কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


ঘাসফড়িং

চুম্বনের প্রায় কাছাকাছি এসে হঠাৎ চোখে পড়ল ঘাসফড়িংটা। দুলে দুলে দুব্বো ঘাসের গা থেকে পিছলে গেল, হারিয়ে গেল, আবার টুকুস করে জানলায় উঁকি।

মুহূর্তে উপসর্গ বিহীন হয়ে যায় সে।

শৈবালের ঠোঁট অনুভব করতে পারে না এত সূক্ষ্ম তফাত। ঠোঁট ইজ ঠোঁট। দুপুরের এই অনুষ্ঠানে সৃজার তেমন আপত্তি নেই, কিন্তু আজ মনটা ফড়িং-এর ডানায় চড়ে বেড়াতে চলে যাচ্ছে।

শৈবাল দেহের চিচিংফাঁকে ঢুকে পড়ে। সৃজা অভ্যাস মতো ক্রিয়াশীল শুধু, কিন্তু মন জুড়ে ভাসছে অনেক প্রাচীন এক গ্রাম, একটা পুকুর, ঘাসফড়িং। দুটো ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি হাফপ্যান্ট, ফুলেল ফ্রক। গরম কালে বৃষ্টি হলে আগাছা ভরা ভিজে মাটি থেকে এমন গরম বাতাস উঠত। কেমন যেন অস্বস্তি। কেন মনে পড়ছে না মুখটা! শরীরের ভেতর-বাইরে করছে ঘাসফড়িংটা।

শৈবালের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শরীর থেকে মন চলে গেলে পড়ে থাকে জীববিজ্ঞান।

বাড়িটা ভুতুড়ে ছিল। মালিকরা চলে যায় দাদুর আমলে। তারপর কেউ আসেনি। ভাঙা দেউল আর আগাছার ফাঁকে অন্ধকার ঘর উঁকি দিত। ছেলেমেয়ে দুটো ঢুকে পড়ত দুপুরে। কামরাঙা পেকে লাল হয়ে থাকত। ঋতুরং।

আলগোছে শৈবালের বুকে মুখ রাখে সৃজা, যেন ভেতরে আছে সেই সব ছবি। সেইসব দিন আর রাতের ভেতরে পাতালপুরী।

ফর্সা টানা টানা চোখ, কোঁকড়া চুল ছেলেটা। ছেলেটার মুখ আবছা।

মা বলত, মেয়েটা বরং ফর্সা সুন্দর হলে ভালো হতো। বিয়ে একটা ব্যাপার, ফ্রক বয়সেও সে চিন্তা মা'র। শৈবাল জামা পরে নিচ্ছে।

শুয়ে শুয়ে দেখছে পুরুষ রূপ। শৈবাল। প্রেমিক তার। হাফপ্যান্ট ছেলেটাও বড় হলে এমনই সুন্দর হতো। অস্পষ্ট মুখ। এমন বলিষ্ঠ পুরুষ হতো সে।

কাছাকাছি পুকুর অথবা যে ডোবা ছিল, খুব ধীরে ধীরে সন্তর্পণে আবর্জনা ফেলে, এখন বহুতলের জন্য খুঁড়ছে মাটি। ওখানেই ফড়িংটা ঘোরাঘুরি করছে।

বিকেলের আধো ছায়া আর আঁধারে বাড়িটা। অনেকেই বলত সাপের আড্ডা। আর সেই টানে ওরা দুজনে উঁকি দিত। কী নিকষ অন্ধকার ঘরগুলোতে! ভেঙে পড়া কড়িবরগা, চামচিকের বাসা আর মোটা ধুলোর আস্তরণ পেরিয়ে ছেলেটা দেখাতো দেওয়ালে শ্যাওলার নন্দনতত্ত্ব।

বিয়ে অবশ্য হয়েছিল সৃজার। ফ্রক থেকে শাড়ি, সেই শাড়ি একটানে খুলে ফেলে আদিম নারী। বিয়ে আছে, বিয়ে নেই। মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল বিশাল এক ঈগল। সাড়াদিন ডানা ঝাপটে সব আলো নিভিয়ে দেয়।

হাফপ্যান্ট ছেলেটা বড় হয়নি, অবিকল আগের মতোই থেকে গেছে। ভালোবাসা তার। ছেলে তো ছেলেই। আপন মাতৃগর্ভে জন্ম হলেও ছেলে। হাত ধরাধরি ছেলেবেলা ঢুকে পড়ে কালো কালো ঘরে। তারপর সিঁড়ি। ভাঙা সিঁড়ি লতাপাতা, জাল কত মাকড়ের, এভাবেই সেই ঘর আর ভাঙ্গা তোরণ।

সৃজা অন্ধকারেও খোঁজ করে ফড়িংটার। ছটফটে স্বচ্ছ রং। যদি ঘরে ঢুকে পড়ে আলো দেখে,অপেক্ষা করে সৃজা। আসে না। কখনো আসে ঘুরে ফিরে চলে যায়।

কেউ আসে না পোড়ো বাড়িটায়। অস্পষ্ট মুখটা একবার পেছন ফিরে দেখে নেয়। লাল ফ্রক। আবছা অন্ধকারে দুজনে চোখাচোখি, স্মিত হাসি।

শৈবাল চলে যাবে একদিন, যেমন অমিত বা সমীর। ওরা কেউ ঘাসফড়িং ছিল না। ভাঙা তোরঙ্গে গোখরোর বাস। যক্ষপুরী। হাফপ্যান্ট ছেলেটা তাকায়। একবার আর্ত ধ্বনি। বিবর্ণ হতে হতে অসহায় চাহনি।

ফর্সা ছেলেটা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ছিল। সৃজা জাগিয়ে রাখতে চাইছে আপ্রাণ। নিদ্রায় বিষ ছড়িয়ে পড়ে।

টানা টানা চোখ খুলে সায়ন একবার তাকিয়েছিল। মুখে লেগে ছিল হালকা হাসি। ফর্সা ছেলেটা নীল। ওঝা, ডাক্তার সকলেই চেষ্টা করেছিল। তবু প্রতিমুহূর্তে আরো দূরে পাড়ি দিচ্ছিল সৃজাকে একা ফেলে সায়ন।

নীল হয়ে যাওয়া শরীর, আধখোলা চোখ কী যেন বলতে চায় তাকে।

বড়ো হচ্ছিল ওরা। ঠিকঠাক ভাইবোন নয় দুজন, একসঙ্গে।

সেদিন গোধূলি হতে কলার ভেলায় ঊর্ণা নদীতে ভাসিয়ে দিল ওরা। কান্নার ধ্বনি। সৃজা চেয়ে দেখল

একটা ঘাসফড়িং কলার ভেলায় সায়নের নিথর বুকে বসে। যে যায় কলার ভেলায় সে কি ফিরে আসে?

তারপর থেকে সব পুরুষের গায়ে সে খুঁজছে ঘাসফড়িং। ঘাসফড়িং-এর শরীর নিয়ে সায়ন আসে। সৃজা জানে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন