কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৭


শূন্যপুর ১৪

লাল গেটটা দিয়ে ঢোকার আগে কদ্দুস জানত না, রসুনের খোসার মতো ফিনফিনে রুটির কথা। তাজ্জব কেরামতি। এত পাতলা, যেন মসলিন জামদানি।  মসলিন জামদানি কদ্দুস চোখে দেখেনি। রেহানা নাম নিত। রেহানাও চোখে দেখেনি। দাদি-নানির ফেলে আসা দেশের শাড়ি। রেহানার শখ ছিল, কিনবে একদিন, শিলচরে গিয়ে। শিলচর যাওয়া হয়নি রেহানার। মসলিন জামদানি দেখা হয়নি। কদ্দুস গোয়ালপাড়ার রুটি দেখেছে। ইয়াল্লা, এরকমই ফিনফিনে হবে কি সে শাড়ি!

কদ্দুসের পেট ভরে না দুখান রুটি আর ঘ্যাঁটে। ঘ্যাঁটখানা সকালের। ওবেলা সঙ্গে ছিল জোলো ডাল আর কাঁকরভাত৷ আর ওয়ার্ডন সাহেবের গলায় বিদ্রুপ ছিল। 'হঃ! রাজার ব্যাটা!'

এমন নয় যে কদ্দুস রাজভোগ খেয়ে মানুষ। কদ্দুস পেটভাতি। একবছর বয়সে  বাপ মারা যেতে মা পুরা আটবছর পেলেছিল। স্বীকার না গেলে গুনাহ্ হবে।  তারপর মা বিয়ে করল। কদ্দুসকে কামে লাগিয়ে দিল। খাওয়ার বদলে কাম। পেট ভরে খেতে দিলে যে ফরমাশ তামিল করে, তারে পেটভাতি কয়।

ওয়ার্ডন সাবকে কদ্দুস বলেনি রুলের গুঁতোর ভয়ে বলেনি রাজভোগ নয়, ভরপেট খাবার পাওয়াটা জরুরি জেনেছে সে আশৈশব। বলেনি, পেটভাতিদের ইস্কুল নাই। মুখ্যমন্ত্রীর নাম তারা জানে না। প্রধানমন্ত্রীর নামও না। ট্রাইবুনালে ওই দুটো প্রশ্ন করেছিল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল কদ্দুস। গাল চুলকে বলেছিল,  'ভূপেন হাজারিকা।' কদ্দুস চিরকাল মাথামোটা। মাথার চেয়ে পেটের প্রতি তার  দায় বেশি।  ম্যাজিস্ট্রেট আশ্বস্ত হয়েছিল, ব্যাটা বিদেশি না হয়ে যায় না।

ওয়ার্ডেনকে কদ্দুস আরও বলেনি, বহু কষ্টে টাকা জমিয়ে নিজের ঠেলাগাড়ি কেনার পর, প্রথম মাসের রোজগার থেকে সে দেশি মোরগ এনেছিল। রেহানারই জন্য। শাড়ির কথা মাথায় আসেনি। পেটের জন্য সব, এই সহজ কথা রেহানাকে বোঝাতে বোঝাতে হাল্লাক কদ্দুস।

রেহানা এখন পেট বোঝে। শাড়ির কথা বলে না। রেহানা আসবে আজ। আনবে ইটভাটার মজুরি থেকে জমানো টাকা। হাত পেতে নিতে লাজ লাগে। তাও নেবে।  ডিম নয় টাকা পিস। আলুর কিলো পঁয়তাল্লিশ। একটু তেল লাগবে, কে জানে  কত করে লিটার! এক সেপাই ব্যবসা দিয়েছে ক্যাম্পে। বাজারের বাড়া দামে ব্যাচে। আরেক সেপাই টাকা দিলে ডিম-আলু সেদ্ধ করে দেবে। ওয়ার্ডেন জানে। জেনেশুনে খোরাকি কমায়।

বিকেলে ডাক এল৷ জালের ফাঁক দিয়ে আঙুল ছোঁওয়ার পালা। রেহানার চোখে হাসি। কোঁচড় খলবল করে। ও কী রেহানা? কোঁচড় আলগা করতে ছটফটে পা দুখানি দেখা যায়। টাকা দিলে মোরগের ঝোল রেঁধে দেবে, সেপাই বলেছে। জিভ  লকলকায়। দুবচ্ছর ট্যালটেলে ডাল আর ওয়ার্ডেনের ধাঁতানি খেয়েও নোলা মরেনি, শালা৷ কদ্দুসের শরীর বয়ে শিরশিরানি। রতির মতো। মোরগের ঠ্যাঙের ওপারে রেহানার পেট দেখা যায়। সেপাইটা রেহানার বাঁয়ে। ও-ও দেখছে কি  মাংস? মোরগের? নারীর?

কদ্দুসের বমি পায়। এই প্রথম খাবারের ঘ্রাণ মনে করে বমি পায়। কদ্দুস মোরগ হয়ে কঁকরকোঁ করে। শুধু রেহানা শুনতে পায়, তাকে চলে যেতে বলছে কদ্দুস। বলছে, মোরগটাকে যেন ছেড়ে দেয়।

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন