কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৭ |
মারণ উচাটন যজ্ঞ
নানারঙের ব্লেণ্ড করা ঘুটঘুটে আঁধারের
মাঝে এক অসংপৃক্ত আগুনশিখা ঘিরে আছে বড়বড় গাছের সড়সড় দীর্ঘশ্বাস। ভৈরববাবার শাসন, এমন
আঁধার খুঁজবি যেন যজ্ঞিআগুন পালাতে না পারে। বছরপাঁচেক আগে প্রায় নিঃস্ব এক সত্তর দশকের
কবি, মানুষের উপর সরল বিশ্বাসে প্রচণ্ড অনীহা থকাহারা সর্বস্বান্ত উদ্দেশ্যহীন হয়ে
এক এঁদোপাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে গণশৌচাগারের দেওয়ালে ভৈরববাবার মায়াউদ্দীশতন্ত্রের বিজ্ঞাপন
দেখেছিলেন। জীবন তাকে অতি অন্যায়ভাবে ঠকিয়েছে। তিনজন অতি নিকটজন, সুজন ভজন ও রাজন,
সরকারী নেতা ও দালাল দিয়ে জমি ও ঘর কেনার নামে রিটায়ারমেণ্টের পি এফ লুটে নিয়েছে। তবুও
কবি ভাগ্যের দোহাই দিয়ে তা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সত্তরদশক থেকে আজঅব্দি উত্তর আধুনিক
এই জাতকবি, তাঁর দুইটি কাব্যগ্রন্থ দুই প্রকাশককে দিয়ে সম্পুর্ণ নিঃস্ব হয়ে দিশাহারা
হয়ে পড়লেন। আজও বই ছাপেনি। কবির স্বপ্নপূরণ হয়নি। লোনের একলক্ষ টাকা বেরিয়ে গেছে। কবি
জেনেছেন, শহরে ধোঁকাবাজেরা জালবিছিয়ে রেখেছে। শুধু লুটে নেবার ধান্দাই নয়, প্রান্তিক
সাহিত্যকার যাতে কোনোপ্রকারে মাথা তুলতে না পারে। ওই অপ সংস্কৃতির ধ্বজাধারী দল সশক্ত
হচ্ছে। এখন প্রতিশোধই একমাত্র ভাষা হোক।
আগুনের পাশে নানান সামগ্রী পুজোর উপকরণ।
সাতরকম তেলে সেদ্ধ সাতরকম ঠকবাজ ঘোড়েল জীবের ঘিলু। ভৈরববাবা ছাড়াও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের
কবিতা তাঁকে শক্তি দিয়েছে, ‘অলৌকিকতার কাছে সবার আকৃতি ঝরে যায়’। তা যেভাবেই হোক। ইতিমধ্যে
একদিন তিনজনের পুত্তলিকার আহুতি হয়ে গেছে, ফলও হাতেনাতে। পার্টিগত হোক বা রাজনীতি,
ভাতে মার তো হয়েইছে। আজের পালা দুই পাবলিশার্স। এক শ্রীমতি দীপাঞ্জনা পাচাল, দুই শ্রীদীপ
চৌধুরী। দুজনই কোলকাতার প্রতিষ্ঠিত লেখক মহলে স্বনামধন্য সাহিত্যিক। দুজনই এই কবিকে
তাঁদের চলতি পত্রিকায় লেখার জন্যে আহ্বান করে সুচতুরভাবে ফাঁসিয়েছে। সরল ও কাব্যপ্রেমী
সহজেই ওদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে।
ধকধকে
যজ্ঞির আলোয় যজ্ঞসাধকের মুখ হঠাত্ ঠা ঠা হাসিতে সরব হল। চোখে কল্পনার আগুন।
-ঈশ্বরের লীলা দেখ? তিন ভূ-মাফিয়ার নামের
সামঞ্জস্য? সুজন ভজন রাজন, জনে জনে মিল। আর সংস্কৃতির ডাকাতদুটোর নাম? দীপ দীপা? হা
হা হা।
অগ্নিহোত্রীর নাম অবোধ প্রসাদ। অর্ধপদ্মাসনে বসে আহুতির জন্য তৈরি। নগ্নগায়ে আকুপাঙ্কচারের মত একশ আটটি কলমের নিব নির্দয়ভাবে বেঁধা। রক্ত গড়াচ্ছে টপটপটপ। ডানহাতে কোশাকুশি, বাঁহাতে ধরা লালশালুতে মোড়া ছোটো দুটি কুশপুত্তলিকা। নর ও নারী।
কবি উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন,
‘...নমঃ হ্লীঙ...স্তম্ভয়...জিব্হাং কীলয় কীলয়...নাশয় নাশয়...’। নানান আহুতি নানা উল্লাস।
মন্ত্রের সাথে সাথে উদাত্ত গলায় ছন্দ কবিতায় মারণ আক্রোশ উর্দ্ধগামী। যেন প্রকৃতিও
চায় মানুষের বিবর্তন ঠিক পথে যায়, যেন সংস্কৃতির মূল্যায়ণ ঠিকমতো হয়। তাই বুঝি স্তব্ধ
বায়ু, হোমগ্নি দাউ দাউ। ভৈরববাবা বলেছেন, না এতে ওরা মরবে না। ওদের ছলচাতুরী থেমে যাবে।
ওরা সম্মোহিত হয়ে থাকবে আমরণ। তবে আর কি অপরাধ?
কবি অবোধ প্রসাদ এবার মন্ত্রপুত একটা
বড় কলম তুলে নিলেন। 'ও ও ওঁ সোহহঙ ফট' এই মন্ত্রে দুই পুত্তলিকাকে বিদ্ধ করলেন। আহুতির
জন্য আগুন তৈরি।
খুব ভালো লেখা। লেখার স্টাইল সবার থেকে আলাদা।
উত্তরমুছুনপ্রান্তিক কবির প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা, ক্রোধ, হতাশা , প্রতিকারহীন সামাজিক অন্যায় কবিকে
উত্তরমুছুনপ্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্যে যজ্ঞের আশ্রয় নেয়া - যার মধ্য দিয়ে প্রতারিত লেখকের চরম অসহায়তাই এই গল্পে প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা বিন্যাস ও লেখার স্টাইলে গল্পটি পড়তে খুব ভালো লাগে।
উত্তরমুছুন