প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা
(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)
(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)
*অধ্যায় -
৩ / ৫*
*উপজাতি বনাম বর্ণ: (আনুমানিক ১০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)*
এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, উপনয়নের অনুরূপ অভিষেক বা দীক্ষার একটি অনুশীলন প্রচলিত ছিল প্রাচীন ইরানীয়দের মধ্যে। ইরানীয় নারী ও পুরুষেরা পনেরো বছর বয়সে পবিত্র সূত্রগুচ্ছ দ্বারা বিভূষিত হওয়ার মাধ্যমে উপনয়নের অনুশীলন করতো, যেটি ছিল আহুরা মাজদা'র (Ahura Mazda) সম্প্রদায়ে তাদের প্রবেশাধিকারের একটি স্বীকারোক্তি। গেইজার (Geiger) বলেছেন যে এটি ছিল একটি প্রাচীন রীতি, পরবর্তী কালে যেটিকে পরিমিত ও বিকশিত করা হয়েছিল। এমনকি স্পার্টা প্রদেশের মানুষদের (Spartans) মধ্যেও যে উপনয়ন-প্রদানকারী সংস্থার অস্তিত্ব ছিল, সেকথাও সুবিদিত। সেইজন্য আমরা ধরে নিতে পারি যে, বেদকীয় ভারতীয়দের মধ্যেও উপনয়নের অনুশীলন ছিল। যেমন প্রথমদিকে, ভগ্নদশাগ্রস্ত আর্য উপজাতির শূদ্র সদস্যরা হয়ত উপনয়ন এবং ব্রহ্মচর্যের আচার-অনুষ্ঠান অব্যাহত রেখেছিল একইরকম ভাবে, যেভাবে তারা অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদিত করতো। সংহিতা-সমূহে এবং ব্রাহ্মণগুলিতে উপনয়নের আচার-অনুষ্ঠান থেকে শূদ্রদের বহিষ্করণের কোনো উল্লেখ নেই।
চঙ্গদোয়া উপনিষদ (Chongdoya Upanisad) আমাদের অভিহিত করেছে যে, জনশ্রুতি (Janasruti), যিনি জীবন (prana) এবং বায়ু (vayu) সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন রাইকভা (Raikva) দ্বারা নির্দেশিত হয়ে, যে রাইকভা ছিলেন একজন শূদ্র। কিন্ত সমস্ত জায়গায় তিনি মহাভ্রাসা নামক মানুষদের একজন প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন, যাদের অবস্থান ছিল উত্তর-পশ্চিমে। তিনি শূদ্র খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন হয়ত এইজন্য যে, শূদ্র উপজাতির লোকেদের সাথে তাঁর মেলামেশা ছিল, যারা একই এলাকায় বসবাস করতো, অথবা এইজন্য যে, শূদ্র নামক এই মানহানিকর শব্দটি ব্যবহৃত হতো সেই সমস্ত মানুষদের উদ্দেশ্যে, যারা ব্রাহ্মণ্য সমাজের সীমার বাইরে অবস্থান করতো।
জনশ্রুতি একজন শূদ্র নাও হয়ে থাকতে পারেন, কিন্ত এটি দেখানোর অন্যান্য ঈঙ্গিতও বিদ্যমান রয়েছে যে, কিছু বিশেষ ধরনের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শূদ্রেরা পুরোপুরিই বঞ্চিত বা বাধাপ্রাপ্ত ছিল না। এইভাবে, তৈতেরিও ব্রাহ্মণ-এ এটি বলা হয়েছে যে, বৈশ্যদের জন্ম হয়েছিল ঋগবেদে, ক্ষত্রিয়দের যজুর্বেদ-এ এবং ব্রাহ্মণদের সামবেদ-এ (Sama Veda)। এটি নিশ্চিতভাবে এই অর্থপ্রকাশ করে যে, অথর্ববেদ অভিপ্রেত (meant) ছিল শূদ্রদের জন্য --- এটি এমন একটি বিধান (provision), যা পরবর্তীতে অস্পষ্টভাবে পুনরাবৃত্ত হয়েছে অপোস্তম্বা ধর্মসূত্রে (Apostamba Dharmasutra)। এটি বোঝায় যে শূদ্রেরা অবশ্যই গোঁড়া-বৈদিক জ্ঞান অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল কিন্ত অন্যান্য ধরনের জ্ঞান থেকে নয়। এমন কিছু অনুভূতিও অর্জিত হয়েছিল শতপথ-ব্রাহ্মণ-এর কয়েকটি রচনাংশ থেকে, যেগুলি আমাদের অবহিত করেছে যে, যাজকেরা নির্দেশিত করতে পারতেন সাপুড়েদের, কুসীদজীবীদের, মৎসজীবীদের, ব্যাধেদের, নিষাদদের, অসুরদের এবং গন্ধর্বদের, যাদের অনেকেরই অবস্থান ছিল শূদ্র বর্ণে। কয়েকটি বিষয়, যেগুলি শেখানো হয়েছিল, সেগুলি যথাক্রমে ইতিহাস, অথর্ববেদ, সর্পবিদ্যা এবং পিশাচ-তত্ত্ব (devajana-vidya)। ছাত্রদের তালিকা এবং বিষয়াবলী (subjects) সুপারিশ করে যে, প্রথমদিকে যাজকেরা কলা এবং কারুশিল্পের অনুশীলন থেকে নিজেদের তফাতে (alloof) রাখতো না, যেগুলিকে পরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল শূদ্রদের সমর্পিত ক্রিয়াকলাপের মধ্যে। কিন্ত এটি পরিষ্কার নয় যে, এই ধরনের নির্দেশাবলী, শূদ্রদের সাহিত্য-শিক্ষা প্রদানের অনুষঙ্গী হয়েছিল কিনা।
শূদ্রদের উপনয়ন থেকে বহিষ্কার এবং ফলত শিক্ষদীক্ষা থেকেও বহিষ্কৃত করার প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি বেদকীয় পর্যায়ের শেষের দিকে। ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি রচনাংশে এই ধরনের একটি ধারণা নীত হয়েছিল, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে একজন ক্ষ্যাতিমান ছাত্রের গৌরব অর্জনের অধিকারী হতে পারেন কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ, রাজন এবং বৈশ্যরাই। কিন্ত আরেকটি জায়গায় আবার শূদ্র-সহ সমাজের সমস্ত ধরনের মানুষজনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। শূদ্রদের সর্বপ্রথম পরিষ্কার বহিষ্করণটি পরিলক্ষ্যিত হয়েছে একটি পরেরদিকের স্রৌতসূত্রে, যেটি তিনটি উচ্চ বর্ণের জন্য উপনয়নের ঋতুর স্থাপনা করেছে। এটিতে পরিষ্কার ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, উপনয়ন, বেদ-চর্চা এবং অগ্নি-প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়গুলি ফল প্রদান করতে পারে কেবলমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই যারা শূদ্র নয় এবং পাপপূর্ণ ক্রিয়াকলাপকে প্রশ্রয় দেয় না। আরেকটি রচনাংশ উপলব্ধ করেছে যে, অভিষিক্ত ছাত্রেরা (upanita) কোনো শূদ্রের সাথে বাক্যালাপ করবে না। এটি পুনরায় বিহিত হয়েছে যে, যে ছাত্রটি শিক্ষাধারা (course) সম্পন্ন করবে (snataka), শূদ্রেরা মধুপর্ক অর্থাত মধু অর্পন (madhuparka) নামক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার চরণযুগল ধৌত করবে। এটি বলা কষ্টকর যে, দুটি স্রৌতসূত্রের এইসব উল্লেখসমূহ পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ের কোনো পরিবেশকে সূচিত করে কিনা। হয়ত সেগুলি আরোপিত হয়েছে সেই পর্যায়ের একেবারে শেষের দিকে এবং এমনকি বেদকীয় পর্যায়ের পরেও হতে পারে, কারণ গ্রহসূত্রগুলি (Grhyasutras) ছিল একেবারে প্রথম দিকের প্রাচীন স্রৌতসূত্রগুলির সমসাময়িক, যার ফলে এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে রথকারা-রা উপনয়নের অধিকারী ছিল।
সুতরাং মনে হয় যে প্রথমদিকে উপনয়নের বিষয়টি সমগ্র উপজাতীয় সমাজের সাথে সংযুক্ত একটি বিষয় ছিল এবং এর প্রতিটি সদস্যকে দীক্ষা গ্রহণ করতে হতো ; কিন্ত উপজাতি যখন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তখন সেটি ব্যক্তিগত বিশেষ সুবিধা বা অধিকার স্থাপনের দিকে অগ্রসর হয়েছে, সম্পদ এবং উচ্চ সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী সম্মান অর্জন করার স্বাতন্ত্র দেখা দিয়েছে, যেটি একটি সূচনা-অক্ষ প্রদান করেছে, কম-বেশি একচেটিয়া ও প্রায়শই অজ্ঞাত একটি সমাজ গড়ে ওঠার। ঠিক যেমন ইরানে হুইতি (Huiti) শ্রেণীকে অস্বীকার করা হয়েছিল, একই ভাবে ভারতে অস্বীকার করা হয়েছিল শূদ্র বর্ণ-কে। সেনার্ট-এর এই ধারণা যে গোষ্ঠীগত অসবর্ণ বিবাহ প্রথা এবং উপজাতীয় অন্তর্বিবাহ প্রথাটি, পরবর্তীতে জাতিগত প্রথায় (cast system)বিকশিত হয়েছিল, --- সেটিকে অনুসরণ করলে হয়ত এটি প্রতিপন্ন করা যাবে যে, তিনটি উচ্চ বর্ণের উপজাতীয় দীক্ষা গ্রহণের রীতিটিকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল উপনয়নে, আর পরিণাম স্বরূপ এটি শূদ্রদের সামাজিক অধঃপতন ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
যদিও উপনয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি শূদ্রদের শিক্ষালাভের অধিকারকে অস্বীকার করার দিকে পরিচালিত করেছিল, কিন্ত সেটি সম্ভবত সেই পর্যায়ে খুব বেশি অসুবিধার সৃষ্টি করেনি বলেই আমাদের মনে হয়। আমরা এখনও সন্দিহান যে পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ে শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা আদৌ ছিল বলে এবং এই বিষয়েটির যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে সেই পর্যায়ে লিপি'র অস্তিত্ব ছিল না। এটি সম্ভাব্য যে, এমনকি ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যরাও যদি বেদের প্রতি তাদের কর্তব্য আদৌ সম্পাদন করে থাকে, তবে সেটি তারা করেছিল অত্যন্ত ভাসা ভাসা ভাবে। একটি পরেরদিকের রচনাংশ দেখিয়েছে যে, সাধারণভাবে বৈদিক শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে ছাত্রেরা, তাদের কর্মক্ষমতার কেবল একটি প্রতিকী প্রয়োগ মাত্র করেছিল এবং শিক্ষালাভের বিষয়টি ছিল প্রধানত ব্রাহ্মণদের মাথাব্যথা। কিন্ত উপনয়নের বিষয়টি শিক্ষালাভের অধিকারের চেয়েও অধিক কোনো কিছুর প্রতি ঈঙ্গিত করে। আসলে উপনয়নের আবির্ভাব হয়েছিল সেই সমস্ত মানুষদের উচ্চ সামাজিক অবস্থান জ্ঞাপন করার জন্য, যারা ধর্মানুষ্ঠানের অধিকারী ছিল।
শূদ্ররা উপনয়নের অধিকার-সম্মত ছিল না এই যুক্তিতে যে সেটি ছিল একটি বৈদিক প্রথা। কিন্ত বেদকীয় পর্যায়ের ধর্মীয় জীবনপ্রণালী এটি দেখিয়েছে যে, শূদ্রদের কয়েকটি নির্দিষ্ট অংশ, বৈদিক ধর্মানুষ্ঠান থেকে সর্বদা বহির্ভূত হয়নি। রথকারাদের দ্বারা বলিদান অনুষ্ঠানে অগ্নি সংস্থাপন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি রচনাংশ রয়েছে। বলিদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের পর চতুর্থ নামের জায়গায় তাঁরা স্থান পেয়েছেন। অশ্বলায়ন স্রৌতসূত্রে (Asvalayana Srautasutra) রথকারাদের স্থানটি অধিকৃত হয়েছে উপক্রুস্তদের (Upakrusta) দ্বারা। এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল যে, একজন ব্যক্তি তাড়িত বা তিরস্কৃত হয়েছে, কিন্ত ভাষ্যকারদের অভিমত অনুযায়ী, এর অর্থ ছুতোর মিস্তিরি (taksaks)। এটি সুপারিশ করে যে, যদিও ছুতোর মিস্ত্রীরা তিরস্কৃত হয়েছিল, কিন্ত তবুও তারা বলিদান সম্পাদন জারি রেখেছিল। আরেকজন ব্যক্তি, যিনি বৈদিক বলিদানের অধিকার ভোগ করেছিলেন, তিনি ছিলেন নিষাদ প্রধাণ (nisadadhipati)। কিন্ত তাঁর বলিদানের উদ্দেশ্য ছিল রুদ্র প্রজাপতির আরাধনার মাধ্যমে পশুদের মধ্যে শান্তিসংস্থাপন করা। একই রচনাংশের অন্য একটি জায়গায়, কেবলমাত্র নিষাদ-কে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্ত ভাষ্যকারেরা বলেছেন যে, এটি নিষাদ প্রধাণকে উল্লেখ করেছে (nishadadhipati), এবং তার সাথে এটিও সংযুক্ত করেছেন যে, অপস্তম্বা স্রৌতসূত্রে, তিনি একজন ত্রৈবর্ণিকি (অর্থাৎ প্রথম তিনটি বর্ণের অন্তর্ভুক্ত) ছিলেন। মহাভারতেও, নিষাদদের প্রধান, (nisadadhipati) এই বলিদান সম্পাদিত করেছিলেন বলে বলা হয়েছে। ঋগবেদের একটি রচনাংশে, বলিদানে 'পাঞ্চজন্য'র (panchjanah) অংশগ্রহণের উল্লেখ আছে। নিরুক্ত (Nirukta) ব্যাখ্যা করেছে যে, পাঞ্চজন্য (panchajanah) শব্দটির অর্থ চারটি বর্ণ এবং নিষাদেরা (Nisadas)। এটিকে ঋক-বেদকীয় পর্যায়ের সমসাময়িক হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না, যেমনটি কখনো সখনো ধরে নেওয়া হয়ে থাকে। নিষাদ শব্দটি না তো ঋগবেদে উল্লেখিত হয়েছে, না তাতে চারটি বর্ণের অস্তিত্বকে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। স্পষ্টতই পাঞ্চজন্য শব্দটি ঋগবেদকীয় উপজাতিকে বুঝিয়েছে, যার সদস্যরা কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই বলিদান সম্পাদন করতো। যশকা'র (Yasaka's) ব্যাখ্যা অনুযায়ী যদিও দেখা যায় যে, তাঁর সময়কালে, শূদ্র তথা নিষাদেরা, যাদেরকে ধর্মশাস্ত্রগুলিতে ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র নারী-জাত একটি মিশ্রজাতি হিসেবে নির্দিষ্টকৃত করা হয়েছে, তারা বলিদানে অংশগ্রহণ করতে পারতো। এইভাবে এইসব উল্লেখসমূহ প্রমাণ করে যে, কখনোসখনো নিষাদ জনসাধারণ এবং সাধারণভাবে নিষাদ-প্রধান, বেদকীয় বলিদানের অধিকার ভোগ করতো। এই রীতি পরিত্যক্ত হয়েছিল যে বিশ্বজিৎ বলিদানে (visvajit sacrifice) বলিদানকারী-কে, তিন রাত্রি যাপন করতে হবে নিষাদদের সাথে তথা বৈশ্য ও রাজন্যদের সাথে। এটি প্রদর্শিত করেছে যে, নিষাদেরা বলিদানের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল।
বলিদানের অধিকার ভোগ করা মানুষজনের দুটি বিভাগের মধ্যে, এটি পরিষ্কার যে রথকারা-রা অথবা তক্সক-রা (taksaka), আর্য সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল, কিন্ত নিষাদেরা মনে হয় অনার্য ছিল, যারা বসবাস করতো তাদের নিজেদের গ্রামে। মহাভারতে এবং বিষ্ণু-পুরাণে, কৃষ্ণ বর্ণের নিষাদ জনসাধারণের বেশ কয়েকটি উল্লেখ আছে। সম্ভবত ব্রাহ্মণত্ব গ্রহণ করার একটি পদক্ষেপ হিসেবে নিষাদদের বেদকীয় রীতিতে বলিদান সম্পাদিত করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যে সুবিধাটি পরবর্তীতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল কেবলমাত্র তাদের প্রধানদের জন্য। এইভাবে, এটি স্পষ্ট যে, বেদকীয় পর্যায়ের ঠিক শেষ অবধি রথকারা-রা এবং নিষাদেরা বলিদানের অধিকার ভোগ করেছিল, যারা পরবর্তীতে পতিত হয়েছিল শূদ্র বর্ণ-বিভাগের অধীনে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, পাঞ্চজন্য শব্দটির যশকারা'র ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর অভিমত অনুসারে সমগ্র শূদ্র বর্ণটিই এই অধিকার ভোগ করেছিল।
শূদ্রদের অনেকগুলি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত আরেকটি নির্দিষ্ট উল্লেখ আছে। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অর্ঘ নিবেদনের (habisvi) প্রস্তুতি-পর্বে তিনটি বর্ণের সদস্যদের সাথে তারাও অংশগ্রহণ করতে পারতো, যদিও তাদের করনীয় অভিভাষণের রীতি-রেওয়াজসমূহ, অনুষ্ঠানে তাদের নিম্নতম স্থান থাকার বিষয়টিকে প্রতিফলিত করে। একইভাবে, অন্যান্য বর্ণের সদস্যদের সাথে তারা সোমরস পান করতে পারতো, এবং বমন উদ্গীরণ করলে তাদের প্রায়শ্চিত্তও করতে হতো। দাসী-পুত্র সম্পর্কিত (dasi-putra) বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে কাভাসা আইলুসা হপকিন্স (Kavasa Ailusa Hopkins) অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন এই বিষয়ের প্রতি যে, অর্ধ-ব্রাহ্মণ্য অর্ধ-জনপ্রিয় উৎসবগুলিতে শূদ্রদের সন্তানেরা বলিদান সম্পাদনার বিষয়টি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতো এবং শূদ্রেরা সোমরস পান করতো। এটি জ্ঞাত হওয়া একটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় যে, কথক সংহিতা'র (Kathaka Samhita) একটি রচনাংশ, শূদ্র এবং রমনীদের সোমরস পানের অনুমতি দেয় না। যদিও এর হদিস অন্যান্য যজু-সংকলনে পাওয়া যায় না, এবং সেইজন্য মনেহয়, হয়ত এটি একটি আন্ত-জনসমষ্টিগত বিষয় অথবা খুব বেশি হলে কথক-স্কুল (Kathaka school)-এর একটি ধারণা।
মহাব্রত (Mahavrata) নামক অয়নকাল সংক্রান্ত ধর্মানুষ্ঠানে (solstice rituals) শূদ্রদের করণীয় কর্তব্যের অংশটি, সেই পর্যায়ের ধর্মীয় জীবনে তাদের অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সরবরাহ করেছে। এটি অনুসারে, শূদ্রেরা বেদী'র (vedi) বাইরে অবস্থান করতো এবং আর্যরা থাকতো ভিতরে। পশু-চর্মের দখল-কে কেন্দ্র করে তারা লড়াই করতো এবং জিত হতো আর্যদের। কয়েকটি রচনাংশে শূদ্র বর্ণ এবং আর্য বর্ণ-কে স্বতন্ত্র ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে অধীত রয়েছে আর্য, সেটি আসলে বৈশ্যদের নিমিত্ত ; অপরদিকে যেখানে দ্রা অধীত আছে , সেটি নিমিত্ত করা আছে অন্য তিনটি বর্ণের সদস্যদের উদ্দেশ্যে। কয়েকটি রচনাংশে আর্যদের স্থান গ্রহণ করেছে ব্রাহ্মণেরা, যারা শূদ্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে, সেটি একটি বৈশিষ্ট্য, যা ছিল বেদকীয় পরবর্তী পর্যায়ের একটি সাধারণ নিয়ম। আরেকটি বেদকীয় রচনাংশ, যার মধ্যে এই দুই-পক্ষ উঠে এসেছে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয় হিসেবে, সেটি বিবৃত করেছে যে, ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্র, কোনো পক্ষকেই প্রজাপতি'র বলিদান হিসেবে উৎসর্গ করা যায়না। ভজসনেয়ী সংহিতা'র পরেরদিকের অংশে যে রচনাংশটির দৃষ্ট হয়েছে, সেটি সম্ভবত এই ঈঙ্গিত করেছে যে, এই উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মণেরা যখন বিরাজ করছে অতি উচ্চ অবস্থানে, শূদ্রেরা তখন বিদ্যমান রয়ে গিয়েছে অত্যধিক নিম্ন অবস্থানে।
মহাব্রত অনুষ্ঠানের তাৎপর্য সম্পর্কে বলতে গেলে, সেটি সম্ভবত গবাদিপশু দখলের জন্য আর্যদের নিজেদের মধ্যেকার সংগ্রাম এবং অনার্যদের সাথে তাদের সংগ্রামসমূহের স্মৃতিকে সংরক্ষিত করেছিল, যে সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে অনার্যরা হ্রস্বীকৃত হয়েছিল শূদ্রদের পর্যায়ে। শাংখ্যায়না-স্রৌতসূত্র বিবৃত করেছে যে, মান্ধাতার আমলের এবং সেকেলে এই মহাব্রত অনুষ্ঠান প্রতিপাদিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এটি জাহির করে যে, মহাব্রত'র মতো একটি পুরাতন ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে শূদ্রেরা যে উচ্চতর বর্ণের সদস্যদের সাথে পবিত্র আচার-আচরণ সংক্রান্ত সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারতো, তা থেকে তাদের নিবৃত্ত করা হয়েছিল এই ধরনের ধর্মানুষ্ঠানের রেওয়াজ বন্ধ করে।
শূদ্রেরা এরপর স্থান পেয়েছিল পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ধর্মানুষ্ঠানে। একথা চাপা থেকে গিয়েছে যে, শূদ্রেরাও অন্ত্যেষ্টিসংক্রান্ত জঞ্জালের স্তুপের ভাগ পেতো, কিন্ত সেটি হতো হাঁটু-বরাবর, কারণ স্তুপের ভাগের উচ্চতা পরিবর্তিত হতো বর্ণ অনুসারে।
অন্য যে কোনো সম্প্রদায়ের মতোই শূদ্রেরা বর্ণিত হয়েছে ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং ঈশ্বরের উপাসক হিসেবে। ভ্রহদরনায়ক উপনিষদে (Brhadaranyaka Upanisad) শূদ্রদের দেবতাকে পুসান (Pusan) বলা হয়েছে, যেটি সুপারিশ করে যে, এই দেবতাকে তাদের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। একইভাবে মহাভারতের পুরাকথায়, যমজ অশ্বিনদ্বয়-কে, যাদের ঈশ্বরের দুই চিকিৎসক বলা হয়েছে, তাদের শূদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, রত্নহবিষ্যি (ratnahavimsi) ধর্মানুষ্ঠানে অশ্বিনদ্বয়-কে সংযুক্ত করা হয়েছে সমগ্রহিত্র'র (samgrahitr) সাথে এবং পুসান-কে ভগদুঘা'র (bhagadugha) সাথে। কিন্ত তৈতেরিও ব্রাহ্মণ-এ, পুসান-কে বিশ্বদেব-এর (Visvadevas, means all Gods) সাথে এবং মারুত-কে (Marut, means peasant gods) সংযুক্ত করা হয়েছে বৈশ্যদের সাথে। তার মানে কোনো এক ভাবে বিশ্বদেবতারাও সরাসরি সংযুক্ত ছিলেন শূদ্রদের সঙ্গেও। অনুস্তভ (The anustabh), যেটি ছিল শূদ্রদের প্রতি আরোপিত পরেরদিককার জনপ্রিয় একটি ছন্দ, সেটি বিশ্বদেবতাদের প্রতিও আরোপিত করা হয়েছিল। এটি বলা হয়ে থাকে যে, এই ছন্দ-আবৃত্তির মাধ্যমে সম্মানিত করা হতো, বিশ্বদেবতাদের মধ্যে প্রজাপতি এবং ঈন্দ্র-কে এবং পাঙ্কালা'র রাজপুত্র ধ্রুব শতানীকি-কে মানব সমাজের শূদ্রদের মধ্যে। সেইজন্য এক্ষেত্রে ঐশ্বরীয় সমাজের বিশ্বদেবতারা মনুষ্য সমাজের শূদ্রদের দেবতাদের অনুরূপ।
শূদ্রদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ঈশ্বরেদের মধ্যে, পুসান হয়ত মেষপালক দেবতা ছিলেন এবং সম্ভবত সেইজন্য তিনি প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আর্য 'ভিস'-দের গবাদিপশুর প্রতিপালন এবং পুষ্টিবিধান ক্রিয়াকলাপের। আশ্বিনেরা (The Asvins), পরেরদিকের ঋকবেদ-এ যাদের বর্ণিত করা হয়েছে, মানুষের খাদ্য সংগ্রহের জন্য লাঙল দ্বারা শস্য-বীজ রোপনকারী এবং দুগ্ধ দোহনকারী হিসেবে, তারা হয়ত 'ভিস'দের কৃষিকাজের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। বিশ্বদেবতারা নির্ধারিত ছিলেন 'ভিস'-দের প্রতি, তাদের সংখ্যা অধিক হওয়ার জন্য। এই সত্য যে, অবিকল অনুরূপ তিন দেবতা, যাঁরা আর্য 'ভিস'-দের অনুষঙ্গী ছিলেন এবং পরবর্তীতে, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আরোপিত হয়েছিলেন শূদ্রদের প্রতিও, সেটি সুপারিশ করে যে, এমনকি যখন 'ভিস'-দের একটি অংশ শূদ্রদের অবস্থানে হ্রস্বীকৃত হয়েছিল, তখনও তারা তাদের পুরনো বেদকীয় দেবতাদের ধারণ করে রাখা অব্যাহত রেখেছিল।
এটি দেখানোর মতো এমন নজির-ও বিদ্যমান রয়েছে যে, নিম্নতর বর্গের একটি বিবেচনাযোগ্য বিভাগ তথা আর্য এবং অনার্যরা, রূদ্র-পশুপতি'র (Rudra-Pasupati) আরাধনা করতো, যিনি মনেহয় এক প্রাক-আর্য দেবতা ছিলেন। শতরুদ্র (satarudriya) নামক প্রার্থনা-সঙ্গীতে, রুদ্রের বিভিন্ন রূপের অনুষঙ্গী মানানসই অর্ঘ্য সহ, গভীর শ্রদ্ধা অর্পন করা হয়েছে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে, সমাজের সমস্ত ধরনের অংশের প্রতি এবং যেটি অনুসৃত হয়েছে রাজন্য, শূদ্র ও বৈশ্যদের ক্ষেত্রে, তাদের বিভিন্ন ধরনের শিল্পী-কারিগর ও আদিবাসীদের ক্ষেত্রে। কিন্ত প্রথম তিনটি বর্ণের কথা উল্লেখিত হয়েছে কেবল যজু'র একটি মাত্র সংকলনে। এর মধ্যে কোনোটিতেই যখন শূদ্রেরা উল্লেখিত হয়নি, সমস্ত যজু-তালিকায় তখন গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে রথকারাদের (cartwrights), কুলালাদের (potters), কর্মরাসদের (smiths), নিষাদদের, পুঞ্জিস্থাসদের (আদিবাসীদের, যারা মাছ অথবা পাখি ধরতো), স্ভনিসদের (কুকুর প্রতিপালক) এবং মৃগয়াদের (শিকারীদের), যাদের সহজেই চতুর্থ বর্ণের মধ্যে ফেলা যায়, তাদের সকলের প্রতি। পাশাপাশি, তৈতেরিও সংহিতা উল্লেখ করেছে তীর-ধনুক প্রস্তুতকারীদের কথা (dhanukara and isukara), যারাও হয়ত এই বিভাগের মধ্যেই পড়ে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন