিয়ে তাকায় মাঠের দিকে। সেই মাঠ তখন শুকনো । সেখানে বৃষ্টি আসবে বলে সব্বাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোথা থেকে বকেরা এসে বসে আছে।   সেই বকেরা বর্ষার খবর পেলে আসে আর ঘন  বর্ষায় তারা মাছ তুলে নিতে গিয়ে দু একটা গাছের তলায় ফেলবেই। সেই মাছ খাবার গল্প শুনল মায়া মাসীমার কাছ থেকে। কে এক লোক ছিল এখানে যে বকের ধরা মাছ খেত যেন। মায়া বলল, “গোটা থাকত মাছ?” মামীমা বলল, 'হ্যাঁ, তা থাকতই গোটা।" তারপর মায়া শুনে শুনে দেখছে তার অজানা সাদা ফুলের কথা। এই বাড়িতে, এই গ্রামে এলে মামীমা খুব ঘোরে আর অনেক দিন থেকে যায় সে কবে থেকে। সে বলে, “আজকাল আর অনেক দিন থাকার কথা ভাবতে পারি না গো।” বড় কত্তা সেই শুনে গরমে পিঠের ঘামাচি চুলকোতে চুল্কোতে বলেছে, “কেন গো চালের কী এত অভাব পড়েছে যে তোমার চলে যেতে হবে?” সেই শুনে সবাই সায় দিয়েছে এটা মায়া দেখছিল। তারপর সে শুনল ওই সাদা ফুল তিলের ফুল। মামীমা তাকে নিয়ে যাচ্ছে তিল বাড়ি। পথে বৃষ্টির হাওয়া দিচ্ছে আর বাজ পড়ছে চারদিকে। তারা তখন বড়ো কত্তার মুখোমুখি হল আর তিনি হনহনিয়ে হাঁটা দিলেন আলু বাড়ির দিকে। মামীমা আর মায়া  চলল পুকুরের কোণ ঘেঁসে ঘেঁসে সেখানে খানিকটা আঁধার মতো হয়ে আছে দিনের বেলা তার ওপর কড়াক্কর বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনটাও দুলে দুলে উঠছে মায়ার এই ভয় পথে যেতে যেতে। সেই ভয় কাটাতে সে অনবরত সাদা সাদা ফুলের কথা ভাবছে তো ভাবছেই। সে গুলো নাকি সাদা বলে তার নাম হতেই হবে সাদা ফুল। সে ফুলের রঙ অনুযায়ীই নাম হবে এই নাকি তার বরের ছিরির কথা। সে কথা শুনতে বড় বয়েই গেছে মায়ার। সে শুধু মামীর পেছু পেছু হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে যেতে থাকল তিল বাড়ির দিকে। সেখানে তারা সাদা ফুলেরা, তিলের ফুলেরা, অশেষ গুণ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে করে এই বাজের মধ্যে  বৃষ্টির আগে মাঠ পাহারা দিচ্ছে। অনেকটা আলের পথ ধরে এগিয়ে চলতে আরম্ভ করল মামীমা। তার দিকে হাত নেড়ে ডাকল, বলল, “আস্তে আস্তে এসো। দেখ মাঠের মধ্যে কতখানি হাওয়া দেয়।” মায়া দেখল পুকুরের ঝুপসি পাড় ছেড়ে, ছায়া ছায়া অঞ্চল ছেড়ে তারা বেরিয়ে পড়ে একেবারে খোলা মাঠের মধ্যে যেখানে অনবরত খালি যেন হাওয়া দিয়েই যাবে আর বাজ পড়বে এরকম একটা ঠিক করে দিয়ে গেছে কে? বড়ো কত্তা? কিন্তু তাকে তো দেখা যায় নি তারপর। সেই যে তিনি হনহনিয়ে গেলেন তারপর আর তাঁর চিহ্নটাও কোথাও নেই। মায়া মামীমাকে জিজ্ঞেস করল “মামী মেসোমশাইকে দেখছি না কেন?” মামী হাঁটতে হাঁটতে উত্তর করে, “দেখগে যাও আলু বাড়ি ছেড়ে এখন সরষে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। যা হাঁটার বেগ যেন হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাবে।”

-সে কি গো অনেক দূরে চলে গেলে ফিরবে কী করে?

-কেন?

-না এই বৃষ্টির মধ্যে।

-ওনার জন্য বৃষ্টি নেই।

-তাই?

মামীমা আর উত্তর করে না। তারা হাঁটতে হাঁটতে দেখে হাওয়া দিচ্ছে ভিজে ভিজে। দূরেই কোথাও বৃষ্টি হয়েছে অথচ দেখা যাচ্ছে না মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে কোন জল। বরং ভিজে ভিজে হাওয়ায় ধূলো উড়ে চোখে ঝাপটা লাগায় মায়া দাঁড়িয়ে গেল দেখে মামী বলে, “কী হল?” মায়া চোখ পিটপিটিয়ে আবার মামীর সঙ্গে হাঁটতে থাকল।

তারা অনেক দূর এসে তিল চাষের জমিতে উপস্থিত হল। সেই সাদা সাদা ফুলগুলো  বেশ বিঘে বিঘে হয়ে রয়েছে ঘন হয়ে। তারা দুলছে হাওয়ায় আর যেন জল আসার আগের আনন্দ উপভোগ করবে বলে সবাইকে ফুল নেড়ে নেড়ে ডাকছে। মামীমা বলল, “এই জায়গাটাকে বলে তিল বাড়ি।”

-বাড়ি?

-হ্যাঁ।

-বাড়ি কেন?

-বা রে, সবার বাড়ি থাকবে আর তিলের থাকবে না।

-তিলের বাড়ি।

-তিলের বাড়ি, আলু বাড়ি, সরষে বাড়ি সব চাষ দেওয়া হয়েছে যেখানে যেখানে, নয়তো চাষ দেওয়া হবে যেখানে যেখানে সবার নিজস্ব নাম।

মায়া অতি কাছে চলে গিয়ে তিলের ঘন বাগান, পাতলা বাগান দেখছিল। সেখান থেকে একজন মাথায় করে তিলের গাছ কেটে নিয়ে আসছিল যার মধ্যে সাদা সাদা ফুল ওঠা গাছও ছিল কি ? লোকটা একটা লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে পরে রয়েছে আর মাথায় তিলের ভিজে ভিজে সবুজ গাছ উপড়ে ঢিবি করে আনছে। মামী বলল, 'ওই দেখ। কেটে আনছে। তারপর শুকোতে দেবে। শুকিয়ে ঝাড়াই করে তিল বার করবে।” মায়া বলল, “বড্ড ওজন না? লোকটা আস্তে আস্তে হাঁটছে।” মামী বলে, “সে তো পঞ্চাশ ষাট চল্লিশ কিলো তো হবেই।” এমন সময় হাওয়া যেন বন্ধ হয়ে গেল আর বহু দূরে কোথাও বাজ পড়ল তারপর আর বৃষ্টির দেখা নেই। মাঠের এক কোণায় গাছের তলায় মামী আর মায়া বসে রয়েছে। মাঠের এক ধারে বাগান জমি আল পথে জোড়া। সেখানে অনেক গাছ লাগিয়ে লাগিয়ে বেশ ঘন হয়ে রয়েছে। এতক্ষণ সেখানে বেশ হাওয়ার দাপাদাপিও চলেছে। হঠাৎ সেখান হতে তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনে মামীমা বলল, 'কাঠ চেরাই হচ্ছে।'

-চেরাই?

-হ্যাঁ ইলেকট্রিক করাতের আওয়াজ।

-মটোরের না তো?

-আমি চিনি।

পেছন থেকে বড়ো কত্তার গলা শোনা গেল, “কী চেন শুনি।” মামী ঘাবড়ে না গিয়ে বলে, “আলু বাড়ি গেলেন না।” বড়ো কত্তা গামছা দিয়ে মুখ মোছে, “কত দিনের গাছটা কেটে ফেলল।”

-কেন?

-পাশের জমির ওপর বড় আওতা হচ্ছিল যে।

-সে কি! তা বলে!

-সে আর এখন শুনছে কে?

-যা বলেছেন।

-একি, এই মেয়েটাকে এতদূর হাটিয়ে নিয়ে এলে। তোমায় নিয়ে আর পারা গেল না।


মায়া দেখল মামীমার পুরু পুরু ঠোঁট জুড়ে হাসি খেলে গিয়ে সেই হাসি সামনের দুলতে থাকা তিলের গাছগুলোর সঙ্গে হাওয়ায় তাল দিচ্ছে। আর সেখানে সাদা সাদা ফুলেরা অনবরত ফুলের মতো করে, তাদের পুরু পুরু ঠোঁট ফুলিয়ে হেসেই চলেছে তো চলেছেই। বাগানের ঘন ঝোপের মধ্যে থেকে মাঝে করে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ইলেকট্রিক করাতের। তীক্ষ্ণ আওয়াজ করছে। সেই দেখে বাগানের বড় বড় গাছেরা গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক ছায়া ছায়া দিয়ে আওতা তৈরি করে চাষের অপরাধ করেছে যে গাছ বা না চাষের সেই অপরাধীকে চিরে চিরে কাটা হচ্ছে এ কথা শুনতে হচ্ছে সবাইকে। কিন্তু বড় কত্তার মতো মামীর কোন দুঃখ হচ্ছে না। সে হাসছে আর বলছে, “ওই জন্য এতো ভয় দেখালেন বাজের। গাছটাকে শেষ দেখা দেখতে আসছিলেন তো।  জানতেনই তো বৃষ্টি হবে না এই হাওয়ায়। চুপিচুপি আসতে চাইছিলেন। যাতে কেউ জানতে না পারে। তাই না?” বড় কত্তা উত্তর করে না। সে গাছের দুঃখে মাঠের মধ্যে বৃষ্টি আর ঝড়ের আগে হাঁটে—আর তিল বাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, সাদা ফুল দেখে।  কোন হাওয়ার তারা দোলে? আধ সবুজ আধ শুকনো তিলের গাছের ঢিপি মাথায় লোকটা ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে। তার দিকে তাকিয়ে ছিল মায়া আর সাদা ফুল খুঁজছিল মরা মরা তিল গাছের মধ্যে, হয়ত পেয়েও গেছিল একটা বা দুটো। তাতে কার বা কী এলো গেল। না গাছের না করাতের।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন