কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী - ২৮




শেষ পর্বে বলেছি এবার থেকে আবার ইউরোপ ভ্রমণ শুরু করব। এই পর্বে আমাদের গন্তব্য  স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ। অর্থাৎ সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ড। এর মধ্যে আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ডের ছবি নিয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই, তাই বাকী চারটে দেশ নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। মনে রাখবেন, পৃথিবীর সেরা ২০ জন পরিচালকের নাম যদি তালিকাবদ্ধ করা হয়, তাহলে এই নর্ডিক অংশ থেকে অন্তত দু’জনের নাম উঠে আসবে।

সেই ভাইকিং রাজাদের সময় থেকে এই অঞ্চল বিখ্যাত এখানকার দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ প্রজাতির জন্য আর এখানকার খুব ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য। এখানকার ভাইকিং রাজা ‘ব্লু-টুথ’ প্রথম এই সমস্ত কন্‌কনে ঠান্ডা অঞ্চলকে একত্রে এনে সমুদ্রের এপাড়ে ওপাড়ে পুরো এলাকায় রাজ্যপাট বিস্তার করেছিলেন। ওনার স্মৃতির উদ্দেশ্যেই কিন্তু আমাদের মোবাইল বা ল্যাপটপে শর্ট রেঞ্জ তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ‘ব্লু-টুথ’ বলা হয়। এখানে অবশ্য ভূগোলের এখনো খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। দক্ষিণদিকে বাল্টিক সাগরের কাছে কিছু  অংশে তাপমাত্রা ৩০/৩৫ ডিগ্রি হলেও নর্ডিক অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গাতেই তাপমাত্রা মাইনাসে থাকে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারী মাসের ঘন তুষারপাতে। যাইহোক, সিনেমায় ফিরি।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা এই লেখা শুরু করব সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যানকে (১৯১৮-২০০৭) দিয়ে, তারপর ডেনমার্কের কার্ল ড্রেয়ার এবং এই পুরো নর্ডিক অঞ্চলের আরো বেশ কিছু বিখ্যাত পরিচালক। গোটা অংশ আমরা দু’পর্বে ভাগ করে পর্যালোচনা করব। কিন্তু সবার শুরুতেই আমি প্রতীক বা চিহ্ন দিয়ে বানানো ছবির ভাষা কি একটু ঝালিয়ে নেব? কারণ সেটা বার্গম্যান থেকে শুরু করে আরো  কয়েকজনের ছবি বুঝতে গেলে কাজে আসবে। সাহিত্য থেকে শুরু করে সিনেমায় যাই, তাহলে স্ক্রিপ্ট ব্যাপারটা বুঝতে আপনাদের সুবিধে হবে।

প্রথমে আমাদের সবার চেনা এক কবিতা দিয়ে শুরু করি (জীবনানন্দ) – ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে / সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে / অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে / সেখানে ছিলাম আমি আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে / আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’। এটা স্ক্রিপ্ট নয় - এটা বর্ণনা। কিন্তু এই ভাষা চিহ্নের ভাষা, প্রতীকের ভাষা। ডিটেলিংয়ে হাঁটা বা ঘোরার বর্ণনার পেছনে যেখানে অগুনতি জীবনের মাঝে ভালবাসা খোঁজার উদ্দেশ্য রয়েছে। এবার আরেকটু এগিয়ে জন স্টেনবেক-এর ‘দ্য পার্ল’ উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদ তুলে ধরি – ‘And the pearl settled into the lovely green water and dropped towards the bottom. The waving branches of the algae called to it and beckoned to it. The lights on its surface were green and lovely. It settled down to the sand bottom among fern-like plants. Above, the surface of the water was a green mirror. And the pearl lay on the floor of the sea. A crab scampering over the bottom raised a little cloud of sand, and when it settled, the pearl was gone’। মুক্তোর আড়ালে এ ভাষাও প্রতীকের ভাষা। মানুষের লোভ ও লোভমুক্তির। কিন্তু দেখুন, চোখের সামনে যেন পুরো একটা লং সিন ভেসে উঠছে, তাই না? এখান থেকে সোজা এক সিনেমায় আসুন। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। বৃষ্টির জলে ভিজে দুর্গার অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে শুরু করে দুর্গার চলে যাওয়া এবং হরিহরের বাড়ি এসে পৌঁছনো অব্ধি। বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন অন্যভাবে,  কিন্তু সত্যজিৎ সেটা ভাঙলেন মোট ১৪টা সিনে। ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইতে এর উল্লেখ পাবেন। এই ১৪টা সিন সত্যজিৎ রায় পুরোটাই মেঘে ঢাকা দিনে শুটিং করেছিলেন। প্রত্যেক শট অন্তত দু’বার শুট হয়েছিল, এবং পুরোটা করতে তিন দিন সময় লেগেছিল। এই নয় যে এই সময় আকাশে সূর্য ওঠেনি, কিন্তু দুর্গার রোগে ভুগে চলে যাওয়ার ভারাক্রান্ত বিষয়টা ক্যামেরায় ফুটিয়ে তোলার জন্য উনি শুধু মেঘলা দিন ব্যবহার করেছিলেন। আবার প্রতীক, এবং প্রতিবার এইসব প্রতীক যেন এক ভিন্ন ভাষা ফুটিয়ে তুলছে। সত্যজিৎ রায় ওনার বইতে এই অংশ নির্মাণ, ভাষা ও স্টাইল অধ্যায়ে রেখেছেন। কাকতালীয় ভাবে, সিডনি  লুমেটের ‘Making Movies’ বইয়ের প্রথম দুটো অধ্যায় স্ক্রিন-প্লে এবং স্টাইল নিয়ে। আমি যেটা এতক্ষণ  ধরে বোঝাতে চাইছি, তা হল, একদম প্রাথমিকভাবে স্ক্রিন-প্লে এবং স্টাইল সিনেমা থেকে সিনেমার ভাষা আলাদা করে দেয় এবং পরিচালকদের স্বাতন্ত্র্য বুঝিয়ে দেয়। তারপর তো ক্যামেরা, সেট সাজানোর খুঁটিনাটি, অভিনয়, মিউজিক, এডিটিং... সব একে একে আসবে।

আর আমরা আজ ইঙ্গমার বার্গম্যানকে নিয়ে শুরু করব এখান থেকেই। সুইডেনের সিনেমার কথা উঠলের শতকরা ৯০% লোক শুধু বার্গম্যানকেই চেনেন। কারণ ওনার ছবিতে মনস্তত্তের অদ্ভুত খেলার পাশাপাশি  ওনার অনবদ্য স্টাইল এবং আরো বড় কথা, এখনো অব্ধি সুইডেনের যে ৩টে সিনেমা অস্কার পেয়েছে, সেগুলো ওনার। কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন, সিনেমা কী? সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, সিনেমা হল সেলুলয়েডে  ফুটিয়ে তোলা জীবনের গল্প। আমি এখান থেকে আরো একধাপ এগোব। সিনেমা আসলে কোন এক গল্প, হয় মূর্ত অথবা বিমূর্ত, এবং সফল সিনেমা আমাদের মনে কোন এক ছাপ রেখে যায়। সেই ছাপ হয় আমাদের মনে অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, অথবা অনুভূতির সঙ্গে টাইম-স্পেস ফারাকে কিছু ধারণাও এনে দেয় অথবা অনুভূতি ও ধারণার সাথে সাথে আমাদের এক আয়নার সামনে বসিয়ে নিজেদের ও সমাজের  একাংশের ব্যাপারে কিছু ভাবতে শেখায়। সিনেমা ভেদে এগুলো এক ডিগ্রি এক ডিগ্রি করে বেড়ে চলে। আবার একজন ইঞ্জিনীয়ার যেমন ‘কী হয়েছে’ বোঝার থেকে ‘কীভাবে হয়েছে’ বুঝতে বেশি আগ্রহ খুঁজে  পান, তেমনি একজন চিত্র পরিচালক গল্পটা জেনে বুঝে যাবার পর ‘কীভাবে’ দর্শকদের সামনে তুলে ধরবেন, সেই নিয়ে কূলকিনারা খুঁজতে বসেন। ওই ‘কীভাবে’র ভেতর লুকিয়ে থাকেন আস্ত এক পরিচালক।

আমার বিচারে বার্গম্যান পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পরিচালক (বিতর্ক থাকতেই পারে, তাই বলেছি ‘আমার বিচারে’)। ১৯৪৪ থেকে ২০০৩, এই সময়ের মধ্যে মোট ৪৯ টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, যার মধ্যে এগুলোর নাম করতেই হয় – সামার উইথ মনিকা (১৯৫৩), দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭), দ্য ভার্জিন স্প্রিং (১৯৬০), থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), দ্য সাইলেন্স (১৯৬৩), পারসোনা (১৯৬৬), শেম (১৯৬৮), ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পার্স (১৯৭২), সিন্‌স ফ্রম আ ম্যারেজ (১৯৭৪), অটাম সোনাটা (১৯৭৮) এবং ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার (১৯৮২)। এই যতগুলো ছবির নাম বললাম, এর সিংহভাগ ছবি যৌন মনস্তাত্তিক ও বেশিরভাগ ছবিতেই বার্গম্যানের প্রিয় অভিনেতা/অভিনেত্রী ম্যাক্স ভন সিডো বা লিভ উলম্যান বা ইনগ্রিড থুলিন অভিনয় করেছেন। এর আগে আমি কোন এক পর্বে লিভ উলম্যানকে নিয়ে যখন আলোচনা করেছিলাম, তখন ‘পারসোনা’ নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু যেদিন পৃথিবীর সেরা ১২ ছবি নিয়ে কলম ধরেছিলাম বা ম্যাক্স ভন সিডো-কে আলোচনায় এনেছিলাম, ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ উল্লেখ করলেও কিছুই লিখিনি। সুতরাং আজ এই ছবি নিয়েই আমরা বার্গম্যানকে ফিরে দেখব।

এক মধ্যযুগীয় অকুতোভয় নাইটের ভূমিকায় ম্যাক্স ভন সিডো। ক্রুসেডের পর সে ব্যক্তিরূপী মৃত্যুর সঙ্গে এই আশা নিয়ে দাবা খেলতে বসে যে যতক্ষণ খেলা চলবে, মৃত্যু তাকে ছুঁতে পারবে না। খেলা এগোতে  থাকে, সিনেমাও। প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে দেখা যায় মৃত্যুর চেয়ে কেউ বড় নয়, সেই নাইট-ও নয়। শেষ দৃশ্যে পুরো স্ক্রিন জুড়ে মৃত্যুর নাচ ছড়িয়ে পড়ে। নাম মাহাত্ম্য? শুরুতে ও শেষে – ‘and when the Lamb opened the seventh seal, there was silence in heaven about the space of half an hour’। কার নিস্তব্ধতা? ভগবানের? এই সিনেমায় আসলে বার্গম্যানের এক প্রশ্ন ছিল, আদৌ কি ভগবান আছে? নাকি শুধুই মৃত্যু?

মাত্র ৩৫ দিনে পুরো সেভেন্থ সিল শুটিং হয়েছিল। স্টুডিও-র পাশের পাহাড়ি জঙ্গলে। মজার ব্যাপার, বার্গম্যান যখন পেটের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন এর স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। এই ছবি প্রকাশ হবার পর আমেরিকা ও ইউরোপের কাগজগুলো একে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিল... piercing… extraordinary… prodigious… eloquent… imaginative… beautiful… rewarding… কিন্তু আপনারা জানেন আমার এক বদ-স্বভাব আছে। আমি নিজে যতক্ষণ কাটা-ছেঁড়া না করি, আমি কোন বিশেষণে বিশ্বাস করি না। তাহলে শুরু হোক।

আলোচনার শুরুর অংশ হবে পরিচালকের স্টাইল নিয়ে। এই ছবির প্রতি সিন এতটাই সহজ যে মনে হবে যেন মধ্যযুগীয় চার্চে উপদেশ শোনানো হচ্ছে। কিন্তু তারপরেই দেখা যাবে এক নাইটের দাঁতচাপা লড়াই, প্রতি মিনিটে মৃত্যুর উপস্থিতি এবং ভগবানের কোথাও না থাকা। ফলে প্রতি সিনে বিশ্বাসের সঙ্গে যেন তর্ক শুরু। এবং এই তর্ক শুরু হচ্ছে তখন, যখন পৃথিবী নিউক্লিয়ার শক্তি পেয়ে গেছে। তাহলে কি এই ছবি মানুষের অবশ্যম্ভাবী নিয়তির আড়ালে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ ধ্বনি? অর্থাৎ এই ছবি প্রতীকী ছবি, এর ভাষা  চিহ্নের ভাষা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ছবি নাটুকে কারণ বার্গম্যানের এক নাটক থেকেই এই ছবি  নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে ভাষায় উনি পুরোটা দেখিয়েছেন, যেমন শুরু থেকে শেষ অব্ধি কালো গাউন পরা মৃত্যু, প্লেগ, সেটা দেখে যে কেউ জিজ্ঞেস করবেই ‘জীবনের অর্থ কি?’ ‘এত মৃত্যুর মধ্যেও ভগবান চুপ কেন?’ ‘তাহলে মৃত্যুর পরে কী?’ এবং অবশেষে দর্শকের শেষ প্রশ্ন হবে ‘সত্যির সংজ্ঞা কী?’

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর আসবে গানার ফিশারের ক্যামেরার কাজ। বেছে বেছে কোথাও কোথাও আলো ফোকাস করা, কোথাও আলো ফ্ল্যাট করে দেওয়া। এই আলো আঁধারির বাঁকারেখা বিমূর্ত ও টাইমফ্রেমহীন হয়ে যায়। এর মাঝে পরিচালক দুই ছোট্ট চরিত্র জফ আর মিয়া-কে নিয়ে এসেছেন শিল্পের ধারক হিসেবে, বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে। জফ ডুবে আছে তার শিল্প নিয়ে। সে বিশ্বাস করে ‘world of angels and devils cannot be understood by common people’। অসাধারণ। মৃত্যুই নিয়তি, কিন্তু  আধুনিক নাইট সিডো তাকে বাধা দিচ্ছে এবং কেউ কেউ বিশ্বাস করছে শিল্প সবাই বোঝে না, পাপ-পুণ্য সবাই বোঝে না, ভূত-ভগবান সবার জন্য না। এই বিমূর্ততার জন্যই এই ছবিকে আমি অন্তত কোন টাইমফ্রেমে বেঁধে রাখতে পারব না। যে কোন স্পেসে, যে কোন সময়ে এই ছবি প্রাসঙ্গিক। ভাবুন তো, কিছুদিন আগেই তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রকৃতির খেয়ালে ভূমিকম্পের যে অবাধ ধ্বংসলীলা, তার পাশে ‘দ্য সেভেন্থ সিল’! যুক্তি আর বিশ্বাসের যুদ্ধ। একে ক্লাসিক না বললে অন্য কোন্‌ ছবিকে বলব?

সুইডেনের ছবিতে বার্গম্যানকে বাদ দিলে আরো যে কয়েকজন পরিচালকের নাম করতে হয়, তারা হলেন – বো ওয়াইডারবার্গ, জন ত্রোয়েল, সেন নিকভিস্ট ও রুবেন আস্টলান্ড। ওয়াইডারবার্গের ছবির মধ্যে র‍্যাভেন’স এন্ড (১৯৬৩), আডালেন ৩১ (১৯৬৯) ও অল থিংস ফেয়ার (১৯৯৫) মনে রাখার মত। ত্রোয়েলের বাছাই ছবি দ্য ইমিগ্রান্টস (১৯৭১), দ্য নিউ ল্যান্ড (১৯৭২) এবং ফ্লাইট অব দ্য ঈগল (১৯৮২)। সেন নিকভিস্ট ছিলেন বার্গম্যানের ক্যামেরাম্যান। ওনার নিজের অনবদ্য সিনেমা বলতে দ্য অক্স (১৯৯১)। এবং আস্টলান্ডের উল্লেখযোগ্য ছবি ফোস মাজার (২০১৪) এবং দ্য স্কোয়ার (২০১৭)। এগুলোর ভেতর আমরা একটা পুরনো ও একটা নতুন ছবি বেছে নেব।

জন ত্রোয়েলের ‘দ্য ইমিগ্রান্টস’ ১৯১ মিনিটের এক দীর্ঘ সিনেমা, মুখ্য চরিত্রে সেই ম্যাক্স ভন সিডো ও লিভ উলম্যান, এই ছবি বাস্তবের এক চাবুক – বার্গম্যানের সূক্ষ্মতার ঠিক উল্টোদিকে।

সুইডেনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নিলসন নামক কৃষক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকে। কিন্তু সুইডেনের খারাপ আবহাওয়ায় তাদের চাষবাস খুব খারাপ হয়, খিদে সহ্য করতে না পেরে তাদের এক ছেলে মারা যায়, তারা আরো কিছু ওঠানামার পর আমেরিকায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই যাত্রায় তাদের সাথে এসে যুক্ত হয় আরো কয়েকটি গরীব পরিবার। যাবার পথে তাদের দুর্দশা নিয়েই ‘দ্য ইমিগ্রান্টস’। এই ছবিকে গ্রাম্য আমেরিকা আস্তে আস্তে কীভাবে তৈরি হয়েছে, তার এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দেখা  হয়। যদিও ক্যামেরার কাজ নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায় কিন্তু সিডো এবং উলম্যানের অভিনয় অকুন্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল। বিখ্যাত সমালোচক রজার এবার্ট এই সিনেমাকে মাস্টারপিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

পরের ছবি আস্টলান্ডের ‘দ্য স্কোয়ার’। আড়াই ঘন্টার ছবি। স্টকহোমের এক বিখ্যাত মিউজিয়ামের কিউরেটর ক্রিস্টিয়ান। ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা নিয়ে জর্জরিত। নিজের মিউজিয়ামে এক নতুন আর্ট প্রদর্শনীর অ্যাড করার জন্য সে একটা টিম নিয়ে আসে যাদের কাজ হবে ‘স্কোয়ার’ নামক সেই আর্ট প্রদর্শনীকে বিতর্কিতভাবে তুলে ধরা যাতে তা আরো প্রচারের আলোয় আসে। কিন্তু সেই ইউ-টিউব অ্যাড এত বাজে ভাবে ছড়ায় যে সবাই ক্রিস্টিয়ানের নিন্দে করে এবং মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাকে সবার সামনে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে।

নিঃসন্দেহে ব্ল্যাক কমেডি। এখনকার শিল্প ও তার মধ্যে মিশে থাকা বিতর্ক নিয়ে এক সুররিয়েল স্যাটায়ার। ক্যামেরার কাজ বেশ ভাল। এবং ডিনারের দৃশ্যে ওলেগের বাঁদরের মত সাহসী আচরণ এই ছবিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। আমার মনে হয়েছে এই ছবিতে পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন যে মনের আশা আর বাস্তবের ফল আলাদা হয়, আর যখন সেটা হয়, তখন কতটা ঘা মারতে পারে। হ্যাঁ, ছবির দৈর্ঘ্য আমার একটু বেশি বলে মনে হয়েছে। অনায়াসেই আরেকটু কাঁচি চালানো যেত।

সুইডেনের পাশাপাশি আজ ফিনল্যান্ডের ছবিও এক ঝলক দেখে নেব। অবশ্য ফিনল্যান্ডের সিনেমার ইতিহাস তেমন পুরনো কিছু নয়, ১৯৭৩ সাল থেকে এখানকার ছবি নিয়মিত অস্কার বিভাগের জন্য  পাঠানো শুরু হয়। এখানকার এক বরিষ্ঠ পরিচালক হলেন আকি কৌরিসমাকি। ওনার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো – শ্যাডোজ ইন প্যারাডাইস (১৯৮৬), ড্রিফটিং ক্লাউডস (১৯৯৬), দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট (২০০২) এবং দ্য আদার সাইড অব হোপ (২০১৭)। আশার বিষয়, এখন ফিনল্যান্ডের অনেক তরুণ  পরিচালক ছবি পরিচালনার কাজে এগিয়ে আসছেন।

আমরা আপাতত কৌরিসমাকির ‘দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট’ নিয়ে আলোচনা করব। দেড় ঘন্টার একটু বেশি নিয়ে এই ছবি। ফিনল্যান্ড ট্রিলজির দু’নম্বর ছবি। এক মাঝবয়সী লোক ট্রেনে চেপে হেলসিঙ্কি স্টেশনে আসে, সেখান থেকে এক পার্কে গিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কিছু লুটেরা ছিন্তাইবাজের হাতে এত মার খায় যে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে কোনোমতে আবার স্টেশনে আসে, বাথরুমে ঢোকে, আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তার জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। কিন্তু আর কিছুই সে মনে করতে পারে না – সে কে, কোথা থেকে এসে এসেছে, কোথায় যেতে চায়, কিছুই না। এক লেকের ধারে তার স্থান হয় গৃহহীন কিছু লোকের মাঝে। উদ্ধারকারী টিম তাকে কিছু জামাকাপড় দেয়। টিনের কন্টেনার দিয়ে সে নিজের জন্য কোনোমতে একটা ঘর বানায়। উদ্ধারকারী টিমের একটি মেয়ে ইরমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সে আবার নিজের মত এক কাজ খুঁজে নেয়।

হাসির ছবি। যারা নিজেদের বংশগরিমা, আভিজাত্য নিয়ে বেশি বড়াই করে, ধরাকে সড়া জ্ঞান করে, তাদের প্রতি স্যাটায়ার। কিন্তু সেই স্যাটায়ার বেহিসেবী নয়, মাত্রার মধ্যে। সর্বহারাদের মধ্যে আদান প্রদানও মন ভরিয়ে দেয়। ফিনল্যান্ডের নামকরা অভিনেতা মার্কু পেলতোলার অভিনয় এই ছবির বড় পাওনা। এবং হাসির সংলাপ ঠিকঠাক। যেমন এই অংশটাঃ M: I went to Moon yesterday; Irma: I see, how was it?; M: Peaceful; Irma: Meet anyone? M: Not really, it was a Sunday. আমার যেটা ভাল লেগেছে, সেটা হল এই ছবির নির্মাণ। হাসির ছবির এক নির্দিষ্ট টোন থাকে, সেখান থেকে  এদিক ওদিক হলে ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিচালক সেই হিসেবে নিখুঁত।

স্ক্যান্ডিনেভিয়া আজ এই অব্ধি। সামনের পর্বে ডেনমার্ক ও নরওয়ের ছবি নিয়ে আলোচনা হবে।

(ক্রমশ) 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন