কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


প্যারানর্মাল ফুলশয্যা

ঘোমটা সামান্য ফাঁক করে মাধবীদেবী দেখলেন দরজার পাশে টিনের একটা দেড়ফুট বাই একফুট বোর্ড লাগানো। আয়তকার কালো রং-এর বোর্ডটাতে সাদা রঙের অক্ষরে লেখা "প্যারাসাইন্স স্পেসালিস্ট অধ্যাপক নীশানাথ সরখেল। সব রকমের প্যারানর্মাল সমস্যার সমাধান এখানেই পাবেন।"

দেখে মাধবীদেবী যারপর নাই সন্তুষ্ট হলেন। তার মানে তিনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। তিনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। ঘরটা ছোটো আর নানা হাবিজাবি বস্তু দিয়ে ঠাসা। জানালা আছে কিন্তু সেটা বন্ধ। একটা বাল্ব জ্বলছে। তবে তার ওয়াটেজ এতটাই কম যে তার আলোতে অন্ধকার দূর হয়নি, কেবল ঘোলাটে হয়েছে। মাধবীদেবীর পরিবেশটা বেশ পছন্দ হলো। তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘোমটা খুলে ফেললেন।

ঘরের মাঝে একটা টেবিল চেয়ার। চেয়ারটা টেনে বসতেই। সারা পেয়ে সরখেলবাবু দেখা দিলেন। বাঁকা লম্বা নাকটাই সর্বাগ্রে নজরে পড়লো। তারপর মুখের উপরে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো। একটু ঝুঁকে পড়ে তিনি মাধবীদেবীকে নমষ্কার করলেন। প্রতিনমষ্কার করলেন মাধবীদেবীও। সরখেলকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার। টেবিলের অন্যপিঠের চেয়ারটাতে এসে বসলেন সরখেলবাবু। টেবিলের উপর থেকে একটা চশমা নিয়ে লম্বা নাকটার উপর চাপালেন। এরপর তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হোলো। নাম ধাম জাতীয় প্রাথমিক প্রয়োজনীয় তথ্যাদি বিনিময়ের পর, সারখেলবাবু জানতে চাইলেন মাধবীদেবীর সমস্যাটা কী?

মাধবীদেবী কথা বলছিলেন মুখ না তুলে। এবারো মুখ না তুলেই জানালেন।  

- আমার বাড়িটা দখল মুক্ত করতে হবে। বাড়িটা আমার ফেরত চাই।

- দখল মুক্ত? দখল করে রেখেছে কে?

- সে এক দুশ্চরিত্রা পেত্নী। অতিশয় বদ এবং ঠ্যাঁটা। সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েও তাকে তাড়ানো যাচ্ছে না।

সরখেলবাবু হাসলেন। তার জন্য কাজটা খুব একটা কঠিন নয়।

এ পেত্নী বাড়ির দখল নিয়েছে। বাড়ির মালকিনের নয়। সেটা হলে কাজটা তার পক্ষে আর একটু কঠিন হতো। তবে সেটাও সরখেলবাবুর জন্য অসাধ্য কিছু নয়। তার ষোলো বছরের এই প্রফেশনে বহুবার এই দুই ধরনের সমস্যাই তিনি সল্ভ করেছেন। এটাও করে ফেলবেন, সে আত্মবিশ্বাস তার আছে। অতঃপর তিনি তার ফিসের কথা জানালেন। মাধবীদেবীও তাতে সম্মতি জানালেন। তবে তাঁর শর্ত আর্ধেক কাজ শুরুর আগে বাকি অর্ধেক কাজ সুসম্পন্ন হলে। এতে দুপক্ষেরই সম্মতি হোলো। এরপর বাকি রইলো অকুস্থলের ঠিকানা জানা আর পেত্নী বিতাড়নের দিনক্ষণ ঠিক করা। সামান্য আলোচনার পর তাও হয়ে গেলো।

নির্দিষ্ট দিনে নানারকম বস্তু সামগ্রী বোঝাই ব্যাগ নিয়ে সরখেল বাবু হাজির হলেন মাধবীদেবী নির্দেশিত জায়গায়। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন মাধবীদেবী। লম্বা ঘোমটা দেওয়া থাকলেও তাকে চিনতে অসুবিধা হলো না সরখেলবাবুর। মাধবীদেবী জানালেন। আমার বাড়িটা একটু ভিতর দিকে। খানিকটা হাঁটতে হবে। দেখা গেলো খানিকটা নয় বেশ খানিকটাই হাঁটতে হলো। বাড়িটা একটা জঙ্গুলে নির্জন জায়গায়। এবং চেহারায় সেটা পুরোপুরি ক্লাসিক্যাল পোড়োবাড়ি। তারা দুজনে দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। পুরনো বাড়ি যেমন হয় এটাও তেমন। দেখে মনে হোলো কামরা রয়েছে বেশ কয়েকটা। আসবাবপত্রও কম নয়। তবে সব সাবেকি ধরনের। সবকিছুই বেশ সাজানো গোছানো। এবং এতোগুলো ঘরদোর সবই কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সরখেলবাবু জানতে চাইলেন।

- আর কেউ নেই?

- আছে তো। তাকেই তো তাড়াতে হবে।

- আরে না। সে ছাড়া?

- না। আর কেউ নেই।

- বলেন কি? এই বাড়িতে একাই থাকেন আপনি?

মাধবীদেবী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

- সব কিছু এমন সাজানো গোছানো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! একা হাতে এতো কাজ?!

- বহুদিন তো একাই করেছি। সে হারামজাদি সেঁধুনোর পর থেকে এখন দুজনে মিলে করছি।

যাকগে মরুকগে। সরখেল নিজের কাজে মন দিলেন। সে পেত্নী নিশ্চয় এখানেই আছে। আড়াল থেকে সব কিছুই লক্ষ্য রাখছে। সেটা সারখেলবাবু জানেন। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা তার। সরখেলবাবু প্রফেশনাল দক্ষতার সঙ্গে অতি দ্রুত আসর সাজিয়ে ফেললেন। তারপর তার পেত্নী বিতাড়নের কার্যক্রম শুরু করলেন। তবে সে সব করতে করতে সামান্য অবাক হয়ে দেখলেন। তিনি কাজ শুরু করার সাথে সাথেই মাধবীদেবী কোথায় যেন সরে পড়লেন। রেয়ার হলেও, এরকম অভিজ্ঞতাও এর আগে হয়েছে তার। ভীত বাড়ির লোকজন আড়ালে থেকেছে। সরখেলবাবু তাই সেদিকে আর খেয়াল না দিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ সম্পন্নও করে ফেল্লেন। শেষ পর্যায়ে এসে শুনতে পেলেন ঝড়ের মতো শব্দ তুলে ঘরের মধ্যে বার কয়েক পাক দিয়ে একটা বাতাস ঘর থেকে হু হু করে বের হয়ে চলে গেলো। সরখেলবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার মানে তার কাজ সফল। এইমাত্র পেত্নীটা এই ঘর ছেড়ে চলে গেলো।

তখনও মাধবীদেবীর দেখা নেই। তাই এই সাফল্যের খবর তাকে জানানো গেলো না। একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে সরখেলবাবু তার জিনিষপত্র গোছাতে লাগলেন। তার ফিসের অর্ধেক মাধবীদেবী আগেই দিয়ে দিয়েছেন। বাকিটা দেবার কথা কাজ মিটলে। সব গোছগাছ করে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন সরখেলবাবু। তাও মাধবীদেবীর দেখা নেই। এরকম প্রতারণার শিকার সরখেলবাবু আগেও হয়েছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরে নিলেন এবারেও সেরকমটাই হলো। তিনি ঘর থেকে বিরক্তি আর ক্ষোভ নিয়ে বের হয়ে এলেন। এদিক ওদিক, এঘর ওঘর ঘুরে দেখলেন। না কোথাও নেই মাধবীদেবী। তিনি হতাশ হয়ে ফিরতে লাগলেন।

তখনই হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘরের একটা দেওয়াল তার উপরে ভেঙ্গে পড়লো। নিমেষে ইট সিমেন্টের চাঙ্গরের বিশাল স্তুপের নীচে বেমালুম চাপা পড়ে গেলেন তিনি।  

অনেক কষ্টে টেনে হিঁচড়ে নিজেকে সেই স্তুপের থেকে বের করতে গিয়ে বেদম হয়ে গেলেন তিনি। হয়তো একা একা ঐ ইট সিমেন্টের পাঁজা সরানো তার পক্ষে সম্ভবই হতো না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন ডেবরিসের স্তুপ সরাবার কাজে হাত লাগিয়েছেন মাধবীদেবীও। কখন যে তিনি সেখানে এসে হাজির হয়েছেন টেরই পাননি সরখেলবাবু। একটা জিনিষ বেশ অবাক করলো সরখেলবাবুকে। এতোখানি চোট পাওয়ার পরেও তার কোনোরকম যন্ত্রনা বোধ হচ্ছে না। হঠাৎ মাধবীদেবী হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরলেন। এবং ওভাবেই  নিয়ে গেলেন একটা ঘরে। সেখানে রয়েছে ফুলটুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো বিছানা সমেত চমৎকার এক পালঙ্ক। মাধবদেবী সলজ্জ হেসে বললেন, পেত্নীটা আর নেই। বিদেয় হয়েছে। এবার এখানে থাকবো আমি আর তুমি। আজ আমাদের ফুলশয্যা।

সরখেল বুঝলেন এক পেত্নীকে তাড়িয়ে তিনি আর এক পেত্নীর খপ্পরে পড়ে গেছেন। তবে সে জন্য তার খুব একটা আফসোস হলো না। কেননা মাধবীদেবী পেত্নী হলে, তিনিও তো এখন মরে ভূত। মারা গেছেন দেওয়াল চাপা পড়ে।

সুতরাং এখন আর কোনো বাধা নেই তাদের প্যারানর্মাল ফুলশয্যায়।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন