কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরী

 

সমকালীন ছোটগল্প


লাম্পট্য এবং বিবাহ

বাবা জিগ্যেস করলেন, তা সঙ্গে যাবার বন্ধুবান্ধব জুটেছে তো?

—হ্যাঁ, প্রফেসর অম্বরীষ কর্মকার আর ওনার ছয় ছাত্র-ছাত্রী  সঙ্গে যাবে, যারা আইটি ইনডাসট্রিতে কাজ করে। আমি বলেছিলুম।

—ওই লম্পট অম্বরীষ? দু-দুটো বিয়ে করেছে, একবার ইউপি সাইডের মোচোরমান আর একবার মারাঠি হিন্দু! আর ওর ফ্ল্যাটের নম্বর কত জানো? সাতচল্লিশ, মুম্বাইয়ের কোলাবার মতন জায়গায়, ওর বাপ কিনেছিল, এখন তিরিশ-চল্লিশ কোটি টাকার হবে। ছাত্ররা ওকে একেফরটিসেভেন নাম দিয়েছে। কাঁধ-নাচানো হাসি হেসে বলেছিলেন বাবা। এটা ছিল ওনার নেভিগেশনের তির্যক বিন্দু যা আমার অভিজ্ঞতায় নতুন কিছু নয়। আমার ওপর অম্বরীষ কর্মকারের প্রভাব সম্পর্কে আর আমার চিন্তাধারায় সবকিছুর উপর উনি আলো ফেলে সন্মোহিত করেছেন কিনা তা যাচাই করার চেষ্টা করলেন বাবা।

 —লম্পট বলছ কে? ভদ্রলোক তো অনেক শিক্ষিত। কলেজে বটানি পড়ান, কোচিঙে বায়োলজি পড়ান আর বাড়িতে ইংরেজি পড়ান। প্রতিবাদ করেছিলেন মা।

—আরে ও ব্যাটা ছাত্র ঠেঙিয়ে আর ছাত্রী ফাঁসিয়ে লাখ-লাখ টাকা কামাচ্ছে; ছুটির দিনে কমবয়সী মেয়েদের ওরলি কিংবা ব্যাণ্ড্রার সিশোর থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ফুর্তি-ফার্তা করে। ড্রাইভার আর পেছনের সিটের মাঝে পার্টিশন আছে যাতে পেছনের কুকর্ম সামনে বসে দেখা না যায়। নাসিকের কাছে কোন গ্রামে বিরাট ফার্মহাউস করেছে, সেখানে কম বয়সী ছোঁড়া-ছুঁড়িদের নিয়ে রেভ পার্টি করে। তোমার ছোট ছেলেও সেই পার্টিতে গিয়ে নেশায় চুর হয়ে নাচানাচি করে, বাবা উদ্গারের সঙ্গে হাসি মিশিয়ে বললেন।

—করলেই বা! মুম্বাইয়ের, তাও সাউথ মুম্বাইয়ের কোন বাড়ির ষোলো বছরের ছেলে–মেয়েরা ভার্জিন থাকে, নেশাভাঙ করে না, বলো আমায়? বললেন মা।

একেফরটিসেভেন জানেন ওনাকে নিয়ে নানারকমের গল্প আছে। কেউ সামনাসামনি বললে উনি গায়ক কবীর সুমনের তুলনা দেন। বলেন, কবীর সুমনের প্রতিভার তুলনা নেই।

আমি বাবাকে বললুম, অম্বরীষ কর্মকার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভয়েস অব আমেরিকাতে সুমন চাটুজ্যে বা চট্টোপাধ্যায় কাজ করার সময় সেখানে পরিচয় হয় ঢাকার মেয়ে সোফিয়া নাজমা চৌধুরীর সঙ্গে। এরপর প্রেম। তারপর তারা দুজনই প্রথমে ঢাকা ফিরে তারপর কলকাতায় গিয়ে সুমন চট্টোপাধ্যায় হিন্দু থেকে মুসলমান হন, নিজের নাম দেন মহম্মমদ ফারুক। মুসলমান হবার পর ঢাকার মেয়ে নাজমাকে বিয়ে করেন ফারুক ওরফে সুমন। এরপর তারা জার্মানিতে যান সেখানে মারিয়া নামে এক জার্মান যুবতীর সাথে পরিচয় হয়। নাজমাকে ছেড়ে মারিয়াকে বিয়ে করেন। এবার অবশ্য আর মুসলমান মহম্মদ ফারুক নামে না, সুমন চট্টোপাধ্যয় নামেই মারিয়াকে মানে হিন্দু হয়েই বিয়ে করেন। বিয়ের কয়েক বছর পর মারিয়া সুমনের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে রীতিমত কলকাতা পুলিশের কাছে মামলা করে। তবে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি। চলতি শতকের গোড়ার দিকে সুমনের পরিচয় হয় বাংলাদেশের গায়ক সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে। এরপর ফের সুমন চট্টোপাধ্যয় নাম পাল্টে মুসলমান হলেন কবীর সুমন নামে। এরপর বিয়ে করলেন সাবিনা ইয়াসমিনকে। পাঁচবার বিয়ের মধ্যে দুবার মুসলান হওয়া কবীর সুমনের গানের শ্রোতা অসংখ্য। সুমনের বিরুদ্ধে জার্মান ফেডারেল কোর্টে নারী নির্যাতন ও প্রতারণার মামলা রয়েছে। তাতে কী?

বাবা বললেন, জার্মানিতে গেলে কবীর সুমন গ্রেপ্তার হতে পারেন। ওনার একটা ভিডিও দেখলাম এবং শুনলাম। সেখানে তিনি অশ্রাব্য ভাষায়  চীনা  কমিউনিস্ট নেতা চৌএন লাই আর মাও জে দঙকে গালাগাল দিচ্ছেন।

—আমি বললুম, মাও জে দঙও চারবার বিয়ে করেছিলেন, লুয়ো ইজিয়ু, য়াং কোইহুল. হে জিঝেন আর জিয়াং কিঙের সঙ্গে, দশটা বাচ্চা ছিল। ওনার ডাক্তার লি ঝিশুই লিখেছেন যে, মাওয়ের বহু শয্যাসঙ্গিনী ছিল। প্রফেসর কর্মকার দুবার বিয়ে করেছেন বটে কিন্তু ধর্ম পালটাননি, কেননা উনি বলেন, ওনার কোনো ধর্ম নেই। বাচ্চাও কেবল ছয়টা।

আমি শুনেছি অম্বরীষ ব্যাটা আরেকবার বিয়ে করার তালে আছে, এক নম্বরের সেক্সুয়াল পারভার্ট, পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, তবু চালিয়ে যাচ্ছে। বললেন বাবা।

—আরে সেরকম পুরুষমানুষ হলে তার সাধ-আহ্লাদ ষাট-সত্তর বছর পর্যন্ত থাকে। আগেকার দিনে অমন বয়সে ব্যাটাছেলেরা গোটাকতক বউ রাখতো আর তাদের বাচ্চাও হতো। কুলীন বামুনদের কোনো বাধা ছিল না।

—তা যা বলেছ, ব্যাটা অনেকগুলো বিয়ে করে কুলীন হতে চায় ওই মাও জে দঙের মতন। বিশ্বের অন্যান্য অংশে, মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়ায়, বহুবিবাহ বৈধ। কিছু দেশে - বিশেষ করে পশ্চিম আর মধ্য আফ্রিকার একটা অংশে যা বহুবিবাহ এলাকা নামে পরিচিত - ব্যাপারটা আইনি আর ব্যাপক।

—আজকাল ইউরোপ আর আমেরিকায় সংসার চালাবার জন্যে বর-রা বেশ কয়েকজন বউয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে। বউরাও তেমন অনেকগুলো বরের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে। বিয়ে করার দরকার হয় না। এটা সেই হিপিদের সময় থেকে চলে আসছে, আমি বললুম।

—জানি, জানি, পশ্চিমারা যারা ধর্মীয় ভিত্তিতে বহুবিবাহকে সমর্থন করে তাদের যুক্তি হলো যে আরও বেশি পিতামাতার অবদানকারী পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের জন্য একটি সমৃদ্ধ এবং আরও স্থিতিশীল পারিবারিক জীবন তৈরি করতে পারে। বিরোধীরা যুক্তি দেন যে বহুবিবাহ শোষণমূলক এবং এই ভুল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যে নারীরা পুরুষের তুলনায় স্বভাবতই কম যোগ্য – এবং যারা বহুবিবাহকে উন্নীত করে তারা সেই বিশ্বাসকে চিরস্থায়ী করে লাভবান হওয়ার ধান্দায় থাকে। গোষ্ঠী বিবাহ হল এমন বিবাহের জন্য কম্বল শব্দ যাতে একাধিক স্বামীর পাশাপাশি একাধিক স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত থাকে। Polyamory হল একাধিক রোমান্টিক সম্পর্ক থাকার অভ্যাস, যেখানে সমস্ত পক্ষের সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকে এবং সম্পূর্ণ সম্মতি প্রদান করে। বিবাহের সাথে সম্পর্কিত নয়। বহুজাতি হল (সেকেলে) তত্ত্ব যে মানবজাতির বিভিন্ন জাতি পূর্বপুরুষের বিভিন্ন সেট থেকে বিবর্তিত হয়েছে। এই শব্দটি বহুবিবাহের সাথে সম্পর্কিত নয় তবে মাঝে মাঝে ‘বহুবিবাহ’এর সাথে বিভ্রান্ত হয়, তাই এটি স্পষ্টতার জন্য এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাবা বলা বজায় রাখলেন, সম্প্রতি যখন খবর আসে যে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তখন বিদেশের পর্যবেক্ষকরা আনন্দিত বা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। এটি অবশ্যই, এমন একজন ব্যক্তি যার তার জীবদ্দশায় পাঁচটি স্ত্রী রয়েছে, বর্তমানে তার ডানাগুলিতে একজন বাগদত্তার সাথে তিনটি রয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ১২টি সন্তানের পিতা হয়েছে,  আরও সাতটি আগে গুজব বা বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে; একজন ব্যক্তি, যিনি 2006  সালে তার ANC কমরেডের এইচআইভি-পজিটিভ মেয়েকে ধর্ষণের জন্য বিচারে ছিলেন, দাবি করেছিলেন যে তিনি কনডম ব্যবহার করেননি, কারণ তিনি পরে গোসল করেছিলেন। তাহলে এখন বড় ব্যাপার কী ছিল?

দাদা বলল, সাহচর্য বা যৌন সম্পর্কের চেয়ে বেশি, বহুবিবাহ অর্থ এবং মর্যাদা সম্পর্কে। সারা বিশ্ব জুড়ে, প্রথাটি ঐতিহ্যগতভাবে তাদের বিশেষাধিকার ছিল যারা বিয়ে করতে এবং অনেক স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। বহুবিবাহ অনুশীলন করা একটি সর্বজনীন লক্ষণ যে আপনার কাছে গড়ের মানুষের চেয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত - বেশি সম্পদ রয়েছে। বিয়ে সবসময় পরিবার এবং গোষ্ঠীর মধ্যে মিত্রতা গড়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়েছে; এটি বহুবিবাহের জন্য আরও সত্য, সংযোগের জন্য এর বিস্তৃত সম্ভাবনার সাথে। একটি অভিনব কাজ বা একটি বড় বাড়ির মত, বহুবিবাহ উভয় অবস্থা তৈরি করে এবং এটি থেকে উদ্ভূত হয়। এবং বিভিন্ন ধরনের মর্যাদা অর্জন করা আজও আফ্রিকাতে পুরুষদের  (এবং মহিলাদের) বহুবিবাহের দিকে পরিচালিত করে। এমনকি আফ্রিকার অনেক ধনী শহুরে কেন্দ্রে, বহুবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ আরও বেশি পুরুষরা আরও বেশি স্ত্রীর সামর্থ্য রাখে, এবং তারা  এই মর্যাদা প্রদান করে এমন প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতা থেকে উপকৃত হয় (যদিও, আমি বহুবিবাহের উপর আমার সাম্প্রতিক বইতে আলোচনা করেছি, সংখ্যাগুলি কঠিন পালাক্রমে আসা)।

—দাদা, মোচরমান বিয়ে করায় কোনো গণ্ডোগোল হয়নি? ফিসফিস করে দাদাকে জিগ্যেস করলুম।

—না রে। মেয়েটা বরইলি থেকে এসেছিল সিনেমায় অভিনয় করবে ভেবে। জানিসই মেয়েদের সামনে টোপ ফেলে কাস্টিঙ ডায়রেক্টাররা প্রযোজকদের বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফ্যালে। প্রফেসর কর্মকারের বউ সোফিয়া অমন নানা ঘাটের জল খেয়ে কোনো ছাত্রের ডেরায় থাকা আরম্ভ করেছিল। ছাত্রটাই ঘাড় থেকে নামাবার জন্য প্রফেসার কর্মকারের ড্রাইভারকে বলে আগে থাকতেই ওনার গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে দিয়েছিল। ব্যাস, প্রফেসর সব শুনে বাড়ি নিয়ে গেলেন আর ব্যান্ড্রা আদালতে গিয়ে বিয়ে করে ফেললেন। ব্যাণ্ড্রা আদালতের সামনে দেখেছিস তো বিয়ে দেবার নানা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। একজন পুরুষ আর একজন মেয়েমানুষ হলেই হলো, ওরা জানে কোন আইনে কেমন বিয়ে দেয়া যায়।

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন