কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

হে নেপথ্যচারিণী




 

(সাত)

 

অভিরাত্রি

 

সর্বানন্দ ঝা আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তথাগত অধিকারী গাড়ি নিয়ে আমাদের শম্ভুবাবু লেন নিয়ে চলল। মোড়ের কাছে গাড়ি পার্ক করে আমি আর আশুদা সরু গলি বেয়ে এগিয়ে চলেছি সেই অভিশপ্ত বাড়িটার দিকে যেখানে অলোককৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শকুন্তলা ঠিক ষোলো বছর আগে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল ইতিহাসের দমচাপা অভিমানী কোনও ক্রিপ্টোবিম আমাদের যেন অনুসরণ করে চলেছে। তার অনেকগুলো না বলা কথা শোনবার জন্যই যেন আশুদার এই শম্ভুবাবু লেনে আসার সিদ্ধান্ত।তথাগত একটি অশ্বত্থঝুরি ঢাকা ভগ্নপ্রায় ঘরের সামনে এসে থেমে গেল। পুরসভা থেকে বাড়ির বাইরে বোর্ড ঝোলানো। সেখানে লেখা 'বিপজ্জনক'। পকেট থেকে একটি বড় চাবি বের করে দরজার কবাটে লাগানো লোহার তালায় মোচড় দিতেই দরজাটি খুলে গেল। আর খুলৈ যেতেই ভিতর থেকে এতো বছরের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস যেন বেরিয়ে এল বাইরে। ইলেকট্রিক কানেকশন কেটে গেছে আগেই। তবে তথাগত একটা হাইপাওয়ারের টর্চ এনেছিল সঙ্গে। ঘরের ভিতর সেই টর্চের আলো ফেলতেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় শিউড়ে উঠতে হল আমাকে। ঘরে আলাদা করে কোনও কিছু বোঝবার আগেই ঘন ধোঁয়াশার চাদরের মতো মাকড়শার জাল চারপাশ ঢেকে দিয়েছে। সেইসব দেখে আশুদা বলল।

-এভাবে হবে না। ঝাড়ু আনতে হবে। চল। পাশেই এন্টালি মার্কেট। কিনে আনি আগে।

দরজা বন্ধ করে মার্কেটে চলে এলাম আমরা। খানিক পর ঘরে ফিরে মুখে মাস্ক চাপিয়ে সাফাইয়ের কাজে লেগে পড়ল আশুদা। আমি আর তথাগতও হাত লাগালাম।আমাদের যৌথ উদ্যোগে ঘরটি ধীরে ধীরে তার ষোলো বছর আগের সেই রূপটি ফিরে পাচ্ছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে আশুদা আমাকে সতর্ক করেছে আগেই। ক্রাইমসীন পরিষ্কার করতে গেলে হতে হবে চতুর্গুণ বেশি সাবধানী। কোনও সামান্য অসিবধান আঁচড়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এভিডেন্স। তাই ঝাড়ুদারেরঝাড়ু ঘরটির ভিতর ধেয়ে এল সুন্দরী রমণীর কোমল গাত্রে প্রেয়সীস্পর্শর মতোই। পরিষ্কারের পর আলো ফেলতে দেখা গেল ঘরের মেঝেতে সাদা রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা একটি জায়গা। এখানেই শকুন্তলা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ষিতা লাশটি পুলিশ উদ্ধার করে। সেই জায়গার অনতিদূরে একটি গোলক। অনুমান করা যায় সেখানেই ঘটনার সময় আট বছর বর্ষীয়া সুচন্দ্রা দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরে একটি সাবেকী ছোট বাহারী খাট। একপাশে একটি ছোট লোহার আলমারি। আলমারি খোলাই ছিল। ভিতরে কয়েকটি বিরক্ত কীটপতঙ্গ ছাড়া তেমন কিছু সূত্র পাওয়া গেল না। আলমারির উপরে একটি ধুলোয় কালো হয়ে আসা থার্মোকোলের নামফলক। সেখানে একসময় সোনালী চুমকি দিয়ে চকমক করে লেখা হয়েছিল 'চিত্রকূট অপেরা'। ঘরের অন্যপ্রান্তে একটি তিনপা বিশিষট টিপয়। তার উপর একজোড়া তবলা রাখা। যদিও তবলার ছাউনি এই এতোবছরের অবহেলায় জীর্ণ শতছিন্ন হয়ে গেছে। তবলার ডাঁয়া ও বাঁয়ার মধ্যিখানে একটি মোমের হাতি রাখা। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে মেরেকেটে ছ ইঞ্চি আয়তন।

-অত্রির সেই মোমের হাতি? আমি উত্তেজনায় বলে ফেললাম।

-হতে পারে। পায়ে শিকলটাও রয়েছে দেখ।

হাতির ডানপায়ে সত্যিই একটি সরু ধাতব শিকল জড়ানো।

-এই হাতিটা আমি আমির কাছে রাখছি তথাগত। তোমার আপত্তি নেই তো।

-কী যে বলেন স্যার। বলে তথাগত মাথা নাড়ল। আমরা ঘরটি থেকে বেরিয়ে এলাম। আশুদার হাবেভাবে বুঝলাম শম্ভুবাবু লেন থেকে আমাদের নতুন করে আর কিছু পাবার নেই।

তথাগত আমাদের স্বক্ষেত্রে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। আজ আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাদিবসের ছুটি। ফিরে যাচ্ছিলাম সাদার্ন অ্যাভিন্যিউতেই। তথাগতকে সকাল থেকেই একটু উদ্বিগ্ন লাগছিল। স্টিয়ারিং আপাতত আশুদির হাতে। গাড়ি চালানো তাল নেশা।পুলিশভ্যান চালাতে চালাতে আশুদা তথাগতকে বলল।

-সব ঠিক আছে তো অধিকারী? এনি প্রবলেম?

-নাহ। জাস্ট গতকয়েকদিন একটু চাপ যাচ্ছে।

-সামনে নির্বাচন। তাই? নাকি ওই 'ত্রিনয়ন' কেসটা নিয়ে চিন্তিত তুমি?

-হ্যাঁ। দ্বিতীয়টাই।

ত্রিনয়ন কেস সিরিজ ইদানিং গেল এক সপ্তাহ ধরে সংবাদপত্র শিরোনামের গরম টপিক। ইতিমধ্যে দক্ষিণ উত্তর কলকাতা মিলে খান তিনেক খুন হয়ে গেছে। প্রথমে ভাবা হচ্ছিল সাধারণ নির্বাচনী দলাদলির জের।কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র নিয়ে। তখনই শহরের জনপ্রিয় একটি সংবাদপত্রের সাংবাদিক তার ক্ষুরধার মেধায় তুলে আনলেন চাঞ্চল্যকর একটি প্যাটার্ন। খুন হওয়া প্রতিটি মানুষের দুই ভুরুর মধ্যিখানে ঠিক ত্রিনয়নের জায়গায় একটি গভীর গর্ত। ব্যাস। মিডিয়া এই ঘোটা ঘটনার নাম দিয়ে দিল 'ত্রিনয়ন সিরিজ'। স্বাভাবিকভাবেই লালবাজারের অফিসাররা এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন। ধড়পাকড় নাকাচেকিং শুরু হলেও লাভের লাভ তেমন হচ্ছে না। এখন বোঝা গেল তথাগত অধিকারীও লালবাজারের সেই বিশেষ অনুসন্ধানদলের একজন সদস্য।

-কিছু জানা গেল কে এটা করছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

-না স্যার। এর আগে এই শহরে এমন ঘটেনি। তবে আমাদের ডাটা টিম বলছিল এক বছর আগে ঠিক এমনই একটি খুন হয়েছিল বাঙ্গালোর শহরে। কিন্তু সে মৃত্যুর কিনারা করা যায়নি।

-তাহলে কি তোমাদের সন্দেহ এই দুটো ঘটনার ভিতর কোনও সম্পর্ক আছে?

-থাকতেই পারে। স্যার যদি কখনও ফাইলটা একটু দেখেন। ঝাজি বলছিলেন।

পরের শব্দগুলো অবশ্যই আশুদাকে উদ্দেশ্য করে। আশুদা উত্তরে সামান্য হাসল শুধু।

ঘরে ফিরে নিজের তৈরি কালার স্ফিয়ারের সামনে শম্ভুবাবু লেন থেকে আনা প্যাকেটবন্দী মোমের হাতিটি রেখে আশুদা বসে পড়ল। আমি বললাম! "কিছু বুঝলে?"

-বুঝলাম। অত্রির স্বপ্নে দেখা সংকেতগুলো প্রত্যেকটাই এক একটা পথ দেখাবে আমাদের।

-এই মোমের হাতি ফিঙ্গারপ্রিন্ট অ্যানালিসিসে পাঠালে হতো না আশুদা?

-লাভ নেই। একগাদা অবাঞ্ছিত আঙুলের ছাপ পেতিস। এই এতোগুলো বছর কতোলোক ওটা তুলে দেখেছে হয়তো। তাদের প্রত্যেকের হাতের ছাপ।তার ভিতর দিয়ে মূল আততায়ী খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তথাগতকে দেখে যা বুঝলাম,তাতে ওই 'ত্রিনেত্র মার্ডার সিরিজ' নিয়ে আপাতত লালবাজার হিমসিম। বেকার বেকার ওদের আর মাথা গুলিয়ে লাভ নেই।

-কী ভাবছ আশুদা? একবার দেখবে নাকি ত্রিনেত্রর ফাইল?

-সে নাহয় দেখলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে একটাই প্রশ্ন। লালবাজারে শকুন্তলা মুখোপাধ্যায়ের শরীরে অন্তত দুইজনের বীর্য পাওয়া গিয়েছিল। প্রথম জন অভিনন্দন শিকদার হলে দ্বিতীয়জনটি কে?

-একবার মহিষাদল গেলে কেমন হয়?

-দারুণ অর্ক। আমিও ঠিক এইটাই ভাবছিলাম। আজ অনেক বেলা হয়ে গেল। তবু দুপুরের খাবার খেয়ে এখনই রওনা দিলে বিকেলের আগেই পৌছে যাব আমরা। কাল আবার আমাকে একটা সেমিনারে ডেকেছে। তোকেও থাকতে হবে। তোকেও মেইল করতে বলেছি চিঠিটা। সে যাইহোক। মোদ্দা কথা। মহিষাদল যেতে হলে আজই।

-বেশ। চলো তবে।

আশুদা আর আমি সাদার্ন অ্যাভিন্যিউতেই ফুটপাতে বসে  মাছ ভাত সাপটে নিলাম। শহরের রেস্তোঁরার প্রতি আশুদার এক অদ্ভুত অভিমান আছে। আর এই অভিমানটা আছে বলেই এই শহরেই কতো সামান্য দামে উপাদেয় খাবার পেতে পারে মানুষ, জেনে গেছি আমি। গাড়ি কোনা ধরতেই আশুদা ফোন বের করে খুটখুট শুরু করল। খুব অত্যাধুনিক না হলেও আশুদা ইদানিং স্মার্টফোন ধরেছে। ছেলে ঋক বাঙ্গালোর থেকে তাকে প্রযুক্তি শেখায়। এই কদিনে আমি দেখছি আশুদা বেশ ফোন পারদর্শী হয়ে উঠেছে। ফোনে খুটখুট শেষ করে আশুদা বলল, "সর্বানন্দ মনোরঞ্জন শিকদারের বাড়ির গুগুল লোকেশন পাঠিয়েছে। এটা ফলো কর।"মহারাজা নন্দকুমারের গোল মৃর্তিবাগান চৌক ঘুরে আমরা চললাম মহিষাদলের দিকে। মনোরঞ্জন শিকদারের বাড়ি হিজলি নদী পেরিয়ে। গাড়ি মহিষাদলের রাজবাড়ির রাস্তা বামে রেখে সামান্য এগিয়ে চলল। লোকেশন সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে একটি থামবিশিষ্ট ঘরের সামনে থেমে গেল। বাড়ির দরজার পিলারে শ্বেতফলকে লেখা 'ব্রজধাম'। বুঝলাম এটাই মনোরঞ্জন শিকাদারের ঘর।

দরজায় নক করতেই এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা আমাদের দরজা খুলে দিলেন। আশুদা নিজের পরিচয় দিতে উনি আমাদের বাইরে বসবার ঘরে বসতে বললেন। বসবার ঘরটি বেশ সুবিস্তৃত। তার এক কোণে একটি সাবেকী তানপুরা আর সারেঙ্গী রাখা। ঘরের ছাইরঙা দেয়ালে অজস্র সাদাকালো ছবি। বাংলা বৈঠকী গানের দিকপালদের সঙ্গে তরুণ মনোরঞ্জনের ছবি। আমি অবাক চোখে সেইসব দেখছিলাম। তখনই ওই ভদ্রমহিলা আবার এসে বললেন।

-বাবা আসছেন। আমি বলেছি আপনাদের কথা। আজকাল বাবা কানে তেমন শুনতে পাননা। গতবছর ব্রেইনস্ট্রোক হয়ে যাবার পর কথাও বলছেন কম।

আশুদা বলল,"আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা সামান্য কয়েকটি বিষয় জেনে নিয়েই উঠে যাব।"

আশুদার কথায় মেয়েটি সামান্য ইতস্তত করে আশুদাকে বলল,"না। সেকথা নয়। মনে হয় বাবা আপনাদের কিছু বলতে চান। বিশেষত আপনার নাম শোনামাত্র বাবা সামান্য উৎকণ্ঠিত হলেন। মনে হল উনি আপনাকে চিনতে পেরেছেন।"

বাংলা টপ্পার এককালের স্বনামধন্য জাদুকর তার ভগ্নশরীরে ঘরে প্রবেশ করলেন। ব্যাধির প্রকোপ যেন মানুষটিকে আরও বেশি বৃদ্ধ করে তুলেছে। নুব্জ হয়ে পা ঘষে ঘষে মনোরঞ্জন শিকদার আশুদার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন কয়েক মিনিট। তারপর সামান্য হেসে প্রণাম করে লাঠি হাতে সোফায় বসতে বসতে বললেন," আমার মেয়ে অলোকপর্ণা। ওই আমাকে এখন এই ভাঙা শরীর বয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে।" লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোক কথা বলতেই ঘরের ভিতর যেন অজস্র সারেঙ্গী আর সেতার ঝঙ্কৃত হলো। বুঝলাম যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা সাধনা ক্ষয়িষ্ণু সময় হঠাৎ করে ছিনিয়ে নিতে পারে  না। আশুদাই কথোপকথন শুরু করল।

-আপনার কাছে এসেছি একটি বিশেষ কারণে। একসময় আপনি, অলোককৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, আর ডাক্তার মুরারী পাল চৌধুরী একটি দল করেছিলেন। সে দলের নাম ছিল চিত্রকূট। সেই দলের ব্যাপারে আমাদের যদি কিছু বলেন।

মনোরঞ্জন শিকদারের মুখে সামান্য বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠেই যেন মিলিয়ে গেল।

-সবার নাম বললেন ভাই। আসল নামটাই তো বললেন না। আমাদের দলের হৃদপিণ্ড। শকুন্তলা।

-ঠিক ঠিক। শকুন্তলা মুখোপাধ্যায়।

লক্ষ্য করলাম মনোরঞ্জনবাবু তাঁর ভাই অভিনন্দনের কথা বললেন না একবারও। এটাও কী মারাত্মক শক পেয়ে ডিনায়াল। নাকি সচেতন পরিহার! মনোরঞ্জনবাবু বলে গেলেন।

-কী অপূর্ব গাইত মেয়েটা। গীতা দত্তর ওই গানটা। এখনও কানের ভিতর বাজে।

-কোন গান?

হঠাৎ চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক। শুধু তার ঠোঁটদুটো থরথর কেঁপে চলল। অলোকপর্ণা ইঙ্গিত করল,আর কিছু বলা যাবে না আপাতত। মনোরঞ্জন শিকদার নিথর মূর্তির মতো হয়ে যেতে আমাদের উঠে পড়তে হলো। দরজার কাছে অলোকপর্ণা সলজ্জ এগিয়ে দিতে এসেছিল। আশুদা নীচু স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করল।

-আপনার বাবার পায়ের রোগটা কি জন্ম থেকেই?

অলোকপর্ণা মাথা নেড়ে বলল,"হ্যাঁ। আসলে অনেক ডাক্তার দেখানোর পরেও কোনও সুরাহা হয়নি। ওই পায়ের জন্যই তো তিনবছর আগে স্টেজে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়ে প্রথম মাথায় আঘাতটা লাগে বাবার।

-বেশ।

মূল দরজার কাছে হেঁটে হেঁটে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল আমাদের। ভিতরের ঘর থেকে সুর ভেসে আসছে। মনোরঞ্জন শিকদার গাইছেন। "কোই চ্যুপকেসে আকে স্বপনে সুলাকে মুঝকো জাগাকে বোলে, কি ম্যায় আ রহা হুঁ।"

আশুদা সামান্য থেমে সে গান শুনতে শুনতে বলল,"তুই ভুল বলিসনি অর্ক। অসামান্য শিল্পী মনোরঞ্জনবাবু।"

ঘরে ফেরার পথে মেচেদার চাদোকানে চা খেতে খিতে যথারীতি আবার প্রশ্ন করলাম আশুদাকে।

-কী বুঝলে?

-অনেক কিছু বুঝলাম অর্ক। আবার অনেক ধোঁয়াশাও উনি তৈরি করলেন।

-আচ্ছা। তুমি ওনার পায়ের কোনও অসুখের কথা বললে তখন।

-ঈশ। অর্ক। তোর বোঝা উচিত ছিল। খেয়াল করিসনি। লোকটার ওই পা ঘষে ঘষে চলবার আসল কারণ শুধুই পক্ষাঘাত নয়।

-তাহলে?

-কনজেনিটাল ট্যালিপেস ইকুইনোভেরাস। ঘোড়ার খুড়ের মতো মানুষের পা বেঁকে যায় ছোটবেলা থেকে।মনোরঞ্জন শিকদারের পায়ের চটি ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারতি ওনার বাম পায়ে ট্যালিপেস রোগ থাকার দরুন ওই পায়ের চটির সোলটি বিশেষরকমের পুরু।

নিজেকে নিজে চাঁটি মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল মাথায়। এই সূত্রটা মিস করলাম কী করে। হঠাৎই একটা কথা মাথায় এসে উঁকি দিয়ে গেল যেন।

-আচ্ছা আশুদা। বাম পা কমজোড় হলে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য তো কারোকে ঠিক করে চলতে গেলে ডান পায়ে অতিরিক্ত ভার দিয়ে চলা প্রয়োজন। তুমি সেদিন বলছিলে ক্রাইনসিনের এভিডেন্স তালিকায় ওই সেরামিক মোল্ডে এমন কারো কথা যে ডান পায়ে অতিরিক্ত জোর দিয়ে হাঁটে। তবে কি...

আশুদার চোখে মুহূর্তের জন্য যেন ঝিলিক খেলে গেল।

-দারুন অর্ক। এইতো করটেক্স নড়েচড়ে বসছে তোর। তবে সেইদিন ঘটনাস্থলে পাওয়া ফুটপ্রিন্ট মনোরঞ্জন শিকাদারেরই কিনা, সেকথা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলি অর্ক! লোকটার ভিতরে একটা অনুকম্পা আছে।

আমিও মাথা নাড়লাম। আমারও তেমনটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু কেন? কীসের অনুকম্পা?কে জানে। আশুদা চোখ বুজে বসে আছে মানে তার কথা অনুযায়ী আপাতত তার মস্তিষ্কর ভিতর 'সিন্থেসিস' চলছে। এখন প্রশ্ন করা যাবে না তাকে।

ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে সামান্য খাওয়াদাওয়া সারলাম দুজনে। খাবার টেবিলে বসে বসে আশুদা বলল।

-তখন গাড়িতে যেতে যেতে ঋককে ফোন করেছিলাম। ওকে বাঙ্গালোরে ঘটে যাওয়া 'ত্রিনেত্র' খুনের আপডেট দিতে বললাম। দেখি কতোটা পারে।

-তোমার ছেলে তো। ঠিক পারবে।

আমি বলেই দেখলাম আশুদার মুখেচোখে প্রশান্তি ফুটে উঠেছে। সেখানে বেনিয়াপুকুর থানায় সুবিচারের আশায় ঘুরতে থাকা বিপন্ন পিতার প্রচ্ছায়া নেই। আশুদার কথায় বুঝলাম তথাগত অধিকারীর প্রস্তাব নিয়ে আশুদা রীতিমতো ভাবতে শুরু করেছে। এর অর্থ আশুদাকে এই জটিল সিরিয়াল খুন রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় কুশীলব করতে সর্বানন্দ সফল হয়েছে।

ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসছিল। কাল কলেজ যেতেই হবে। কিন্তু আশুদার চোখে সেই শ্রান্তির বিন্দুমাত্র খুঁজে পেলাম না। রঙগোলকের ভিতর আলো জ্বালিয়ে সে এক মনে মোমের হাতিটাকে উল্টেপাল্টে দেখছিল। চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করলাম,"কিছু পেলে আশুদা?"আশুদা হেঁয়ালি করে বলল।-আজ মহিষাদলে মনোরঞ্জন শিকদার তার টপ্পার জতে আমাকে এই রঙ গোলকের ক্রোমাটিক টিউনিং ফর্কের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। খুব ঘুম না পেলে বস। বুঝিয়ে বলি। হয়তো মজা পাবি।

আমি বসতেই আশুদা টেবিলের নিচে থেকে আরও একটা ছোট চাকতি বের করল। সেই চাকতিতে মূলত পাঁচরকমের রঙ রয়েছে। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ আর বেগুণি।

-লক্ষ্য করে দেখ। এই রঙগুলো কোনওটাই তার চেনা পোশাকে নেই। ঠিক এই রহস্যের চরিত্রগুলোর মতো। লাল রঙ খানিকটা ফ্যাকাশে খানিকটা কালচে। মাঝামাঝি হওয়ায় এর নাম 'মিডল রেড'। ঠিক তেমনই অন্য,রঙ গুলোর নাম যথাক্রমে মিডল ইয়েলো, মিডল ব্লু, মিডল গ্রীন, মিডল পার্পল। ঠিক যেমন শব্দের তীক্ষ্ণতা মাপে মিউজিকাল টিউনিং ফর্কের জুরি নেই, তেমনই এই 'ক্রোমাটিক টিউনিং ফর্ক' রঙের পিচ মাপতে অতুলনীয় পারদর্শী। আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম অত্রির স্বপ্নে দেখা নেপথ্যচারিনীকে দিয়ে। কিন্তু আজ মনোরঞ্জন শিকদার টিউনিং ফর্কের মতোই আমাকে আসল রঙ চিনতে সাহায্য করছে।

-ফুটপ্রিন্ট?

-না। গীতা দত্তর গান। গীতা দত্তর শেষ জীবনে গাওয়া এই অনবদ্য গানটিই তথাগত অধিকারীর কথা অনুযায়ী সেই ফ্লপিতে উদ্ধার করা গানটি। অথচ এই গান মনোরঞ্জনবাবুর কথা অনুযায়ী শকুন্তলাদেবী অতো অপূর্ব মূর্চ্ছনায় গাইতেন। এটা কি নেহাতই একটা কাকতালীয় ঘটনা? নাকি আমার এই ক্রোমাটিক টিউনিং ফর্কের মতোই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের একটি মাপকাঠি? আপাতত এই প্রশ্নই আমাকে ভাবাচ্ছে।

আমি দেখলাম গভীর রাত উপেক্ষা করেই আশুদা তার আলোর চাকতির ওপর গবেষণা করতে করতে আপন মনে গুণগুণ করছে। "কোই চুপকে সে..."

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন